জনজিজ্ঞাসার জবাব কি রাজনীতিবিদরা দেবেন?

  • আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

গেল কয়েক দিন অন্ধকারে ডুবে থাকা সময়ে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ, যাঁরা রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন, তাদের বহু জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হয়েছি আমরা। অবস্থার পাকে পড়ে কম্পিত ও দ্বিধান্বিত এসব মানুষেরা দেশের রাজনীতিবিদদের কাছে অসংখ্য জিজ্ঞাসা ছুঁড়ে দিয়েছেন। সাতেপাঁচে না যাওয়া মানুষেরা অনেক কিছু না বুঝেও যা বুঝেছেন তার মর্মার্থ হচ্ছে, ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা আকড়ে থাকতে চান আর বিরোধীরা চান ক্ষমতার গদিতে আসীন হতে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের পথ ধরে ধ্বংসলীলার শুরুর পর সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ও বক্তব্য বিশ্লেষণ করে যা বলা যায় তা হচ্ছে, ধ্বংসযজ্ঞের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করাই সবচেয়ে জরুরি ছিল এবং সরকার তা-ই করেছে। কয়েক দিন ধরে চলা নজিরবিহীন এই ধ্বংসলীলার ঘটনাবলী ও সংবাদমাধ্যমের কাছে থাকা ছবি-ভিডিও বিশ্লেষণ করলে যা দেখা যাচ্ছে তাতে কয়েকটি বিষয় চিহ্নিত করা কঠিন হবে না।

বিজ্ঞাপন

সরকারের নীতিনির্ধারক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা বার বারই দাবি করেছেন, জামায়াত-শিবির এবং বিএনপি ও দলটির সহযোগি সংগঠনের প্রশিক্ষিত সন্ত্রাসীরাই এই ধ্বংসলীলা চালিয়েছে। তারা এও দাবি করেছেন যে, ‘বিদেশে পালিয়ে’ থাকা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানই এই অরাজকতা সৃষ্টির মাস্টারমাইন্ড। এই অপচেষ্টার পেছনে সরকারকে হটানোই ছিল মূল লক্ষ্য। সংহিসতা শুরুর পূর্ব পর্যন্ত সকলেই পথে পথে ছাত্র-জনতার উপস্থিতিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনই মনে করেছিল। শুরুর দিকের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনটি কিভাবে নজিরবিহীন তাণ্ডবলীলার হাতিয়ার হলো তা সাধারণের বোধগম্য নয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ব্যানার ‘ছিনতাই’ হওয়া এবং তাতে বহু আমজনতার না বুঝেই জড়িয়ে পড়ার দাবিও কেউ কেউ করছেন। পথে বের হওয়া বিপুল সংখ্যক মানুষের সকলেই ধ্বংসলীলা চালায়নি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি ও ভিডিওগুলো বিশ্লেষণ করলেও তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

এখানে প্রশ্ন হচ্ছে ‘কিছু সংখ্যক’ সন্ত্রাসী কয়েক দিন ধরে তাণ্ডবলীলা চালাল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দমনের চেষ্টা করে হতাহত হল’; তারপরও ধ্বংসের স্রোত থামাতে টানা কয়েক দিন লাগলো! এই সময়ে দেশের বাদবাকী মানুষদের ভূমিকা তাহলে কেমন ছিল? সমাজ ও রাজনীতি বিশ্লেষকদের ধারণা, হয়ত সাধারণের একটি অংশের সহানুভূতি বা মৌন সমর্থন ছিল এই ‘কিছু সংখ্যক’দের প্রতি। আর সাধারণ মানুষের আরও একটি অংশ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিল, তাদের সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে কোন একটি পক্ষকে সমর্থন, বর্জন কিংবা প্রতিরোধের অবস্থা ছিল না; কারণ প্রকৃত সত্য তারা জানতেনই না।

বিজ্ঞাপন

যদি দৃষ্টি ফেরাই রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের দিকে, সেখানেও দেখব দ্বিধাবিভক্তির এক চরম অবস্থা। টানা দেড় দশক শাসন ক্ষমতায় থাকা বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ ঐতিহাসিকভাবে দেশের স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান করেছে। বর্তমানে সক্রিয় রাজনীতিতে থাকা প্রায় সব দলই স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত। সাংবিধানিক ভাবে গণতান্ত্রিক কাঠামো স্বীকৃত হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর অন্ধরে কিংবা বাহিরে কোথাও গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই-এই অভিযোগ সর্বত্রই উচ্চারিত হয়।

ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দর্শনকে অবলম্বন করে তাদের রাজনীতি ও শাসন ক্ষমতা পরিচালনা করেন বলে দাবি করে থাকেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরুর দিকে ক্ষমতাসীন দল ও তাদের ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে বিরোধে জড়ায় মূলতঃ সরকারি চাকুরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে। অবস্থাদৃষ্টে এটি প্রতীয়মান হয় যে, মহান মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে বর্তমান সমাজের দ্বিধাবিভক্তি আরও প্রশস্ত হয়েছে। নিঃসন্দেহে একটি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও তার সুমহান চেতনার প্রতি সমান্যতম অবজ্ঞা বা শ্লেষোক্তি অমার্জনীয় অপরাধ। কিন্তু দেশের প্রজন্ম যদি সত্যিকারের ইতিহাস জানার সুযোগই না পায় তাহলে নতুন প্রজন্মকে আপনি কিভাবে দায়ী করবেন? রাজনীতির অন্ধরে মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে সর্বজনীনন অভিন্ন অবস্থান কেন স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দি পেরিয়েও আমরা অর্জন করতে পারলাম না, সেই জনজিজ্ঞাসার জবাব রাজনীতিবিদদেরই দিতে হবে।

কেবল আওয়ামীলীগই নয়, অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রায় সকলেই মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ উঠতেই মুখে ফেনা উঠিয়ে ফেলেন কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ প্রতিপালনে তাদের সামান্য মনযোগ দেখা যায় না। একথাগুলো এজন্য বলা জরুরি যে, বিগত জাতীয় নির্বাচনের সময়কার স্মৃতি উলটে যদি আমরা দেখি তবে শুধুমাত্র মনোনয়ন পাওয়ার জন্য বিভিন্ন দলের কি পরিমাণ তথাকথিত নেতা রাজধানীতে ভিড় করেছিলেন তা আমরা সহজেই মনে করতে পারব। তখন গণমাধ্যমের কাছে তারা প্রত্যেকেই দেশ ও জনগণের সেবায় নিজেদের পুরোপুরি উৎসর্গ করার পণ করে ফেলেছিলেন। জিজ্ঞাসা এখানেই, রাজধানীসহ সারাদেশে যে নজিরবিহীন তাণ্ডবলীলা চললো, জনগণের-রাষ্ট্রের বিপুল সম্পদ পুড়ে ছাই হলো, লুট করা হলো-তারা তখন কোথায় ছিলেন?

এই নজিরবিহীন সময়ে প্রায় প্রতিদিনই দুই প্রধান দল আওয়ামীলীগ ও বিএনপির শীর্ষনেতারা সংবাদ সম্মেলনে এসেছেন। এতে নেতাদের উপচেপড়া ভিড়। দলের সাধারণ সম্পাদক বা মহাসচিব বক্তব্য দিচ্ছেন আর সবাই মাথা নেড়ে, কেউবা উচ্চস্বরে ‘ঠিক..ঠিক’ বলে রব করেছেন। খুব স্বাভাবিক জ্ঞানে রাজনীতির ওই মুখগুলোকে কপট ছাড়া কিছুই মনে হয় না। কেননা দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে তাদের স্ব-স্ব এলাকায় দিয়ে নিজদের সমর্থক, অনুগত এবং সাধারণ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তাণ্ডবলীলা প্রতিরোধ করতে যাওয়ার কথা। দলবেঁধে সংবাদ সম্মেলনে নিজের চেহারা দেখানোর প্রতিযোগিতায় থাকার কথা নয়। ঔপনিবেশিক কিংবা সামন্তবাদী সময়কাল পেরিয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতির উন্মেষের পরবর্তী সময়ে আমরা এদেশেই রাজনীতিবিদদের নিষ্ঠা দেখেছি। কিভাবে নিজের সবকিছু নিঃশেষ করে জনগণের পাশে দাঁড়াতেন তাঁরা! 

বর্তমানে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্যসহ দেশের ৩৫০জন সংসদ সদস্য আছেন। আছেন সিটি মেয়র, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানসহ বিপুল সংখ্যক জনপ্রতিনিধি। জনগণের প্রতি সত্যিকারের দায়বদ্ধতা থাকলে এই জনপ্রতিনিধিরা রাষ্ট্র ও জনগণের জানমাল রক্ষায় সচেষ্ট থাকতেন। জনগণ সম্পৃক্ত জনপ্রতিনিধিরা উসকানি না দিয়ে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি মাঠে থাকলে আমরা হয়ত এই ধ্বংসলীলা নাও দেখতে পারতাম। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, বাস্তবে এর কিছুই আমরা দেখিনি। তার অর্থ কি জনগণের হিত সাধনের জন্য আমাদের রাজনীতিবিদদের ‘রাজনীতি’ নিবেদিত নয়? কিন্তু আমরা তো দেখি, একই দলের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমাতে মাঠে ময়দানে তাদের প্রাণপণ চেষ্টা! এই নিষ্ঠার সামান্যও যদি তারা জনগণের কল্যাণ ও সমাজের শান্তি বিধানে প্রয়োগ করতেন, তবে দেশে এমন ক্রান্তিকাল উপস্থিত হতো না।

