জেনোসাইডের স্বীকৃতি

  • কবির য়াহমদ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বায়ান্ন বছরেও একাত্তরের পঁচিশে মার্চের কালরাত্রির জেনোসাইডের বৈশ্বিক স্বীকৃতি মেলেনি। বৈরী ভাবাদর্শের রাজনীতি এবং জেনোসাইড নিয়ে অমনোযোগিতা আমাদের পিছিয়ে দিয়েছে। কালরাত্রির অপারেশন সার্চলাইট নামের যে জেনোসাইড চলে, তার স্বীকৃতির সুযোগ ছিল। কিন্তু সেটাও আমরা আদায় করতে পারিনি। বলা যায়, সময়মতো চেষ্টা করা হয়নি।

পঁচিশে মার্চের জেনোসাইডের স্বীকৃতি আমরা না পেলেও এখনও সুযোগ আছে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক নির্যাতনের স্বীকৃতির।

বিজ্ঞাপন

একাত্তরের আট মাস বাইশ দিনে ত্রিশ লাখ মানুষকে হত্যা থেকে শুরু করে দুই লাখের অধিক নারী-শিশুর ওপর যৌনসহিংসতা চালিয়েছিল পাকিস্তান এবং তাদের এদেশীয় দোসরেরা। নির্যাতনের ধরনগুলো জাতিসংঘ ঘোষিত জেনোসাইডের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মেলে। জাতিসংঘের ‘কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন এন্ড পানিসমেন্ট অব দ্য ক্রাইম অব জেনোসাইড’-এর আর্টিকেল ২ অংশে জেনোসাইডের পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলা আছে, যার কোনো একটি সংঘটিত হলে জেনোসাইডে বলা যাবে। ওই আর্টিকেল বলছে— কোনো গোষ্ঠীর মানুষকে হত্যা, তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে চরম ক্ষতিসাধন, জীবনমানের প্রতি আঘাত ও শারীরিক ক্ষতিসাধন, জন্মদান বাধাগ্রস্ত করা এবং শিশুদের অন্য গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া। এই পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রথম চারটি বৈশিষ্ট্যই পাকিস্তান বাহিনীর দীর্ঘ নয় মাসের নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের মধ্যে রয়েছে।

একাত্তরের নয় মাস পাকিস্তানিদের নির্যাতনের সঙ্গে জেনোসাইডের জাতিসংঘ ঘোষিত সংজ্ঞার মধ্যে পড়লেও ২৫ মার্চের জেনোসাইডের বৈশ্বিক স্বীকৃতি নেই। ২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদের চতুর্দশ অধিবেশনে ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা করার পর ওই বছর থেকেই দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘গণহত্যা দিবস’ পালিত হচ্ছে। এছাড়া দিবসটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম নেওয়ার জন্য একটি বিলও পাস হয় সংসদে। বাংলাদেশ যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘গণহত্যা দিবস’ পালন শুরু করে তার দুই বছর আগে থেকেই বিশ্বব্যাপী ‘গণহত্যা দিবস’ নামে একটি দিবস পালন হয়। ২০১৫ সালে জাতিসংঘ ৯ ডিসেম্বরকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা করে। এর ফলে ২৫ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতির আর সুযোগ থাকছে না। তবে ২৫ মার্চকে জেনোসাইড দিবস হিসেবে পালনের বৈশ্বিক সুযোগ না থাকলেও বাংলাদেশের এখনও সুযোগ রয়েছে একাত্তরের নয় মাসের পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির। কিন্তু এই স্বীকৃতি আদায়ে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম কত দূর, এ সম্পর্কেও আমরা নিশ্চিত নই। মার্চ এলেই কেবল জেনোসাইড নিয়ে কথা হয়, তবে এই কথাগুলো এতটা ক্ষীণ স্বরে যে, একদিনের আলোচনাতেই তা সীমাবদ্ধ।

বিজ্ঞাপন

পঁচিশে মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের দাবি নতুন নয়। নব্বইয়ের দশক থেকে এই দাবি জানিয়ে আসছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। ১৯৯৩ সালে ওঠা ওই দাবিকে পাত্তা দেয়নি তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার। ২০০১ সালে জাতিসংঘের ইউনেস্কোর কাছে বাংলাদেশের জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ের বিষয়টি তুলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের গবেষক এবং ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির প্রধান ডা. এম এ হাসান। জবাবে ইউনেস্কো জানিয়েছিল, স্বীকৃতির জন্য বাংলাদেশকে জাতিসংঘে তা তুলে ধরতে হবে। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সম্মতিক্রমে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে পাস করতে হবে। ২০০৬ সালে নির্মূল কমিটি আন্তর্জাতিকভাবে চেষ্টা শুরু করে। ২০০৭ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ইউনেস্কো এবং জেনোসাইডের ভিকটিম বিভিন্ন দেশে চিঠি লিখে, আইন প্রণেতাদের সঙ্গে কথা বলে জেনোসাইড দিবস পালন প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে নির্মূল কমিটি। ২০১৫ সালের মার্চে আর্মেনিয়া থেকে পাল্টা চিঠি দিয়ে বাংলাদেশে দিবসটি কীভাবে পালন করা হয় এবং এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত পাঠানোর জন্য বলা হলে, নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে তখন জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানানো হয়।বাংলাদেশে এখনো দিবসটি ঘোষণা হয়নি। তবে এই দিনে বিভিন্ন সংগঠন ও সাধারণ মানুষ জেনোসাইডের শহিদদের স্মরণে নানা কর্মসূচি পালন করে থাকেন। দেশেই রাষ্ট্রীয়ভাবে যে দিবসের স্বীকৃতি নেই, বিশ্বব্যাপী হবে কীভাবে? হয়ওনি। ফলে ২৫ মার্চ নয়, ৯ ডিসেম্বরকেই বেছে নেয় জাতিসংঘ। এর ফলে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমরা ২৫ মার্চের জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ের সুযোগ হারাই। এটা নিশ্চিতভাবেই আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা।

আশার কথা, একাত্তরের নয় মাসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের পথ এখনই বন্ধ হচ্ছে না আমাদের। আর্মেনিয়া, রুয়ান্ডা ও যুগোস্লাভিয়ার জেনোসাইডের জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আদালতের স্বীকৃতি আছে। আর্মেনিয়ানদের এজন্যে শত বছর চেষ্টা ও অপেক্ষা করতে হয়েছে। আমাদের অপেক্ষা করতে আপত্তি নেই, কিন্তু এজন্যে রাষ্ট্রীয় চেষ্টা-তদবির তো থাকতে হবে! এটা কতখানি রয়েছে, এ নিয়ে আশ্বস্ত হওয়া যাচ্ছে না এখনও।

একাত্তরের নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এবং আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত বিজয় আমাদের গৌরবের স্মারক। এই গৌরবকে উঁচুতে তোলে ধরতে আমাদের ওপর চালিত পাকিস্তানিদের জেনোসাইডকে অস্বীকার কিংবা অবমূল্যায়ন করা যাবে না। গৌরবের যে অর্জন, তার সঙ্গে জড়িয়ে যতখানি রক্ত আর সম্ভ্রম তার স্বীকৃতি দরকার; রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে!

কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক।