পাঠ্যপুস্তকে ভুল ও বিতর্ক থেকে প্রত্যাহার
স্কুলের পাঠ্যবইয়ে বিজ্ঞানী চার্লস রবার্ট ডারউইনের বিবর্তনবাদ নিয়ে চারদিকে দারুন বিতর্ক ও নানা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। দীর্ঘ একমাস ১০ দিন ধরে স্কুলের পাঠ্যবইয়ে নানা ভুল-ভ্রান্তি ও এই বিতর্কিত মতবাদ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার কমতি নেই, শেষও নেই। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্কুলের পাঠ্যবই বিতর্ক নিয়ে সরব হয়ে উঠেছে চারদিক। এরই মাঝে গত ১০ ফেব্রুয়ারি নানা বিতর্কের মুখে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’বই দুটির পাঠদান প্রত্যাহার করা হয়েছে।
এছাড়া আরও দুটি বই সংশোধন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে- ঐ দুই শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুশীলনী পাঠ’ও ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান ‘অনুসন্ধানী পাঠ।’এ দুটি বইয়ের কিছু অধ্যায় সংশোধন করা হবে।
বলা হয়েছে এর অনেক কারণ। তন্মধ্যে দুটি বড় কারণ হলো- প্রথমত: এই বইগুলোতে অনেক বানান, শব্দ ও বাক্যগত ভুল রয়েছে। দ্বিতীয়ত: বিবর্তনবাদ ও মানুষের উৎপত্তি নিয়ে যেসকল কথা রয়েছে তাতে অনেকগুলো ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে এই মতবাদের ব্যাখ্যা সাংঘর্ষিক। যথার্থ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণ ছাড়া শুধু প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে গৃহীত এমন একটি বিতর্কিত মতবাদ দেশের কোমলমতি বাচ্চাদের সার্বিক চিন্তাচেতনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ জ্ঞান বিকাশে উপযুক্ত কি-না তা গভীরভাবে যাচাই না করে তাদের পাঠ্যবইয়ে অর্ন্তভূক্তিকরণ, ইত্যাদি।
অনেক পরিশ্রমের পরও কোন বই বা যে কোন লেখার মধ্যে ভুল থেকে যেতে পারে। সে জন্য লেখক-প্রকাশক-কে শুরুতেই ‘মুদ্রণ প্রমাদ বা ভুলত্রুটি হলে পাঠক ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন বলে আশা করি’-ইত্যাদি লিখে আগেভাগেই ক্ষমা চেয়ে নেয়ার রীতি বেশ প্রচলিত রয়েছে। পরবর্তী সংস্করণে মূল্যবান মতামতগুলো সংশোধিত আকারে প্রকাশ করার কথা ও বেশ প্রচলিত। এ নিয়ে লেখক, প্রকাশক বা পাঠকের কোন বড় দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কথা তেমন শোনা যায় না।
কিন্তু এ বছরের স্কুলের পাঠ্যবই নিয়ে বিতর্কের শুরুটা ভিন্নরকম। এর আলোচনা, সমালোচনার রূপ, কৌশল ও গভীরতা ভিন্ন জায়গায়। মুদ্রণ বা বানান বিভ্রান্তি থেকে সেটা অনেক অনেক গভীরে ঢুকে মানুষের মনন ও ধর্মীয় বিশ্বাসের অঙ্গনে বিস্তার লাভ করেছে। শিগগিরই সেটা রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যপকতা লাভ করা সম্ভাবনা রয়েছে। সুতরাং এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে বিতর্কিত বই তুলে নেয়া বা বাতিল করা অথবা যথযথভাবে সংশোধন করে পুনরায় সরবরাহ করার বিকল্প নেই। সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে হয়তো এনসিটিবি বই দুটির পাঠদান প্রত্যাহার করেছেন।
বর্তমানে পাঠ্যবইয়ে এসব দিক নিয়ে চারদিকে এত বিতর্ক চলছে যেটার গভীরে গিয়ে খেই ধরে পর্যালোচনা করা খুব কঠিন। কারণ, ধর্ম ও বিজ্ঞান দুটোই আমার উপরেও প্রভাব বিস্তার করে আছে। তদুপরি সামগ্রিক দিক বিবেচনা করে কিছুটা আলোকপাত করার সাহস করছি।
যুগে যুগে কৌতুহলী জ্ঞানী মানুষেরা তাদের কৌতুহলকে নানামাধ্যমে প্রকাশ করে গেছেন। এসব জ্ঞানী মানুষেরা কেউ প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসকে আঘাত দিয়েছিলেন কেউ কোনরূপ আঘাত না দিয়ে সত্যটাকে তুলে ধরেছিলেন নিজেদের মহৎ গুণের মাধ্যমে। এজন্য কেউ পুরস্কার পেয়েছেন কেউবা নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। কেউ রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পেয়েছেন আবার কেউ সেটা না পেয়ে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। ভাল হোক বা মন্দ হোক মনিষীদের দেয়া সব ধরনের মতবাদ ও তত্ত্ব যুগ যুগ ধরে আলোচিত-সমালোচিত হয়ে আসছে। সেগুলোর উপর মানুষের মধ্যে দৃষ্ঠিভঙ্গিগত পার্থক্য থাকলেও তার উপর ভিত্তি করে অদ্যাবধি নতুন নতুন গবেষণার হাইপোথিসিস গ্রহণের ক্ষেত্রে সুবিধা নেয়া হচ্ছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও ধর্ম দুটি আলাদা বিষয় হিসেবে পড়ানো হয়। এজন্য সেভাবেই দুটিকে ভিন্ন ভিন্ন সিলেবাস রয়েছে। তবে অসংখ্য সুপ্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী রয়েছেন যাদের মধ্যে গভীর ধর্মবিশ্বাস রয়েছে। কারণ তারা মনে করেন ধর্ম সম্পর্কিত পড়াশুনা করা ও ধর্ম সম্পর্কিত জ্ঞানার্জন করাও একটি বড় ধরণের বৈজ্ঞানিক বিষয়। অগাধ ধর্মীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অনেক বড় বড় বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণের হাইপোথিসিস হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে নতুন জ্ঞানের উন্মোচনে সহায়তা করেছে। তারা প্রচলিত জ্ঞানের সকল শাখায় বিচরণ করাকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করেন। তাই সেখানে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে সংঘাত তৈরি হয়নি।
বিজ্ঞান অজানাকে জানার জন্য অনুসন্ধান করে একসময় প্রমাণসাপেক্ষে নতুন জ্ঞান তৈরি করে। প্রাণসৃষ্টি হওয়াটা প্রাকৃতিক ব্যাপার হলেও সেখানে একজন সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ত্ব রয়েছে। একজন সৃষ্টিকর্তা একসাথে সবপ্রাণ সৃষ্টি করেছেন-এই জ্ঞান মহামানবগণ ওহির মাধ্যমে লাভ করেছেন। সেটা ঐশীগ্রন্থের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ শিক্ষালাভ করেছে। এই প্রাণের আলাদা সত্ত্বা ও অবয়ব রয়েছে। প্রাণের এই স্বকীয়তার কোন ব্যত্যয় হওয়া সম্ভব নয়। সেজন্য কেউ নিকৃষ্ট প্রাণি আবার কেবা শ্রেষ্ঠ প্রাণি অভিহিত।
পরিবেশের কারণে রোগে-শোকে বা দুর্ঘটনায় পড়ে একটি বানরের লেজ ক্ষয়ে যেতে পারে বা মানুষের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে সে মানুষের মতো নাচতে পারে, খেলা দেখাতে পারে। সেজন্য সেই বানর কখনও মানুষের মতো রকেট বা উড়োজাহাজ বানাতে পারে না, হয়তো কোনদিনও পারবে না। সেজন্য মানুষই সেরা জীব, সৃষ্টির সেরা ‘আশরাফুল মাখলুকাত’। সেটাও ঐশীগ্রন্থে থেকে মানুষ শিক্ষালাভ করেছে।
কিন্তু কিছু মানুষ অহংকার ও আত্মম্ভরিতার প্রভাবে সেই শিক্ষাকে স্বীকার করতে চায় না। তাই তাদের অর্জিত জ্ঞানভান্ডার অনেকটা অসম্পূর্ণ। এরপরও তারা নিজেদের সীমাবদ্ধতাকে নিয়ে বড়াই করে ও মৃত্যুর কাছে হেরে যায়।
