করোনা মহামারি, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও অর্থনীতির গতি



ড. মাহফুজ পারভেজ
করোনা মহামারি, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও অর্থনীতির গতি

করোনা মহামারি, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও অর্থনীতির গতি

  • Font increase
  • Font Decrease

করোনাকালের চীনা অর্থনৈতিক মন্দার লক্ষণীয় বিষয় হলো দেশটির ব্যবসায় সঙ্কুচিত পরিসর, বহু দেশই চেষ্টা করছে সেই জায়গা নিতে। 'ইকোনমিক হাব' নামে উত্থিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বৈশ্বিক মহামারি করোনার বহুবিধ প্রভাবের মধ্যে এখন ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে মন্দার চিত্র। এরই সঙ্গে আর্থিক পরিস্থিতিকে পাল্লা দিয়ে করোনার দোলাচলে ত্রস্ত চীন। এমতাবস্থায়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা বৃহত্তর ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলের সামরিক ও নিরাপত্তাগত মেরুকরণকে ছাপিয়ে সামনে চলে আসছে অর্থনৈতিক প্রপঞ্চসমূহ এবং এর বহুমাত্রিক পালাবদলের দৃশ্যপট। জনস্বাস্থ্যের মতোই মহামারিকালে আর্থিক রূপান্তরের চিত্রও এতে স্পষ্ট হয়েছে।

একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষক সংস্থার হিসাবে, নববর্ষের জমায়েতের কারণে চীনে করোনায় দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা ৩৬ হাজার ছুঁতে পারে। সংস্থাটির হিসাবে কোভিডের কারণে চীনে এখন পর্যন্ত ৬ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যদিও সরকারি তরফে বলা হচ্ছে নিয়ন্ত্রণে এসেছে কোভিড পরিস্থিতি, তথাপি চীনে এখনও চোখ রাঙাচ্ছে করোনাভাইরাস। দেশটির এক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মিডিয়াকে জানিয়েছেন, ১৩ জানুয়ারি থেকে ১৯ জানুয়ারির মধ্যে সে দেশে ১৩ হাজার মানুষ কোভিড আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। ওই অফিসার আরও জানিয়েছেন যে, শূন্য কোভিড নীতি তুলে নেওয়ার পর সে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন।

চীনের ‘ডিজ়িজ কনট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনে’র তরফে চলতি সপ্তাহের শুরুতে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে জানানো হয়েছে, ১৩ হাজার জনের মধ্যে ৬৮১ জন সরাসরি কোভিড আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। বাকি ১১ হাজার ৯৭৭ জনও কোভিড আক্রান্ত হয়েছিলেন, তবে তাঁদের অন্যান্য শারীরিক সমস্যা ছিল। অবশ্য বাড়িতে নিভৃতবাসে থাকা নাগরিকদের কত জন মারা গিয়েছেন, সে সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি এই বিবৃতিতে।

চীনে বর্তমানে চান্দ্র নববর্ষ উপলক্ষে উৎসব উদ্‌যাপন চলছে। কঠোর কোভিড নীতি উঠে যাওয়ায় দীর্ঘ দিন পরে দেশের নানা শহরে হইহুল্লোড়ে মেতেছে জনতা। এ অবস্থায় নতুন করে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা করছে বেজিং প্রশাসন।

একটি নিরপেক্ষ সমীক্ষক সংস্থার হিসাবে, চাইনিজ নববর্ষের হুল্লোড় এবং জমায়েতের কারণে সে দেশে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা ৩৬ হাজার হতে পারে। ওই সমীক্ষক সংস্থাটির হিসাব বলছে কোভিড নীতি শিথিল করার পর চীনে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ৬ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

এদিকে, পশ্চিমি মিডিয়াগুলোর একাংশের দাবি, চীন যদি প্রথম থেকে কোভিডে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা প্রকাশ্যে আনত, তবে হয়তো সম্ভাব্য এই বিপর্যয় এড়ানো যেত। পশ্চিমা দেশের কোনও কোনও নেতা চীনের 'কোভিড নীতি' এবং 'রক্ষণশীল মনোভাব' সম্পর্কে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আসছেন। তারা মনে করছেন, মহামারির আঘাত ও প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য ও পরিসংখ্যান প্রকাশের ক্ষেত্রে চীনের 'গড়িমসি কৌশল' বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে এবং অপরাপর দেশের প্রস্তুতি গ্রহণকে 'বিভ্রান্ত' ও 'বিলম্বিত' করেছে।

করোনা মহামারির নেতিবাচক প্রভাব চীনের সামাজিক জীবনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকেও নাড়া দিয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। বিশ্বঅর্থনীতির শীর্ষস্থান অধিকারের প্রত্যাশায় যে চীনের গতি ছিল অব্যাহত ও তেজি, সেখানে থেকে সাম্প্রতিক কালে বহু দেশই তাদের উৎপাদন কেন্দ্র সরিয়ে নিচ্ছে। পূর্ব এশিয়ার বিনিয়োগ অর্থনীতিতে যে ফাঁকা জায়গা তৈরি হচ্ছে, তা পূরণ করতে নানা ফন্দিফিকির কষছে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরাশক্তিগুলো, বিশেষত চীনের পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত এক দশক জুড়ে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে চলার পর বস্তুত করোনার ধাক্কায় চীনের অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতির পিছনে আরও কাজ করছে চীনের বাইরে অবস্থিত কারখানা এবং জোগান ব্যবস্থার দিকে উৎপাদন তথা অর্থনীতির অভিমুখ ঘুরে যাওয়ার ঘটনা। ফলে সাম্প্রতিক চার দশক ধরে উৎপাদন এবং বাণিজ্যে চীনের সাফল্য, যা তাকে ‘বিশ্বের কারখানা’ বলে পরিচিত করেছে, তা থেকে এক নতুন হাওয়ার ঘূর্ণিতে পৃথিবীর যাবতীয় কর্পোরেট পরিচালকদের নজর একেবারে উল্টো দিকে ঘুরে যাওয়ার বিষয়টি চীনের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও দৃঢ়তার প্রতিষ্ঠিত ধারণার সঙ্গে একেবারেই মানানসই নয়। তা সত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, চীন ব্যতীত অন্য প্রতিযোগী দেশগুলোর শিল্পনীতিতেও কিছু বদল ঘটেছে, যা বিভিন্ন সংস্থাকে চীনের বিকল্প নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।

পরিস্থিতির প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় চীন থেকে জাপানের সংস্থাগুলোকে তাদের উৎপাদন কেন্দ্রগুলো দেশে ফিরিয়ে আনতে অর্থ বিনিয়োগ করছে টোকিও প্রশাসন। গত গ্রীষ্মে জাপান এক নতুন অর্থনৈতিক নিরাপত্তা আইন পাশ করেছে যার দ্বারা ১৪টি ক্ষেত্রকে একটি সামাজিক পরিকাঠামোর অঙ্গীভূত করা সম্ভব হয়েছে। তদ্রূপ,  দক্ষিণ কোরিয়া এবং তাইওয়ান তুলনামূলক ভাবে ‘রি-শোরিং’ বা 'দেশের বাইরে চলে যাওয়া কোনও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া' শুরু করেছে।

এসব নীতিগত পরিবর্তনের মূল লক্ষ্য হলো, চীন থেকে তাদের ব্যবসাকে গুটিয়ে আনা। সুতরাং, এশিয়ার সব থেকে বেশি শিল্পায়িত ৩টি দেশ তাদের সংস্থাগুলোকে চীন থেকে দেশের মাটিতে কিংবা সুবিধাজনক দেশে ফিরে আসতে ইনসেন্টিভ দিচ্ছে। এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী এবং বিশ্বের ও আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাৎপর্যবাহী।

জাপানের নীতিগত পরিবর্তনের নিরিখে দৃশ্যমান হয়েছে যে, 'রি-শোরিং’-এর জন্য টোকিওর বাজেট বেড়ে ২৫০ কোটি আমেরিকান ডলার হয়েছে। কমবেশি আড়াইশো জাপানি সংস্থা গত কয়েক বছরে চীন ছেড়ে চলে গিয়েছে। আর এই চীন-ত্যাগের ইস্যুকে ইউরোপের ব্রেক্সিটের অনুসরণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নামকরণ করা হয়েছে ‘চেক্সিট’। লক্ষণীয় বিষয় হলো সবগুলো সংস্থা যে চীন ছেড়ে সব সময় জাপানে ফিরে যাচ্ছে, তা-ও নয়। বরং ওই ভূগোলের অন্যসব আশেপাশের দেশেই তারা আস্তানা গাড়ছে। অর্থনৈতিক এই পরিবর্তমান গতিশীলতা চীনকে কেন্দ্র করে চলমান আর্থিক ধারাকে বহুলাংশে শ্লথ করবে।

জাপানের সংবাদমাধ্যম ‘আসাহি শিমবুন’-এর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী গত বছর ১৩৫টি সংস্থা চীন ছেড়ে অন্য দেশে তাদের উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করেছে। এই সব সংস্থা মূলত সেমিকন্ডাক্টর, মোটরগাড়ি, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি এবং পোশাক নির্মাতা। সোনি তার স্মার্টফোন উৎপাদনের একাংশকে থাইল্যান্ডে নিয়ে গিয়েছে। লক্ষণীয়, এই স্থানান্তরণের ফলে ২০২১ নাগাদ সেখানে উল্লেখযোগ্য রকমের বিদেশি বিনিয়োগ ঘটেছে। আরও লক্ষ করার বিষয় এই যে, বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ কিন্তু চীনেরই বিভিন্ন সংস্থা।

দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্থাগুলোও যে শুধুমাত্র ‘ফ্রেন্ড-শোরিং’ বা বন্ধুরাষ্ট্র বা যে সব দেশ পরস্পরের সঙ্গে বিভিন্ন চুক্তির দ্বারা আবদ্ধ, সেখানে যন্ত্রাংশ তৈরির বরাত দেওয়া বা সরবরাহের পরিধিকে সেই সব দেশের মধ্যে আবদ্ধ রাখার নীতি করছে, এমন নয়। যেমন, স্যামসাং ভিয়েতনামে আগ্রহ প্রকাশ করেছে সে দেশ গুগলকে তার পিক্সেল ফোন বানাতে। অ্যাপলকে তার ম্যাকবুক এবং আইফোন উৎপাদনে এবং এমনকি নাইকি ও অ্যাডিডাসকেও বিনিয়োগে আকৃষ্ট করেছে।

এমনকি, চীন থেকে বত্রিশটি প্রকল্প সরিয়ে নিয়ে গিয়ে মালয়েশিয়া লাভবান হয়েছে। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের তরফে এশিয়ার শিল্প-দানবদের চেয়ে বেশি ইনসেন্টিভ দেওয়ার ঘোষণার উত্তরে হুন্ডাই পাল্টা ঘোষণা করেছে যে, তারা জর্জিয়ায় একটি বৈদ্যুতিক গাড়ি এবং ব্যাটারি কারখানা গড়ে তুলবে। পাশাপাশি, হোন্ডার সঙ্গে যৌথ ভাবে এলজি ওহায়োতে একটি নতুন ব্যাটারি কারখানার উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে এসব পরিবর্তনের ফল আমেরিকানদের জন্য আশাবাদী হওয়ার মতো পরিস্থিতির জন্ম দিচ্ছে, তা বলা চলে না।

পক্ষান্তরে চীন এসব ব্যাপারে আগ্রাসী আচরণ দেখাতে অবশ্যই বাকি রাখেনি। তারা তৈরি করেছে এক দ্বিমুখী ভিসা নিষিদ্ধকরণ, যা জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়াকে আঘাত করেছে এবং যা থেকে রাজনীতির আঙিনাতেও উদ্বেগও তৈরি হয়েছে। কোরিয়ায় লোত্তে-র খুচরো ব্যবসার পরিকাঠামো, সুইডেনের এরিকসন, অস্ট্রেলিয়ার সুরা-নির্মাতারা, তাইওয়ানের আনারস চাষিরা এবং লিথুয়ানিয়ার সকলেই চীনা ড্রাগনের আগুনে নিশ্বাসের উত্তাপ পেয়েছে।

স্বাভাবিক ভাবেই, বিশ্ববাণিজ্য মহল সার্বিক অর্থে চীনে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঝুঁকি দেখতে পেয়েছে, সে দেশে বিভিন্ন রকমের বৈষম্য, ক্রমাগত বাড়তে থাকা উৎপাদন ব্যয়, যেমন, ভিয়েতনামে অদক্ষ শ্রমিকের মজুরি চীনের থেকে ৬০ শতাংশ কম, পরিবেশ সংক্রান্ত কঠোর নিয়মকানুন, কোভিড সংক্রমণ এবং অবশ্যই বার বার বিঘ্নিত সরবরাহ ব্যবস্থার সম্পর্কে শুনেছে। শুধু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোই নয়, বরং ইউরোপের একটি সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, মহাদেশটির ২৩ শতাংশ সংস্থা চীন থেকে সরে আসার কথা ভাবছে।

আপাতত এসব নেতিবাচক কারণগুলো কিন্তু চীনকে উৎপাদন কেন্দ্র বা বাজার হিসেবে খাটো করে দেখাচ্ছে না। ২০২২ সালে নানা বিঘ্নের পরও চীনে প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের পরিমাণ কার্যত বেড়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, জার্মানির বিএএসএফ তার কর্মকাণ্ড চীনে ফিরিয়ে আনছে। ‘ফিন্যান্সিয়াল টাইমস’ চীনের আর্থিক শক্তিতে কোনধরনের ধ্বস হয়েছে বলে মানতে নারাজ। তাদের সাম্প্রতিক অনেকগুলো প্রতিবেদন চীনের ক্ষেত্রে নানা সঙ্কুলতার কথা উল্লেখ করলেও দেশটির সার্বিক আর্থিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেনি। বরং, কী উপায়ে অ্যাপলের উৎপাদন পদ্ধতি চীনের পরিবেশের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত, তা ফলাও করে প্রচার করেছে।

এ সব সত্ত্বেও বলা যায়, পরিবর্তনের হাওয়া কিন্তু বইছেই। সিএনবিসি এক সরবরাহ ব্যবস্থা সংক্রান্ত ‘হিট ম্যাপ’ (ডেটা প্রদর্শনকারী পদ্ধতি বিশেষ)-এ দেখাচ্ছে যে, চীন ক্রমে ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ, ভারত এবং তাইওয়ানকে হারাতে চলেছে।

সুতরাং, বিশ্বায়নের দিনগুলোতে করোনাকালে যত পরিহাসই করা হয়ে থাকুক না কেন, জাতীয় শিল্পনীতির পুনরুজ্জীবন এক বাস্তব ঘটনা, যা কার্যত জাতীয় নিরাপত্তা, সরবরাহ-শৃঙ্খলা এবং রাজনৈতিক উদ্বেগের দ্বারা চালিত হয়। এবং এই সমস্ত কিছুই একত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গত সেপ্টেম্বরে চীন নিজেই এক বিস্তারিত জাতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথা ঘোষণা করেছিল, যার বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ না করেই। যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘সমস্ত কিছুরই নিরাপত্তা বিধান’। এর মানে হলো পরিবর্তন আঁচ করেছে খোদ চীন এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়েও তারা ভাবছে।

চীনের পরিস্থিতি ফায়দা তুলতে মুখিয়ে আছে বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বী আমেরিকা ও আঞ্চলিক প্রতিযোগী ভারত। ভারতের সাম্প্রতিক উৎপাদন বিষয়ক ইনসেন্টিভ, পুঁজির ক্ষেত্রে ভর্তুকি প্রদান ইত্যদি নীতির উপর জোর দেওয়ার ব্যাপার কিন্তু বিশেষ ভাবে চীন তথা পুর্ব এশিয়া এবং ব্যাপকার্থে বিশ্বের প্রবণতার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানের প্রত্যাশার নিবিড় সম্পর্ক রাখে। যদিও ভারত ২০২১ সালের জাতিসংঘের বৈদেশিক বিনিয়োগ-তালিকায় সপ্তম স্থানে রয়েছে এবং চীনের বিকল্প হিসাবে তাকে বিশ্বের বৃহৎ সংস্থাগুলো বিবেচনা করেনা, তথাপি আর্থিক ক্ষেত্রে নিজেকে এগিয়ে নেওয়ার ভারতীয় তৎপরতা থেমে নেয়। দেখছে না। ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা পুর্ব এশিয়ার সঙ্গে আরও বেশি মাত্রায় বাণিজ্য সম্পর্ক তৈরি, শুল্কনীতির শিথিলায়ন, শ্রমক্ষমতার গুণগত মানের উন্নয়ন ইত্যাদির মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় যোগ্য হয়ে উঠার তাগিদ দিচ্ছেন। এরই মাঝে বহু পূর্ব এশীয় ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শক্তিসম্পদ দেশগুলো প্রয়োজনীয় সক্ষমতা অর্জনের পথে সামনের পরিস্থিতিতে সুবিধাজনক অবস্থান হাসিলের লক্ষ্যে চলতে শুরু করেছে।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম

সংঘাত এক অসমাপিকা ক্রিয়া



ড. মাহফুজ পারভেজ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

এতো মৃত্যু, এতো রক্ত, এতো ধ্বংস, এতো তাণ্ডবের সম্মিলিত চেহারাটা বড় বীভৎস এবং করুণ। মধ্য জুলাই ২০২৪ সালের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাপ্রবাহের জেরে দগ্ধ ও রক্তাক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। দেশবাসীর তাজা স্মৃতি ছুঁয়ে রয়েছে আতঙ্ক, ভীতি ও উদ্বেগ, যা ক্রমশ স্বস্তির দেখা পেলেও একটি প্রশ্ন সবাইকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, এই সংঘাতময় নজিরবিহীন নৈরাজ্যে কার জয় হলো? কার হলো পরাজয়?

সহজে বা এককথায় উত্তর পাওয়া যাবে না। কারণ, নৈরাজ্য এক বিকারগ্রস্ত পরিস্থিতির নাম। যুক্তি ও বুদ্ধি কাজ করে না নৈরাজ্যবাদী সংঘাতে। আর সংঘাত এক অসমাপিকা ক্রিয়া। দুষ্টচক্রের মতো বাড়তে থাকে। এক সংঘাত আরেক সংঘাতকে ডেকে আনে। সংঘাতে আচ্ছন্ন করে ফেলে সবকিছু।

সংঘাত ও নৈরাজ্যের কারণে কোনও কাজ, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, আন্দোলন আর স্বরূপে স্থির থাকতে পারে না। পরিণত হয় ধ্বংসাত্মক তাণ্ডবে। পক্ষ-বিপক্ষের প্রতিটি ধারাও নিয়মের সীমারেখার ভেতর থাকতে পারে না। চলে যায় নিয়ম ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ফলাফল সর্বাত্মক ধ্বংসযজ্ঞ, অগণিত মৃত্যু, সীমাহীন রক্তপাত। পক্ষ-বিপক্ষ উভয়েই অপরিসীম ক্ষতির সম্মুখীন। ক্ষতির মাত্রা কল্পনার চেয়েও অধিক।

সংঘাত ও নৈরাজ্যের পরিস্থিতিতে একটা লাগামছাড়া আক্রোশ সওয়ার হয়। ক্ষোভ ও হিংসা দখল করে পুরো পরিস্থিতি। উন্মত্ততা তেড়ে আসে বন্য পশুর মতো। গণউন্মত্ততার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় ধ্বংসযজ্ঞে। কেন এমন হয়েছিল কেউ ঠিক ঠিক বলতে পারবে? হয়তো কখনও জানা যাবে সমাজতাত্ত্বিক-মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা করা হলে। হয়তো এর রাজনৈতিক কার্যকারণও জানা যাবে। কিন্তু মানবিক ও বস্তুগত ক্ষতির পূরণ সম্ভব হবে না কোনোও দিনও। হয়তো ধ্বংসের পর নির্মাণ হবে। মৃত্যুর পর নবজন্ম হবে। তথাপি সহজে মুছবে না দগদগে ক্ষতির চিহ্ন ও রেশ।

সংঘাত ও নৈরাজ্যের সংগঠিত রূপ হলো গণউন্মত্ততা। প্রায়ই যে ছেলেধরা বা কথিত চোর সন্দেহে অবলীলাক্রমে জীবন্ত মানুষকে পিটিয়ে মারা হয়, তা আসলে এক ধরনের গণউন্মত্ততা, যা সংঘাতময় মনোবৃত্তি ও নৈরাজ্যজনক মানসিকতার ভিন্নধর্মী বহিঃপ্রকাশ। সমাজ ও মানুষ অস্থিরতার কবলে নিপতিত হলে বিস্ফোরণ ঘটে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার।

সেজন্যই সমাজে শান্তি, ভারসাম্য ও স্থিতিশীলতা জরুরি। আর শান্তিপূর্ণ, স্বাভাবিক সমাজের স্বার্থে ও মানুষের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গণউন্মত্ততা বড়ই বিপদজনক। এর প্রকৃত কার্যকারণ অবশ্যই খুঁজে বের করা দরকার। নচেৎ বিষফোঁড়া হয়ে তীব্র যন্ত্রণা দিয়ে ফেটে বের হবে এবং সংঘাত ও নৈরাজ্যের ধারাকে পুষ্ট করতে থাকবে অসমাপিকা ক্রিয়ার মতো, যার শুরু থাকলেও শেষ থাকবে না। বরং এর থেকে জন্ম নেবে আরও সংঘাত। আরও নৈরাজ্য। আরও তাণ্ডব ও উন্মত্ততা।

মধ্য জুলাই ২০২৪ সালের ধ্বংস-চিহ্নিত ও রক্ত-মথিত ঘটনাপ্রবাহে সংঘাত ছিল। নৈরাজ্য ছিল। তাণ্ডব ছিল। গণউন্মত্ততা ছিল। সবই ছিল। শুধু অনুপস্থিত ছিল বিবেক, যুক্তি, মানবিকতা, সহনশীলতা। যার পরিণতি ভোগ করতে হলো পুরো দেশ ও জাতিকে। প্রচুর মূল্য দিয়ে এবং শঙ্কার কৃষ্ণপ্রহর পেরিয়ে মানুষকে ফিরতে হয়েছে স্বাভাবিক জীবনের ছন্দে।

বিশ্বের দেশে দেশে সংঘাত এক ভয়ঙ্কর বিপদের নাম। রাজনৈতিক কারণে, সামাজিক বিভেদে, অর্থনৈতিক বৈষম্যে, জাতিগত দ্বন্দ্বে, মতাদর্শিক মতপার্থক্যে বহু দেশ সংঘাতে নিমজ্জিত হয়ে পৌঁছে গেছে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। সংঘাত-কবলিত সমাজ হচ্ছে রক্তাক্ত, মানুষ হচ্ছে বিপন্ন।

ক্ষুদ্র আয়তনে বিপুল জনসংখ্যার বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সংঘাত কতো মারাত্মক হতে পারে তার প্রমাণ মধ্য জুলাইয়ের নজিরবিহীন ঘটনাপ্রবাহ। এই দুঃখজনক ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সংঘাত-মুক্তির পথ খুঁজে বের করা আবশ্যক। বিভেদ ও বিতর্কের গতিপথ আর যেন দ্বন্দ্ব-সংঘাতের দিকে চলে যেতে না পারে, তা নিশ্চিত করা জরুরি। সংঘাতকে সংঘাত দিয়ে নয়, সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে সমাধানে উত্তীর্ণ করার কৌশল অবলম্বন করাই সুবিবেচনার কাজ। প্রতিপক্ষের ক্যাম্পে ঠেলে দিয়ে নয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক মনোভাবে কাছে টেনেই বরং সঙ্কট সমাধান ও সঙ্কট প্রশমন করা লাভজনক, শান্তিপূর্ণ ও বিচক্ষণ পদ্ধতি।

উদীয়মান অর্থনীতির বাংলাদেশকে সামনে এগুতে হচ্ছে সীমাহীন প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে। লড়তে হচ্ছে মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতি, চাকরি প্রাপ্তির অনিয়ম ও নানা রকমের অব্যবস্থার বিরুদ্ধে। এই যাত্রাপথ মসৃণ নয়। এতে যদি সংঘাতের দৈত্য এসে হানা দেয় তাহলে কষ্টার্জিত সকল অর্জনই ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। অগ্রগামী বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়তে থাকবে। বাংলাদেশের মানুষের দুর্ভোগও বাড়তে থাকবে।

এমন সঙ্কুল পরিস্থিতিতে কার লাভ হবে? কে জিতবে? কে হারবে? এসব প্রশ্নের উত্তর না দিয়েও নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের আপামর মানুষের ক্ষতি ছাড়া কোনও লাভ হবে না। আসলে সংঘাত, নৈরাজ্য, উন্মত্ততা পরিশেষে কাউকেই লাভবান করতে পারে না। এক অসমাপিকা ক্রিয়ার মতো সবাইকে এক সমাপ্তিহীন ধ্বংসের গহ্বরে ফেলে দিতে পারে শুধু

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

উদারবাদিতার সীমা



সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবার আগে পৃথিবীব্যাপী মানুষের মনুষ্যত্বের দুর্দশা দেখে রবীন্দ্রনাথ ‘প্রশ্ন’ নামের কবিতাটিতে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু নিভাইছে তব আলো/ তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছো ভালো?” তাঁর চোখ সেদিন অশ্রুসিক্ত ছিল, জানিয়েছেন তিনি। সেটা ১৯৩১-এর ঘটনা। তার পরে প্রায় এক শ’ বছর কেটে গেছে কিন্তু মনুষ্যত্বের দুর্গতি মোটেই কমেনি। ১৯৩৯ আবার একটি বিশ্বযুদ্ধ বেধেছে, পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদীরাই ঘটিয়েছে দখলদারিত্বের প্রতিযোগিতায় নেমে; তারপরে তৃতীয় একটা বিশ্বযুদ্ধ ঘটেনি ঠিকই, কিন্তু পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের শোষণ পীড়ন লুণ্ঠন অসংখ্য স্থানীয় ও আঞ্চলিক যুদ্ধের রূপ নিয়েছে। তারা আজ কেবল যে বায়ু ও আলোকে বিপন্ন করছে তা-ই নয়, পানিও দিয়েছে নষ্ট করে, ধরিত্রীকে তপ্ত করেছে দুঃসহ রূপে। খবর বলছে ২০২৩ সালে গ্রীষ্ম ছিল গত দুই হাজার বছরের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ; এবং শঙ্কা নাকি এই রকমের যে চলতি বছরের উষ্ণতা ওই রেকর্ডও ভেঙে ফেলবে।

রবীন্দ্রনাথের প্রশ্নটা ছিল ভগবানের কাছে। এযুগে ইহজাগতিকরণ বৃদ্ধি পেয়েছে, প্রশ্ন নিয়ে মানুষ এখন আর ভগবানের দ্বারস্থ হয় না, জিজ্ঞাসা করে মানুষকেই। এ ক্ষেত্রে মানুষই এখন ভগবানের জায়গা নিয়ে নিয়েছে। মানুষের নাকি অনেক ক্ষমতা; বিশেষ করে এই জন্য যে তারা ভোট দিতে পারে, ভোট দিয়ে পছন্দের সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে পারে। কিন্তু পছন্দ করবার মতো সক্ষমতা মানুষের আছে কী? গণতন্ত্রের জন্য ‘আদর্শ’ ভূমি আমেরিকা; সেখানে একটি নির্বাচন এগিয়ে আসছে; জনগণ পুনরায় ক্ষমতা পাবে পছন্দের মানুষটিকে প্রেসিডেন্টের আসনে বসাবার। কিন্তু তারা কাকে বসাবে? হয় বাইডেনকে নয়তো ট্রাম্পকে। দু’জনের মধ্যে পার্থক্য কতটা? সে তো উনিশ বিশের।

ফিলিস্তিনি প্রশ্নে তাদের অবস্থান দেখলে তো বোঝা যায় যে উনিশ বিশের নয়, সাড়ে উনিশ ও বিশের বটে। ট্রাম্প বলেছেন তিনি নির্বাচিত না হলে আমেরিকাই থাকবে না; অর্থাৎ যে বর্ণবাদী আমেরিকা একদা কলম্বাসের ইউরোপীয় সহযোগীরা তাদের জবরদখল-করা ভূমিতে কায়েম করেছিল সেটা থাকবে না। ট্রাম্পের আওয়াজটা হচ্ছে, শ্বেতাঙ্গদের শাসন যদি টিকিয়ে রাখতে চাও তাহলে আমাকে ভোট দাও। কথাটা বাইডেন ঠিক ওই ভাবে বলেন না, কিন্তু তিনিও যে শ্বেতাঙ্গ-শাসনই অক্ষুন্ন রাখতে চান তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে কথিত যে ভারত, সেখানেও তো বর্তমান প্রধানমন্ত্রীই পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন, দুটি ভিন্ন দলের কাঁধে ভর দিয়ে, তবে উন্নয়নের ডঙ্কা বাজিয়ে নয়, যেটা আগেরবার বাজিয়ে ছিলেন; এবার সেটা করেননি কারণ উন্নয়ন তেমন ঘটাতে পারেননি, তার চেয়ে সহজ এবং তাঁর ধারণা অধিক কার্যকর পথ হচ্ছে তিনি না এলে মুসলমানরা ক্ষমতাবান হয়ে উঠবে, দেশের ধনসম্পত্তি সব দখল করে নেবে ভৌতিক এই ভয়টাকে প্রচার করে।

বুর্জোয়া নির্বাচন ব্যবস্থা মোটামুটি পৃথিবী জুড়েই অকেজো হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে যে জাতীয় নির্বাচন হয়ে গেল সেখানে তো দেখলাম ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলো নিজের দলের লোকদের বিরুদ্ধেই। স্থানীয় নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলেছে দলের লোকদের মধ্যেই। নির্বাচনে বিজয়ীরা যা খরচ করেন তার বহুগুণ তাঁরা যে তুলে নেবেন সেটা তাঁরা জানেন আমরাও জানি; স্থানীয় নির্বাচনে অনেক ক্ষেত্রেই কী ঘটেছে সে সম্পর্কে ঠাকুরগাঁওয়ের এক আওয়ামী লীগ নেতা ঠিকই জানিয়েছেন : “ভোটের প্রতি মানুষের আস্থা নেই, বিশ্বাস উঠে গেছে। সারাদিন দুই-তিনটা ভোট পড়েছে, বিকেলে তা বানানো হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩০০০ হাজার” [আজকের পত্রিকা, ১৭ মে]। ৩০০ থেকে ৩০০০ হাজারের ভেতর একটি মাত্র শূন্যের ব্যবধান বৈকি; ব্যাপারটাও দাঁড়াচ্ছে শূন্য কুম্ভের মতোই। শূন্য কুম্ভের আওয়াজ বেশি, কারণ ভেতরের জিনিস কম।

মোক্ষম সত্যটা অবশ্য প্রকাশ পেয়েছে একটি দৈনিকের শিরোনামে : “যেখানে এক আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি”। সংবাদে-উল্লেখিত মিলের জায়গাগুলো হলো উপজেলা নির্বাচনে (ক) দলীয় সিদ্ধান্ত মানছে না দুই দলের মাঠ পর্যায়ের নেতারা, (খ) নির্দেশনা অমান্য করার শাস্তি হয়নি সরকারি দলের কারও; এবং (গ) বিএনপি বহিষ্কারের পথে হাঁটলেও পাল্টা দায় দিচ্ছেন বহিষ্কৃত নেতারা”। মূল ঐক্যটা যেখানে তার কথা অবশ্য এই সংবাদ-তথ্যে নেই; সেটা হলো পুঁজিবাদী উন্নয়নে দীক্ষা। এক্ষেত্রে উভয় দলই সহযাত্রী, তাঁরা সেই উন্নয়নই সমর্থন করে থাকে যে-উন্নয়ন বৈষম্য বৃদ্ধি করে, বিচ্ছিন্নতা বাড়ায়, নিচের দিকে ঠেলে দেয় দেশপ্রেমকে। উন্নয়নের ওই নীতিতে আওয়ামী লীগ-বিএনপি’তে কোনো ফারাক নেই, যেমনটা ঘটেছে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর এলাকায়, যেখানে দুইদলের নেতারা পাবলিকের জমি দখল করে একত্রযোগে একটি দোকান গড়েছেন।

উদারনীতিকেরা সংস্কারের কথা বলেন, কিন্তু সংস্কারে যে কুলাবে না তা অত্যন্ত স্পষ্ট। নাট্যকার হেনরিক ইবসেন বুনো হাঁস নামে একটি নাটক লিখেছিলেন সেই ১৮৮৪ সালে, অর্থাৎ আজ থেকে ১৪০ বছর আগে। নাটকটিতে ওই সময়েই পুঁজিবাদ কী ভাবে কাজ করে সেটা তিনি দেখিয়েছেন। নাটকে দেখা যাচ্ছে পুঁজিবাদী প্রতারণা ব্যবস্থার শিকার হচ্ছে একডাল পরিবার। বৃদ্ধ একডাল ব্যবসা করতেন তাঁর বন্ধু ওয়ারলের সঙ্গে। ওয়ারল খাঁটি পুঁজিবাদী। সে নেমেছিল কাঠকাটার অবৈধ ব্যবসাতে; কাজটা ধরা পড়ে যায়। মামলা হয়। ওয়ারলের ছিল প্রচুর টাকা; টাকার জোরে সে খালাস পেয়ে যায়, কিন্তু দশ বছরের জেল হয় একডালের। একডালরা একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, টাকাওয়ালা ওয়ারল লোকটা ছিল ভীষণ ভোগবাদী; সে তার গৃহ পরিচারিকা জীনার ওপর যৌন নির্যাতন চালায়। জীনা সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়লে তড়িঘড়ি তাকে বিয়ে দিয়ে দেয় একডালেরই পুত্র হেলমারের সঙ্গে। জীনা একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। জীনার স্বামী হেলমার একডাল যে কন্যাটির জৈব-পিতা নয়, এটা সে খোঁজ নিলেই জানতে পারতো। কিন্তু খোঁজ হেলমার নেয়নি। তার বসবাস ছিল স্বপ্নের জগতে।

জীনা এবং কন্যাটিকে নিয়ে তার দিন কেটে যাচ্ছিল। পেশা ছিল ফটোগ্রাফারের। স্বপ্ন ছিল একটি ফটোগ্রাফির যন্ত্র উদ্ভাবনের, যাতে তাদের সংসারে প্রচুর টাকা আসবে, পরিবারের জন্য আসবে সম্মান ও সুখ। কিন্তু হেলমারের বাল্যবন্ধু ওয়ারলের একমাত্র সন্তান গ্রেগারস বাবার কীর্তিগুলো ধরে ফেলেছিল। এই পুত্র বাবাকে ভীষণ ঘৃণা করে, বন্ধু হেলমারকে সে গভীর ভাবে ভালোবাসে। সে আদর্শবাদী এবং সংস্কারপন্থি। সে চাইলো অন্তরের বন্ধু হেলমারকে মিথ্যার জাল থেকে উদ্ধার করবে, সত্য ধরিয়ে দিয়ে পরিপূর্ণ বোঝাবুঝির ওপর বন্ধুর দাম্পত্যজীবনের প্রতিষ্ঠা ঘটাবে। তাই একদিন সে তার বন্ধু হেলমারকে ডেকে নিয়ে জীনার সন্তান সম্পর্কে ‘সত্য’টা জানিয়ে দিল। ফল দাঁড়ালো এই যে, হেলমারের কষ্ট-করে-সাজানো সংসারটা গেল ভেঙে, হেলমারের অবস্থাটা দাঁড়াল অর্ধউন্মাদের; সে তার অত্যন্ত আদরের কন্যাটিকে ঘৃণা ভরে দূরে সরিয়ে দিল।, স্ত্রীকে অসৎ বলে ঘোষণা দিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে বলে ঠিক করলো।

১৪ বছর বয়সের কন্যাটি বুঝতে পারলো না কী ঘটেছে, কেন ঘটছে, কিন্তু টের পেল যে তার বাবা তাকে আর ভালোবাসেন না, সহ্যই করতে পারেন না। মেয়েটির সন্দেহ হলো হয়তো সে তার বাবা-মা’র সন্তান নয়, মা তাকে কুড়িয়ে পেয়েছেন। হঠাৎ-জাগা উপলব্ধিতে অসহায় মেয়েটি আত্মহত্যা করে বসলো। বাবার অকৃত্রিম বন্ধুর সংস্কার-চেষ্টার সমস্তটা ভার গিয়ে পড়েছিল নিরূপায় কন্যাটির ওপর, যেটা বহন করার ক্ষমতা তার ছিল না। নষ্ট পিতা ওয়ারল টাকার জোরে যে-পরিবারটিকে পথে বসিয়ে দিয়েছে, উপকার করতে গিয়ে আদর্শবাদী পুত্র তাদেরকেই দিল ছিন্নভিন্ন করে।

বিখ্যাত এই নাটকটির নানা রকমের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আছে; কিন্তু এর এই বক্তব্যটা খুবই সুস্পষ্ট যে, নষ্ট পিতার আদর্শবাদী পুত্র গ্রেগারস বন্ধুর পরিবারে সংস্কার ঘটাতে গিয়ে যা ডেকে আনলো তা ভয়াবহ বিপর্যয় ভিন্ন অন্যকিছু নয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সংস্কার আনতে গেলে পরিণতিটা এর চেয়ে ভালো হবার নয়। গ্রেগারস তার বন্ধু হেলমারের উপকার করতে পারতো সংস্কারের পথে না গিয়ে, আর্থিক ভাবে সাহায্য করতে সে সামর্থ্য তার ছিল। বিজ্ঞানী ডারউইন প্রাকৃতিক জগৎকে পরিবর্তন সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক সত্য আবিষ্কার করার পরে মানবজাতিকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন প্রকৃতিকে নিজের মতো থাকতে দিতে, হস্তক্ষেপ না ঘটাতে; পুঁজিবাদীরা সে-পরামর্শকে গুরুত্ব দেয়নি, তারা প্রকৃতিকে নানা ভাবে উত্ত্যক্ত করেছে, যার পরিণতি হচ্ছে বর্তমান দুরবস্থা।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

;

ছাত্র-শক্তিকে অগ্রাহ্যে হলো যে ক্ষতি



কবির য়াহমদ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

কোটা বিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনের শুরুর দিকে এটাকে পাত্তা দেয়নি সরকার। দাবিদাওয়া কিংবা যেকোনো পর্যায়ের যেকোনো আন্দোলনকে শুরুর দিকে সচরাচর পাত্তা দেয় না আওয়ামী লীগ সরকার। টানা চার মেয়াদে ক্ষমতাসীন থাকার নানা সময়ে বিভিন্ন আন্দোলনের মুখে পড়েছে তারা, কিন্তু কোনো আন্দোলনকেই শুরুর দিকে পাত্তা দেয়নি তারা। বিভিন্ন ভাবে আন্দোলন বানচালের চেষ্টা চালিয়ে এরপর শক্তি প্রয়োগে সে সব আন্দোলনকে স্তব্ধ কর দিয়ে এসেছে। কোটা নিয়ে শিক্ষার্থী আন্দোলনও এক পর্যায়ে এই ধারাবাহিকতার মধ্যে পড়েছিল।

প্রথমে ছাত্রলীগকে দিয়ে আন্দোলন দমাতে গিয়ে হিতে বিপরীত হয়েছে। ছাত্রলীগই মার খেয়েছে, ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। পুলিশ দিয়ে আন্দোলন দমাতে গিয়ে এটা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়েছে। পুলিশের লাঠি-বন্দুকে ভয় না পেয়ে বরং দুর্দমনীয় সাহসে পেতে দিয়েছে বুক। পুলিশ গুলি করেছে, তবু সরেনি পুনর্বার গুলির শঙ্কা থাকলেও। ফের গুলি করেছে পুলিশ। রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ এভাবে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছে। তার প্রাণ বলিদান আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মনোবল ভেঙে দেয়নি। উপরন্তু এক মৃত্যুতে মরণের সমূহ ভয় কেটে গেছে অন্য সবার। বন্দুক-লাঠি-বেয়নেট-টিয়ার গ্যাস তখন হয়ে গেছে মামুলি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আরও শক্তি প্রয়োগের দিকে গেছে সরকার। বিজিবি নামিয়েছে। পরে সেনাবাহিনী।

দাপ্তরিক আদেশে বন্ধ করেছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ক্যাম্পাস থেকে কৌশলে এবং জোর করে বের করে দিয়েছে শিক্ষার্থীদের। কিন্তু তবু আন্দোলন থামেনি। বরং ক্যাম্পাসের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একাত্ম হয়েছে সাধারণ মানুষও। অনেকেই রাস্তায় নেমেছে। ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে পড়েছে পুলিশ-র‍্যাব-বিজিবিসহ বিভিন্ন বাহিনী।

ছাত্র-শক্তির এই তুমুল রূপের সামনে আওয়ামী লীগ এবারই প্রথম পড়েনি। ২০১৮ সালের পর পর দুইটা আন্দোলনের মুখে পড়ে তখনো পিছু হটেছিল। কোটা বিরোধী আন্দোলনে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল সরকার। সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে একই বছরের অপর এক আন্দোলনেও বিজয়ী হয়েছিল শিক্ষার্থীরা। লক্ষণীয় যে, এবারের কোটা আন্দোলন শুরু করেছিল যারা তাদের হাত ধরেই গড়ে ওঠেছিল সড়ক নিরাপত্তার আন্দোলন। তখন তারা ছিল মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী। এবার তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের।

কোটা বাতিলের এবারের যে আন্দোলন এবং যে দাবি তাতে সরকারের দ্বিমত ছিল না। বরং সরকারের জারি করা ২০১৮ সালের পরিপত্র বাতিল করেছিল হাইকোর্ট, এবং পরিপত্র বাতিলের কারণে ফিরে এসেছিল কোটা ব্যবস্থা। যদিও সরকার ছয় বছর আগে আন্দোলনের মুখে বাতিল করেছিল কোটা, তবে হাইকোর্টের ভিন্ন রায় এবং অব্যবহিত পরও সরকার ছিল কোটা বাতিলের পক্ষেই। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল তার প্রমাণ। এরপর শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করলে প্রথম দিকে পাত্তা দেয়নি। ফলে আপিল পর্যন্ত থেমে থেকেছিল বিষয়টি। শুনানি এগিয়ে আনতে রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ কোন উদ্যোগের দেখা মেলেনি। তবে যখনই আন্দোলন ক্রমে বড় হতে থাকল, তখন হাইকোর্টের রায়ে স্থগিতাদেশ দিলেন আপিল বিভাগ, এবং পূর্ণাঙ্গ শুনানির জন্যে এক মাসের অপেক্ষার জন্যে রেখে দেওয়া হলো। এরপর পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেল, তখন আপিল এগিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়, এবং সর্বশেষ ফুল কোর্ট শুনানিতে আসল চূড়ান্ত রায়। আপিল বিভাগ চূড়ান্ত রায়ে ৭ শতাংশ কোটা রেখে রায় দেন আদালত।

চূড়ান্ত রায়ের আগে সরকারের ভূমিকা ছিল বিতর্কিত। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিদের অগ্রাধিকারের প্রসঙ্গ আসায়, আন্দোলনকারীরা ভাবল, এই বুঝি কোটা ফিরে এলো। যেখানে দেশে রাজাকারের কোন তালিকাই নাই সেখানে রাজাকারের নাতিপুতির প্রসঙ্গ এনে যে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেছিলেন, তাদের উদ্দেশ্য নিয়েই সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক। কোটা নিয়ে আন্দোলনকারীদের মধ্যে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছিল তা হচ্ছে ৩০ শতাংশের মুক্তিযোদ্ধা কোটা। এই সুযোগে অনেকেই একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপমানের সুযোগ ছাড়ল না। মুক্তিযুদ্ধে তাদের অংশগ্রহণের উদ্দেশ্য নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলল। মুক্তিযোদ্ধারা রাষ্ট্রীয়ভাবে অনেক সুযোগসুবিধা পেয়ে থাকেন, চাকরি ক্ষেত্রে তাদের সন্তান ও নাতিপুতিরা কেন বিশেষ সুবিধা পাবে, এই প্রশ্ন তুলল।

মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও সরকার বিষয়টিকে ইগোর লড়াই হিসেবে দেখল বলেই কিনা ক্ষীণ স্বরে হলে কোটা ফিরিয়ে আনার একটা আওয়াজ ওঠল। বিষয়টি যদিও আনুষ্ঠানিক ছিল না, তবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য এবং বিভিন্ন মন্ত্রীর বক্তব্যে সন্দেহ দানা বাঁধল। ফলে কোটা ফিরে আসার যে ইঙ্গিত, তাতে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠল শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে আওয়ামী লীগ সরকার হালকাভাবে দেখল, এবং ভাবল ছাত্রলীগ আর পুলিশকে দিয়ে নস্যাৎ করে দেওয়া যাবে এটা। তাদের এই অভিসন্ধি ফুটে ওঠল ওবায়দুল কাদেরের নানা বক্তৃতায়। তিনি আন্দোলনকারীদের বিষয়টি ছাত্রলীগ দেখবে বলে যে কথা উচ্চারণ করেছেন, সেটা ক্ষোভের সঞ্চার করেছে আন্দোলনকারীদের মাঝে। এরপর তিনি বিষয়টি রাজনৈতিক ভাবে মোকাবেলার কথা জানিয়ে ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে প্রতিরোধ গড়ার নির্দেশ দেন দলীয় নেতাদের। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াত ঢুকে গেছে এমন মন্তব্য করেন তিনি। ছাত্র-শক্তিকে অগ্রাহ্য করে তার বক্তব্য ও নির্দেশনা আগুনে ঘি ঢেলে দেয়।

ছাত্র-শক্তিকে অগ্রাহ্য করার বিষয়টি এসেছে মূলত সরকারবিরোধী আন্দোলনকে মোকাবেলা করার সাম্প্রতিক ইতিহাস। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার বিএনপি-জামায়াতসহ সকল সরকারবিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে অগ্রাহ্য করে, তাদের বর্জন সত্ত্বেও নির্বাচন করেছিল। ওই নির্বাচনের আগে আমেরিকা-ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিদেশি অনেক শক্তি সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও শেষ পর্যন্ত সরকার নির্বাচন করে এবং ফের সরকার গঠন করে। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তিকে মোকাবেলা করে সরকারের এই পথ চলায় তাদের মধ্যে অহংবোধ জেগে ওঠায়, কোন শক্তিকেই পাত্তা না দেওয়ার একটা মানসিকতা গড়ে ওঠেছে। এই মানসিকতা কাল হয়েছে শিক্ষার্থী আন্দোলনকেও একইভাবে দেখার মধ্য দিয়ে।

সরকার ভেবেছিল নির্বাহী আদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ও ক্যাম্পাস খালি করে দিয়ে পুলিশি ভয় দেখিয়ে শিক্ষার্থীদেরও দমিয়ে রাখা যাবে। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার কারণে আন্দোলন ক্যাম্পাস থেকে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। রাস্তায় নেমে আসে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও। ছাত্র আন্দোলন রূপ নেয় ছাত্র অভ্যুত্থানে।

যদিও আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের হাতে থাকেনি, তবে যথাসময়ে এর সমাধান করলে বিপুল প্রাণের অপচয় আর সরকারি-বেসরকারি সম্পদহানির ঘটনা ঘটত না, দেশ অর্থনৈতিকসহ নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতো না। যে অনিয়ন্ত্রিত, অস্থির এবং অস্বাভাবিক অবস্থা চলছে দেশে, সেটা এমন নাও হতে পারত সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলে।

টানা ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ কাউকেই পাত্তা দেয় না বলে যে অভিযোগ, এবারের শিক্ষার্থী আন্দোলনের সময়ে আরও একবার প্রমাণিত হয়েছে। দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছ থেকে যে সঠিক নির্দেশনার দরকার ছিল সে নির্দেশনা দিতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। যার খেসারত দিতে হলো দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে এবং রাষ্ট্রকে। সাধারণ এক শিক্ষার্থীকে আন্দোলনের এমন ভয়াল রূপে এখন আঙুল তোলা হচ্ছে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তির দিকে। নাশকতায় তারা জড়িত থাকতে পারে, কিন্তু এই আন্দোলনকে সেই পর্যায়ে নিয়ে আসার পেছনে আওয়ামী লীগ সরকারের দায়কে কি অস্বীকার করা যাবে? আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এখন দায়-চাপানোর রাজনীতিতে মনোযোগী হওয়ায় একদিকে যেমন সাংগঠনিক দুরবস্থাকে আড়াল করা হচ্ছে, অন্যদিকে আড়ালে পড়ে যাচ্ছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার বিষয়টিও।

শিক্ষার্থীরা যতই বিক্ষুব্ধ হোক, তারা অন্তত নাশকতায় জড়াবে না। কেপিআই ভুক্ত এলাকায় আগুন দেবে না, মেট্রোরেলের ক্ষতি করতে যাবে না, টেলিভিশন ভবনে হামলা করবে না, রাতভর সংঘর্ষে জড়াবে না, কারাগারে হামলা করে অস্ত্রাগার লুট করে বন্দি ছিনতাই করবে না; এসবে অন্য কেউ থাকবেই। এদেরকে প্রতিরোধ করতে পারেনি সরকার; না রাজনৈতিক ভাবে, না প্রশাসনিক ভাবে। এই ব্যর্থতার দায় তারা অস্বীকার করলেও এটা অস্বীকারের বিষয় নয়। এখন রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির তথ্য সামনে আসছে, সরকারই এখানে আগ্রহ দেখাচ্ছে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকদের ক্ষয়ক্ষতির প্রমাণ দেখানো হচ্ছে। এতে কি আড়ালে পড়ে যাচ্ছে না বিপুল প্রাণের অপচয়? অথচ রাষ্ট্রীয় সম্পদের হেফাজতের দায়িত্ব যেমন সরকারের, তেমনি দায়িত্বও তাদের নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

এই আন্দোলন এবং আন্দোলনের একটা পর্যায়ে সরকারের নিয়ন্ত্রণ হারানো প্রমাণ করে ছাত্র-শক্তিকে অগ্রাহ্য করা উচিত হয়নি। তবে আশঙ্কা হচ্ছে, সরকার না আবার এটাকে এই ভাবতে বসে—শেষ পর্যন্ত আমরা হারিনি! আওয়াজ ওঠতে শুরু করেছে। এক পুলিশ কর্মকর্তা জোর দিয়ে বলেছেন কথাটা। এবার অন্যরা বলতে শুরু করলে শক্তির খেলায় হার-জিতের প্রসঙ্গ নির্ণয় ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে!

;

তকমা, ক্ষোভ অভিমান ও নিষ্ঠুরতার হোলি



-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
তকমা, ক্ষোবাভিমান ও নিষ্ঠুরতার হোলি

তকমা, ক্ষোবাভিমান ও নিষ্ঠুরতার হোলি

  • Font increase
  • Font Decrease

কোটা সংস্কার নিয়ে ১ জুলাই ২০২৪ ঢাকাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসমাবেশ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি দিয়ে প্রথম শুরু হয় প্রতিবাদ। এটা কোন দলীয় বা রাজনৈতিক কর্মসুচি ছিল না, এখনও নয়। দলমত নির্বিশেষে এটা সকল শিক্ষার্থীর আন্দোলন। তাই এ সপ্তাহ না পেরুতেই এর সমর্থন ও জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠে গেছে। কিন্তু একে বিভিন্নভাবে রাজনৈতিক তকমা দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ তকমা এসেছে উচ্চ পর্যায় থেকে রাজাকারের ‘নাতিপুতি’ নামক শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে। এটাকে কোমলমাতি শিক্ষার্থীরা মেনে নিতে পারেনি। তারা অনেকেই মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা নাতিপুতি অথবা মুত্তিযোদ্ধা পরিবারের হওয়ায় তাদের অন্তরকে ক্ষোভের আগুনে উদ্দীপ্ত করে তুলেছে। তারা এই তকমাকে মিথ্যা অপবাদ ও চরম অপমানজনক হিসেবে ধরে নেয়ায় এটা তাদের আন্দেলনে ভস্মে ঘি ঢেলে দেয়ার মতো দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে চারদিকে।

এটাকে মনের অভিমানে তারা নিজেদেরেকে রাজাকার বলে যখন ব্যঙ্গ করে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ মুরু করেছে তখনও তাদের অভিমানকে কেউ পাত্তা দেয়নি। বরং উল্টো তাদেরকে আরো বেশী করে রাজাকারের ‘নাতিপুতি’ অপবাদ দিয়ে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করে ভিন্নদিকে প্রবাহিত করার চেষ্টায় মেতে উঠে এক শ্রেণির সুবিদাবাদী নেতা। কারো যৌক্তিক প্রশ্ন বা কোনকিছুর উপর সঠিক যুক্তি দিতে অপারগ হলে বিভিন্ন অপবাদ দেয় অথবা কথার ফাঁকে রাজাকার হিসেবে গালি দিয়ে দেয়। অনেকে কথায় কথায় একজন শিশু-কিশোরকেও এমন টিজ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে হিন্দু ছাত্রকেও স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার, শিবির হিসেবে ট্যাগ দিয়ে চাঁদা আদায় করতে দেখা গেছে। এমন ঘটনা বেশ কবছর ধরে পত্রিকায় লক্ষ্যণীয় হচ্ছিল।

এসব ভুঁইফোড় নেতাদের দম্ভ, উন্নসিকতা, হম্বিতম্বি তখন দেখার মতো ছিল। তাদের কথাগুলো সাড়ম্বরে প্রচারিত হয়ে আন্দোলনকারীদের অন্তরকে আরো বেশী বিষিয়ে তোলে। ফলে এসব মিথ্যা অপবাদ সহ্য করতে না পেরে তারা সরকারী ছাত্ররাজনীতি থেকে পদত্যাগ করে ফেসবুকে স্টাটাস দিয়ে দলে দলে আরো বেশী কোটা সংস্কার আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে উঠে।

তাদের এই দু:খ, কষ্ট, অভিমানকে সরকারী মহলের কেউই পাত্তা দেননি। বরং বিভিন্ন উস্কানীমূলক বক্তব্য দিয়ে তাদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করে সরকারী ছাত্রসংগঠন থেকে আরো দূরে ঠেলে দিয়েছেন। এ থেকে ঘটনা ভিন্ন দিকে মোড় নিতে শুরু করে। তাদেরকে লুফে নিয়ে এটাকে বৃহত্তর রাজনৈতিক আন্দোলনের ব্যানারে ছড়িয়ে দেয় সারা দেশে, সারা পৃথিবীতে। তাদের সমর্থক বেড়ে লক্ষ কোটি জনতায় পরিণত হয়ে পড়ে। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী এসকল নিরীহ ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের বড় সাফল্য হলো- খুব দ্রুতগতিতে জনপ্রিয়তা অর্জন লাভ করা। তারা দেশের অন্যান্য সকল রাজনৈতিক দলের সমর্থন লাভ করতে থাকে এবং এর সাথে অভিভাবক, সাধারণ মানুষ তাদের জন্য দরদী হয়ে উঠে। ফলে তারা অসীম সাহসী ও জেদী হয়ে উঠে এবং তাদের দাবী আদায়ে অনড় থাকে।

দেশের কর্ণধারগণ তাদেরকে অনেকটা দূরে ঠেলে দেয়ায় তারা মহামান্য রাষ্ট্রপতির নিকট স্মারকলিপি দিয়ে সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা শুরু করে। সেখানে কিছুটা আশ্বাস পেলেও তা তৎক্ষণিকভাবে কোন সুফল বয়ে আনেনি। ফলে আন্দোলন আরো গতিপ্রাপ্ত হয়ে নতুন দিকে মোড় নিতে শুরু করে।

অপরদিকে কোটা আন্দোলনকারীদেরকে দমন করার জন্য ‘শুধু ছাত্রলীগ’বা একটি ছাত্রসংগঠনই যথেষ্ট এমন মন্তব্য আরো বেশী উস্কে দিয়েছে তাদের এই অভিমানকে। কর্তৃপক্ষকে উন্নাসিকতার সুরে বলতে শোনা গেছে- ‘আন্দোলন করে করে ওরা ক্লান্ত হোক তখন দেখা যাবে।’এভাবে সরকারের তরফ থেকে দীর্ঘদিন এই আন্দোলনকে গুরুত্ব না দেয়ায় যে বিভ্রান্তি ও ভুল বুঝাবুঝি পারস্পরিক আলাপ আলোচনায় না গিয়ে শুধু হম্বিতম্বি ও দৈহিক শক্তি প্রদর্শণ করাটা সবার জন্যই চরম ক্ষতিকর পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়। চারদিকে হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যেতে থাকে।

এর পরবর্তী ঘটনাগুলোর সময় দেশে ইন্টারনেট সচল থাকায় হয়তো সবাই মোটামুটিভাবে অবগত হয়েছেন। কিন্তু ১৮ জুলাই থেকে হঠাৎ করে দেশের ইন্টারনেট সেবা ও মোবাইল ফোর জি সেবা বন্ধ করে দেয়ায় এই আন্দোলনের সঠিক তথ্য সঠিক সময়ে জনগণের নিকট পৌঁছাতে পারেনি। দেশের মানুষ যা ভাবেনি বা জানে না কিন্তু এসময় কোন কোন নেতা আগ বাড়িয়ে বক্তব্য দিয়েছেন- ‘শেখ হাসিনা মারা গেলেও দেশ ছেড়ে পালাবে না’। এসব হঠকারী বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা সন্দেহ দানা বাঁধতে দেখা গেছে। কিন্তু দেশে ইন্টারনেট না থাকলেও বিদেশী গণমাধ্যমের মাধ্যমে কোন না কোনভাবে সেগুলো মানুষের নিকট পৌঁছাতে থাকে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে গুলিতে প্রাণ হারায় শিক্ষার্থীরা। কিন্তু দেশের গণমাধ্যমগুলো সে রাত ১০টা পর্যন্ত মাত্র ১১ জন নিহত হবার কথা প্রকাশ করেছে।

এতে সাধারণ জনগণ আরো বেশী কৌতুহলী ও হতাশ হয়ে উঠে।  জায়গায় তারা রাস্তা অবরোধ করে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। সারা দেশে আন্দোলনের গতি ছড়িয়ে পড়লে ঢাকার সাথে দেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং পুলিশের সাথে র‌্যাব, বিজিবি-কে মাঠে নামানো হয়। গত ১৮ জুলাই এসকল বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারায় অজানা সংখ্যক মানুষ।

কেন এমন হলো? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের হলগুলো ভ্যাকেট করে দেয়ায় তারা বাধ্য হয়ে অন্যত্র চলে যায়। তারা নিকটস্থ বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হল বা মেসে অবস্থান নেয়। সেখানে তাদের বন্ধু, আত্মীয় বা পরিচিতজনদের আশ্রয়ে থেকে আন্দোলনকে আরো বেশী শাণিত করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো হঠাৎ ভ্যাকেট  ‘শাঁখের করাত’হিসেবে মনে করা হচ্ছে। রাজধানীর উত্তরা, শনির আখড়া, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, সাভার ইত্যাদিতে তারা ছড়িয়ে থেকে ১৮ জুলাই আরো সক্রিয় হয়ে উঠে। পুলিশও সেখানে মারমুখি হয়ে উঠে গুলি, গ্যাস ছোঁড়ায় যুদ্ধ বেঁধে যায়। পুলিশের সাঁজোয়া যান ছাত্রদের মিছিলে উঠে যায়। সেদিন রয়টার, সিএনএন, এনএইচকে, এপি, সিনহুয়া, নিউইয়র্ক টাইমস্ ইত্যাদি থেকে প্রচারিত সংবাদে ৮৩ জনের মৃত্যুসংবাদ প্রচারিত হলেও দেশের গণমাধ্যমগুলো কারো ভয়ে মাত্র কয়েকজনের মৃত্যুর কথা বলেছে! হাসপাতাল সূত্রে মৃত্যুসংখ্যা শত শত। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো এ বিষয়ে তেমন কোন সংখ্যা প্রচার করেনি। এটাই কি তাদের বৃহত্তর গণতন্ত্রের নমুনা?

কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকে সাঁজোয়া যান দিয়ে আঘাত করার এই নিষ্ঠুর কান্ড ঘটানো দেখে পুরো পৃথিবী নির্বাক, স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে। তার পরেও দেশের কর্ণধাররা এতদিন নির্বিকার হয়ে আরো বেশী হার্ডলাইনে যাবার ঘোষণা দিয়ে জাতিকে মর্মাহত করেছে।

সাধারণত: সামরিক সরকারকে জনগণের পালস্ বুঝতে দয়ে না তার আশেপাশের চাটুকাররা। কিন্তু এমন বিষাদময় পরিস্থিতিতেও একটি গণতান্ত্রিক সরকারের দাবীদারকে সেই পরিস্থিতিতে পড়তে হবে কেন? যারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ সংগ্রহ করে সুবিধা নিয়ে আসছেন এক্ষেত্রে তাদের চাটুকারিতা ও দাপট বেশী। তারা প্রধানমন্ত্রীকে বাইরের আন্দোলনের আবহাওয়া বুঝতে না দিয়ে ঘেরাটোপের মধ্যে রেখে দেন। এভাবে একটি জনগণের পালস্ বুঝেও সেটা বুঝেও না বোঝার চেষ্টা করা বা শক্তি দেখানো বিপজ্জনক-সেটা সম্প্রতি অতি নেতিবাচকভাবে দৃশ্যমান হয়েছে।

অন্যদিকে এই আধুনিক যুগে আন্দোলন দমনের নামে সারাদেশে ইন্টারনেট ও ফোরজি মোবাইল সেবা বন্ধ করে দিয়ে আমদানি-রপ্তানি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ফুডের ই-সেবা সবকিছু স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে। এটা ডিজিটাল স্বৈারচারের নতুন দিক। এ দিয়ে প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক মানুষের কর্মগতি রুদ্ধ করা যায় না। যারা শুধু শুধু মানুষের হতাশা বাড়ানোর জন্য এসব কুবুদ্ধি দেন তারা প্রাচীন যুগের মনমানসিকতা নিয়ে আধুনিকতার বড়াই করেন মাত্র।

কর্তৃপক্ষ বলছেন, আন্দোলনকারীরা নেটওয়ার্ক অফিসে আগুন দিয়েছে বলে নেটসেবা নেই। কিন্তু মাত্র একটি অফিসে আগুন লাগলে যদি কয়েকদিন ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায় ও তড়িৎ কোন বিকল্প ব্যবস্থায় নেট চালু করা সম্ভব না হয় তাহলে এই সেক্টর নিরাপত্তাহীনতার চাদর গায়ে এতদিন কি ঘুমিয়ে ছিল? যে কোন দুর্ঘটনায় উন্নত বিশ্বের মানুষ বিকল্প উপায়ে এসব সেবা দ্রুত পেয়ে যান।

ইন্টারনেট আজকাল একটি জরুরী সেবা, এদিয়ে মানুষ খাদ্য-পথ্য কেনে, ওষুধ কেনে, এ্যম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে যায়।। এটাকে বন্ধ করে দিয়ে মানুষের মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন করা হয়। এই জরুরী সেবা বন্ধ রেখে মানুষকে কষ্ট-হতাশায় ফেলে যারা বাহাদুরী করেছেন তাদের মুখে ডিজিটাল বাংলাদেশ মানায় না। যদি আন্দোলনকারীরা অথবা কোন শত্রুতাবশত কেউ ইন্টারনেট নষ্ট করে দিয়ে থাকে তাহলে বিকল্প বা প্যারালাল চ্যানেলে দ্রুত রিকভার করার ব্যবস্থা না থাকাটা বোকামি। যে কোন কারনেই হোক দীর্ঘদিন ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় দেশের সবার জন্য বিপর্যয় ডেকে এনেছে।

অন্যায়ভাবে কোন ভাল ইনোসেন্ট মানুষকে গালি দেয়া, খারাপ কিছুর তকমা দেয়া একধরণের বুলিং, ইভটিজিং। এগুলোও বিভিন্ন দেশে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। আমাদের সমাজে খোটা দেয়া, গাজ্বলা তকমা ছুঁড়ে দিয়ে মানুষের মনে কষ্ট, ক্ষোভ, অভিমান, পারস্পরিক বৈরীতা সৃষ্টি করা একটি অন্যায় কালচার ও সামাজিক অপরাধ। এর জন্য সৃষ্ট ক্ষোভ ও অভিমান সংগে সংগে নিরসনের জন্য ব্যবস্থা নিতে বড্ড দেরী করায় বাংলাদেশে ‘কারফিউ’জারি রাখতে হচ্ছে। তবে এখনও যে ক্ষতির ঢেউ বয়ে যাচ্ছে তার দায় কেউ নিতে এলেও সেই ক্ষত দ্রুত সেরে উঠবে কি? সেই ক্ষতি কি খুব সহজে পোষানো সম্ভব হবে ?

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

;