বহুভাষিক শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার রূপান্তর
একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাংলাদেশে ১৯৫২ সাল থেকে এই দিনটিকে জাতীয় শহীদ দিবস বা ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। দিনটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বাংলাদেশের বীর সন্তানদের শাহাদাত বরণ করার দিন। মানবজাতির ইতিহাসে মাতৃভাষার জন্য জীবন উৎসর্গের এটাই একমাত্র দিন ।
দিবসটির এই তাৎপর্যের জন্য, ১৯৯৯ সালের নভেম্বরে, জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (UNESCO) ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং বহুভাষিকতার প্রচারের জন্য ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। বলাবাহুল্য, বিশ্বব্যাপী এই দিবসটি উদযাপনে বাংলাদেশ অনুপ্রাণিত করেছে।
২০২৩ সালের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের থিম, ‘বহুভাষিক শিক্ষা – শিক্ষাকে রূপান্তরিত করার প্রয়োজন’ (Multilingual education – a necessity to transform education)। এই থিমটি জাতিসংঘ কর্তৃক আয়োজিত ২০২২ সালের ট্রান্সফর্মিং এডুকেশন সামিটের সময় করা সুপারিশগুলোর সঙ্গে মিল রেখে নির্ধারণ করা হয়েছে, যেখানে আদিবাসীদের শিক্ষা এবং ভাষার উপরও জোর দেওয়া হয়েছিল।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ তারা যে ভাষায় কথা বলে বা বোঝে সে ভাষায় শিক্ষার সুযোগ বা প্রবেশাধিকার নেই। মাতৃভাষার ওপর ভিত্তি করে বহুভাষিক শিক্ষা অ-প্রধান ভাষা, সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ভাষা এবং আদিবাসী ভাষাতে কথা বলে এমন জনগোষ্ঠীর জন্য শেখার প্রবেশাধিকার এবং অন্তর্ভুক্তির সুবিধা দেয়। বহুভাষাবাদ অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের বিকাশে অবদান রাখে যা একাধিক সংস্কৃতি, বিশ্বদর্শন এবং জ্ঞান ব্যবস্থাকে সহাবস্থান এবং পারস্পরিক ভাব বিনিময় করার অনুমতি দেয়।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্বীকৃতি দেয় যে ভাষা এবং বহুভাষিকতা অন্তর্ভুক্তিকে এগিয়ে নিতে পারে, এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা কাউকে পিছনে না রাখার উপর ফোকাস করে। ইউনেস্কো মাতৃভাষা বা প্রথম ভাষার উপর ভিত্তি করে বহুভাষিক শিক্ষাকে উৎসাহিত করে এবং প্রচার করে। এটি এমন এক ধরনের শিক্ষা যা সেই ভাষায় শুরু হয় যেটি শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি আয়ত্ত করে এবং তারপর ধীরে ধীরে অন্যান্য ভাষার সাথে পরিচিত হয়। এই পদ্ধতির সাহায্যে যে শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষা শিক্ষার ভাষা থেকে আলাদা তা বাড়ি এবং স্কুলের মধ্যে ব্যবধান দূর করতে, একটি পরিচিত ভাষায় স্কুলের পরিবেশ আবিষ্কার করতে এবং এইভাবে আরও ভালোভাবে শিখতে সক্ষম করে।
মাতৃভাষা হল প্রথম ভাষা যা কেউ বলে। একজন ব্যক্তির মাতৃভাষা একজন ব্যক্তির পরিচয় সংজ্ঞায়িত করতে সাহায্য করে। কেউ কেউ তাদের মাতৃভাষাকে মহান সৌন্দর্যের বিষয় বলে মনে করেন। এটি বিশেষভাবে সত্য যদি তারা এমন একটি এলাকায় বাস করে যেখানে তাদের মাতৃভাষা বলা হয় না। তাদের জন্য, তাদের মাতৃভাষা তাদের জন্মভূমি এবং তাদের সংস্কৃতির সাথে সংযুক্ত থাকার একটি উপায়। দুর্ভাগ্যবশত, প্রতি দুই সপ্তাহে একটি মাতৃভাষা অদৃশ্য হয়ে যায়। যখন এটি ঘটে, তখন এটির সাথে একটি সম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অদৃশ্য হয়ে যায়।
