বিদায়ের বাকরুদ্ধ বার্তা ও মানবিক বিপর্যয়



প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের ৩১২ ঘণ্টা পরেও জীবিত মানুষকে উদ্ধার করার আশা ত্যাগ করা হয়েছে । ভূমিকম্পের পর দশম দিনে তুরস্কের আন্তাকিয়া থেকে ইলা নামক এক নারী ও তার দুই সন্তান মেইসাম ও আলীকে এবং কাহারা মানমারাস প্রদেশে আলেয়ানা ওলমেজ নামক ১৭ বছরের এক কিশোরী ও নেহিলান কিলিক নামের ৪২ বছরের এক নারীকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। বিশ্বের ৭০টি দেশের হাজার হাজার উদ্ধারকর্মী প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে ঘটনার এগারো দিন পরও উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। বৃষ্টি, তুষারপাতের ফলে হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রাকে উপেক্ষা করে ইট-পাথরের ভগ্নাশেষ সরানোর চেষ্ট চলছে। তুষারবৃত ধ্বংসস্তুপের নিচে আটকে পরা মানুষের কান্না ক্রমান্বয়ে ক্ষীণ হয়ে আসতে আসতে আর শোনার আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। তবুও ভূমিকম্পের ১৩তম দিনেও অনেকের আত্মীয়-স্বজনেরা বোবা কান্না নিয়ে অলৌকিক কিছু শোনার আশায় ধ্বংসস্তুপের নিকটে অবস্থান করছেন।

চারদিকে সারি সারি শুয়ে আছে ভেঙে থাকা গর্বের দালান-কোঠা-সুউচ্চ ইমারত। শুধু তুরস্কে ৯৮ হাজার ভবন ধ্বংস হয়েছে। চাপা পড়েছে সহায়-সম্পদ, শখের জিনিসপত্র, শিশুদের খেলনা, পতুল, পোষা পশুপাখিটিও। এ পর্যন্ত পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তন্মধ্যে তুরস্কে ৪৪ হাজার ও সিরিয় অংশে ৬ হাজার। জাতিসংঘ আশঙ্কা করছে দ্বিগুণেরও অধিক হতে পারে ও শুধু সিরিয়াতেই গৃহহীন ৫.৩ মিলিয়ন মানুষ। কারণ, সেখানে তুরস্কের মতো উদ্ধারকাজ চালানো যাচ্ছে না। মানবিক বিপর্যয়ের কোন বাকি নেই সেখানে।

সারা পৃথিবীর বড় বড় ত্রাণসংস্থা ও ব্যক্তিগত ত্রাণ তৎপরতার বড় বড় বহর তুরস্কে এস জমা হচ্ছে কিন্তু সিরীয়ায় সেই তৎপরতা খুবই অল্প। তাদের প্রয়োজনীয় ক্রেন, অ্যাম্বুলেন্স, ওষুধের বড় অভাব দেখা দিয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সিরিয়ার ভূমিকম্প কবলিত বেঁচে যাওয়া মানুষেরা অভিযোগ করেছেন, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির রেষারেষিতে আমাদের মানবিক বিপর্যয় হবে কেন? আমাদের অপরাধ কি?

কিন্তু তাদের সেই বার্তা সময়মতো সবার কাছে পৌঁছাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। খাদ্য, গরম বস্ত্র, জরুরি ওষুধের অভাবে ঠান্ডা তাঁবু ও গাছতলায় আশ্রয় নেয়া অনেকের প্রাণবায়ু নিভে যাচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। আধুনিক সভ্য দুনিয়ার ধ্বজাধারী মানুষের নিকট এর চেয়ে অমানবিক কোন বার্তা আছে বলে মনে হয় না।

অপরদিকে তুরস্কের ক্ষমতা আছে, প্রস্তুতিও আছে তবুও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কাছে তারাও যেন বড় অসহায়। ভিন দেশের অনেকে সেখানে চাকরি অথবা পড়াশোনা করতে এসে মৃত্যুর শিকার হয়েছেন। ফামাগুস্তা তার্কিশ মারিয়া স্কুলের ভলিবল দলের ৩৯ জন একিটি ভবনের নিচতলায় চাপা পড়ে মাত্র চারজন জীবিত বের হয়ে আসতে পেরেছিলেন। বাকিদের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা জানা যায়নি। এছাড়া বিদেশি ফুটবলার একটি ক্লাবে খেলতে এসে মৃত্যুর শিকার হয়েছেন।

ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পড়া মেয়ের হাত ধরে বাকরুদ্ধ বাবা বসে বসে বিদায়ের বার্তা দিতে গিয়ে বিশ্ববাসীর নিকট যে ভয়ংকর বার্তা দিয়েছেন তাতে বেপরোয়া যুদ্ধবাজদের কি কোন শিক্ষাণীয় বিষয় আছে? নাকি ভূমিকম্পন সহনশীল ভবন তৈরি না করা দুর্নীতিবাজদেরে কোন আফসোস হচ্ছে? তুর্কি প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দিয়েছেন, দুর্গত এলাকায় অবৈধভাবে দুর্বল ইমারত তৈরিকারীদের ১১৩ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এদেরকে শাস্তির আওতায় আনা হবে। ইতিমধ্যে ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দুর্নীতির কারণে নিমর্তি নতুন এসব ভবনকে অনিরাপদ বলে চিহ্নিত করে বসবাসে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়েছিল। তুর্কি প্রেসিডেন্ট তাইয়েপ এরদোয়ানের এই কঠোর বার্তা আমাদের দেশে অবৈধ ভবন মালিকদেরকে কি কিছুটা বিচলিত করে তোলে?

জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এনালেনা বারবক ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থদের কষ্টের কথা আঁচ করে একটি সুন্দর প্রস্তাব দিয়েছেন। তা হলো- দুই দেশের ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য সাময়িকভাবে জার্মানিতে চলে যাবার ভিসা প্রদান। তিনি বলেন, এটা একটা মানবিক সাহায্য। বর্তমানে জার্মানিতে ৩০ লাখ তুর্কি ও ১০ লাখ সিরীয় বসবাস করছেন। তারা চাইলে বিনা ঝামেলায় দ্রুত তাদের পরিবারে ও নিকটজনদেরকে জার্মানিতে নিয়ে আসতে পারেন। এই দুঃসময়ে এটা একটা আমার বাণী। কিন্তু স্বজন হারানোরা অতি দ্রুত তাদের প্রিয়জনদের কবর, স্মৃতি ও ভিটেমাটি ছেড়ে জার্মানিতে চলে যেতে চাইবেন কি-না তা একটি বড় প্রশ্ন। হয়তো যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার অনেক বঞ্চিত, দুঃখী পরিবার জার্মানির এই অফার নিতে আগ্রহী হবেন।

প্রায় প্রতিবছর বিশ্বের কোথাও না কোথাও ভূমিকম্পের খবর পাওয়া যায়। বড় কোন ভূমিকম্পের সংবাদ শুনলে আমরা আতকে উঠি। ক্ষয়ক্ষতির সংবাদে কষ্ট পাই, আফসোস করি এবং নিজেদের দেশের বা বাড়ির কথা ভেবে বিচলিত হয়ে উঠি। কিছুদিন পরে সব কিছু সামলে নিয়ে বেমালুম সবকিছু ভুলে যাবার চেষ্টা করি।

কয়েক বছর পূর্বে জাপানের কোবে শহরের ভূমিকম্পে মাত্র একটি দ্বিতল রাস্তা কাত হয়ে পড়েছিল সেটির কংক্রিটের বর্জ্য কেটে সরাতে তাদের আটমাস সময় লেগেছিল। জাপানের মতো উন্নত প্রযুক্তির দেশে যদি এই ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয় তাহলে আমাদের কোন বিপর্যয়ে সেটা আরো কত বেশি ভয়াবহ হতে পারে তা অনুমান করা বেশ কঠিন।

রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছুদিন প্রচারণা চলে কিন্তু সেটার স্থায়ীত্ব যেন ক্ষণিকের। সেসব সতর্ক বার্তা ভবন মালিক, নির্মাণকারী করো কর্ণগহ্বরে দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সেজন্য সবাই রাজধানী ঢাকার মায়া ছেড়ে সামান্য বাইরের পরিবেশে বের হতে চাই না। দিনে দিনে ঢাকাকে ইট-পাথর, কংক্রিট দিয়ে ঘিঞ্জি ভাগাড়ে পরিণত করে তালা হচ্ছে। এত ভার সইবার ক্ষমতা তিলোত্তমা ঢাকার আছে কি? সাভারের রানা প্লাজা শুধু একটি বহুতল ভবন ছিল। সেই দুর্ঘটনা আমদেরকে সচেতন হবার শিক্ষা দিতে পারেনি।

তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তে ভূমিকম্পের দু-একদিন আগেও যারা অপরকে সাহায্য দিত, যাদের সুরম্য অট্টালিকা, নতুন মডেলের গাড়ি, ঠান্ডা নিবারণের জন্য অত্যাধুনিক হিটিং মেশিন ছিল তা কি জানতো যে দুদিন পরে তারা নিজেরা ত্রাণ গ্রহণের জন্য হিমশীতল লাইনে দাঁড়াতে হবে? কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ত্রাণদাতারা নিজেরাই ত্রাণ পাবার জন্য বহিঃবিশ্বের কাছে সাহায্যের হাত পেতেছে। এটাই প্রকৃতির অমোঘ শিক্ষা।

আমাদের দেশে বহুতল ভবনের হাজারো দরজায় তালা, লাখ লাখ জানালায় লৌহ-ইস্পাতের নকশাকাটা গ্রিল দিয়ে বেষ্টনি তৈরি করা থাকে। সবকিছুই চোরের ভয়ে। হঠাৎ ভবনের বাইরে বের হতে চাইলে দ্রুত বের হবার কোন উপায় নেই।

জাপানসহ অনেক উন্নত দেশে দরজা-জানালায় গ্রিল বা এত তালাচাবি নেই। জরুরি বহির্গমনের পথসহ অনেকগুলো পথ সবসময় খোলা থাকে। আমার এক আত্মীয়া অস্ট্রেলিয়ার স্কুলে পড়ার সময় টিচারের প্রশ্নানুযায়ী ক্লাসমেটদের সাথে নিজ নিজ দেশের পৈত্রিক বাড়ির ছবি এঁকেছিল। সে একটি বাড়ি এঁকে অনেকগুলো জানালা এঁকে সেখানে লোহার শিক বা গ্রিল দিয়ে নকশা করে দিয়েছিল। সে ছবি দেখে টিচার বলেছিল, জানালায় এত মোটা মোটা লৌহদণ্ড কেন? আত্মীয়া বুদ্ধিমতি। তাই সে বলেছিল আমাদের দেশে রয়েল বেঙ্গল টাইগার আছে। ওরা যে কোন সময় বাড়িতে ঢুকতে পারে। তাই লোহার গ্রিল দিয়ে প্রটেকশান দিয়েছি। সে বাচ্চা মানুষ, তাই ততটুই ভাবতে পারে। কিন্তু আসলে সেটা নয়- সারা দেশের সব জায়গায় চোরের উৎপাত ঠেকানোই আমাদের উদ্দেশ্য। সেজন্য আমরা বহুতল ভবনের দরজা জানালায় মোটা মোটা লৌহদণ্ডের ব্যবহার করে থাকি। যেগুলোতে ভারী তালা মেরে ঝুলিয়ে দিই। ভূমিকম্পের সময় তালা খুলতে দেরি হলে এসব গ্রিল -তালা মৃত্যু ডেকে আনার নামান্তর।

আমাদের দেশে ভূমিকম্প বিশারদদের ভবিষ্যৎবাণী যদি কখনও সফল হয় তাহলে মানবিক বিপর্যয় হয়েছে- একথা বলে আফসোস করার লোক খুঁজে পাওয়া হয়তো কষ্টকর হতে পারে। তুরস্কের ভূমিকম্পের রেশ না কাটতেই ১৬ ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইনে ৬.১ ও সিলেটে ৪.১ মাত্রার ভূমিকম্প নতুন সংশয়ের সৃষ্টি করেছে। ২০০৯ সালে বলা হয়েছিল ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় ৭২ হাজার ভবন ধ্বসে পড়বে। ২০২৩ সালে এসেও দুর্বল কাঠামোর হাজারো উঁচু স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে। ভূমিকম্পের ভীতি ছাড়াও মারাত্মক বায়ুদূষণের শীর্ষে টানা বারদিন ঢাকা শহর অবস্থান করছে।

তাই ঢাকায় অতিদ্রুত গভীর চিন্তাপ্রসূত জরিপ (ইনডেপ্থ সার্ভে) পরিচালনা করে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলার প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় ক্রেন ও আধুনিক যন্ত্রপাতি মজুদ রাখতে হবে। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রিকরণের মাধ্যমে ঢাকাকে কিছুটা ফাঁকা করে মানুষ কমিয়ে একদিকে সম্ভাব্য ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর চিন্তা করা যেতে পারে ও অন্যদিকে বর্তমানে এখানে সুস্থভাবে বাঁচার জন্য নির্মল বাতাসের ব্যবস্থা করতে উদ্যত হওয়া খুব জরুরি।

লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।

   

বেনজীর কি তবে ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টার অংশ?



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

দ্রুততম সময়ের মধ্যে তিনটি বড় ঘটনা এই মুহূর্তে আলোচিত। দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব) আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা, ভারতে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম হত্যাকাণ্ড এবং সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ব্যবস্থা, এবং তার দেশে থাকা-না থাকা নিয়ে ধোঁয়াশা। ঘটনাগুলো পর পর ঘটেছে, এবং একটির আলোচনা অন্যটিকে ছাপিয়ে না গিয়ে একই সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে।

সাবেক সেনাপ্রধান যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে ছিলেন না। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ঢাকা সফরের পর পরই আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দেশটি। বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র, তবে তিনি আগে থেকে দেশটির নিষেধাজ্ঞায় আওতায় ছিলেন। র‍্যাবের সাবেক যে সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যে নিষেধাজ্ঞা চলমান তার মধ্যে আছে বেনজীর আহমেদের নাম। এবার তার বিরুদ্ধে নতুন করে কোন সিদ্ধান্ত না আসলেও দুদক ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের যে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি, তার মধ্যেই পড়েছেন বেনজীর আহমেদ। অথচ দায়িত্বে থাকাকালে তিনি ছিলেন সরকারঘনিষ্ঠ এবং প্রভাবশালী।

সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার ভারতে গিয়ে নিখোঁজ হওয়ার পর জানা গিয়েছিল তিনি চিকিৎসার জন্যে গিয়েছিলেন। এরপর তার মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশের পর চিকিৎসা বিষয়ক কোন তথ্য আর আসছে না। তার দুঃখজনক মৃত্যুর পর সমবেদনা ছাপিয়ে সামনে আসছে অতীত, যা সুখের নয় তার পরিবারের জন্যে, বিব্রতকর অবস্থা ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের জন্যে। তিনি সোনা চোরাকারবারি ছিলেন, হুন্ডি ব্যবসায় জড়িত ছিলেন, দক্ষিণাঞ্চলের আগের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অন্যতম ছিলেন, ইন্টারপোলের রেড নোটিশ পাওয়া অপরাধী ছিলেন—এসব তথ্য সামনে এসেছে। তথ্যগুলো এতখানি শক্তিশালী যে, মৃত্যুতে স্বাভাবিক সমবেদনার চাইতে এটাই বেশি আলোচনার। এই আলোচনায় স্রেফ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ থাকছে এমন না; বরং সব শ্রেণিপেশার মানুষের মাঝে তার জনপ্রতিনিধি বিষয়ক পরিচিতির চাইতে এসবই মুখ্য হয়ে ওঠেছে।

হত্যাকাণ্ডের তিন সপ্তাহেও আনোয়ারুল আজীম আনারের মরদেহের সন্ধান মেলেনি। ঢাকা ও কলকাতা পুলিশ এনিয়ে তদন্ত করছে। চাঞ্চল্যকর তথ্য আসছে। পুলিশের পক্ষ থেকে দেওয়া বক্তব্যে এখন পর্যন্ত এটাকে ‘রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড’ বলে দাবি হচ্ছে না। অপরাধ সাম্রাজ্যের কর্তৃত্ব ও আর্থিক দ্বন্দ্ব এখানে প্রভাবক। চিকিৎসার নামে কাউকে কিছু না জানিয়ে বা তথ্য গোপন করে ভারতে গমন এবং সেখান থেকে কলকাতায় গিয়ে নিহত হন তিনি। মৃত্যুর পর যে অতীত সামনে আসছে, তাতে জনপ্রতিনিধি মনোনয়নের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা চলছে। বিতর্কিতদের কীভাবে মনোনয়ন দেয় রাজনৈতিক দলগুলো, এই প্রশ্ন ওঠছে প্রবলভাবে। যদিও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এই প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, জনপ্রিয়তা দেখে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল তাকে। আনোয়ারুল আজীম আনার তিনবারের এমপি, জনপ্রিয় ছিলেন তিনি; এই উত্তর কাউকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি, বিশেষত সর্বশেষ তিন নির্বাচনকে এখানে উদাহরণ হিসেবে টানা হয়েছে। কারণ এই তিন নির্বাচনে কোন জনপ্রতিনিধির জনপ্রিয়তা নির্দেশক কিনা এনিয়ে প্রশ্নও আছে ঢের!

আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ড বাদে অপর দুই ঘটনার সঙ্গে দুর্নীতি জড়িত। জেনারেল (অব) আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নিষেধাজ্ঞা দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ এবং দুর্নীতিতে সহায়তার অভিযোগে। যুক্তরাষ্ট্রের ভাষায়, তিনি তার ভাইকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহি এড়াতে সহযোগিতা করেছেন। অন্যায়ভাবে সামরিক খাতে চুক্তি বা ঠিকাদারি পাওয়া নিশ্চিত করতে তিনি তার ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। নিজের স্বার্থের জন্য সরকারি নিয়োগের বিনিময়ে ঘুষ নিয়েছেন। গত ২০ মে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের ওয়েবসাইটে নিষেধাজ্ঞার তথ্য প্রকাশের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছিলেন, এটা সেনাবাহিনীর বিষয়। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীও একই ধরনের কথা বলেছিলেন। পরে সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, দুদক চাইলেই সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করতে পারে। এই আলোচনাও চলমান রয়েছে, তবে এখন পর্যন্ত দুদকের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের তৎপরতা দৃশ্যমান হয়নি।

দুদক এবার ব্যস্ত সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদকে নিয়ে। গত ১৮ এপ্রিল বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। অভিযোগ অনুসন্ধানে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে তার ব্যাংকের লেনদেনের তথ্য চেয়ে পরের সপ্তাহেই চিঠি দেওয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ), স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের তথ্য চেয়ে চিঠি দেওয়া হয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব), সিটি করপোরেশন, ভূমি অফিস, রেজিস্ট্রি অফিস, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ বিভিন্ন দফতরে। সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর তথ্য পাওয়ার পর দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-সন্তানদের ৬২১ বিঘা জমি, ঢাকার চারটি ফ্ল্যাট এবং ৩৩ ব্যাংক হিসাব, বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে থাকা ১৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও তিনটি বিও হিসাব (শেয়ার ব্যবসা করার বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) এবং ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ও সাভারের জমি জব্দের আদেশ আসে আদালত থেকে।

এরইমধ্যে জানা গেছে, পরিবারসহ বেনজীর আহমেদ দেশে নেই। জানা যাচ্ছে, চিকিৎসার নামে গত মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি সিঙ্গাপুর চলে গেছেন। এখন তিনি কোথায় সেটাও কেউ বলতে পারছে না।

বেনজীর আহমেদ র‍্যাব ও পুলিশপ্রধান থাকাকালে তার সম্পদ বিষয়ক তথ্য প্রকাশিত হয়নি। কেন প্রকাশিত হয়নি, এ প্রশ্নের উত্তর একটাই—ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস করেনি। তিনি ছিলেন বিপুল ক্ষমতার অধিকারী এবং সরকারঘনিষ্ঠ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পুলিশের অতি-ক্ষমতায় তার বিরুদ্ধে কাউকে কিছু বলার সুযোগ দেয়নি। তবে তিনি দায়িত্ব থাকাকালেই এই সম্পদের মালিক হয়েছেন। এবং এটা নিশ্চিতভাবেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে। একজন সরকারি কর্মকর্তার বেতন-ভাতা এতখানি নয় যে কাউকে শত কিংবা হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক করতে পারে! এখানে কাজ করেছে সরকারের ‘সুনজর’, তা না হলে কি এমনটা সম্ভব?

বেনজীর আহমেদ হুট করে এমন সম্পদের মালিক হননি। সরকার কি তবে এটা জানত না? এটা বিশ্বাস করা কঠিন। তবে কি সরকার তাকে সহায়তা করেছে? করেনি কীভাবে বলি? বক্তব্যে-বিবৃতিতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি যেখানে সেখানে কেন তবে বেনজীর ছাড় পেলেন? কারণ হয়ত একটাই—পুলিশপ্রধানকে আস্থায় রেখে পুরো বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ! রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মোকাবিলায় প্রশাসনকে ব্যবহার করতে যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে তাতে বেনজীরদের মতো লোকেরা ছাড় পেয়েছেন। আর এই ছাড়ে বৈধ-অবৈধ পথে হয়েছেন বিপুল সম্পদের মালিক, বিপুল ক্ষমতার অধিকারী।

তবু প্রশ্ন, সরকারঘনিষ্ঠ বেনজীর আহমেদ কেন তবে সেই সরকারের আমলেই আইনি ব্যবস্থার মুখে? উত্তর ওই যে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ঢাকা সফরের সময় দুদেশই দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থার বিষয়ে এক সঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। ডোনাল্ড লুর সফরের পর পরই সাবেক সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর ঢাকাকে বড় কিছু দেখাতে হচ্ছে। মানবাধিকার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে থাকা বেনজীর আহমেদ এক্ষেত্রে হয়ে গেছেন ‘সহজ সমাধান’। এখন ঢাকা ওয়াশিংটনকে বলতে পারছে, সাবেক পদ-পদবি নির্বিশেষে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতেই আছে সরকার।

সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব) আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের হত্যাকাণ্ড-পরবর্তী কালো অতীত সামনে আসা এবং আগে থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে থাকা বেনজীর আহমেদের বিপুল সম্পদের তথ্য প্রকাশের পর সরকার পড়েছে ভাবমূর্তি সংকটে। এই সংকট থেকে উত্তরণে দরকার ছিল বড় কিছুর। বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুদকের ব্যবস্থা, এবং এতে সরকারের সায় দেওয়া সে ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টার অংশ।

আগেও আমরা দেখেছি এমন কিছুর। ক্যাসিনোকাণ্ডের পর যুবলীগের চেয়ারম্যানসহ আরও অনেকের ওপর থেকে ‘ছায়া’ সরে গিয়েছিল। এবার সম্ভবত সরেছে আজিজ-বেনজীরের ওপর থেকে। ওমর ফারুকসহ আরও অনেককে দিয়ে আমরা বুঝেছি—ছায়া সরলে থাকে কেবলই কায়া। বেনজীরদের ক্ষেত্রেও হয়ত সেই অদৃশ্য ছায়া সরেছে! আমরা কায়া দেখছি, কিন্তু কার ছায়া সেটা ঠিক দেখতে পাচ্ছি না; এটা দেখাও যাবে না!

;

তিস্তা পুনরুজ্জীবন প্রকল্প বাস্তবায়নে দোদুল্যমানতা নয়



প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
তিস্তা পুনরুজ্জীবন প্রকল্প বাস্তবায়নে দোদুল্যমানতা নয়

তিস্তা পুনরুজ্জীবন প্রকল্প বাস্তবায়নে দোদুল্যমানতা নয়

  • Font increase
  • Font Decrease

তিস্তা সমস্যা নিয়ে বহুযুগ ধরে বার বার শুধু কথা চলে আসছে। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না বাংলাদেশের তিস্তা তীরবর্তী কয়েক কোটি মানুষের জীবনধারণের সাথে সম্পর্কিত বহুবিধ আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। প্রতি বছর খরা যায়, বর্ষা আসে। তাপে পুড়ে যায়, অকাল বন্যায় ভেসে যায় জমির ফসল। থমকে যায় সেসব সমস্যা প্রতিকারের সব প্রচেষ্টা।

গত ১৯৯৩ সাল থেকে তিস্তা নদী সম্পর্কিত সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য বাংলাদেশ আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। কিন্তু এর সমস্যাগুলোর বড় অংশ অভিন্ন, আন্তর্জাতিক ও দ্বিপাক্ষিক হওয়ায় বাংলাদেশের একার পক্ষে সমাধান করা দুরূহ ব্যাপার। তাই প্রতিবেশী ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার ভিত্তিতে চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং আন্তর্জাতিক আইন মেনে সমাধানের জন্য বার বার বৈঠক করে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। গত তিন দশকের অধিক সময় ধরে শতাধিক বৈঠকে নানাবিধ আলাপ আলোচনার মাধ্যমে অনেকগুলো চুক্তি সই করা হয়েছে। কিন্তু নানা কারণে ও অজুহাতে সেগুলো ফলপ্রসূ হয়নি।

উজান দেশের অসহযোগিতা ও একঘেয়েমি মনোভাবের কারণে তিস্তা সমস্যা দীর্ঘদিন ফাইলে আটকে রাখা হলে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর ২০১৪ সাল থেকে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন সমস্যার জট খুলতে শুরু করে এবং কিছুটা হলেও আশার আলো দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাথে মতের অমিল থাকায় সেসব প্রচেষ্টা বার বার হোঁচট খেয়ে ভেস্তে যায়।

বিশেষ করে খরার সময় তিস্তা নদীর পানি সংকট সমস্যা কেন্দ্র ও রাজ্যের পারস্পরিক দোষারোপ ও মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি মধ্যে চরম বৈপরীত্য পরিস্ফুট হয়ে উঠে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার প্রহর গুনে হতাশ হয়ে পড়ে সরকার ও তিস্তা পাড়ের ভুক্তভোগীরাসহ গোটা বাংলাদেশের মানুষ। অনির্দিষ্টকালের জন্য ভারতের নিকট থেকে আশানুরূপ সাড়া না পেয়ে বাংলাদেশ বিকল্প উপায় খুঁজতে থাকে। এর প্রেক্ষিতে তৃতীয় কোনো পক্ষকে তিস্তা পুনরুজ্জীবন প্রকল্পে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানানো হলে এগিয়ে আসে চীন। তারা চীনের দু:খ বা হোয়াংহো নদীর পুনরুজ্জীবন প্রকল্পের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তিস্তা সমস্যা সমাধানে হাত বাড়ায়।

তিস্তা পুনরুজ্জীবন প্রকল্পে বিনিয়োগের জন্য ২০১৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর চীনের ‘পাওয়ার কন্সট্রাকশন কর্পোরেশন অব চায়না’- কোম্পানির সাথে বাংলাদেশের এক সমঝোতা স্মারক সাক্ষরিত হয়ে। সেটিও দীর্ঘদিন যাবত দোদুল্যমান অবস্থায় ছিল। পাঁচ বছর পূর্বে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী চীনের প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে তাগাদা দিলে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আশাবাদ শুরু হয়। চীন ইতোমধ্যে বাংলাদেশের তিস্তা ক্যাচমেন্ট এলাকায় ১১৫ কি.মি. অংশে জরিপ সম্পন্ন করে প্রকল্পের খসড়া তৈরি করে। চীন ভারতের তিস্তা অংশে সিকিম তিস্তা খাড়ি ও শিলিগুড়ির অদূরে ‘চিকেন নেক’এলাকায় সুগভীর জরিপ চালাতে আগ্রহ প্রকাশ করলে সেটা নিয়ে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার অভাবের কারণে অনাগ্রহ লক্ষণীয় হয়ে উঠে।

তিস্তা পুনরুজ্জীবন প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ ও চৈনিক ইঞ্জিনিয়ার ও বিশেষজ্ঞদের ভারতের মাটিতে অবস্থান ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারকে ভারত নিজেদের নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে মনে করে। তবুও গত ৭ জানুয়ারি ২০২৪ জাতীয় নির্বাচনের পর পরই চীন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন কাজ শুরু করতে চেয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের পর পাঁচ মাস গত হলেও প্রকল্পের কাজ এখনও শুরু করা হয়নি।

এরই মাঝে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ২০২৩ সালের ২ আগস্ট রংপুরে এক নির্বাচনী জনসভায় তিস্তা পুনরুজ্জীবন প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করার ঘোষণা দেন। সেই ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য শুরুর দিনক্ষণ শোনার জন্য এবছর মে মাসের নিদারুণ খরার দিনগুলি পর্যন্ত অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে তিস্তা পাড়ের ভুক্তভোগী অধিবাসীরা।

তিস্তা পুনরুজ্জীবন প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং চীনের পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন অব চায়না বা পাওয়ার চায়নার মধ্যে যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল সেই পরিকল্পনায় পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির আদলে তিস্তা নদীর দুই পাড়ে পরিকল্পিত স্যাটেলাইট শহর, নদী খনন ও শাসন, ভাঙন প্রতিরোধ ব্যবস্থা, আধুনিক কৃষি সেচ ব্যবস্থা, মাছ চাষ প্রকল্প ও পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

চীনা কোম্পানিটি ইতোমধ্যে তিস্তা পাড়ে নির্মিতব্য প্রকল্প বাস্তবায়নে নকশা ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ করেছে। তিস্তা নদী পাড়ের জেলাগুলো নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর ও গাইবান্ধায় চীনের তিনটি প্রতিনিধি দল কাজ করে চলছে। এরমধ্যে গত ১০ মে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তিস্তার বুকে ড্রেজিং এবং ব্যারাজ নির্মাণের প্রস্তাবিত বহুমুখী প্রকল্পটিতে অর্থ বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে নয়াদিল্লি। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে ঢাকায় এক বৈঠকে এই প্রস্তাব করেছেন।

এ প্রেক্ষিতে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্য হলো, ‘আমরা তিস্তায় একটা বৃহৎ প্রকল্প হাতে নিয়েছি। ভারত সেখানে অর্থায়ন করতে চায়। আমি বলেছি, তিস্তায় যে প্রকল্পটি হবে, সেটি আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী হবে। আমাদের প্রয়োজন যেন পূরণ হয়।’ আমাদের প্রয়োজন পূরণ করার জন্য এটা একটি বড় উদ্যোগ হতে পারে। তবে বহু দশক গড়িমসি করে হঠাৎ তিস্তা পুনরুজ্জীবন প্রকল্প নিয়ে ভারতের মনোযোগ চিন্তায় ফেলে দিয়েছে আমাদের নীতি নির্ধারকদেরকে। এর পিছনে ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন ছাড়াও আরো কোনো রহস্য লুক্কায়িত আছে কি-না তা ভেবে দেখতে বলা হয়েছে।

কলকাতার বাংলা পত্রিকা আনন্দবাজার বলেছে, ‘চিন ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্পে বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছে ঢাকাকে। জানুয়ারিতে শেখ হাসিনার নতুন সরকার শপথ নেওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকায় চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন নতুন বিদেশমন্ত্রী মাহমুদের সঙ্গে দেখা করে তিস্তা নিয়ে তাদের প্রকল্পে দ্রুত ছাড়পত্র দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত তিস্তা নদীর জলপ্রবাহ নিয়ে তৃতীয় একটি দেশের ইঞ্জিনিয়ার ও কারিগরদের কাজ করা নিয়ে বাংলাদেশের কাছে উদ্বেগ জানিয়েছিল দিল্লি।

‘মূলতঃ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তিস্তার বুকে ড্রেজিং এবং ব্যারাজ নির্মাণের প্রস্তাবিত বহুমুখী প্রকল্পটিতে অর্থ বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে তারা। অন্তত ১২ বছর ধরেই বাংলাদেশ এই প্রকল্প নিয়ে বেজিংয়ের কাছে দরবার করছিল। হাসিনার চিঠির পরে চিন বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে তিস্তার ১১৫ কিলোমিটার গতিপথে সমীক্ষা চালিয়ে একটি প্রকল্পের খসড়া তৈরি করে জমা দেয়। সেই প্রকল্পে তিস্তার বুকে ড্রেজিং করে ১০ মিটার গভীরতা বাড়ানোর পাশাপাশি দুপাশের জমি উদ্ধার করে সেখানে চার লেনের রাস্তা তৈরি এবং কয়েকটি ব্যারাজ ও সেচ-খালের মাধ্যমে জলের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু তার পরে প্রকল্পটি ছাড়পত্র পায়নি। এখন ভারত সেই প্রকল্পটি রূপায়ণের প্রস্তাব দিল।’

তবে চীনের সাথে আগে চুক্তি হওয়া এবং তার উপর ভারতের জাতীয় নির্বাচন চলাকালীন হঠাৎ ভারতের এই প্রস্তাব কিছুটা রহস্যজনক। বাংলাদেশের সকল নীতিনির্ধারক এবং জনগণ এতদিন পরে হঠাৎ ভারতের এই বিনিয়োগের আগ্রহকে কীভাবে গ্রহণ করবে তা চিন্তার বিষয়। বাংলাদেশ কতটুকু বিশ্বস্ততার সাথে ভারতের এই অর্থায়ন আগ্রহ বিবেচনা করবে তা সময় হলে বুঝা যাবে।

তিস্তা পুনরুজ্জীবন প্রকল্প নিয়ে চীনের কাজ শুরু করার সময় ঘনিয়ে আসার পর শুধু তাদের পররাষ্ট্র সচিবের প্রস্তাবে তিস্তা পানিবণ্টন নিয়ে এতদিনের ঘুমন্ত ভারতকে আস্থায় রাখা সহজ হবে না। একতরফাভাবে তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে নেয়ার অভ্যাস যে ভারতের তৈরি হয়েছে এবং তার ফলে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক নদী তিস্তার প্রবাহের আইনগত ও ন্যায্য হিস্যা প্রদানের ব্যাপারে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা খুব বেদনাদায়ক। সেখানে তৃতীয় কোনো দেশের সাথে তিস্তা পুনরুজ্জীবন প্রকল্প চুক্তি সই হওয়ার পর ভারতের অর্থায়নের আগ্রহ দেখানোর বিষয়টি চীনের আগ্রহ ও অংশগ্রহণ ঠেকানোর জন্য ভারতের নতুন দোদুল্যমানতা তৈরি হতে পারে বলে বিশ্লেষকগণ মনে করছেন।

এছাড়া তিস্তা পুনরুজ্জীবন প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশের ‘নিড’বা প্রত্যাশাগুলো কি তা এখনও ভারতকে জানানো হয়নি। ভারত ও চীনের মধ্যে আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক কর্তৃত্ব নিয়ে যে টানাপড়েন চলছে তা আরো বেশি উসকে দেবে যদি বাংলাদেশ চীনের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তি ভঙ্গ করে ভারতের দিকে হাত বাড়ায়। এছাড়া চীন বাংলাদেশের প্রতি আস্থা হারিয়ে আমাদের চলমান অন্যান্য বৃহৎ প্রকল্পে তাদের বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা হ্রাস বা বন্ধ করে দিতে পারে।

তাই ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের অর্থায়নের আগ্রহের প্রস্তাব চীনের তিস্তা পুনরুজ্জীবন প্রকল্পকে আরো দীর্ঘায়িত করার পাশাপাশি বাংলাদেশের সাথে চীনের সুসম্পর্ক নষ্ট করতে পারে। ভারতের অর্থায়ন প্রস্তাবের পর ইতোমধ্যে চীন বাড়তি ত্রিশ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের চাহিদা শুনিয়েছে। কাজ শুরু না হতেই এমন বাগড়ায় বাংলাদেশের ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’-র মতো দোটানা অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করছেন।

কিন্তু কোনোরূপ জনমত যাচাই না করে হঠাৎ আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এমন ভাবনার উদয় হলো কেন?

তিস্তা পানি সমস্যা সমাধানের জন্য ভারত বার বার প্রতিশ্রুতি দেবার পরও কাজ হয়নি। এজন্য বিকল্প উপায় খুঁজে বের করেছি আমরা। সেটাতে নিবিষ্ট থাকতে সমস্যা কোথায়? এই দোদুল্যমানতা পরিহারে গভীরভাবে চিন্তা করতেই হবে। আর এজন্য আরো গভীরভাবে ভেবে ভারতের অর্থায়নের প্রস্তাবে সাড়া দেয়া উচিত। আগাম বড় কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলা আরেকটি হঠকারিতা হতে পারে। তাই বিষয়টি অতি দ্রুত আরো গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত বলে বিশ্লেষকগণ মনে করছেন।

লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।

;

রাখাইনে বাস্তুচ্যুতদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল-মানবিক করিডোর স্থাপন দরকার



ব্রিঃ জেঃ হাসান মোঃ শামসুদ্দীন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

মিয়ামারের আভ্যন্তরীণ সংঘাত ও রাখাইনে আরাকান আর্মির (এ এ) সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘর্ষের তীব্রতা চলমান রয়েছে। সীমান্তের ওপারে রাখাইনের কয়েকটি টাউনশিপে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে এ এ ব্যাপক সংঘর্ষ চলছে। সেখানে রোহিঙ্গাদের বেশ কয়েকটি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। সংঘর্ষের তীব্রতায় টিকতে না পেরে রোহিঙ্গারা প্রাণভয়ে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে পালিয়ে আসছে। অনেকে মনে করছে যে, এ এ সেসব এলাকায় বসবাসরত রোহিঙ্গাদের গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দিয়ে তাদেরকে ঘরবাড়ি ছাড়া করে দেশত্যাগে বাধ্য করছে। অন্যদিকে দীর্ঘদিন যাবত চলমান যুদ্ধে একদিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং অন্যদিকে এ এ রোহিঙ্গাদেরকে মানব ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে সুপরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গা নিধন চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা যায়। চলমান সংঘর্ষে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে এ এ’র কাছে অনেক এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে এ এ’র সঙ্গে সংঘর্ষের সময় রোহিঙ্গাদেরকে জোরপূর্বক ধরে তাদেরকে এ এ’র সঙ্গে লড়াই করার নির্দেশ দিচ্ছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। তারা রোহিঙ্গাদেরকে তাদের এলাকায় এ এ’র আক্রমণ থেকে নিজেদেরকে রক্ষার নামে এ এ’র সঙ্গে সংঘাতে জড়াতে বাধ্য করে আন্তসাম্প্রদায়িক সহিংসতা উস্কে দিচ্ছে। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের হিসাব অনুসারে, ফেব্রুয়ারি থেকে প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও এ এ দুই পক্ষই তাদের হয়ে লড়াই করতে চাপ দিচ্ছে এবং রোহিঙ্গাদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

রাখাইনে রাজ্যে এখনো প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। বিদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা কয়েকটি সক্রিয় সংগঠন অভিযোগ করেছে যে, এ এ রাখাইনের বুথিডং শহরে রোহিঙ্গাদের উদ্বাস্তু হতে বাধ্য করছে। তাদের বাড়িঘর লুটপাট ও আগুন লাগানো হয়েছে এবং সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। অনেক রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। বুথিডং ও মংডুতে এ এ ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যকার সংঘর্ষে ১০ হাজার নাগরিক বাস্তুচ্যুত হয়েছে। তাদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। মিয়ানমারের সংঘাতময় পরিস্থিতির বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাষ্ট্র ও কয়েকটি দেশ এক যৌথ বিবৃতিতে বেসামরিক নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিবাদমান সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। এ এ জানিয়েছে যে তারা রোহিঙ্গাদেরকে নিরাপদ এলাকায় সরে যেতে সহায়তা করেছে তবে সেখানে মিয়ানমার জান্তাবাহিনী ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত করার অভিযোগ ও সহিংসতা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ জানিয়ে চলমান পরিস্থিতিতে বেসামরিক জনগণকে সুরক্ষা দেওয়া ও সেখানে মানবিক সহায়তা প্রবেশের সুযোগ দিতে মিয়ানমারের জান্তা ও এ এ’র প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার তুর্ক রাখাইন রাজ্যের বুথিডং শহর থেকে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং সেখানে অবিলম্বে সংঘাত বন্ধের জন্য মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও এ এ’কে অনুরোধ জানায়। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে বুথিডং শহরে নতুন করে সহিংসতা ও সহায় সম্পত্তি ধ্বংসের ফলে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়েছে। বেসামরিক লোকজনের সুরক্ষা, অবিলম্বে নিরবচ্ছিন্নভাবে মানবিক সহায়তার অনুমতি দেওয়া এবং আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বিধান নিঃশর্তভাবে মেনে চলার জন্য জাতিসংঘ মিয়ানমার সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছে। ফলকার তুর্ক বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশকে নিপীড়নের স্বীকার রোহিঙ্গাদের সহায়তায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।

জাতিসংঘ রাইটস অফিসের মিয়ানমার টিমের প্রধান জেমস রোডেহেভার চলমান পরিস্থিতিকে ভয়ানক বলে বর্ণনা করেছে। জাতিসংঘ সতর্ক করে বলেছে যে, রোহিঙ্গা ও রাখাইন একে অপরের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে আন্তসাম্প্রদায়িক উত্তেজনা আরও বেড়ে যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে প্রতিশোধমূলক সহিংসতার ঘটনা ঘটতে পারে বলেও আশঙ্কা জাতিসংঘের। মানবাধিকার পর্যবেক্ষকেরাও সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন অন্তত আটটি গ্রাম থেকে রোহিঙ্গাদের জোর করে একটি গ্রামে স্থানান্তরের কথা নিশ্চিত করেছে।

মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ক জাতিসংঘের স্পেশাল রেপোর্টিয়ার থমাস অ্যান্ডুস, রাখাইনের চলমান সংকটের প্রেক্ষিতে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে ‘বন্ধ সীমান্ত’ নীতি থেকে সরে আসতে বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘ, দাতা দেশ ও সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কাজ করে যাওয়া স্বত্বেও বাংলাদেশের উদারতা রোহিঙ্গাদের একমাত্র ভরসা বলে তার মত প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘের স্পেশাল রেপোর্টিয়ার বাংলাদেশের ভেতরের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর পরিস্থিতি উন্নয়নে জরুরি তহবিল নিয়ে এগিয়ে আসার জন্য বিশ্বের সব রাষ্ট্রের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছে। থমাস অ্যান্ডুস রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এ এ’র ‘জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের’ ঘটনার অবসানের আহ্বান জানিয়েছে।

জাতিসংঘের রাইটস অফিসের মুখপাত্র এলিজাবেথ থ্রোসেল জানিয়েছে যে, সংঘাত-বিধ্বস্ত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ক্রমবর্ধমান সহিংসতার মধ্যে আরাকানের বুথিডাং ও মংডু শহরের কয়েক হাজার বেসামরিক লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে। রাখাইন রাজ্য থেকে সম্প্রতি প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে প্রায় ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা নাফ নদীর তীরে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে অপেক্ষা করছে। এলিজাবেথ থ্রোসেল আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য মিয়ানমার সরকার ও এ এ’কে আহ্বান জানিয়েছেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জরুরি হস্তক্ষেপ ও সমর্থন ছাড়া এই সঙ্কট মোকাবেলা সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। ত্রান সহায়তা হ্রাসের ফলে রেশন কর্তন, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, সহিংসতা এবং রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের জীবন হুমকির মুখে ফেলেছে।

বাংলাদেশ সীমন্ত জুড়ে থাকা মিয়ানমারের সীমান্ত চৌকিগুলো বর্তমানে এ এ’র দখলে। এ এ পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মিয়ানমারের রাষ্ট্র কাঠামোর অধীনে ভবিষ্যতে আরাকান রাজ্য গড়ে তুলতে চায়। এ এ’র মূল শক্তি হলো রাখাইনবাসীদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ধর্মীয় সহনশীলতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অঙ্গীকার। সংকটময় এই পরিস্থিতিতে এ এ’র দূরদর্শিতা তাদেরকে সামনের দিনগুলোতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে ভুমিকা রাখবে।

সীমান্তের এপারে কক্সবাজার এলাকায় জাতিসংঘ ও অন্যান্য সাহায্য সংস্থাগুলো গত সাত বছর ধরে তাদের পেশাগত দক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে কাজ করছে। তারা রাখাইন পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত রয়েছে। চলমান প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ, ইউ এন এইচ সি আর, আই ও এম এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা এ এ’র সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে রাখাইনে বাস্তুচ্যুতদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল ও একটা মানবিক করিডোর স্থাপন করে নির্যাতনের শিকার পালিয়ে আসা মিয়ানমারের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে উদ্যোগ নিতে পারে। কক্সবাজারের শান্তিপূর্ণ অবস্থানে থেকে অতি সহজে এই কার্যক্রম তারা পরিচালনা করতে পারবে। এ এও এই কাজে তাদেরকে সহযোগিতা করবে কারণ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাদের গ্রহণযোগ্যতা প্রয়োজন।

জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার সঙ্গে মিলে এ এ এই সহায়তা কার্যক্রমে অংশ নিয়ে শুধুমাত্র রাখাইনের জাতিগত সশস্ত্রগুষ্টি হিসেবে তাদের পরিচয়ের বাহিরে নিজেদেরকে রাখাইনের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে প্রমান করতে পারবে। এর পাশাপাশি এ এ’র কাছে রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রকাশ পেলে তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সামনের দিনগুলোতে আন্তর্জাতিক সহায়তা পেতে কাজে লাগবে।

বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের সহায়তা প্রদানে দাতাসংস্থাগুলো চাপে রয়েছে, তাই নতুন করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মিয়ানমারের নাগরিকদের আশ্রয় নেয়ার সুযোগ নাই। বাংলাদেশ সরকার সীমান্তে সতর্কতামুলক ব্যবস্থা নিয়েছে। সীমান্ত দিয়ে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কায় বান্দরবান সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বান্দরবান ও কক্সবাজার সীমান্ত এলাকায় সীমান্ত চৌকি ও স্থাপনাগুলোতে বিজিবির সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং সীমান্ত এলাকায় টহল ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সীমান্ত এলাকায় বসানো সিসি ক্যামেরায় সার্বক্ষণিক নজর রাখা হচ্ছে এবং বিজিবির পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান মানবিক বিপর্যয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্রুততার সঙ্গে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ২০১৭ সালের নৃশংস ঘটনা তাদেরকে পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আগে সতর্ক হতে শিখিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশ নানা সীমাবদ্ধতার থাকার পর ও মানবিক দিক বিবেচনায় কতটুকু উদার ছিল তা বুঝতে পেরেছে। তারা বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ ধরনের উদারতার অনুপস্থিতি অনুভব করছে। চলমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বাস্তুচ্যুতদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল ও একটা মানবিক করিডোর স্থাপন করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। রাখাইনের চলমান মানবিক সংকট মোকাবেলায় জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো দ্রুত সিধান্ত গ্রহনের মধ্যে দিয়ে এই সংকট মোকাবেলা করতে পারবে। রাখাইনের অভ্যন্তরে কাজের এই অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আরও জোরালো ভুমিকা রাখতে সহায়ক হবে। রাখাইন রাজ্যের এ এ’র নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকায় কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহনের মাধ্যমে এই সংকটের সমাধানে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো এগিয়ে আসবে এটাই প্রত্যাশা।

ব্রিঃ জেঃ হাসান মোঃ শামসুদ্দীন, এন ডি সি, এ এফ ডব্লিউ সি, পি এস সি, এম ফিল (অবঃ)
মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক

;

বেনজীরের পেছনে আরও কত বেনজীর?



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদের আয় বহির্ভূত বিপুল সম্পদের জব্দ করা নিয়ে বেশ শোরগোল চলছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালতের আদেশে গেল বৃহস্পতিবার (২৩ মে) সাবেক এই দুর্দণ্ড-প্রতাপ পুলিশ কর্মকর্তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ দেওয়ার পর রোববার (২৬ মে) ‘খোঁজ পাওয়া’ আরও সম্পদ জব্দের আদেশ আসে। বাংলাদেশ পুলিশের একজন সাবেক মহাপরিদর্শকের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ এ ভাবে ক্রোকের এ ঘটনাকে বিরল বললেও অত্যুক্তি হবে না। বেনজীরের বিপুল সম্পদের ‘খোঁজ’ পাওয়া এবং আদালতের দুটি পৃথক আদেশে সম্পত্তি ক্রোকের খবর নিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিম-লে ইতিমধ্যেই বিস্তর আগ্রহ এবং আলোচনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য কিংবা স্যোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা-বিতর্ক যখন তুঙ্গে তখন কিছু প্রশ্নও সমান্তরালে বেশ দাঁনা বাধছে।

দেশের ২৮তম পুলিশ প্রধান ছিলেন বেনজীর আহমেদ। আইজিপি, র‌্যাব প্রধান কিংবা ডিএমপি কমমিশনারের মতো পদে থাকাকালীন সময়ে বেনজীর আহমেদের যে তৎপরতা-বক্তব্য গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে আমরা শুনে এসেছি, তাতে কেউ কখনো ভাবতেই পারেনি এই পুলিশ কর্মকতার সম্পদ নিয়ে এমন টানাহেচড়া হতে পারে। আইজিপি হিসাবে মেয়াদ শেষের দিকে এসে বেনজির আহমেদের একটি বইয়ের প্রকাশনা উৎসব হয়েছিল রাজধানীর কৃষিবিদ মিলনায়তনে। খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সভাপতিত্বে ওই পাঠ উন্মোচন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক।

সেই অনুষ্ঠানে আইজিপি’র গ্রন্থের পাঠ উন্মোচনে সরকারের দুই মন্ত্রীসহ ‘বিশিষ্ট’ অতিথি আলোচকগণ প্রশংসায় ভাসান বেনজীর আহমেদকে। যেখানে তাঁর মেধা-সততা ও পেশদারিত্ব নিয়ে ভূয়সী প্রশংসা করে বক্তারা যেসব কথা বলেন, তাতে বেনজীর বাংলাদেশ পুলিশের সবচেয়ে যোগ্য ও সক্ষম পুলিশ প্রধান। লেখকের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বেনজীর আহমেদ তার দীর্ঘ বক্তৃতায় নিজেকে সৎ ও দেশপ্রেমিক এবং সরকারের কতটা অনুগত তা বলার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এই সময়ে এসে আয় বহির্ভূত সম্পদের খোঁজ ও তা জব্দ করা নিয়ে কেবল এই জিজ্ঞাসাটিই প্রবল হচ্ছে যে, আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো কত দুর্বল! একজন ব্যক্তির উত্থানের এই দীর্ঘ পটভূমিতে এত দিন রাষ্ট্র কি তবে ঘুমিয়ে ছিল?

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক কর্মকর্তা যখন পেশাদারিত্বের জন্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে রাষ্ট্রপতি পদক, প্রধানমন্ত্রী পদক, পুলিশ পদক-শুদ্ধাচার পদকসহ অসংখ্য সম্মান ও স্বীকৃতিতে ভূষিত হন; তখন সেই কর্মকতার বিরুদ্ধে অবসরের পর এত গুরুতর অভিযোগ আমাদের কাঠামোগত দুর্বলতাকে স্পষ্ট করে তুলে। এখন পর্যন্ত বেনজীর আহমেদের জব্দকৃত যে পরিমাণ সম্পদের তথ্য গণমাধ্যমে এসেছে তাকে যদি গড় হিসেবে দেখা হয়, তবে প্রতিদিন যে আয় তিনি করেছেন বলে ধরে নেওয়া যায়, তা আলাদীনের চেরাগের চেয়েও কম আশ্চর্যের নয়।

সাম্প্রতিক বেনজীর ইস্যুতে ক্ষমতাসীন, বিরোধী দল কিংবা আইনজীবীদের তুলনামুলক যে বক্তব্য এসেছে তাতে পরস্পরবিরোধী চরিত্রটিই দৃশ্যমান হচ্ছে। এখন পর্যন্ত পুলিশের যেসব কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক অভিলাষ লক্ষ্য করা গেছে, বেনজীর আহমেদ তাদের মধ্যে অন্যতম। পুলিশ প্রধান হিসেবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে বিতর্ক উসকে দিতে দেখা যেত বেনজীরকে। যখন তিনি অবসরে গেলেন-শোনা যাচ্ছিল, অচিরেই কোন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ‘প্রাইজ পোস্টিং’ পাবেন। কিন্তু বাস্তবে তেমনটি ঘটলো না। আমরা দেখেছি, এই কর্মকর্তার অবসরের পর তাঁর নিরাপত্তার জন্য পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়।

আমরা অনেক সাবেক আইজিপিদের অবসরের পর গুরুত্বপূর্ণ পদে ফের পদায়নের দৃষ্টান্ত দেখতে পাই। অনেককে রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনার কিংবা আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়নে সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ সংসদ সদস্যও হয়েছিলেন। কিন্তু বেনজীর আহমেদের মতো এতটা দুর্দ- প্রতাপ ও রাজনৈতিক অভিলাষী কর্মকর্তা কেন সেই সুযোগ পেলেন না-তা নিয়েও নানা মত রয়েছে। বলা হচ্ছে, পুলিশ বাহিনীতেই তার সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক ছিল এমন কর্মকর্তারা চান না তিনি ফের প্রভাবশালী হয়ে উঠুন। বেনজীরে দ্বারা কোন কারণে নিগৃহীত কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কর্মরত কর্মকর্তাদের যোগাযোগও এই ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে-এমন তথ্য কেউ কেউ সামনে আনছেন।

কিন্তু যদি রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করা হয় যে, আমাদের দেশে ‘বেনজির’ এই বেনজীর আহমেদ কি একজনই? অনেকেই দাবি করেছেন-দেশে এমন বেনজীরের সংখ্যা অনেক। কেবল খবরে এলেই তাদের নিয়ে আলোচনা করা হয়। কিন্তু দেশে আর্থ-সমাজিক অসমতার নিরিখে যদি চিন্তা করা হয়; বাংলাদেশের স্বল্প সংখ্যক মানুষের হাতে সিংহভাগ সম্পদ পূঞ্জীভূত হয়ে আছে। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় নামক যে শব্দের সঙ্গে এক শুভঙ্করের ফাঁকি জড়িয়ে আছে, এটি বলা অসঙ্গত হবে না যে এমন ‘বেনজির’ আলাদীনের চেরাগ কা- এ পেছনে দায়ী। সমাজে মধ্যবিত্ত-নি¤œমধ্যবিত্ত কিংবা ছিন্নমূল মানুষের জীবনে দারিদ্র ও অসহায়ত্বের যে ছাপ পরিলক্ষিত হয় তার কার্যকারণ হিসাবেও এসব দৈত্যদের উত্থানকে দায়ী করেন সমাজবিজ্ঞানী ও বিশ্লেষকরা।

আমরা স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে বিভিন্ন সরকারের সময়েই এমন আলাদীনের চেরাগের দৌলতে ফুলে ফেঁপে উঠা সরকারি কর্মচারীদের দেখে থাকব। কিন্তু যেসব তথাকথিত ক্ষমতাধরদের ছত্রছায়ায় কিংবা আষ্কারায় এই বেনজীরদের উত্থান ঘটে, তারা কি তবে আড়ালেই থেকে যাবেন। জনগণের করের টাকায় প্রতিপালিত সরকারের কর্মচারীরা যখন জনগণকে শুষে নিয়ে সামন্তবাদী জমিদারদের মতো চরিত্রধারণ করে বিপুল ভূ-স্বামী বনে যান তখন ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’ কথাটি আর ধোঁপে টিকে না।

লোকপ্রবাদ আছে, ‘গাঁজাখোরের বিচার হবে/করবে বিচার আফিম যে খায়’। বেনজীর ইস্যুতে দৃশ্যমান সত্যটি সেই লোকপ্রবাদেরই প্রতিধ্বনি। জনগণতান্ত্রিক শাসন কাঠামোতে প্রশাসন কিংবা নীতিনির্ধারকদের জাবাবদিহিতার জায়গাটি যে গুরুত্ব বহন করে, সংশ্লিষ্টটদের সেই বিষয়ে ততোটাই অনীহা। বহু বার ডাকঢোল পিটিয়ে জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মচারীদের ‘সম্পদের হিসাব’ দেওয়া নিয়ে হইচই শুনলেও ক’দিন যেতেই তা নিশ্চুপ হয়ে যায়। দুর্নীতি ও সুশাসনের প্রশ্নে সব কিছুই যেন একটা চোর-পুলিশ খেলা চলে। দীর্ঘ সময়ে ধরে এ রীতি চলমান থাকায় এই প্রবণতা এখন গাঁ সওয়া হয়ে গেছে। এবং এভাবেই এটি একধরণের সামাজিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে জনগণের মনন ও মূল্যবোধকেও দুর্নীতি মনষ্কতায় ভরিয়ে তুলেছে। সে কারণেই হয়ত আলদীনের চেরাগে ভর করে সম্পদের কুমির বনে যাওয়া ব্যক্তিরা দায়মুক্তি পেয়ে যাচ্ছেন।

এদিকে, হঠাৎ ঘুমে ভেঙে উদয় হওয়া দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর তৎপরতা লক্ষণীয়। যদিও দুদক দীর্ঘ সময়ে ওই ব্যক্তির বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া দূরে থাক, একটি বাক্যও বলেনি। তা সত্ত্বেও আদালতের আদেশে বেনজীর আহমেদের বিপুল সম্পদ জব্দের বিষয়টি একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে রাষ্ট্রের সম্পদে পরিণতে হলে এমন অজস্র ব্যক্তির সম্পদ জব্দ করার পথ প্রশস্ত হবে। কিন্তু ‘বৈপ্লবিক’ এই প্রবণতা কতদূর পর্যন্ত টিকে থাকবে বা টিকিয়ে রাখা যাবে তা দেখার অপেক্ষায় সাধারণ মানুষ।

;