বিদায়ের বাকরুদ্ধ বার্তা ও মানবিক বিপর্যয়
তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের ৩১২ ঘণ্টা পরেও জীবিত মানুষকে উদ্ধার করার আশা ত্যাগ করা হয়েছে । ভূমিকম্পের পর দশম দিনে তুরস্কের আন্তাকিয়া থেকে ইলা নামক এক নারী ও তার দুই সন্তান মেইসাম ও আলীকে এবং কাহারা মানমারাস প্রদেশে আলেয়ানা ওলমেজ নামক ১৭ বছরের এক কিশোরী ও নেহিলান কিলিক নামের ৪২ বছরের এক নারীকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। বিশ্বের ৭০টি দেশের হাজার হাজার উদ্ধারকর্মী প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে ঘটনার এগারো দিন পরও উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। বৃষ্টি, তুষারপাতের ফলে হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রাকে উপেক্ষা করে ইট-পাথরের ভগ্নাশেষ সরানোর চেষ্ট চলছে। তুষারবৃত ধ্বংসস্তুপের নিচে আটকে পরা মানুষের কান্না ক্রমান্বয়ে ক্ষীণ হয়ে আসতে আসতে আর শোনার আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। তবুও ভূমিকম্পের ১৩তম দিনেও অনেকের আত্মীয়-স্বজনেরা বোবা কান্না নিয়ে অলৌকিক কিছু শোনার আশায় ধ্বংসস্তুপের নিকটে অবস্থান করছেন।
চারদিকে সারি সারি শুয়ে আছে ভেঙে থাকা গর্বের দালান-কোঠা-সুউচ্চ ইমারত। শুধু তুরস্কে ৯৮ হাজার ভবন ধ্বংস হয়েছে। চাপা পড়েছে সহায়-সম্পদ, শখের জিনিসপত্র, শিশুদের খেলনা, পতুল, পোষা পশুপাখিটিও। এ পর্যন্ত পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তন্মধ্যে তুরস্কে ৪৪ হাজার ও সিরিয় অংশে ৬ হাজার। জাতিসংঘ আশঙ্কা করছে দ্বিগুণেরও অধিক হতে পারে ও শুধু সিরিয়াতেই গৃহহীন ৫.৩ মিলিয়ন মানুষ। কারণ, সেখানে তুরস্কের মতো উদ্ধারকাজ চালানো যাচ্ছে না। মানবিক বিপর্যয়ের কোন বাকি নেই সেখানে।
সারা পৃথিবীর বড় বড় ত্রাণসংস্থা ও ব্যক্তিগত ত্রাণ তৎপরতার বড় বড় বহর তুরস্কে এস জমা হচ্ছে কিন্তু সিরীয়ায় সেই তৎপরতা খুবই অল্প। তাদের প্রয়োজনীয় ক্রেন, অ্যাম্বুলেন্স, ওষুধের বড় অভাব দেখা দিয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সিরিয়ার ভূমিকম্প কবলিত বেঁচে যাওয়া মানুষেরা অভিযোগ করেছেন, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির রেষারেষিতে আমাদের মানবিক বিপর্যয় হবে কেন? আমাদের অপরাধ কি?
কিন্তু তাদের সেই বার্তা সময়মতো সবার কাছে পৌঁছাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। খাদ্য, গরম বস্ত্র, জরুরি ওষুধের অভাবে ঠান্ডা তাঁবু ও গাছতলায় আশ্রয় নেয়া অনেকের প্রাণবায়ু নিভে যাচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। আধুনিক সভ্য দুনিয়ার ধ্বজাধারী মানুষের নিকট এর চেয়ে অমানবিক কোন বার্তা আছে বলে মনে হয় না।
অপরদিকে তুরস্কের ক্ষমতা আছে, প্রস্তুতিও আছে তবুও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কাছে তারাও যেন বড় অসহায়। ভিন দেশের অনেকে সেখানে চাকরি অথবা পড়াশোনা করতে এসে মৃত্যুর শিকার হয়েছেন। ফামাগুস্তা তার্কিশ মারিয়া স্কুলের ভলিবল দলের ৩৯ জন একিটি ভবনের নিচতলায় চাপা পড়ে মাত্র চারজন জীবিত বের হয়ে আসতে পেরেছিলেন। বাকিদের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা জানা যায়নি। এছাড়া বিদেশি ফুটবলার একটি ক্লাবে খেলতে এসে মৃত্যুর শিকার হয়েছেন।
ধ্বংসস্তুপের নিচে চাপা পড়া মেয়ের হাত ধরে বাকরুদ্ধ বাবা বসে বসে বিদায়ের বার্তা দিতে গিয়ে বিশ্ববাসীর নিকট যে ভয়ংকর বার্তা দিয়েছেন তাতে বেপরোয়া যুদ্ধবাজদের কি কোন শিক্ষাণীয় বিষয় আছে? নাকি ভূমিকম্পন সহনশীল ভবন তৈরি না করা দুর্নীতিবাজদেরে কোন আফসোস হচ্ছে? তুর্কি প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দিয়েছেন, দুর্গত এলাকায় অবৈধভাবে দুর্বল ইমারত তৈরিকারীদের ১১৩ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এদেরকে শাস্তির আওতায় আনা হবে। ইতিমধ্যে ১২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দুর্নীতির কারণে নিমর্তি নতুন এসব ভবনকে অনিরাপদ বলে চিহ্নিত করে বসবাসে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়েছিল। তুর্কি প্রেসিডেন্ট তাইয়েপ এরদোয়ানের এই কঠোর বার্তা আমাদের দেশে অবৈধ ভবন মালিকদেরকে কি কিছুটা বিচলিত করে তোলে?
জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এনালেনা বারবক ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থদের কষ্টের কথা আঁচ করে একটি সুন্দর প্রস্তাব দিয়েছেন। তা হলো- দুই দেশের ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য সাময়িকভাবে জার্মানিতে চলে যাবার ভিসা প্রদান। তিনি বলেন, এটা একটা মানবিক সাহায্য। বর্তমানে জার্মানিতে ৩০ লাখ তুর্কি ও ১০ লাখ সিরীয় বসবাস করছেন। তারা চাইলে বিনা ঝামেলায় দ্রুত তাদের পরিবারে ও নিকটজনদেরকে জার্মানিতে নিয়ে আসতে পারেন। এই দুঃসময়ে এটা একটা আমার বাণী। কিন্তু স্বজন হারানোরা অতি দ্রুত তাদের প্রিয়জনদের কবর, স্মৃতি ও ভিটেমাটি ছেড়ে জার্মানিতে চলে যেতে চাইবেন কি-না তা একটি বড় প্রশ্ন। হয়তো যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার অনেক বঞ্চিত, দুঃখী পরিবার জার্মানির এই অফার নিতে আগ্রহী হবেন।
প্রায় প্রতিবছর বিশ্বের কোথাও না কোথাও ভূমিকম্পের খবর পাওয়া যায়। বড় কোন ভূমিকম্পের সংবাদ শুনলে আমরা আতকে উঠি। ক্ষয়ক্ষতির সংবাদে কষ্ট পাই, আফসোস করি এবং নিজেদের দেশের বা বাড়ির কথা ভেবে বিচলিত হয়ে উঠি। কিছুদিন পরে সব কিছু সামলে নিয়ে বেমালুম সবকিছু ভুলে যাবার চেষ্টা করি।
কয়েক বছর পূর্বে জাপানের কোবে শহরের ভূমিকম্পে মাত্র একটি দ্বিতল রাস্তা কাত হয়ে পড়েছিল সেটির কংক্রিটের বর্জ্য কেটে সরাতে তাদের আটমাস সময় লেগেছিল। জাপানের মতো উন্নত প্রযুক্তির দেশে যদি এই ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয় তাহলে আমাদের কোন বিপর্যয়ে সেটা আরো কত বেশি ভয়াবহ হতে পারে তা অনুমান করা বেশ কঠিন।
রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছুদিন প্রচারণা চলে কিন্তু সেটার স্থায়ীত্ব যেন ক্ষণিকের। সেসব সতর্ক বার্তা ভবন মালিক, নির্মাণকারী করো কর্ণগহ্বরে দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সেজন্য সবাই রাজধানী ঢাকার মায়া ছেড়ে সামান্য বাইরের পরিবেশে বের হতে চাই না। দিনে দিনে ঢাকাকে ইট-পাথর, কংক্রিট দিয়ে ঘিঞ্জি ভাগাড়ে পরিণত করে তালা হচ্ছে। এত ভার সইবার ক্ষমতা তিলোত্তমা ঢাকার আছে কি? সাভারের রানা প্লাজা শুধু একটি বহুতল ভবন ছিল। সেই দুর্ঘটনা আমদেরকে সচেতন হবার শিক্ষা দিতে পারেনি।
তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তে ভূমিকম্পের দু-একদিন আগেও যারা অপরকে সাহায্য দিত, যাদের সুরম্য অট্টালিকা, নতুন মডেলের গাড়ি, ঠান্ডা নিবারণের জন্য অত্যাধুনিক হিটিং মেশিন ছিল তা কি জানতো যে দুদিন পরে তারা নিজেরা ত্রাণ গ্রহণের জন্য হিমশীতল লাইনে দাঁড়াতে হবে? কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ত্রাণদাতারা নিজেরাই ত্রাণ পাবার জন্য বহিঃবিশ্বের কাছে সাহায্যের হাত পেতেছে। এটাই প্রকৃতির অমোঘ শিক্ষা।
আমাদের দেশে বহুতল ভবনের হাজারো দরজায় তালা, লাখ লাখ জানালায় লৌহ-ইস্পাতের নকশাকাটা গ্রিল দিয়ে বেষ্টনি তৈরি করা থাকে। সবকিছুই চোরের ভয়ে। হঠাৎ ভবনের বাইরে বের হতে চাইলে দ্রুত বের হবার কোন উপায় নেই।
জাপানসহ অনেক উন্নত দেশে দরজা-জানালায় গ্রিল বা এত তালাচাবি নেই। জরুরি বহির্গমনের পথসহ অনেকগুলো পথ সবসময় খোলা থাকে। আমার এক আত্মীয়া অস্ট্রেলিয়ার স্কুলে পড়ার সময় টিচারের প্রশ্নানুযায়ী ক্লাসমেটদের সাথে নিজ নিজ দেশের পৈত্রিক বাড়ির ছবি এঁকেছিল। সে একটি বাড়ি এঁকে অনেকগুলো জানালা এঁকে সেখানে লোহার শিক বা গ্রিল দিয়ে নকশা করে দিয়েছিল। সে ছবি দেখে টিচার বলেছিল, জানালায় এত মোটা মোটা লৌহদণ্ড কেন? আত্মীয়া বুদ্ধিমতি। তাই সে বলেছিল আমাদের দেশে রয়েল বেঙ্গল টাইগার আছে। ওরা যে কোন সময় বাড়িতে ঢুকতে পারে। তাই লোহার গ্রিল দিয়ে প্রটেকশান দিয়েছি। সে বাচ্চা মানুষ, তাই ততটুই ভাবতে পারে। কিন্তু আসলে সেটা নয়- সারা দেশের সব জায়গায় চোরের উৎপাত ঠেকানোই আমাদের উদ্দেশ্য। সেজন্য আমরা বহুতল ভবনের দরজা জানালায় মোটা মোটা লৌহদণ্ডের ব্যবহার করে থাকি। যেগুলোতে ভারী তালা মেরে ঝুলিয়ে দিই। ভূমিকম্পের সময় তালা খুলতে দেরি হলে এসব গ্রিল -তালা মৃত্যু ডেকে আনার নামান্তর।
আমাদের দেশে ভূমিকম্প বিশারদদের ভবিষ্যৎবাণী যদি কখনও সফল হয় তাহলে মানবিক বিপর্যয় হয়েছে- একথা বলে আফসোস করার লোক খুঁজে পাওয়া হয়তো কষ্টকর হতে পারে। তুরস্কের ভূমিকম্পের রেশ না কাটতেই ১৬ ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইনে ৬.১ ও সিলেটে ৪.১ মাত্রার ভূমিকম্প নতুন সংশয়ের সৃষ্টি করেছে। ২০০৯ সালে বলা হয়েছিল ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় ৭২ হাজার ভবন ধ্বসে পড়বে। ২০২৩ সালে এসেও দুর্বল কাঠামোর হাজারো উঁচু স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে। ভূমিকম্পের ভীতি ছাড়াও মারাত্মক বায়ুদূষণের শীর্ষে টানা বারদিন ঢাকা শহর অবস্থান করছে।
তাই ঢাকায় অতিদ্রুত গভীর চিন্তাপ্রসূত জরিপ (ইনডেপ্থ সার্ভে) পরিচালনা করে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলার প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় ক্রেন ও আধুনিক যন্ত্রপাতি মজুদ রাখতে হবে। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রিকরণের মাধ্যমে ঢাকাকে কিছুটা ফাঁকা করে মানুষ কমিয়ে একদিকে সম্ভাব্য ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর চিন্তা করা যেতে পারে ও অন্যদিকে বর্তমানে এখানে সুস্থভাবে বাঁচার জন্য নির্মল বাতাসের ব্যবস্থা করতে উদ্যত হওয়া খুব জরুরি।
লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।