পৃথিবীতে মানুষে-মানুষে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, কৃষ্টিগত নানা মতপার্থক্য থেকে বিভাজনের মাধ্যমে জনবসতিতে নির্দিষ্ট সীমারেখা দেয় শুরু হয়েছে। আন্তঃরাষ্ট্রের জন্য রাষ্ট্রীয় সীমানা কাঠামোই শুধু নয়- অন্তঃরাষ্ট্রেও নানা বিভাজনের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে ভিন্ন ভিন্ন দল, উপদল ইত্যাদি। এগুলোই জ্ঞানের ভিন্নতা জানান দেয়। এজন্য তৈরি হয়েছে নান পক্ষ-বিপক্ষ। কিন্তু কোন একটি নির্দিষ্ট জাতির ছায়ায় থেকে যখন সেই জাতিকে হেয় করা হয় বা সেই জাতির নামধারী হয়েও যখন ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানো হয় তখনি সেটা হয়ে যায় ডাবল স্টান্ডার্ড । নিজেকে প্রকাশ করে এমন অস্তিত্বের কোনকিছুকে অস্বীকার করলেই তৈরী হয় নানা কোন্দল। একদল মানুষ আরেকদলকে হেয় করে, নানা অভিধায় গালাগালি করে। আমাদের দেশে স্কুলের পাঠ্যবইয়ে নিয়ে এরকম একটি অহেতুক বিতর্ক শুরু করা হয়েছে।
আমাদের সমাজে প্রায় ৯৯.৭ ভাগ মানুষই কোন না কোন ধর্মবিশ্বাসী বলে ধারণা করা হয়। বিশ্বাসীদের দেশে ধর্ম অবিশ্বাসী মানুষের কোন মতবাদ প্রবলভাবে প্রত্যাখিত হবে এটাই স্বাভাবিক। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘আমি একজন ধর্মবিশ্বাসী মানুষ। স্কুলের পাঠ্যবই থেকে এসব বিতর্কিত বিষয়াবলী মুছে ফেলার নির্দেশ দেয়া হলেও সেগুলো মুছে ফেলা হয়নি।’ ‘বানর থেকে মানুষ সৃষ্টি হয়নি একথা বইয়ের তিন জায়গায় বলা হয়েছে। ...যেসব ভুল এখন ধরা হচ্ছে সেগুলো দশ বছর আগের।’
স্কুলের পাঠ্যবইয়ে বিশ্লেষকগণ বলছেন, ‘কিছু অতি উৎসাহী মানুষ এই নির্দেশকে অবহেলা করে দেশের মানুষের বিশ্বাসকে আঘাত দেয়ার জন্য পাঠ্যবইয়ে এই ধরণের অলীক মতবাদ জুড়ে দিয়ে সমস্যা সৃষ্টি করা হয়েছে। একজন শিক্ষামন্ত্রীকে বিব্রত করা বা ভিলেন বানানোই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য।’পাঠ্যবই ছাপার সঙ্গে জড়িত একজন প্রেসমালিক বলেছেন, ‘বইয়ের পরীক্ষামূলক সংস্করণ দেখে আমরা মনে করেছিলাম বিতর্ক হবে, এনসিটিবির কর্মকর্তাদেরকে জানিয়েছিলাম... বিষয়টি তখন আমলে নিলে এত সমস্যা হতো না।’
সারা পৃথিবী যখন এগিয়ে যাচ্ছে তখন আমরা এসব পুরনো কাঁসুন্দি নিয়ে অহেতুক ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে চলেছি। বিজ্ঞানের অনেক বিষয় নিয়ে এখনও কেন অহেতুক বিতর্ক চলে? কারণ সেগুলো যুক্তিতর্কের উর্দ্ধে উঠে যথেষ্ট পরিমাণ প্রমাণের মাধ্যমে সুপ্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক জ্ঞান নয়।
কোন বিষয়ে বিতর্ক করার বেসিক জানতে আরো গভীর জ্ঞানের প্রয়োজন -যেটা অনেক বিতার্কিকের জানা নেই। সেজন্য সেসব বিতর্ক কলহের জন্ম দেয়। আর বিতর্ক যদি সঠিক পথের সন্ধান না দিয়ে ক্রমাগত কলহের জন্ম দিতে থাকে তবে সেই বিতর্ক সবার পরিহার করা উচিত। সমাজে বিভিন্ন মত-পথ, বিশ্বাস-অবিশ্বাস ইত্যাদি থাকতেই পারে। শান্তিপূর্ণভাবে তাদের ধরাবাহিকতা বজায় থাকার মধ্যে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা দৃশ্যমান হয়ে উঠে । অন্যথায় শুরু হয় কলহ-সংঘাত। তাই ভবিষ্যতে এসব জাতীয় গুরুত্ত্বপূর্ণ সর্বজনীন কাজে দায়িত্ব প্রদানের পূর্বে ভাবতে হবে বহুবার। পাশাপাশি বিতর্কিত যে কোন বিষয় যেগুলো কলহ সৃষ্টি করে ও সমাজে শান্তিপূর্ণ সহবস্থান নষ্ট করতে পারে তা সবার পরিহার করা উচিত।
লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।