জাতিসংঘের তথ্যমতে, বিশ্বের ৬,০০০ ভাষার মধ্যে ৪৩ শতাংশই বিপন্ন। এই বিপন্ন ভাষাগুলো ভবিষ্যতে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বিভিন্ন কারণে ভাষা বিপন্ন হয়ে পড়ে। কিছু ভাষা সহজভাবে আরও ব্যাপকভাবে কথ্য ভাষা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। অন্যান্য ভাষা নতুন প্রজন্মের শিশুরা শিখছে না। এমন কয়েক ডজন ভাষা রয়েছে যেগুলির শুধুমাত্র একজন স্থানীয় ভাষাভাষী এখনও বসবাস করে। সেই ব্যক্তি মারা গেলে তাদের ভাষাও বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বিপন্ন ভাষাগুলোর মধ্যে রয়েছে পাপুয়া নিউ গিনির উপজাতি; অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী মানুষ; আমেরিকার আদিবাসীরা; প্রান্তিক ইউরোপীয় জনগণ যেমন আইরিশ এবং বাস্ক।
উত্তর আমেরিকায় একসময় শত শত ভিন্ন ভাষা ছিল। আজ প্রায় ১৯৪টি ভাষা অবশিষ্ট রয়েছে। যেহেতু অনেক ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, ভাষাবিদরা তাদের সম্পর্কে যতটা সম্ভব শেখার চেষ্টা করছেন। ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও ভাষার জ্ঞান তার সাথে মারা যাবে না। একটি সংস্কৃতির ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য তাদের মৃত্যুর আগে ভাষা সম্পর্কে শেখা অপরিহার্য।
উল্লেখ্য, বহুভাষিক শিক্ষায় অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে কারণ এর গুরুত্ব সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান উপলব্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা এবং জনজীবনে এর উন্নয়নে আরও প্রতিশ্রুতিবদ্ধতা অনুভূত হচ্ছে এবং বিভিন্ন ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হচ্ছে।
প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য সচেতনতা তৈরি করে। এটি বহুভাষিকতা প্রচারের একটি দিন। দিবসটি পালনের জন্য বিশ্ববাসী খালি পায়ে ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে এবং গান গেয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে লাখো মানুষ শহীদ স্মৃতিসৌধে যায়।
বিশ্বের অনেক মানুষ এই দিনে তাদের মাতৃভাষা দিবস উদযাপন করে। এই দিনে অনেককে পুরষ্কার দেওয়া হয় যারা তাদের দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী কাজের মাধ্যমে নিজ নিজ ভাষা সংরক্ষণ, প্রচার এবং বহুভাষিকতার প্রচারে দক্ষতা অর্জন করেছে। ফ্রান্সের প্যারিসে ইউনেস্কোর সদর দপ্তরও প্রতি বছর একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনেক স্কুল দিনটিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের তাদের মাতৃভাষায় কিছু লিখতে, ছবি আঁকতে উত্সাহিত করেন অথবা তারা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে যা বিভিন্ন ভাষার বিভিন্ন নানা অনুষঙ্গ তুলে ধরে।
একুশ ফেব্রুয়ারি আমাদের ভাষা শহীদ দিবস একই সাথে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বিশ্বের সকল জাতিগোষ্ঠীর মানুষের মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদার স্বীকৃতির এই দিনটি বাঙালিদের জন্য বিশেষভাবে আবেগময় স্মৃতি বহন করে। কারণ, ১৯৫২ সালের এই দিনে মাতৃভাষা বাংলার অধিকারের দাবিতে আমাদের তরুণেরা ঢাকার রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। আজ আমরা গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করছি সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিউরসহ সকল ভাষা শহিদদের। যতদিন বাঙালি থাকবে, বাংলাদেশ থাকবে, বাংলাভাষা থাকবে ততদিন এই দিনটি যথাযথ মর্যাদার সাথে বিশ্বব্যাপী পালিত হবে।
ড. মতিউর রহমান: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী