ভৈরব উপজেলার গুরুত্ব ও উন্নয়ন প্রত্যাশা



এম এ বাকী বিল্লাহ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের ৪৯৫টি উপজেলার মধ্যে ভৌগোলিক বিবেচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে ভৈরব উপজেলা, যা জেলায় রূপান্তিত করার দাবি স্থানীয় ও জাতীয় প্রয়োজনে বিবেচনাযোগ্য। রাজধানী ঢাকা হতে সড়ক ও রেলপথে সিলেট, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ এই তিন বিভাগের সাথে যোগাযোগের এক গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হচ্ছে এই ভৈরব। মধ্য-বাংলাদেশের তিনটি বিভাগ ও দেশের দুটি প্রধান নদীর সঙ্গমস্থল ভৈরব রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় পালন করতে পারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

যদিও আঠারো শতকের রেনেলের মানচিত্রে ভৈরবের কোন অস্তিত্ব ছিল না। তথাপি, প্রাপ্ত ইতিহাস থেকেোধদদ জানা যায়, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পলিবিধৌত বদ্বীপ এককালে উলুকানদি নামে পরিচিত ছিল।

মুক্তাগাছার জমিদার ভৈরব রায় তার জমিদারী সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে নতুন জেগে উঠা এই এলাকায় মানব বসতি গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে জমিদারের নামানুসারেই এই অঞ্চলের নামকরণ ভৈরব বাজার করা হয় বলে প্রচলিত রয়েছে।

মেঘনা নদীর তীরে অবস্থিত ভৈরব উপজেলার ১২১.৭৩ বর্গকিলোমিটার আয়তন জুড়ে রয়েছে সাতটি ইউনিয়ন ও একটি প্রথম শ্রেণি পর্যায়ের পৌরসভা। বন্দরনগরী ভৈরবের বেশিরভাগ মানুষ হচ্ছেন ব্যবসায়ী। দেশের কয়েকটি পাইকারি কয়লা বিক্রয়কেন্দ্রের মধ্যে ভৈরব একটি। জুতা উৎপাদনের ক্ষেত্রে পুরান ঢাকার পর-ই ভৈরবের অবস্থান। বন্দরনগরী ভৈরবের রাতের মাছের আড়ত বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ মাছের আড়ৎ হিসেবে পরিচিত।

এছাড়াও বিংশ শতাব্দীর একজন সাম্যবাদী ধারার লেখক ও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকারী বিপ্লবী রেবতী মোহন বর্মন, বাংলাদেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি আলহাজ্ব মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি কমান্ডার আব্দুর রউফ-সহ এইরকম খ্যাতনামা অনেকের জন্ম এই ভৈরব উপজেলায়।

এতদসত্ত্বেও শিল্প-সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নে ভৈরব উপজেলা যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছে। শিল্প-সংস্কৃতিতে শহরে কিছুটা উন্নতি দেখা গেলেও গ্রামাঞ্চলে তা একেবারেই নেই বলা যায়। আবার অর্থনৈতিকভাবে যতটা অগ্রগতি থাকার কথা, বাস্তবতায় তা থেকে রয়েছে অনেক পিছিয়ে এই উপজেলা। রাজনীতিতে সেই চিত্র ভিন্ন নয়। পুরো উপজেলায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক চর্চা বিদ্যমান। কাজেই ভৈরব উপজেলার সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন সুদৃঢ় জনঐক্য, সুচিন্তিত পদক্ষেপ, সমন্বিত পরিকল্পনা ও তার সঠিক বাস্তবায়ন করা।

ভৈরব মানে শুধু ভৈরব শহর বা ভৈরব পৌরসভাকে বোঝায় না। ভৈরব মানে পুরো ভৈরব উপজেলা এবং ভৈরব জনপদ মানে আশেপাশে অবস্থিত কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর ও কুলিয়ারচর, নরসিংদীর রায়পুরা ও বেলাবোর কিয়দাংশ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের একাংশ। কাজেই ভৈরবের সাত ইউনিয়নের উন্নয়ন ব্যতীত ভৈরবকে কাঙ্ক্ষিত উন্নতির সোপানে পৌছানো কখনো সম্ভব নয়। আবার ভৈরবকে কেন্দ্রে রেখে আঞ্চলিক উন্নয়ন সাধিত না হলে জাতীয় উন্নয়নে গতিবেগ আনয়ন করাও অসম্ভব। সেক্ষেত্রে পুরো ভৈরব উপজেলা বা প্রস্তাবিত জেলার অগ্রগতির লক্ষ্যে কিছু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বা সম্ভাবনা উত্থাপন করার চেষ্টা করছি, যা স্থানীয়, আঞ্চলিক ও জাতীয় উন্নয়নে নবযুগের সূচনা ঘটাবে।

প্রথমত, ভৈরব পৌরসভাকে পরিকল্পিত শহর হিসেবে গড়ে তুলতে তার রাস্তা-ঘাট পুনঃসংস্কার করে আধুনিকায়ন করতে হবে৷ দুর্জয় মোড়ের বাস টিকেট কাউন্টারগুলোকে সরিয়ে নির্দিষ্ট দূরত্বে স্থাপন করে দুর্জয় মোড়কে করতে হবে যানযট মুক্ত। একইসাথে অবাধে চলাচল ও জানমালের নিরাপত্তার তাগিদে ছিনতাই মুক্ত ভৈরব গড়তে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত জরুরি। ভৈরবের সঙ্গে আশেপাশের অঞ্চলের নিবিড় যোগাযোগের বন্ধন বিঘ্নমুক্ত করতে হবে। কারণ, মসৃণ যোগাযোগ হলো উন্নয়নের প্রধান পূর্বশর্ত।

দ্বিতীয়ত, পৌরসভার সাথে সাত ইউনিয়নের যোগাযোগের আন্তঃসড়কগুলো পুনঃসংস্কার এবং সেসাথে পৌরসভা ও ইউনিয়নের আন্তঃযোগাযোগের প্রত্যেকটি রাস্তার প্রশস্থতা বৃদ্ধি করতে হবে। এর মাধ্যমে আশেপাশে জেলাগুলোর সংলগ্ন অঞ্চলও যোগাযোগের নেটওয়ার্কের আওতায় চলে আসবে।

তৃতীয়ত, ভৈরব ফেরিঘাট হতে কোদাল কাটি, ছাতিয়ানতলা, লুন্দিয়া, খলাপাড়া হয়ে মেন্দিপুর পর্যন্ত সুপ্রশস্থ রাস্তা কাম বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা যেতে পারে৷ এতে করে মেঘনা নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে বিশাল শিল্পাঞ্চল। যার ফলে শিল্প ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে নিঃসন্দেহে। সিলেট, কুমিল্লা, ঢাকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণ সঞ্চারিত হবে এর মাধ্যমে এবং রাজধানী ঢাকার উপর সীমাহীন চাপও কমবে এর ফলে। নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুরের মতো ভৈরব বন্দরকে উন্নত করা হলে দেশের আর্থিক কাঠামো বিকেন্দ্রীকরণ হয়ে আরো গতিশীল হবে।

চতুর্থত, রাজনৈতিক উন্নয়নে গণতান্ত্রিক চর্চার সুষ্ঠু বিকাশের তাগিদে কলেজ ভিত্তিক ছাত্র সংসদ নির্বাচন চালু করা যেতে পারে। একইসাথে গণতান্ত্রিক বিকাশ ও রাজনৈতিক উন্নয়নের জন্য ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক চর্চা তথা তোষামোদি রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিহার করতে হবে। ভৈরবে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি প্রকৌশল ও চিকিৎসা শিক্ষার উচ্চতর প্রতিষ্ঠান করা হলে বৃহত্তর ঢাকা, কুমিল্লা, সিলেট, ময়মনসিংহের একটি বিরাট অঞ্চল আলোকিত হয়ে সুদক্ষ মানবসম্পদের বিকাশক্ষেত্রে পরিণত হবে।

পঞ্চমত, শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে এখনো ভৈরব তথা মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্রের উভয় তীরের গ্রামগুলোতে গ্রাম বা গোষ্ঠী ভিত্তিক সংঘর্ষ লক্ষ্য করা যায়, যা খুনাখুনি পর্যন্ত গিয়ে পৌছায়। তাই সেসকল এলাকায় শিক্ষার প্রসার, সাংস্কৃতিক মানোন্নয়ন, খেলাধুলার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নির্মাণ ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য করণীয় নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করা জরুরি।

এছাড়াও বন্ধরনগরীকে ভৈরবকে দেশের একটি অর্থনৈতিক জোন (EPZ) হিসেবে গড়ে তোলা যায়। যোগাযোগ সুব্যবস্থা ও জনমুখী এই ভৈরবে একটি সরকারি বা বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপন করা যেতে পারে। এমনকি ভৌগোলিক বিবেচনায় এইখানে একটি আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম করা যায় অনায়াসে। যাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে অসংখ্য হোটেল-মোটেল ও পর্যটন সংস্থা। ভাটীবাংলার দ্বার রূপে ভৈরব খুলে দিতে পারে আর্থিক ও পর্যটনের অবারিত সুযোগ। এতে করে,শুধু ভৈরবের নয়, চার বিভাগের সংযোগস্থলে শিল্প-সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সামাজিক গতিশীলতায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে নিঃসন্দেহে।

ভৌগোলিক অবস্থানের সুবাদে চাইলেই এই উপজেলাকে বাংলাদেশের একটি জেলা, অন্যতম একটি অর্থনৈতিক জোন ও পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। কাজেই যারা ভৈরবের অভিভাবক বা নেতৃত্বের শীর্ষে রয়েছেন, প্রয়োজন তাদের আন্তরিক সদিচ্ছা এবং ভৈরবপ্রীতি। পাশাপাশি জাতীয় নীতিনির্ধারকদেরও এক্ষেত্রে মনোযোগী হওয়া আবশ্যক। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ভৈরব হতে পারে বাংলাদেশের সিঙ্গাপুর এবং দেশের অন্যতম মডেল উপজেলা। যে মডেলের সম্ভাব্যতা নিয়ে স্থানীয় উচ্চশিক্ষিত তরুণ জনশক্তি গবেষণামূলক কাজ করছে, যা ক্রমেই ভৈরবের উন্নয়ন প্রচেষ্টা নামে জনমতের অংশে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতিবিদ এবং প্রশাসনের পক্ষে এসব উদ্যোগের প্রতি ইতিবাচক মনোযোগ দেওয়া হলে ও সমন্বয় করা হলে ভৈরব তথা বাংলাদেশের উন্নয়ন ধারায় যুগান্তকারী রূপান্তর সাধিত হবে।

এম এ বাকী বিল্লাহ, সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ, ভৈরব এবং স্নাতকোত্তর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

জেনোসাইডের স্বীকৃতি



কবির য়াহমদ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বায়ান্ন বছরেও একাত্তরের পঁচিশে মার্চের কালরাত্রির জেনোসাইডের বৈশ্বিক স্বীকৃতি মেলেনি। বৈরী ভাবাদর্শের রাজনীতি এবং জেনোসাইড নিয়ে অমনোযোগিতা আমাদের পিছিয়ে দিয়েছে। কালরাত্রির অপারেশন সার্চলাইট নামের যে জেনোসাইড চলে, তার স্বীকৃতির সুযোগ ছিল। কিন্তু সেটাও আমরা আদায় করতে পারিনি। বলা যায়, সময়মতো চেষ্টা করা হয়নি।

পঁচিশে মার্চের জেনোসাইডের স্বীকৃতি আমরা না পেলেও এখনও সুযোগ আছে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক নির্যাতনের স্বীকৃতির।

একাত্তরের আট মাস বাইশ দিনে ত্রিশ লাখ মানুষকে হত্যা থেকে শুরু করে দুই লাখের অধিক নারী-শিশুর ওপর যৌনসহিংসতা চালিয়েছিল পাকিস্তান এবং তাদের এদেশীয় দোসরেরা। নির্যাতনের ধরনগুলো জাতিসংঘ ঘোষিত জেনোসাইডের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মেলে। জাতিসংঘের ‘কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন এন্ড পানিসমেন্ট অব দ্য ক্রাইম অব জেনোসাইড’-এর আর্টিকেল ২ অংশে জেনোসাইডের পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলা আছে, যার কোনো একটি সংঘটিত হলে জেনোসাইডে বলা যাবে। ওই আর্টিকেল বলছে— কোনো গোষ্ঠীর মানুষকে হত্যা, তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে চরম ক্ষতিসাধন, জীবনমানের প্রতি আঘাত ও শারীরিক ক্ষতিসাধন, জন্মদান বাধাগ্রস্ত করা এবং শিশুদের অন্য গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া। এই পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রথম চারটি বৈশিষ্ট্যই পাকিস্তান বাহিনীর দীর্ঘ নয় মাসের নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের মধ্যে রয়েছে।

একাত্তরের নয় মাস পাকিস্তানিদের নির্যাতনের সঙ্গে জেনোসাইডের জাতিসংঘ ঘোষিত সংজ্ঞার মধ্যে পড়লেও ২৫ মার্চের জেনোসাইডের বৈশ্বিক স্বীকৃতি নেই। ২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদের চতুর্দশ অধিবেশনে ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা করার পর ওই বছর থেকেই দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘গণহত্যা দিবস’ পালিত হচ্ছে। এছাড়া দিবসটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম নেওয়ার জন্য একটি বিলও পাস হয় সংসদে। বাংলাদেশ যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘গণহত্যা দিবস’ পালন শুরু করে তার দুই বছর আগে থেকেই বিশ্বব্যাপী ‘গণহত্যা দিবস’ নামে একটি দিবস পালন হয়। ২০১৫ সালে জাতিসংঘ ৯ ডিসেম্বরকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা করে। এর ফলে ২৫ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতির আর সুযোগ থাকছে না। তবে ২৫ মার্চকে জেনোসাইড দিবস হিসেবে পালনের বৈশ্বিক সুযোগ না থাকলেও বাংলাদেশের এখনও সুযোগ রয়েছে একাত্তরের নয় মাসের পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির। কিন্তু এই স্বীকৃতি আদায়ে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম কত দূর, এ সম্পর্কেও আমরা নিশ্চিত নই। মার্চ এলেই কেবল জেনোসাইড নিয়ে কথা হয়, তবে এই কথাগুলো এতটা ক্ষীণ স্বরে যে, একদিনের আলোচনাতেই তা সীমাবদ্ধ।

পঁচিশে মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের দাবি নতুন নয়। নব্বইয়ের দশক থেকে এই দাবি জানিয়ে আসছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। ১৯৯৩ সালে ওঠা ওই দাবিকে পাত্তা দেয়নি তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার। ২০০১ সালে জাতিসংঘের ইউনেস্কোর কাছে বাংলাদেশের জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ের বিষয়টি তুলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের গবেষক এবং ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির প্রধান ডা. এম এ হাসান। জবাবে ইউনেস্কো জানিয়েছিল, স্বীকৃতির জন্য বাংলাদেশকে জাতিসংঘে তা তুলে ধরতে হবে। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সম্মতিক্রমে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে পাস করতে হবে। ২০০৬ সালে নির্মূল কমিটি আন্তর্জাতিকভাবে চেষ্টা শুরু করে। ২০০৭ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ইউনেস্কো এবং জেনোসাইডের ভিকটিম বিভিন্ন দেশে চিঠি লিখে, আইন প্রণেতাদের সঙ্গে কথা বলে জেনোসাইড দিবস পালন প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে নির্মূল কমিটি। ২০১৫ সালের মার্চে আর্মেনিয়া থেকে পাল্টা চিঠি দিয়ে বাংলাদেশে দিবসটি কীভাবে পালন করা হয় এবং এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত পাঠানোর জন্য বলা হলে, নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে তখন জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানানো হয়।বাংলাদেশে এখনো দিবসটি ঘোষণা হয়নি। তবে এই দিনে বিভিন্ন সংগঠন ও সাধারণ মানুষ জেনোসাইডের শহিদদের স্মরণে নানা কর্মসূচি পালন করে থাকেন। দেশেই রাষ্ট্রীয়ভাবে যে দিবসের স্বীকৃতি নেই, বিশ্বব্যাপী হবে কীভাবে? হয়ওনি। ফলে ২৫ মার্চ নয়, ৯ ডিসেম্বরকেই বেছে নেয় জাতিসংঘ। এর ফলে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমরা ২৫ মার্চের জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ের সুযোগ হারাই। এটা নিশ্চিতভাবেই আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা।

আশার কথা, একাত্তরের নয় মাসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের পথ এখনই বন্ধ হচ্ছে না আমাদের। আর্মেনিয়া, রুয়ান্ডা ও যুগোস্লাভিয়ার জেনোসাইডের জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আদালতের স্বীকৃতি আছে। আর্মেনিয়ানদের এজন্যে শত বছর চেষ্টা ও অপেক্ষা করতে হয়েছে। আমাদের অপেক্ষা করতে আপত্তি নেই, কিন্তু এজন্যে রাষ্ট্রীয় চেষ্টা-তদবির তো থাকতে হবে! এটা কতখানি রয়েছে, এ নিয়ে আশ্বস্ত হওয়া যাচ্ছে না এখনও।

একাত্তরের নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এবং আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত বিজয় আমাদের গৌরবের স্মারক। এই গৌরবকে উঁচুতে তোলে ধরতে আমাদের ওপর চালিত পাকিস্তানিদের জেনোসাইডকে অস্বীকার কিংবা অবমূল্যায়ন করা যাবে না। গৌরবের যে অর্জন, তার সঙ্গে জড়িয়ে যতখানি রক্ত আর সম্ভ্রম তার স্বীকৃতি দরকার; রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে!

কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক।

;

স্মৃতিতে একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাস্কর শামীম শিকদার



সামিয়া মহসীন
একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাস্কর শিল্পী শামীম শিকদার

একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাস্কর শিল্পী শামীম শিকদার

  • Font increase
  • Font Decrease

গত ২১ মার্চ রাজধানী ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিশিষ্ট ভাস্কর শামীম শিকদার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মহান এই গুণী শিল্পী ২০০০ সালে একুশে পদক লাভ করেন। ৭০ বছর বয়সী এই ভাস্কর কার্ডিওভাসকুলার, শ্বাসতন্ত্র এবং কিডনির জটিলতাসহ নানা শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে শামীম শিকদার ২ সন্তান রেখে গেছেন। চারুকলা প্রাঙ্গণে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর পর ঢাকার মোহাম্মদপুর কবরস্থানে বাবা-মায়ের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়েছে ।

অসম্পূর্ণ কিছু কাজ শেষ করার উদ্দেশ্যেই কয়েক মাস আগে লন্ডন থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনি। ঢাবির চারুকলা অনুষদে জয়নুল আবেদিনের ভাস্কর্যটি আবার নতুন করে গড়ার স্বপ্ন দেখছিলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুয়ের্নিকা ভাস্কর্যও নতুন করে করার পরিকল্পনা ছিল শামীম শিকদারের।


ঢাবির চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের অধ্যাপক শামীম শিকদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে 'স্বোপার্জিত স্বাধীনতা' এবং ফুলার রোডে 'স্বাধীনতা সংগ্রাম' নির্মাণ করেন। এর আগে ১৯৭৪ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মরণে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়েই উনাকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে অবস্থিত ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’ শিরোনামের ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। ভাস্কর্যটির মূল বেদীতে আছে একাত্তরের বিভিন্ন ঘটনার চিত্র। ১৯৮৮ সালের ২৫ মার্চ এটি স্থাপন করা হয়। এই ভাস্কর্য টি যখন তৈরি করা হয়েছিল, তখন খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। তিনি সিমেন্ট, ব্রোঞ্জ, কাঠ, প্লাস্টার অব প্যারিস, কাদা, কাগজ স্টিল ও গ্লাস ফাইভার মাধ্যমে কাজ করেছেন। প্রখ্যাত কম্যুনিস্ট বিপ্লবী নেতা সিরাজ শিকদার শামীম শিকদারের আপন বড় ভাই।


শামীম শিকদার যখন ভাস্কর্য নির্মাণ করতেন কখনো তাঁর পরণে থাকতো জিন্স আর সাদা টি শার্ট। আবার কখনো সাদা শার্ট প্যান্ট । সাদা রঙ; তাঁর প্রিয় রঙ ছিল বলেই মনে হত। কপালে কখনো কখনো  ব্যান্ডানা বাঁধতেন। সেই আশির দশকে এমন একজন ভাস্কর শিল্পীর পোশাক সেই সময়ের মানুষকে ভীষণভাবে অবাক করতো। দু’হাতে যতো  কাজই করুন না কেন, ঠোঁটের কোণে সিগারেট ধরাই থাকতো। তখন তো এখনকার মতো মোবাইল ফোন ছিল না। থাকলে উনার কাজ করার মুহূর্তগুলোর স্মৃতি ধরে রাখা যেত। তাঁর সেই কাজগুলো যেগুলো তিল তিল করে ভালোবাসা আর শ্রম দিয়ে তিনি করেছিলেন সেই ভাস্কর্যগুলো ঠাঁই পেয়েছে ফুলার রোডের সড়ক দ্বীপে। ফুলার রোড এলাকায় ‘স্বাধীনতাসংগ্রাম’-এ  তাঁর করা ১১৬টি ভাস্কর্য ঠাঁই পেয়েছে। এই ভাস্কর্য পার্ক টি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাকে অলঙ্করণ করেছে। এখানে তিনি আরও ১৩৪টি ভাস্কর্য তৈরির কাজের উদ্দেশ্য নিয়েই দেশে আসেন। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল।


শামীম শিকদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে ১৯৯৪ সালে স্বামী বিবেকানন্দের ভাস্কর্য নির্মাণ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়েই উনার স্টাইল এবং কাজের সাথে পরিচিত হয়ে উঠেছিলাম। আমার তো মনে হয় আশির দশক থেকে আজ অবধি কেউ তাঁকে ছুঁতে পেরেছে বলে মনে হয় না। একজন নারী স্রোতের বিপরীতে চলেও তাঁর রুচি, শিক্ষা ও কর্ম দিয়ে কিভাবে স্বাক্ষর রেখে যেতে পারেন। শামীম শিকদার তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। নারী বিদ্বেষীরা সেদিনও ছিলো, আজও আছে। তবে তাঁর মতো সাহসী নারী শত বছরে হয়তো একবারই জন্মে। বেশিরভাগ সময়েই মোটরবাইক চালিয়ে চলাচল করতেন। সেই সত্তর আশির দশকে এমনটা ঘটনা আসলেই বিরল ছিল। শখের বশে জুডো শিখেছিলেন।

এমন দেশপ্রেমী শামীম শিকদারদের কখনোই মৃত্যু হয়না। তিনি আজীবন বেঁচে থাকবেন বাঙালির হৃদয়ে, বাঙালির মননে, বাঙালির চেতনায়। এই কিংবদন্তীর প্রতি রইল শত সহস্র সালাম।

সামিয়া মহসীন‚ লেখক,নাট্যশিল্পী, তে কথামালা সাহিত্য-সংস্কৃতি আন্দোলন নেতা।

;

যাত্রীরাই ইউএস-বাংলার এক একজন ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর



মো. কামরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

এশিয়ার আকাশ দাপিয়ে বেড়ানো বাংলার গর্ব ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সকে শুনতে হয় না ‘নয়টার প্লেন কয়টায় যাবে’। শুনতে হয় না যাত্রীদের কাছ থেকে ‘ফ্লাইট কি অন-টাইম’? শুনতে হয় না ‘আপনাদের প্লেন পৌছানোর পর লাগেজ পেতে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়’? এই প্রশ্নগুলো না শুনতে পারাই ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট পরিচালনার স্বার্থকতা।

সুনামের সাথে দশ বছর ধরে আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করে আসছে ইউএস-বাংলা। ঢাকা থেকে যশোর রুটে ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই যাত্রা শুরু করার পর আজ অবধি শতকরা ৯০ ভাগের অধিক ফ্লাইটই অন-টাইম। আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট চালুর পর থেকেই ফ্লাইট গন্তব্যে পৌঁছানোর ১৫ মিনিটের মধ্যে লাগেজ ডেলিভারী এক অনন্য উদাহরন। বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ রুটে প্রথমবারের মতো ইউএস-বাংলা ব্র্যান্ডনিউ এয়ারক্রাফট দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করছে।

বৈশ্বিক এভিয়েশনের মানচিত্রে উপরোক্ত প্রশ্নগুলো শুনলে মনে হয় দেশের এভিয়েশনের কি করুন দশাই না ছিলো এয়ারলাইন্সগুলোর। প্রশ্নগুলোর সত্যতা কতটুকু বাস্তব হলেই স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও দিনের পর দিন যাত্রীদের মনে বাসা বেঁধে আছে। প্রশ্নগুলোর সত্যতা প্রমান করার প্রয়োজনীয়তাবোধ করেনি ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। একটি যাত্রীবান্ধব এয়ারলাইন্স হিসেবে নানা পরিকল্পনা আর বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে ইউএস-বাংলা।

বাংলাদেশের প্রাইভেট এয়ারলাইন্সকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় নানাবিধ সমস্যাকে সঙ্গী করেই বাংলাদেশ এভিয়েশনে অগ্রসর হতে চেয়েছে। অবকাঠামোগত সমস্যা, আর্থিক অস্বচ্ছলতা, পরিবহননীতির অস্বামঞ্জস্যতা, জাতীয় বিমান সংস্থার সাথে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড না থাকা, বিভিন্ন ধরনের অতিরিক্ত অ্যারোনোটিক্যাল ও নন-অ্যারোনোটিক্যাল চার্জ।

এছাড়া বিশ্ব মার্কেটের সাথে জেট ফুয়েল প্রাইসের প্রার্থক্য, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট চলাচলের ক্ষেত্রে দ্বিমূখী নীতি, এয়ারক্রাফট কিংবা এয়ারক্রাফট পার্টসের অতিরিক্ত কাস্টমস্ ডিউটি নির্ধারন, যা বাংলাদেশ এভিয়েশনে প্রাইভেট এয়ারলাইন্স এর এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় বলেই প্রতীয়মান।

নানাবিধ অস্বামঞ্জস্যতা থাকার পরও ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স বাংলার আকাশে তথা বিশ্বের আকাশে উদীয়মান সূর্য হয়ে একবিংশ শতাব্দীতে আবির্ভূত হয়েছে। মাত্র দশ বছর সময়ে বিশাল জনগোষ্টির বাংলাদেশের আকাশ পরিবহনের যাত্রীরা পূর্ণ আস্থা রেখেছে ইউএস-বাংলার উপর। দু’টি ড্যাশ৮-কিউ৪০০ এয়ারক্রাফট নিয়ে যাত্রা শুরু করা ইউএস-বাংলায় এখন ৮টি বোয়িং ৭৩৭-৮০০, ৮টি এটিআর৭২-৬০০ এয়ারক্রাফটসহ মোট উনিশটি এয়ারক্রাফট রয়েছে বিমান বহরে।

ইউএস-বাংলার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুনের স্বপ্নযাত্রার স্বপ্ন যেন আকাশ সমান, স্বপ্নের বিস্তৃতি আর বাস্তবায়ন চলছে সমান্তরালে। দেশের এভিয়েশনকে নিয়ে যেতে চান সুউচ্চ মর্যাদায়। আজ ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স প্রতিযোগিতা করছে এমিরেটস, কাতার এয়ারওয়েজ, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স, মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স, থাই এয়ারওয়েজ, ওমান এয়ার এর মতো বিশ্ববিখ্যাত এয়ারলাইন্সগুলোর সাথে।

স্বল্পতম সময়ে ইউএস-বাংলা বাংলাদেশী যাত্রীদের সেবা দেয়ার মানসে দুবাই, শারজাহ, মাস্কাট, দোহা, সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর, ব্যাংকক, গুয়াংজু, মালে, চেন্নাই ও কলকাতা রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। আগামী মে –জুনে ইউএস-বাংলা দু’টি ৪৩৯ সিটের এয়ারবাস ৩৩০ এয়ারক্রাফট বিমান বহরে যোগ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। যা দিয়ে এশিয়ার অন্যতম গন্তব্য আর বাংলাদেশী যাত্রীদের আকর্ষণ সৌদি আরবের জেদ্দা রুটে ফ্লাইট পরিচালনার পরিকল্পনা করছে ইউএস-বাংলা।

ইউএস-বাংলা এয়ারলা্ইন্সে ২৫০০ এর অধিক কর্মকর্তা, কর্মচারী রয়েছে। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর ব্যবস্থাপনা পরিষদের সুচিন্তিত দিক নির্দেশনা এবং যাত্রীদের আস্থা ইউএস-বাংলাকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করছে।

ইউএস-বাংলা পরিবারের সকল সদস্য আর যাত্রীরাই এক একজন ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। যাত্রীদের আস্থাই ইউএস-বাংলার অগ্রযাত্রার মূল পাথেয়।

লেখক: মো. কামরুল ইসলাম, মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স

;

ফলস এলার্ম ও অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ মহড়া



প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বসন্তের ‘হানামি’বা চেরিফুল ফোঁটার মৌসুমে ছুটির দিনে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেশ মজা করা হয়েছিল। রাতে আরেক অনুষ্ঠানে যেতে হবে। সারাদিন লম্বা ড্রাইভ করে চেরি বাগান ঘুরে ঘুরে বহুদূরের ওপেন লেকে মাছ ধরে সবাই ক্লান্ত। মাছের বারবিকিউ রাতের খাবারের একটি মেন্যু। কিন্তু বাইরে হঠাৎ ঝির ঝির বৃষ্টি ও ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করলে ক্যাম্পাসের চেরিতলার স্পট পরিত্যাগ করে সবাই আমাদের ডর্মের দ্বিতীয় তলার হলঘরে গিয়ে উঠলাম। সেখানে ফ্রি চুলায় রান্নাসহ সব ব্যবস্থা ছিল।

সবাই খুব ব্যস্ত হয়ে রান্না-বান্নার কাজে মনোযোগ দিয়েছিল। বিদেশের ওসব পার্টিতে কারো বাবুগিরি করা চলে না। সবাই খুশীমনে সবকাজে অংশ নেয়ার নিয়ম। রান্না শেষে খাবার সাজানো হয়েছে। এমন সময় ডর্মের ‘ফায়ার এলার্ম’ বেজে উঠলো। বেশ কর্কশ স্বরে একবার, দুইবার নয়- তিনবার বাজতে লাগলো। উপরের তলায় কোথাও আগুন লেগেছে এই ভেবে সবাই অতি দ্রুত হলঘর থেকে বের হয়ে বাইরের পার্কিং লটে চলে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ পর জানা গেল আমাদের ভবনে আগুন লাগেনি। আমাদের মাছ বারবিকিউ করার চারকোলের অতিরিক্ত ধোঁয়ায় এক্সজস্টর চালু করে না দেয়ায় বদ্ধ কিচেনের ‘ফায়ার এক্সটিংগুইশার’ মেশিন আগুনের ধোঁয়া আঁচ করে গোটা ভবনে জরুরি এলার্ম বাজিয়ে সবাইকে আগুনের সতর্কবার্তা পৌঁছে দিয়েছে। সবাই জরুরি নির্গমণ পথ অনুসরণ করে নিরাপদে নিচে চলে গেছে।

তখন মনে হয়েছিল- কত সেন্সেটিভ ওদের ‘ফায়ার এক্সটিংগুইশার’মেশিন! একটু বেশিমাত্রার ধোঁয়ার সন্ধান পেলে আর রক্ষা নেই। সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে এলার্ম দিয়ে সবাইকে সতর্ক করে দেয়। এই মেশিন জাপানের সব ভবনের সবঘরেই লাগানো থাকে। শুধু দাউ দাউ আগুন নয়, ধোঁয়ার সূত্রপাত হলেই সেগুলো বেজে উঠে সবাইকে সতর্ক করে দেয়। যাহোক, যারা সেবছর নতুন গিয়েছিল আমাদের ক্যাম্পাসে তারা এলার্ম শুনে অনেকটা ভয় পেয়েছিল। আমরা যারা পুরনো বাসিন্দা ছিলাম তারা এরকম ফায়ার এলার্ম অনেকবার শুনেছি। যেগুলো ছিল সতর্কতামূলক মহড়া মাত্র। পরে সে রাতে আমাদের পার্টি ঠিকমতোই শেষ হয়েছিল।

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার গুলশানের এক আধুনিক বহুতল আবাসিক ভবনের ৭ম তলায় আগুনের সূত্রপাত হয়। সে আগুন উপরের দিকে ছড়িয়ে গেলে ১২ তলা থেকে দুজন লাফিয়ে নিচে পড়লে মারা যান। ঐ অগ্নিকাণ্ডে শিশুসহ ২২ জন আহত হয়।

জানা গেছে, সেই ভবনটিতে আধুনিক অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল। জরুরি নির্গমণ পথ ছিল। ‘ফায়ার এলার্ম’ দেবার মতো ওদের ‘ফায়ার এক্সটিংগুইশার’মেশিন প্রতিটি ফ্লোরে লাগানো ছিল। তবে অনেকে ফায়ার এলার্ম শোনেননি। যারা শুনেছিল তারা ভেবেছে সেটা ছিল ‘ফলস্ ফায়ার এলার্ম’! অথবা রাস্তা দিয়ে অ্যম্বুলেন্স জরুরি এলার্ম বাজিয়ে সব সময় যাতায়ত করে। সেরকম কিছু একটার শব্দ হতে পারে। তাই তারা এলার্মের গা করেননি। আর এরকম একটি আধুনিক ভবন যেখানে কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে অগ্ন্কিান্ডের সময় বাইরে না বেরিয়ে ঘরের ভিতর বসে থাকই ভাল!

অর্থ্যাৎ, আধুনিক যন্ত্রপাতি লাগানো হলেও সেগুলোর ব্যবহার বিধি সম্পর্কে সচেতনতামূলক জ্ঞান তাদের সবার মধ্যে ছিল না। তাইতো একজন বাবুর্চি ও একজন গৃহকর্মী জরুরি নির্গমণ পথ দিয়ে বের হবার চেষ্টা না করে আতঙ্কে ১২ তলার বেলকুনি থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ে মারা গেছেন।

আমাদের দেশে অগ্নিকাণ্ডের প্রতি মানুষের ভয় বেড়েছে। কিন্তু সচেতনতা বাড়েনি। পুরাতন বড় বড় ভবনে এত আধুনিক মানের ফায়ার ‘ফায়ার এলার্ম’ দেবার মতো যন্ত্রপাতি বসানো না হলেও অধূনা এব্যাপারে সচেতনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কারণ, বিল্ডিং কোডের মধ্যে ‘ফায়ার এলার্ম’ দেবার প্রয়োজনীয় যথপোযুক্ত ব্যবস্থা রাখার আইনী বিধান রয়েছে। এটা অমান্য করলে ভবন মালিকের শাস্তি অবধারিত।

তবে বিল্ডিং কোডের এথিকস্ মেনে আংশিক কাজ করে পুরো কাজের জন্য সনদ তুলে নিয়ে ঘরে রাখলেই মানুষ ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ঠেকানো কঠিন। তাই আন্তরিকতার সাথে প্রতিটি ভবনে বিল্ডিং কোডের এথিকস শতভাগ মেনে আধুনিক ফায়ার নিরাপত্তাব্যবস্থা চালু রাখা প্রয়োজন।

পাশাপাশি এলার্ম বাজলো আর আমি শুনেও ঘুমিয়ে থাকলাম সেট করা হলে বিপদ অনিবার্য। অনেক অলস ব্যক্তি জরুরি কাজের জন্য ঘড়িতে জেগে ওঠার সময় এলার্ম দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। এলার্ম ঠিকসময় বেজে উঠলে রাগ করে ঘড়িকে থাপ্পর দিয়ে এলার্ম বন্ধ করে দিয়ে পুনরায় ঘুমিয়ে যেতে দেখা যায়। এর পরিণতি সম্পর্কে তারা মোটেও ভাবেন না। এমন বদঅভ্যাস থাকলে ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে না ঘুমানোই শ্রেয়।

যেটা ঘটতে শোনা গেছে গুলশানের বাড়ির বাসিন্দাদের মুখ থেকে। তাদের কেউ কেউ বলেছেন, অগ্নিকাণ্ডের জরুরি ফায়ার এলার্ম শুনেছেন কিন্তু সেটাকে তারা ‘ফলস এলার্ম’ ভেবেছেন। তাই ভবনের বাইরে যেতে চাননি। এরূপ বিপদের সময় এটা শুধু নিতান্ত অবহেলাই নয়- চরম হেঁয়ালীপনার নামান্তর। এরকম হেঁয়ালীপনা নিজের ও পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।

তাই এই অবস্থা নিরসনের জন্য প্রয়োজন ঘন ঘন সতর্কতামূলক মহড়ার আয়োজন করা। আমাদের দেশে যে হারে সুউচ্চ ভবন তৈরি হচ্ছে এবং যেভাবে মানুষ বহুতল ভবনে বসবাস করতে আগ্রহী হয়ে পড়েছে সেই হারে ফায়ার নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিকশিত হয়নি।

আজকাল বহুতল ভবনে ফায়ার প্রতিরোধী স্প্রে, ফায়ার প্রতিরোধী গ্যাস সিলিন্ডার, পানির পাইপ, মুখোশ, পোশাক ইত্যাদি সংরক্ষণ করতে দেখা যায়। অনেক অফিসের বিভিন্ন তলার কোণায় কোণায় এসব নিরাপত্তা সরঞ্জাম সাজানো থাকে।

কিন্তু কথা হলো সেগুলো শুধু সাজিয়ে রাখার জিনিস নয়। কারণ, মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেলে বা বেশি পুরনো হয়ে গেলে সেগুলো অকার্যকরী হয়ে পড়ে। সেজন্য প্রতি তিন বা ছয় মাস পর পর সেসব জিনিষ ব্যবহার উপযোগী আছে কি-না তা পরীক্ষা করার জন্য জরুরি মহড়ার আয়োজন কার উচিত। বিপদের সময় সেগুলো ঠিকমতো সেবা দেয় না। আবার অনেকেই সেসব নিরাপত্তা সামগ্রীর ব্যবহার করতে জানেন না। এসব জিনিষের মেয়াদ পার হলে সেগুলো ফেলে দিয়ে নতুন নিরাপত্তা কিট্স কেনা উচিত।

এজন্য প্রতিটি ভবনে অফিসে, কারখানায় বাধ্যতামূলক বাজেট রাখার নির্দেশনা বস্তবায়ন করা উচিত। উঁচু অফিস, হোটেল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও বসত ঘরের প্রতিটি কক্ষে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে ‘ফায়ার এক্সটিংগুইশার’ মেশিন লাগানো বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। যারা একটু ধোঁয়া পেলেই জরুরি সংকেত দিবে।

এছাড়া হাসপাতাল, তেলের ডিপো, পাম্প, গুদাম, বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজার এমনকি পল্লী অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোতে নিয়মিত অগ্নিনির্বাপণ মহড়া গ্রহণ করে মানুষকে অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা থেকে সচেতন করার পদক্ষেপ হাতে নেয়া উচিত।

সেসব মহড়ায় বাড়ির বা অফিসের ছোট-বড় সবার অংশগ্রহণ আবশ্যিক করা উচিত। কারণ প্রশিক্ষণ নেয়া থাকলে বিপদের সময় একটি শিশুও অনেক মূল্যবান জান-মাল রক্ষায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

আমাদের দেশে প্রতিটি বিপর্যয় ঘটে যাবার পর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, বোর্ডসভা করা হয়। কিন্তু যেসব ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব সেগুলো নিয়ে পূর্বপরিকল্পনা মাফিক দায়িত্ব পালন বা কাজ সুসম্পন্ন করা হয় কি-না তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। তাই প্রতিটি কাজের জবাবদিহিতা বাড়ানো এবং অত্যাধুনিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করে অগ্নিকাণ্ডের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে জোরদার করতে ও পুরনো নিরাপত্তা সরঞ্জাম পরখ করতে ঘন ঘন অগ্নি-নির্বাপণ মহড়ার আয়োজন করা খুব জরুরি।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

;