আমরা যদি সাম্প্রতিক বছরের সংবাদপত্রে প্রকাশিত আঞ্চলিক রাজনীতির খবরাখবরের দিকে দৃষ্টি দিই তবে দেখতে পাবো-ক্ষমতাসীন দলের অন্দরেই কি পরিমাণ বিবাদ! তৃণমূলের একনিষ্ঠ কর্মীদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা দলটির নেতারা স্ব-স্ব অবস্থানে নিজেদের এতটাই ক্ষমতাবান ভাবতে শুরু করেন যে কর্মীদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ সামান্যই। এর ফলে সংকটকালে জনগণের পাশে থাকার যে কর্তব্য ছিল আওয়ামীলীগের তৃণমূলের, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হাইকমাণ্ড নির্দেশ সত্ত্বেও তা উপেক্ষিত হচ্ছে বলেই সংবাদপত্রের খবরে প্রকাশ। ফলে বিরোধী দলে থাকাকালীন সময়ে আওয়ামীলীগ যতটা সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় ছিল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকেও তাদের সাংগঠনিক অবস্থাকে ভঙ্গুর না বললেও খুব সুসংগঠিত বলা যায় না। এই প্রসঙ্গটি এজন্য উল্লেখ করা প্রয়োজন, কারণ দেশবিরোধী স্বার্থান্বেষী চক্রের উত্থানে ক্ষমতাসীন দলের সাংগঠনিক দুর্বলতাও ভূমিকা রাখে। 

রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ দেশের কিছু কিছু স্থানে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের প্রতিরোধের মুখে পড়তে দেখেছি নাশকতাকারীদের। প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামীলীগ বাদে দেশের নিবন্ধিত বাকী ৪৩টি রাজনৈতিক দল তাহলে কি করেছিল এ কয়দিন? পরস্পরকে দোষারোপ করে সংবাদ সম্মেলন কিংবা গণমাধ্যমে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েই তারা দায় সেরেছেন। কেউ কেউ হয়ত তাও করেনি, নীরব দর্শকের ভূমিকায় থেকেছে। এই ‘রাজনীতিবিদদের’ জনবিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও প্রতি জাতীয় নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট চাইতে তারা কোন মুখে আসেন?

সমাজ, রাজনীতি ও সরকার বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের অবশ্য এ নিয়ে মত হচ্ছে, জনগণের অসচেতনতা ও হুজুগে প্রবৃত্তি কপট রাজনীতির পথকে অনেকটা প্রশস্ত করে তুলেছে। শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে অপ্রতুল বিনিয়োগে মননশীলতা ও মূল্যবোধ বিকাশের পথ আজ সংকুচিত। এই অনুদারতায় মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং নৈতিক শিক্ষা অর্জন মুখ থুবড়ে পড়েছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নে এগিয়ে গেলেও সমাজে মানুষের মূল্যবোধ যে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে তা ভেবে দেখার কথা হয়ত রাজনীতিবিদরা ভুলেই গেছেন! নইলে প্রায় ৭ লক্ষ কোটি টাকা জাতীয় বাজেটে সংস্কৃতির জন্য বরাদ্দ কিভাবে ৭৭৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা হয়?

এই অনুদারতায় দেশের প্রান্তিক জনপদে কুসংস্কার আরও কূপমণ্ডুকতার বিস্তার ভয়াবহভাবে ঘটেছে। সাধারণ মানুষের মাঝে বোধগম্যতার এই যে সংকট তা লাঘবের চেষ্টা নেই বলেই হয়ত মহান মুক্তিযুদ্ধ, জাতির জনক ও মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লক্ষ শহিদের আত্মগৌরবের ইতিহাস নিয়ে কটাক্ষের সুযোগ মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশেই সৃষ্টি হয়। এর জন্য জনসেবা ভুলে গিয়ে আদর্শচ্যুত রাজনীতিবিদদের সম্পদ অর্জনে বল্গাহীন দুর্নীতিই অনেকাংশে দায়ী বলে মনে কনে বিশ্লেষকরা। সচেতন জনগণের অগণিত প্রশ্নবাণে জর্জরিত এই সময়ের রাজনীতিবিদরা কি এ দায়মোচনে আদৌ কোন চেষ্টা করবেন?