জেনোসাইডের স্বীকৃতি



কবির য়াহমদ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বায়ান্ন বছরেও একাত্তরের পঁচিশে মার্চের কালরাত্রির জেনোসাইডের বৈশ্বিক স্বীকৃতি মেলেনি। বৈরী ভাবাদর্শের রাজনীতি এবং জেনোসাইড নিয়ে অমনোযোগিতা আমাদের পিছিয়ে দিয়েছে। কালরাত্রির অপারেশন সার্চলাইট নামের যে জেনোসাইড চলে, তার স্বীকৃতির সুযোগ ছিল। কিন্তু সেটাও আমরা আদায় করতে পারিনি। বলা যায়, সময়মতো চেষ্টা করা হয়নি।

পঁচিশে মার্চের জেনোসাইডের স্বীকৃতি আমরা না পেলেও এখনও সুযোগ আছে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক নির্যাতনের স্বীকৃতির।

একাত্তরের আট মাস বাইশ দিনে ত্রিশ লাখ মানুষকে হত্যা থেকে শুরু করে দুই লাখের অধিক নারী-শিশুর ওপর যৌনসহিংসতা চালিয়েছিল পাকিস্তান এবং তাদের এদেশীয় দোসরেরা। নির্যাতনের ধরনগুলো জাতিসংঘ ঘোষিত জেনোসাইডের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মেলে। জাতিসংঘের ‘কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন এন্ড পানিসমেন্ট অব দ্য ক্রাইম অব জেনোসাইড’-এর আর্টিকেল ২ অংশে জেনোসাইডের পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলা আছে, যার কোনো একটি সংঘটিত হলে জেনোসাইডে বলা যাবে। ওই আর্টিকেল বলছে— কোনো গোষ্ঠীর মানুষকে হত্যা, তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে চরম ক্ষতিসাধন, জীবনমানের প্রতি আঘাত ও শারীরিক ক্ষতিসাধন, জন্মদান বাধাগ্রস্ত করা এবং শিশুদের অন্য গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া। এই পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রথম চারটি বৈশিষ্ট্যই পাকিস্তান বাহিনীর দীর্ঘ নয় মাসের নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের মধ্যে রয়েছে।

একাত্তরের নয় মাস পাকিস্তানিদের নির্যাতনের সঙ্গে জেনোসাইডের জাতিসংঘ ঘোষিত সংজ্ঞার মধ্যে পড়লেও ২৫ মার্চের জেনোসাইডের বৈশ্বিক স্বীকৃতি নেই। ২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদের চতুর্দশ অধিবেশনে ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা করার পর ওই বছর থেকেই দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘গণহত্যা দিবস’ পালিত হচ্ছে। এছাড়া দিবসটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম নেওয়ার জন্য একটি বিলও পাস হয় সংসদে। বাংলাদেশ যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘গণহত্যা দিবস’ পালন শুরু করে তার দুই বছর আগে থেকেই বিশ্বব্যাপী ‘গণহত্যা দিবস’ নামে একটি দিবস পালন হয়। ২০১৫ সালে জাতিসংঘ ৯ ডিসেম্বরকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা করে। এর ফলে ২৫ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতির আর সুযোগ থাকছে না। তবে ২৫ মার্চকে জেনোসাইড দিবস হিসেবে পালনের বৈশ্বিক সুযোগ না থাকলেও বাংলাদেশের এখনও সুযোগ রয়েছে একাত্তরের নয় মাসের পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির। কিন্তু এই স্বীকৃতি আদায়ে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম কত দূর, এ সম্পর্কেও আমরা নিশ্চিত নই। মার্চ এলেই কেবল জেনোসাইড নিয়ে কথা হয়, তবে এই কথাগুলো এতটা ক্ষীণ স্বরে যে, একদিনের আলোচনাতেই তা সীমাবদ্ধ।

পঁচিশে মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের দাবি নতুন নয়। নব্বইয়ের দশক থেকে এই দাবি জানিয়ে আসছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। ১৯৯৩ সালে ওঠা ওই দাবিকে পাত্তা দেয়নি তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার। ২০০১ সালে জাতিসংঘের ইউনেস্কোর কাছে বাংলাদেশের জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ের বিষয়টি তুলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের গবেষক এবং ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির প্রধান ডা. এম এ হাসান। জবাবে ইউনেস্কো জানিয়েছিল, স্বীকৃতির জন্য বাংলাদেশকে জাতিসংঘে তা তুলে ধরতে হবে। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সম্মতিক্রমে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে পাস করতে হবে। ২০০৬ সালে নির্মূল কমিটি আন্তর্জাতিকভাবে চেষ্টা শুরু করে। ২০০৭ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ইউনেস্কো এবং জেনোসাইডের ভিকটিম বিভিন্ন দেশে চিঠি লিখে, আইন প্রণেতাদের সঙ্গে কথা বলে জেনোসাইড দিবস পালন প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে নির্মূল কমিটি। ২০১৫ সালের মার্চে আর্মেনিয়া থেকে পাল্টা চিঠি দিয়ে বাংলাদেশে দিবসটি কীভাবে পালন করা হয় এবং এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত পাঠানোর জন্য বলা হলে, নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে তখন জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানানো হয়।বাংলাদেশে এখনো দিবসটি ঘোষণা হয়নি। তবে এই দিনে বিভিন্ন সংগঠন ও সাধারণ মানুষ জেনোসাইডের শহিদদের স্মরণে নানা কর্মসূচি পালন করে থাকেন। দেশেই রাষ্ট্রীয়ভাবে যে দিবসের স্বীকৃতি নেই, বিশ্বব্যাপী হবে কীভাবে? হয়ওনি। ফলে ২৫ মার্চ নয়, ৯ ডিসেম্বরকেই বেছে নেয় জাতিসংঘ। এর ফলে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমরা ২৫ মার্চের জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ের সুযোগ হারাই। এটা নিশ্চিতভাবেই আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা।

আশার কথা, একাত্তরের নয় মাসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের পথ এখনই বন্ধ হচ্ছে না আমাদের। আর্মেনিয়া, রুয়ান্ডা ও যুগোস্লাভিয়ার জেনোসাইডের জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আদালতের স্বীকৃতি আছে। আর্মেনিয়ানদের এজন্যে শত বছর চেষ্টা ও অপেক্ষা করতে হয়েছে। আমাদের অপেক্ষা করতে আপত্তি নেই, কিন্তু এজন্যে রাষ্ট্রীয় চেষ্টা-তদবির তো থাকতে হবে! এটা কতখানি রয়েছে, এ নিয়ে আশ্বস্ত হওয়া যাচ্ছে না এখনও।

একাত্তরের নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এবং আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত বিজয় আমাদের গৌরবের স্মারক। এই গৌরবকে উঁচুতে তোলে ধরতে আমাদের ওপর চালিত পাকিস্তানিদের জেনোসাইডকে অস্বীকার কিংবা অবমূল্যায়ন করা যাবে না। গৌরবের যে অর্জন, তার সঙ্গে জড়িয়ে যতখানি রক্ত আর সম্ভ্রম তার স্বীকৃতি দরকার; রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে!

কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক।

বয়স্কদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমে যাওয়ার কারণ ও পুনরুদ্ধারের উপায়



মো. বজলুর রশিদ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন একটি নির্দিষ্ট সমাজের সাংস্কৃতিক প্রতীক এবং সামাজিক নিয়ম দ্বারা বোঝা যায়। বিভিন্ন সমাজ প্রায়শই বয়স্ক ব্যক্তিদের তাদের বয়স এবং জীবনের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে আচরণ সংক্রান্ত নিয়ম এবং প্রত্যাশা স্থাপন করে।

অনেক সমাজের বয়স-ভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাস রয়েছে যা ব্যক্তিদের বয়সের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ভূমিকা, অধিকার এবং দায়িত্ব প্রদান করে। বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রায়ই বিশেষ মর্যাদা এবং কর্তৃত্ব দেওয়া হয়, কারণ তারা সময়ের সাথে সাথে জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে বলে দেখা হয়।

প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধাকে আন্তঃপ্রজন্মীয় সংহতির প্রকাশ হিসেবেও দেখা যেতে পারে, যেখানে তরুণ প্রজন্ম বয়স্ক ব্যক্তিদের অবদানকে স্বীকার করে এবং মূল্য দেয়। এই সংহতির অনুভূতি সামাজিক সংহতিকে শক্তিশালী করে এবং একটি সম্প্রদায়ের মধ্যে ধারাবাহিকতা এবং স্থিতিশীলতার ধারণা জাগায়।

প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধার ধারণা বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং সমাজে পরিবর্তিত হতে পারে। কিছু সংস্কৃতি ধার্মিকতা, পিতামাতা এবং গুরুজনদের প্রতি দৃঢ় শ্রদ্ধা এবং আনুগত্যের ওপর জোর দেয়। অন্যান্য সংস্কৃতিতে বয়স্ক ব্যক্তিদের কাছ থেকে পরামর্শ এবং নির্দেশনা চাওয়ার মাধ্যমে বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের জড়িত করে সম্মান প্রকাশ করে থাকে।

এটি লক্ষ্য করা গুরুত্বপূর্ণ যে বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা সময়ের সাথে পরিবর্তিত হতে পারে। শিল্পায়ন, নগরায়ন, বিশ্বায়ন এবং পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তন, আন্তঃপ্রজন্মীয় সম্পর্কের গতিশীলতা, ইত্যাদি প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধার প্রকাশকে প্রভাবিত করতে পারে।

যদিও প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা সাধারণত একটি ইতিবাচক সামাজিক মূল্য হিসেবে বিবেচিত হয়, তবে এটি স্বীকার করা অপরিহার্য যে ক্ষমতার গতিশীলতা, আর্থিক অসমতা এবং সাংস্কৃতিক পক্ষপাতগুলি এই দৃষ্টিকোণকে প্রভাবিত করতে পারে। সমাজবিজ্ঞানীরা এই বিষয়গুলি অধ্যয়ন করেন এবং নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা কীভাবে প্রকাশ পায় তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকেন।

বিভিন্ন সময় বলা হয়ে থাকে যে আমাদের দেশে প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশে বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ কমে যাওয়ার পেছনে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক কারণকে দায়ী করা যেতে পারে। অন্যান্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও সাম্প্রতিক দশকে দ্রুত আধুনিকায়ন ও পশ্চিমাকরণ হয়েছে। এই পরিবর্তনগুলি প্রবীণদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিসহ প্রথাগত মূল্যবোধ এবং নিয়মের পরিবর্তন ঘটাতে সহায়ক হয়েছে। পশ্চিমা সাংস্কৃতিক প্রভাব, যা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ এবং যুব-কেন্দ্রিক মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার দেয় তা প্রবীণদের সম্মান করার অনুভূত গুরুত্ব হ্রাসে অবদান রাখতে পারে।

ঐতিহ্যবাহী বর্ধিত পারিবারিক কাঠামো যেখানে বেশ কয়েকটি প্রজন্ম একসাথে বসবাস করে এবং যেখানে প্রবীণরা অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল- এই ধরনের পরিবারের বিলুপ্তি তাদের মধ্যে দৈনন্দিন মিথস্ক্রিয়া হ্রাস করতে পারে, সম্ভাব্য আন্তঃপ্রজন্মের বন্ধন এবং সম্মানের সুযোগগুলি হ্রাস করতে পারে। একক পরিবারে বাবা-মা ছাড়া শিশুরা আর কোনো সদসস্যের সংস্পর্শে আসতে পারেনা। এ কারণে তাদের মধ্যে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ বৃদ্ধি পায় এবং সমাজের অন্যান্য প্রবীণ সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ শেখার জায়গা সংকুচিত হয়।

দ্রুত নগরায়ন এবং বিশ্বায়ন জীবনধারা এবং সামাজিক মিথস্ক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে। শহুরে এলাকায় প্রায়ই একটি দ্রুতগতির, প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ থাকে যা প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধার ঐতিহ্যগত মূল্যবোধের চেয়ে ব্যক্তিগত সাফল্য এবং অর্জনকে অগ্রাধিকার দিতে পারে।

অর্থনৈতিক চাপ এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতাও আন্তঃপ্রজন্মের সম্পর্ককে প্রভাবিত করতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে, পরিবারের অল্পবয়সী সদস্যরা বড়দের যত্ন এবং সমর্থনের চেয়ে তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিতে পারে, যার ফলে প্রবীণদের সম্মান করার অনুভূত গুরুত্ব হ্রাস পায়।

শিক্ষার বর্ধিত প্রবেশাধিকার এবং বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঐতিহ্যগত বিশ্বাস এবং মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। প্রযুক্তির কল্যাণে বিভিন্ন ধারণা এবং দর্শনের সংস্পর্শে আসা তরুণ প্রজন্ম প্রবীণদের সম্মান করাসহ প্রচলিত নিয়মগুলিকে প্রশ্ন বা চ্যালেঞ্জ করতে পারে।

এটি লক্ষ করা গুরুত্বপূর্ণ যে যদিও কিছু দিক থেকে প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা হ্রাস পেতে পারে, বাংলাদেশে অনেক ব্যক্তি এবং সম্প্রদায় এখনও তাদের প্রবীণদের সম্মান করার গুরুত্বকে মূল্য দেয় এবং অগ্রাধিকার দেয়। সামাজিক পরিবর্তনগুলি জটিল এবং বহুমুখী এবং এই ঘটনাটি ব্যাপকভাবে বোঝার জন্য বাংলাদেশি সমাজের মধ্যে নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বিবেচনা করা অপরিহার্য।

বাংলাদেশে বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রতি সম্মান প্রর্দশনের বিষয়টি পুনরুদ্ধারের জন্য একটি বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন যাতে ব্যক্তি, পরিবার, সম্প্রদায় এবং সরকারসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার জড়িত থাকবে। এখানে কিছু কৌশল রয়েছে যা প্রবীণদের প্রতি সম্মান বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে।

প্রবীণদের সম্মান করার মূল্য এবং গুরুত্ব তুলে ধরে শিক্ষা এবং সচেতনতামূলক প্রচারনা চালানো। এটি সরকারি ঘোষণা, স্কুল পাঠ্যক্রম, কমিউনিটি প্রোগ্রাম এবং গণমাধ্যমের মাধ্যমে করা যেতে পারে। লক্ষ্য হল বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রতি সন্মানবোধ জানানোর উপলব্ধির অনুভূতি জাগানো।

আন্তঃপ্রজন্মমূলক প্রোগ্রাম এবং ক্রিয়াকলাপগুলিকে উৎসাহিত করা যা তরুণ এবং বয়স্ক প্রজন্মকে একত্রিত করে। যেখানে মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম, সম্প্রদায় পরিষেবা উদ্যোগ, বা সাংস্কৃতিক বিনিময় অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। এই প্রোগ্রামগুলি তরুণ প্রজন্মের প্রবীণদের কাছ থেকে শিখতে এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বোঝাপড়া বিকাশের অনুমতি দেয়।

পরিবার এবং সম্প্রদায়কে প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে উৎসাহিত করা। এটি আন্তঃপ্রজন্মগত সম্পর্কের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে, প্রজন্মের মধ্যে যোগাযোগের প্রচার এবং সক্রিয় শ্রবণ এবং পরিবার ও সম্প্রদায়ের মধ্যে বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য সহায়তা ব্যবস্থা প্রদান করে অর্জন করা যেতে পারে।

বয়স্ক ব্যক্তিদের অধিকার এবং কল্যাণ রক্ষা করে এমন নীতি এবং আইন তৈরি করা। এতে বয়স্কদের সামাজিক নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্যসেবা বিধান এবং আন্তঃপ্রজন্মমূলক কর্মসূচির জন্য সমর্থন অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। একটি ব্যাপক আইনি কাঠামো এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে যা বয়স্ক ব্যক্তিদের মূল্যায়ন করে এবং সম্মান করে।

প্রবীণদের অবদান এবং জ্ঞানকে তুলে ধরে সাংস্কৃতিক উদযাপন এবং ঐতিহ্যের প্রচার করা। এতে উৎসব, গল্প বলার সেশন এবং স্বীকৃতি অনুষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। বয়স্ক ব্যক্তিদের সাংস্কৃতিক তাৎপর্য প্রদর্শন করা তাদের মূল্যবোধকে শক্তিশালী করে এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ায়।

বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য পর্যাপ্ত সামাজিক পরিষেবা, স্বাস্থ্যসেবা এবং সহায়তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এতে স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা, প্রবীণ-বান্ধব অবকাঠামো, এবং তাদের প্রয়োজনগুলিকে সমাধান করার জন্য সামাজিক কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। বয়স্ক ব্যক্তিদের ব্যবহারিক চাহিদা পূরণ করা ও তাদের প্রতি যত্ন ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করার জন্য সকলকে উৎসাহিত করা।

গণমাধ্যমে বয়স্ক ব্যক্তিদের ইতিবাচক এবং সম্মানজনক প্রতিনিধিত্বকে উৎসাহিত করা। গণমাধ্যম সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং উপলব্ধি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গণমাধ্যমে এমন সব বিষয় প্রচার করা যা বয়স্ক ব্যক্তিদের সমাজে মূল্যবান অবদানকারী হিসাবে চিত্রিত করে এবং নেতিবাচক ধারণাগুলিকে চ্যালেঞ্জ করে।

এটি লক্ষ করা গুরুত্বপূর্ণ যে বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রতি সম্মান পুনরুদ্ধার করা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া যার জন্য সমাজের সকল সদস্যের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। বয়স্ক ব্যক্তিদের জ্ঞান এবং অবদানকে মূল্যায়ন করে এবং সম্মান করে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করার জন্য সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, সাংস্কৃতিক অনুশীলন এবং নীতির পরিবর্তন প্রয়োজন।

মো. বজলুর রশিদ: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।

;

দারিদ্র্যসূচক কমেছে ভিখারি কমেনি



প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিসিএস)-এর এক জরিপ রিপোর্টে বলা হয়েছে দেশে দারিদ্র কমেছে, শিক্ষার হার বেড়েছে, দেশের সার্বিক উন্নয়নসূচকের অনেকটা অগ্রগতি লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে।

গত ১৭ এপ্রিল ২০২৩ বিবিএস-এর বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল ষ্টাটিস্টিকস-২০২১ এর ফল প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছয়মাস কমেছে। পুরুষের গড় আয়ু ৭০.৬ এবং নারীর গড় আয়ু ৭৪.৪ বছর। এই প্রথম বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু কমলো।

আরেক সংবাদে বলা হয়েছে, সরকারী চাকরী করেন মিরপুরের এমন একজন বাসিন্দা জীবনে প্রথমবার মেট্রোরেলে উঠে ‘উন্নয়ন অনুভব করা যাচ্ছে’ বলে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। বিষয়গুলো বিভিন্ন সংবাদে জেনে খুব খুশি লাগে।

কিন্তু একই টিভিতে আরেক সংবাদে যখন একজন ভিখারি আক্ষেপ করেন যে আগে রেল স্টেশনে ভিক্ষা করতাম, ট্রেনে চড়ে হাত পাতলেই ভিক্ষা পেতাম এখন সেই উপায় নেই। আগে ইন্টারসিটি ট্রেনে চড়ে ঈদের সময় ভিক্ষা করতে করতে বাড়ি চলে যেতাম। এখন সে উপায় নেই। লোকাল ট্রেনে এত মানুষ যে ভেতরে ঢোকা যায় না। কোনরকমে উঠতে পারলে ভিক্ষার জন্য এদিক সেদিক নড়াচড়া করার উপায় নেই। আগের মতো আমার আয়-রোজগার নাই। বাসা-বাড়িতে ভিক্ষার জন্য গেলে ভেতরে ঢোকার উপায় নাই। দারোয়ান তাড়িয়ে দেয় অথবা তালাচাবি দেখে ফিরে আসতে হয়। দোকানে ভিক্ষার জন্য হাত পাতলে একটা খুচরা পয়সা দেয়। সারাদিন যা পাই তা দিয়ে জীবন চালানো দায়।

আধুনিক যুগে যাদের স্থায়ী আয় আছে, সঞ্চয় আছে এবং ব্যাংক ঋণ পাবার যোগ্যতা আছে তারা বেশি বেশি উঁচু বাড়ি বানাচ্ছেন বা কিনছেন। সেগুলো ভাড়া দিচ্ছেন নতুবা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করছেন। তাপর সেগুলোতে নিরাপত্তার জন্য সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগ দিয়ে তাদের হাতে একবোঝা চাবিসহ নতুন মডেলের তালা কিনে দিয়ে স্বস্থি খুঁজে পাচ্ছেন। সুসজ্জিত গেইট, ডিজিটাল তালাচাবি, সিসি ক্যামেরা, কুকুর, দারোয়ান ইত্যাদি মিলে ভিখারি তাড়ানোর মহোৎসব গড়ে উঠেছে বহুতল ভবনের শহুরে মানুষদের জীবনে। এটাই এখন বিত্তশালীদের বৈভব পাহারা দেয়া সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ।

অর্থ্যাৎ, যাদের স্থায়ী আয় করার যোগ্যতা আছে তাদের নিকট উন্নয়ন অনুভবটা সুখকর। কিন্তু যারা ভাসমান, ভিখারি, বেকার অথবা উচ্চশিক্ষিত হয়েও বহুবছর ধরে একটি চাকুরীর জন্য পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তাদের প্রকৃত অবস্থা নিয়ে কোন ভাবনার অবকাশ নেই তাদের মধ্যে।

অথচ, এরা ধনাঢ্য পরিবার যাদের ৯৯% মুসলমান। যারা এতসব নিরাপত্তার আয়োজন সম্পন্ন করে আকাশচুম্বি অট্টালিকা, বাগানবাড়ি, সুইমিংপুল, হাল-ফ্যশনের বিলাসবহুল গাড়ি, দেশে বিদেশে বিপুল অঙ্কের অর্থ লগ্নি ও সঞ্চয় নিয়ে কালাতিপাত করেছেন তারা ঈমানদার দাবী করেন। তাদের অনেকে নিয়মিত নামায আদায় করেন রোজা রাখেন, আরো নানা ইবাদত করেন। কিন্তু মিসকিনকে দান-খয়রাত ও সঠিকভাবে সরকারী কর প্রদানের বেলায় দারুণ কিপ্টেমি করতে দ্বিধা করেন না। অথচ. তারা ‘সাচ্চা মুসলিম’ অভিধায় নিজেকে শুনতে বেশ ভালবাসেন।

এসব বিত্তশালীদের সীমাহীন আয় ও পথে ঘুর বেড়ানো ভিখারির আয় সম্মিলন করে গড় করে গোটা দেশের মাথাপিছু আয় নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। তাই অর্থনীতিবিদগণ অনেকেই কোন অসম আয়ের দেশের দেশের জনগণের মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধিকে শুভঙ্করের ফাঁকি ও এক ধরণের প্রতারণা বলে মনে করেন।

তাই এসব দেশের দামী মার্কেটের কেনাকাটা বা অভিজাত রেষ্টুরেন্টের আলো-আঁধারিতে বসে বঙ্গবাজরের টিনশেডের সামান্য জায়গায় হাজার হাজার ঘুপচি দোকানঘর পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাবার পর প্রকৃত দোকানদারদের সংখ্যার তালিকা ও দাবীর সংগে হিসেব মিলাতে হিমশিম খেতে হয়। কারণ, দরিদ্র, অতিদরিদ্র, হকার, টোকাই, দিনমজুর, উন্মাদ, ভাসমান পতিতা, পথশিশু, ভিখারি ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর সঠিক হিসেবে বড় গড়মিল লক্ষ্যণীয়।

আরেকটি বিশেষ বিষয় হলো মুসলমানদের জন্য যাকাত প্রদানের বাধ্যবাধকতাকে উপেক্ষা করা। অনেক মুসলিম যাকাত প্রদানের বেলায় বেশ উদাসীন। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই ধনীদের সম্পদে দরিদ্রদের অধিকার রয়েছে।’

রাজা রেখে যেমন দেহ-মনকে পবিত্র করা হয়, যাকাত দিয়ে তেমনি সম্পদকে পবিত্র করা হয়। মহাগ্রন্থ পবিত্র আল-কোরআনে বলা হয়েছে-“ অবশ্যই সফলকাম হয়েছে মুমিনগণ, যারা নিজেদের নামাজে বিনয়-নম্র হয়েছে, যারা অনর্থক (অন্যায়) কাজ থেকে বিরত হয়েছে, আর যারা যাকাত দানে সক্রিয় হয়েছে”(সুরা মুমিনুন, ১-৪)। অন্যত্র বলা হয়েছে- “ আর যারা সোনা ও রূপা জমা করে রাখে এবং সেগুলো আল্লাহর পথে খরচ করে না, তাদেরকে মর্মন্তÍদ শাস্তির সংবাদ দিন”(সুরা তওবা ৩৪ আয়াতংশ)।

সূরা আদ্ব দোহায় বলা হয়েছে, ‘ওয়া আম্মাচ্ছায়েলা ফালা তানহার’অর্থ্যাৎ, ‘ভিখারিকে ধমক দিও না।’ (সূরা ৯৩: আয়াত ৯)। সূরা আল হুমাজাহ্-য় বলা হয়েছে- ‘আল্লাজি জামাআমালাওঁ ওয়াদ্দাদাহ্’ দুর্ভাগ্য এমন সেই ব্যক্তিদের জন্য, ‘যারা সম্পদ জমা করে ও বার বার গণনা করে। (সূরা ১০৪: আয়াত ২)।’

অনেকে দোজখের আগুনের লেলিহান শিখা থেকে বাঁচার জন্য পবিত্র রমজানের রোজা রাখে। অথচ, অনেক মুসলমান ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই ঘুস, দুর্নীতি ও সুদের মধ্যে বাঁচতে ভালবাসে। তাদের দুয়ারে তৃষ্ণার্ত ভূখা-নাঙ্গা ভিখারি বা সাহয্যপ্রার্থী দেখলেই রেগে উঠে, তাড়িয়ে দেয়। অচিরেই লেলিহান শিখাযুক্ত আগুনের করাল গ্রাসের কথা সেসব সম্পদ জমাকারীদের মধ্যে কোন বোধদয় জাগ্রত করে না।

একদিকে ধর্মীয় দিকে বিরাট ফাঁকি, অন্যদিকে তথ্যবিভ্রাট ও প্রকাশিত তথ্যের পরিসাংখ্যিক ও বৈজ্ঞানিক দুর্বলতা আমাদের দেশের গবেষণার জন্য একটি বড় লুপহোল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিসিএস)-এর জরিপের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে সন্তুষ্ট নয় সরকারী-সেরকারী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান । তাদের অভিযোগ চাহিদামতো বিবিএস-এর তথ্য পাওয়া যায় না। তারপরও বিভিন্ন সূত্রে যা পাওয়া যায় সেসব প্রদত্ত তথ্যের উপর অস্তুষ্ট ৫৯% উত্তরদাতা।

পরিকল্পনা উপমন্ত্রী বলেছেন, “তাঁর প্রশ্ন, উত্তরদাতার সংখ্যা নির্বাচন নিয়ে। তিনি বলেন, ভুটানের মতো সাড়ে সাত লাখ জনগোষ্ঠীর দেশে এই ধরনের জরিপে উত্তরদাতার সংখ্যা ৯৬০। বাংলাদেশ সাড়ে ১৭ কোটি জনগোষ্ঠীর দেশ হয়েও উত্তরদাতা নেওয়া হয়েছে মাত্র ৬০৯ জন। এর ব্যাখ্যা আমরা কীভাবে দেব?”

তাঁর এই প্রশ্ন তোলার প্রেক্ষাপটে বিবিএসের মহাপরিচালক মহোদয় বলেন, ‘মাননীয় মন্ত্রী ঠিকই বলেছেন। মূল প্রশ্ন হলো, এই স্যাম্পল সাইজ পুরো জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে কি না। যদি পেশাভিত্তিক সংখ্যা পাওয়া যেত, তাহলে অংশগ্রহণভিত্তিক স্যাম্পল পাওয়া যেত। ভবিষ্যতে এসব ঠিকঠাক করে জরিপ করা হবে। প্রথমবার বলে ভুলত্রুটি রয়ে গেছে।’

বিবিএস-এর জরিপ অনুযায়ী, ‘উত্তরদাতাদের সবচেয়ে বেশি অসন্তুষ্ট জাতীয় আয় শাখার তথ্য-উপাত্ত নিয়ে। আলোচিত পাঁচটি অসন্তুষ্টির সব কটিতেই অর্ধেক উত্তরদাতা এই শাখার তথ্য–উপাত্তে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। বৈদেশিক বাণিজ্যসংক্রান্ত পরিসংখ্যান তথা তথ্য–উপাত্ত নিয়ে অর্ধেক উত্তরদাতা সন্তুষ্ট নন। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের তথ্য–উপাত্তেও একই অবস্থা।’

অর্থ্যাৎ, বিবিএস-এর এই জরিপের তথ্য নিয়ে গণমানুষের চুলচেরা বিশ্লেষণের পূবেই কর্তৃপক্ষ নিজেরাই দোদূল্যমানতা প্রকাশ করেছেন। সমসাময়িক দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হারানো, বেকারত্ম, ভিক্ষুকদের বিপুলসংখ্যায় দ্বারে দ্বারে ঘুরে হাত পাতা ইত্যাদি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যা বলা যায় বাস্তবতা ও বিবিএস প্রকাশিত সেমিনারে কর্তৃপক্ষের জরিপ ফলাফলের তথ্যের মধ্যে অনেক ফাঁরাক।

এছাড়া গবেষণার জন্য যাচিত হলে পর্যাপ্ত তথ্য-–উপাত্ত দেওয়া হয় না; তথ্য-–উপাত্ত পুরোনো; প্রয়োজনীয় তথ্য থাকে না; আরও তথ্যের প্রয়োজন, তথ্যের উপস্থাপনা ব্যবহারযোগ্য নয় ইত্যাদি নানা অভিযোগ তো আছেই।
জনগণ সেটাই দেখেন, যা সংবাদ হয়ে প্রতিদিন তাদের চোখের সামনে ভেসে আসে। তার সাথে দরজার সামনে, রাস্তায়, বাজারে বা বাস্তবে কি পরিমাণ মিল বা অমিল সেটার সাথে জনগন তুলনা করেন।

অন্যান্য যা কিছু অর্জন থাক না কেন, বাজার দরের ক্রমাগত উল্লম্ফন ও ক্রয়ক্ষমতা হারানোর হতাশা এবং দান, ভিক্ষা, সাহায্য ইত্যাদি প্রাপ্তির আশায় অগণিত দরিদ্র, অসহায় ভিখারিদের সারিবদ্ধ চলাফেরা, মলিন চেহারার দলবল নিয়ে দরজায় কড়া নাড়া ইত্যাদির মধ্যে বিস্তর শুভঙ্করের ফাঁকি বিদ্যমান। তাই দারিদ্রসূচক খাতা-কলমে কমে গেছে কিন্তু বাস্তবতায় কবে কমবে সেটা সেমিনারে আশ্বাস দিতে পারলে হয়তো সেগুলোও আজকের লেখায় ফুটে ওঠানো যেত। কিন্তু সেটা সুদূর পরাহত মনে হচ্ছে। উন্নয়ন হলে বৈষম্য বাড়ে-এটা ভ্রান্ত ধারণা। কারণ, সুষম উন্নয়ন হলে মানুষে-মানুষে আয় ব্যয়ের বৈষম্য বাড়ে না। সামান্য যে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে তাতে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষ সুবিধা বঞ্চিত হচ্ছে।

সুতরাং বাস্তবতার নিরীখে বলা যায়, দারিদ্র্যসূচক কমেছে কিন্তু ভিখারি কমেনি বরং বেড়েছে।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

 

;

কাদের স্বার্থে, মদতে শান্তি ও সম্প্রীতির পাহাড়ে চলছে সন্ত্রাসবাদ?



আবুল খায়ের মোহাম্মদ
কাদের স্বার্থে, মদতে শান্তি ও সম্প্রীতির পাহাড়ে চলছে সন্ত্রাসবাদ?

কাদের স্বার্থে, মদতে শান্তি ও সম্প্রীতির পাহাড়ে চলছে সন্ত্রাসবাদ?

  • Font increase
  • Font Decrease

দুই যুগ আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে হানাহানির অন্ধকার অধ্যায়ের অবসান হয়ে এসেছিল শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের নতুন ভোর। তারপর আলোকোজ্জ্বল হয়েছে পশ্চাৎপদ পার্বত্যাঞ্চল। নবজীবনের স্বাদ পেয়েছে পাহাড়ে বসবাসকারী উপজাতি ও বাঙালি জনগোষ্ঠী।

কিন্তু অকস্মাৎ বান্দরবানের গহীনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাদের স্বার্থে, কাদের মদদে শুরু হলো সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের নাশকতা? অভিজ্ঞরা বলেন যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম হলো লাভজনক সন্ত্রাসবাদের ‘দোকান’। সেখানে সন্ত্রাসের নতুন সংজ্ঞার নাম 'পাহাড় দখল'। তারপর আন্তর্জাতিক মাফিয়া গোষ্ঠীর মদতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আফিম ও গাঁজার চাষ। দেশের হেরোইন রাজধানী হয়ে উঠেছে ভারত ও মায়ানমারের সীমান্তরেখা।

আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিক তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশের অপর পার্শ্বের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো মাদক তৈরির কারখানা, মানুষ ফসলের চাষবাস বন্ধ করে আফিম চাষ করছেন। মায়ানমার-চট্টগ্রাম সীমান্ত জুড়ে মাদক তৈরি সংগঠিত ‘শিল্প’, যা কুকিদের ব্যবহার করে তা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। মায়ানমার ও মিজ়োরাম থেকে কুকিরা নাগাড়ে ঢুকছেন মাদক আর অস্ত্র নিয়ে। আফিম চাষের পাশাপাশি উন্নত আগ্নেয়াস্ত্র দিয়েও মদত দিচ্ছে,সীমান্তের ও-পারের এজেন্টরা। যার ফলে নিরাপত্তার ক্ষতি হচ্ছে শান্ত পাহাড়ের এবং বিশেষভাবে বান্দরবানের।

সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সঠিক চিত্র পেতে তাকানো দরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে। বাংলাদেশের আয়তনের প্রায় এক দশমাংশ এলাকা নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম। এই এলাকাটি বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে ভিন্ন প্রকৃতির। এখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপজাতি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতি, ভাষাগত বৈচিত্র, তাদের বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, প্রথাগত রীতিনীতি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি খ্যাত সাজেক পর্যটন এলাকা, আলুটিলা, রাঙামাটি ঝুলন্ত ব্রীজ, বান্দরবান এর নীলগিরি, বগালেক ও তাজিংডং পাহাড় এর মত উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান এই অঞ্চলেই অবস্থিত বিধায় এই এলাকাটি বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত।

আরও পড়ুন: বান্দরবানে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের উত্থান নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ

শান্তিচুক্তির পরবর্তী সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থিতিশীলতা রক্ষার পাশাপাশি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা এই অঞ্চলের আপামর জনসাধারণের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, খাদ্য সমস্যা, মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত স্থানীয় ব্যক্তিবর্গদের চিকিৎসা সেবা, দরিদ্র ব্যক্তিবর্গদের আর্থিক অনুদান প্রদান করে স্বাবলম্বী হতে সহযোগিতা করা, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা, দুর্গম এলাকায় পানির সমস্যায় জর্জরিত স্থানীয়দের কষ্ট লাঘবে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা এবং বেকার ব্যক্তিবর্গের কর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্র কারখানা স্থাপন করে আসছে।

এছাড়া তিন পার্বত্য জেলার অরক্ষিত সীমান্ত এলাকাকে নজরদারির আওতায় আনতে বাংলাদেশ সরকারের আহবানে সাড়া দিয়ে দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল ও উপজাতি সন্ত্রাসীদের প্রতিকূল অবস্থান মোকাবেলা করে সীমান্ত সড়ক নির্মাণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিবেদিতপ্রাণ হয়ে দায়িত্বপালন করছে।

দেশমাতৃকার সেবায় নিয়োজিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড এবং শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় তাদের আত্মত্যাগের বিষয়টি আজ দেশে-বিদেশে প্রশংসিত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের আত্মত্যাগ ও কল্যাণকর কাজে ফলে পাহাড়ে বৃদ্ধি পেয়েছে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য। এজন্য সেনাবাহিনী কঠোর ত্যাগ স্বীকার করে চলছে। উদাহরণ স্বরূপ দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল খাগড়াছড়ি জেলার আলুটিলা পুনর্বাসন এলাকায় ১৬০টি পরিবারের ৪০০ জন ব্যক্তিবর্গ দীর্ঘদিন যাবৎ পানির সমস্যায় ভূগছিল। সেখানে ছিলনা কোন সুপেয় পানির উৎস। এই খবর জানার পরপরই ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে খাগড়াছড়ি রিজিয়নের উদ্যোগে সেনাবাহিনী কর্তৃক ১০ হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি পানির ট্যাংক স্থাপন করা হয়। যা ৫০০ মিটার গভীর হতে মোটর এর মাধ্যমে পানি সংগ্রহ করতঃ উক্ত পানির ট্যাংকে সংরক্ষিত হয় এবং সেখান থেকে স্থানীয়রা সুপেয় পানি সংগ্রহ করে। সেখানে এই প্রকল্প চালুর পর স্থানীয় জনগোষ্ঠীর পানির সমস্যা সমাধান হওয়ায় সেনাবাহিনীর অনন্য ভূমিকায় আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন।

অতি সম্প্রতি খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার গোলাবাড়ী ইউনিয়নের জংলীটিলা এলাকায় স্থানীয় পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের পানির সমস্যা সমাধানে মহালছড়ি সেনা জোনের মাধ্যমে একটি সুপেয় পানির হাউজ নির্মাণ করা হয়। এতে ঐ এলাকার স্থানীয় জনগণ সেনাবাহিনীর মানবিক দায়িত্ব পালনে অত্যন্ত আনন্দিত ও গর্ববোধ করছে।

পাহাড়ের অসুস্থ মানুষকে হাসপাতালে দ্রুত পৌঁছে দেন তারা। যে কোনো দুর্যোগে পাহাড়ি মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায় তাদের। না এখানেই শেষ নয়, বেকার যুবকদের জন্য ব্যবস্থা করছেন কর্মসংস্থানের। রাত হলে উপজাতি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর কারণে ঘুমাতে পারেন না পাহাড়ি-বাঙালিরা। তাদের শান্তিতে ঘুমোনোর ব্যবস্থাও করছেন এই বাহিনীর প্রতিটি সদস্য।

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন পাহাড়ি অঞ্চল- খাগড়াছড়ি, বান্দরবন এবং রাঙামাটিতে সেনাবাহিনীর মানুষের পাশে থাকার কথা সর্বজনবিদিত। সামাজিক উন্নয়নে এই বাহিনীর ভূমিকা যেমন এখন দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশংসিত, তেমনি আস্থা অর্জন এবং সম্প্রীতি বজায়ে তিন পাহাড়ের সব ধর্মের মানুষের কাছে সেনাবাহিনী একটি নির্ভরতার প্রতীক। পার্বত্য চট্টগ্রামে সাধারণ মানুষের প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর পাশে দাঁড়ানোর বিষয়টি এখন একটি নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা।

খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার হাজাপাড়া নামক দূর্গম পাহাড়ী এলাকায় মহামারি আকারে ডায়রিয়া আর অন্যান্য পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিলো কিছু দিন আগে। ঐ সময়ে বেশ কিছু পাহাড়ী যুবক, বৃদ্ধা ও শিশু গুরুত্বর অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর পাওয়ার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অতি দ্রুত সেখানে ছুটে গিয়ে দূর্গম পাহাড়ী পথে কয়েক ঘন্টা হেটে হাতিরমাথা অতিক্রম করে হাজাপাড়া এলাকায় পৌছায়, সেখানে অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প নির্মাণ করে ১৫০-১৬০ জন মহামারী আক্রান্ত রোগীদের পরম যত্নের সাথে চিকিৎসা সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলে। প্রখর রৌদ্র উপেক্ষা করে দূর্গম ঐ এলাকায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা দেশমাতৃকার সেবায় নিজেদের কষ্ট বিসর্জন দিয়ে বিভিন্ন প্রকার চিকিৎসা সেবা এবং জনস্বার্থমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল।

করোনায় যখন সারাদেশের মানুষ নিজের জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই খাগড়াছড়ি, বান্দরবন এবং রাঙামাটির দুর্গম অঞ্চলের মানুষকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সেনাবাহিনী। কেবল তাই নয়, করোনা ছাড়াও রাত-বিরাতে অনেক মানুষ হাসপাতালে যেতে পারেন না। তাদেরকে উদ্ধার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন এই বাহিনীর প্রতিটি চৌকষ সদস্য।

এই বাহিনীর আরও রয়েছে নানান ভূমিকা। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার পাশাপাশি তারা সেখানকার বসবাসরত লোকজনের জীবনমানোন্নয়নে ধারাবাহিকভাবে উন্নয়নমূলক প্রকল্প পরিচালনা করে আসছে।

পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত ৩ বছরে ২৪ পদাতিক ডিভিশনের আওতাধীন তিন পার্বত্য জেলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ৫০ হাজারের বেশি মানুষের ভেতর শীতবস্ত্র বিতরণ করেছে। এছাড়াও অন্তত এক লাখ মানুষের মাঝে বিভিন্ন প্রকার ত্রাণসামগ্রী বিতরণ ও ২০ হাজার জনকে বিভিন্ন আর্থিক অনুদান প্রদান করেছে। নিয়মিতভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে বিনামূল্যে চক্ষুশিবির।

এসব চক্ষুশিবিরে দুর্গম পার্বত্য এলাকার সুবিধাবঞ্চিত বয়োবৃদ্ধ পাহাড়ী ও বাঙালির চোখের ছানি অপারেশনসহ বিভিন্ন ধরনের চক্ষু সেবা প্রদান করা হয়।

ইতিপূর্বে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা, রাঙামাটির সাজেক ও বান্দরবানের বিভিন্ন এলাকায় হাম আক্রান্ত হয়ে বহু পাহাড়ী শিশু নিহত হবার ঘটেছে। এসব আক্রান্ত এলাকাগুলোতে নিজেদের জীবন বাজি রেখে সুপেয় পানি সরবরাহ, খাবার ব্যবস্থা, অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প করে অসুস্থদের চিকিৎসাসেবা পরিচালনা করে পাহাড়ে হাম আক্রান্ত পাহাড়ীদের জীবন বাঁচানোর মতো মানবিক কাজে সেনাবাহিনীর অবদানও কম নয়।

পাহাড়ে সশস্ত্র সন্ত্রাস দমন, শান্তি রক্ষায় সেনাবাহিনী রয়েছে বদ্ধপরিকর। বিভিন্ন সময়ে পাহাড়ের দূর্গম স্থানগুলোতে গর্ভবতী মুমূর্ষ নারীদের পাহাড়ী রাস্তায় কাঁঢ়ে করে এনে হেলিকপ্টার যোগে সিএমএইচ এ নিয়ে সন্তান প্রসবসহ সুস্থ করে তোলার নজিরও রয়েছে অহরহ।

দূর্গম পাহাড়ি এলাকায় ২০২০ সালে ভাল্লুকের আক্রমণে গুরুতর আহত মঙ্গলিয় মুরং (০৬) ও তার দাদা ইয়াংসাই (৪৮) কে আশংকাজনক অবস্থায় উদ্ধার করে চট্টগ্রাম সিএমএইচ এ নিয়ে চিকিৎসা সেবা ও এরপর ভাল্লুকের আক্রমনে আহত ত্রইল মুরং (৬৬) নামের আরো এক পাহাড়ীকে উদ্ধার করে হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রাম সিএমএইচ এ নিয়ে চিকিৎসা সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলার একমাত্র প্রসংশার দাবীদার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীই।

শিক্ষাবিস্তারে সেনাবাহিনী এর তত্ত্বাবধানে সর্বশেষ গত ৩ বছরে ২৫০টির বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাহাড়ে নির্মাণ করা হয়েছে। যেখান থেকে প্রচুর স্কুল শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে একধাপ এগিয়ে যাচ্ছে। এখানেই শেষ নয়। ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষায়ও এগিয়ে আছে সেনাবাহিনী। গত ৩ বছরে ২২০টির বেশি ধর্মীয় উপসনালয় গড়ে দিয়েছে তিন পাহাড়ি জেলায়। অবেহেলিত শিশুদের মানসিক বিকাশে তাদের রয়েছে সময়োপযুগী পদক্ষেপ। অনেক স্কুলে পড়ালেখার বই নেই। নেই উপকরণ। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিভিন্ন প্রকার শিক্ষা উপকরণ, ছাত্রছাত্রীদের স্কুল ড্রেস ও খেলাধুলার সামগ্রী বিতরণ করে তারা মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

পার্বত্য অঞ্চলের অবহেলিত মানুষদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে সেনাবাহিনী নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিনামূল্যে কম্পিউটার ও সেলাই মেশিন বিতরণসহ ঐ বিষয়ে প্রশিক্ষণও প্রদান করছে তারা। এতে পিছিয়ে পড়া পাহাড়ী-বাঙালি নারীরা স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছে।

দুর্গম পার্বত্য এলাকার জনগণের সুষ্ঠু বিনোদনের জন্য সেনাবাহিনী প্রতিবছর নানা দিবসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। তাদের এসব কার্যক্রম মুক্তবুদ্ধি ও সাংস্কৃতিক চর্চাকে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পথে পরিচালিত করছে। যা ইতিবাচক বলে মত দিয়েছেন দেশের আপামর জনগণ।

একসময় ভীষণ অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম। ছিলনা শিক্ষার আলো। রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের বা গুরুত্বর অসুস্থ ও আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ছিলনা। এছাড়া তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়ী সন্ত্রাসী দলগুলোর পাল্টা-পাল্টি হামলা ও খুনোখুনির কারণে ভয় নেমে আসতো সেখানকার বসবাসরত সাধারণ মানুয়ের ভেতর। সময় গড়িয়ে এখন বদলে গেছে এই পাহাড়ী জনপদ। বঙ্গবন্ধু কন্যা ও বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার পাহাড়ের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে হাতে নিয়েছেন নানান পরিকল্পনা।

আর সেই পরিকল্পনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হাত ধরেই এগিয়ে যাচ্ছে খাগড়াছড়ি, বান্দরবন ও রাঙামাটি জেলায়। যার ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে গুইমারা সেনা রিজিয়নের উদ্যোগে গুইমারা রিজিয়নের পুরাতন কমান্ডার বাংলোতে একটি কম্বল ও ব্যাগ ফ্যাক্টরি উদ্বোধন করা হয়। এতে ঐ এলাকার স্থানীয় জনগণের ক্ষুদ্র কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ায় বেশ কিছু বাঙালি ও পাহাড়ী ব্যক্তিবর্গ শ্রমিক হিসাবে নিয়োগ লাভ করায় তাদের পারিবারিক ভরণপোষণ ক্ষমতা ও স্বচ্ছলতা বৃদ্দি পেয়েছে। অনেকেই ভাবেননি এসব অঞ্চলে পানি আসবে, থাকবেনা বিদ্যুৎ সমস্যা। দুর্গম পাহাড়ী পথে ঘটবে উন্নয়ন, প্রান্তিক চাষিগণ প্রত্যন্ত এলাকা হতে বিভিন্ন উৎপাদিত কৃষিপণ্য ও ফলফলাদি পরিবহণে সুবিধা প্রাপ্তি হয়ে নিজেদের অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়নে অবদান রাখবে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, দুর্গম পাহাড়ে এখন জ্বলছে বিদ্যুতের আলো। রাস্তা করা হয়েছে প্রশস্ত। কোথাও পাকা সড়ক। বেড়েছে কৃষিকাজ। বেড়েছে চাষাবাদ। পর্যটন খাতেও উন্নতির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সেখানে বাড়ছে বিনিয়োগ। তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এখন চলছে উন্নয়নযজ্ঞ।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য তিন জেলাতে যোগাযোগের উপযোগী রাস্তা ছিল ২ হাজার ৮০৩ কিলোমিটার, বর্তমানে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের তত্ত্বাবধানে নির্মিত সড়ক যোগাযোগের পরিধি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৯৪৯ কিলোমিটার।

শান্তিচুক্তির পূর্বে তিন জেলায় হাসপাতাল-ক্লিনিক ছিল মাত্র ২৪টি, এখন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও কমিউনিটি পর্যায়ে ক্লিনিক স্থাপিত হয়েছে ২৭০টির বেশি। যাত্রী ছাউনি ও ব্রীজ নির্মাণ করা হয়েছে ২০টি। সীমান্তসড়ক নির্মাণেও ভূমিকা রয়েছে তাদের। এর সবই সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধায়নে।

পাহাড়ি জনগোষ্ঠী এবং বাঙালিদের মাঝে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে সেনাবাহিনী নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকাগুলো ছিলো একসময় অরক্ষিত। বলা যায়, সন্ত্রাসী আর উগ্রবাদীদের অভয়ারণ্য। গোষ্ঠীগুলোর পরস্পরবিরোধী কার্যকলাপে প্রায়ই ঘটতো মৃত্যুর ঘটনা। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার প্রথমবার ক্ষমতায় আসে।

এরপরই সেখানে শান্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর। সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে কয়েক দফা সংলাপের পর অনুষ্ঠিত হয় পার্বত্য শান্তিচুক্তি। যা ইতিহাসে ঠাঁই করে নেয় সফলতার সঙ্গে।

এই চুক্তির পরপরই কমে আসে পাহাড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। স্থানীয় সূত্র মতে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশের বসবাস তিন পার্বত্য জেলায়। সেনাবাহিনী দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই যেন এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটেছে। তবে শান্তিচুক্তির পরও এখনও পাহাড়ে উগ্র উপজাতি গোষ্ঠী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে তৎপর রয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি চার ভাগ হয়ে এখন প্রতিদিনই ঘটাচ্ছে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। তবে সেনাবাহিনীর কারণে সেখানে অনেক কমে আসছে এই ধরণের ঘটনা।

পাহাড়ে অনেক স্থান ছিলো অনুন্নত। পায়ে হেঁটে যাওয়ার কথা তো ভাবাই যায় না। অথচ সেনাবাহিনীর সদস্যরা পার্বত্যাঞ্চলে দিনরাত পরিশ্রম করে রাতারাতি সেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটিয়েছেন।

পাহাড়ে শান্তিকামী মানুষকে প্রায়শই বিচলিত দেখা যায়। উপজাতি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। লুটপাট করে। পর্যটক অপহরণ করে নিয়ে যায়। চাঁদাবাজি তো আছেই। এসব অপকর্ম থেকে পাহাড়ের মানুষকে শান্তিতে রাখতে দিনরাত অতন্দ্র প্রহরী হয়ে কাজ করছে সেনাবাহিনীর সদস্যরা।

স্থানীয় সূত্রমতে, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি এবং বান্দরবানে একাধিক উপজাতি সন্ত্রাসী সংগঠন রয়েছে। যাদের হাতে জিম্মি রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েক লাখ মানুষ।

শান্তিচুক্তির পরবর্তী সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) এবং ইউনাইটেড পিপল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এবং ওয়ান এলিভেন সরকারের পর এ দুইটি সংগঠন থেকে আরও দুইটি উপজাতি সশস্ত্র সংগঠন সৃষ্টি হয়ে তারা বিভিন্ন নাশকতা ও সন্ত্রাসীমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার মাধ্যমে চাঁদাবাজি, অপহরণের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায়, হামলা ও পাল্টা হামলার মাধ্যমে নিজেদের এলাকার নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব বিস্তারে সক্রিয় রয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য সরকার কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে। অথচ এসব উপজাতিগোষ্ঠী সেখানে উন্নয়ন কাজে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও ইউনাইটেড পিপল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট নামক উপজাতি সংগঠন মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হচ্ছে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা যখনই কোন ঘটনা ঘটার খবর পাচ্ছেন, সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ছুটে যাচ্ছেন। তাদের কাছ থেকে নানা অভিযানে উদ্ধার করা হয়েছে রকেট লঞ্চার, ১৪-এমএম, এম-১৬, এসকে-৩২, সেনেভা-৮১, এম-৪ এবং এম-১ এর মতো ভয়াবহ অস্ত্র।

পার্বত্য এলাকা থেকে সেনাক্যাম্প অপসারণ না করার দাবি সেখানকার লাখো বাঙালির। এই দাবিতে একমত স্বয়ং পাহাড়িরাও। তারা বলেছেন, সেনাবাহিনীর তৎপরতার কারণে পাহাড়ের মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সুখী। কেননা পাহাড়ী-বাঙালি সবার জন্যই এই বাহিনীর সদস্যরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে।

একটি সূত্র জানায়, বিভিন্ন খাত থেকে বছরে এসব সন্ত্রাসী গ্রুপের আয় ৫০০ কোটি টাকার বেশি। খাগড়াছড়িতে গত ২০ বছরে এমন সংঘাতে ৭শ’র বেশি খুন হয়েছে। এছাড়া রাঙামাটিতে গত ৫ বছরে মারা গেছে অন্তত ৪৫ জন।

২০১৭ সালের জুন মাসের ১২ তারিখ সোমবার রাত ১৩ তারিখ মঙ্গলবার ভোরে অতিবৃষ্টির ফলে রাঙামাটির বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে, সেখানে ব্যাপক প্রানহানি ও ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এদিন জেলার মানিকছড়িতে পাহাড় ধসে মাটি ও গাছ পড়ে চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি মহাসড়ক বন্ধ হয়ে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে রাঙ্গামাটি জোন সদরের নির্দেশে মানিকছড়ি আর্মি ক্যাম্প থেকে সেনাবাহিনীর ১৬ জনের একটি দল ওই সড়কে চলাচল স্বাভাবিক করতে উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করে।

উদ্ধার কার্যক্রম চলাকালীন আনুমানিক বেলা ১১টায় পাশেই পাহাড়ের একটি বড় অংশ উদ্ধারকারীদলের সদস্যদের ওপর ধসে পড়ে। পাহাড় ধসের ফলে সেনবাহিনী সদস্যরা প্রায় ৩০ ফুট নিচে পড়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই মেজর মোহাম্মদ মাহফুজুল হক ও ক্যাপ্টেন মো. তানভীর সালাম শান্ত নিহত হয়েছেন। পরে এ ঘটনায় আরো ৩ সেনা সদস্যের লাশ উদ্ধার করা হয় এবং ১০ সেনা সদস্য গুরুতর আহত হন।

বাকি নিহতরা হলেন কর্পোরাল মোহাম্মদ আজিজুল হক ও সৈনিক মো. শাহিন আলম ও সৈনিক মোঃ আজিজুর রহমান। পাহাড় ধসে উদ্ধারের বিষয়ে হয়তো তাদের কোন প্রশিক্ষণ ছিল না, কিন্তু দেশের মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানোকে নিজেদের কর্তব্য মনে করেই ওরা সেদিন এগিয়ে গিয়েছিল।

এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফেরাতে এসে আজ অবধি বহু সেনা সদস্য মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া হয়ে, সাপের কামড়ে কিংবা বন্য জন্তুর আক্রমনে নিহত হয়েছেন। কেউ কেউ আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন।

দেশমাতৃকার সেবায় নিয়োজিত সেনাবাহিনীর বেশকিছু সদস্য পাহাড়ের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে সশস্ত্র আঞ্চলিক সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। বহু সেনা সদস্য আহত হয়েছেন।

সর্বোপরি, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় থেকে এ পর্যন্ত প্রতিনিয়ত সবসময়ে বাংলাদেশের মানুষ তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের আপদে/বিপদে সেনাবাহিনীর সদস্যদেরকে কোন না কোনভাবে নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে যেতে দেখা গেছে, এমন ঘটনা অসংখ্যবার ঘটেছে।

তারপরেও কাদের স্বার্থে, কাদের মদতে পাহাড়ে সন্ত্রাসবাদ চলছে? এই প্রশ্নে সঠিক উত্তর পাহাড়ে বসবাসকারী প্রতিটি মানুষকে জানতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে পাহাড়ে সন্ত্রাসবাদের নেপথ্য কারণ। এবং সম্মিলিতভাবে সন্ত্রাসের মূলোৎপাটন করে শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের পথে পার্বত্য চট্টগ্রামের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে আর সুদৃঢ় করতে হবে জাতীয় নিরাপত্তা।

আবুল খায়ের মোহাম্মদ, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম

;

আম পাড়ার দিনক্ষণে পরিপক্কতা নিয়ে প্রশ্ন



প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আমের নাম শুনেনি এমন মানুষ পৃথিবীতে বিরল। একটিও আমগাছ নেই সেসব দেশের বাজারেও আম কিনতে পাওয়া যায়। কারণ বিশ্বব্যাপী সুস্বাদু আমের চাহিদা রয়েছে এবং এজন্য আমকে ফলের রাজা বলা হয়। রাজাকে মানুষ চিনবে না জানবে না এমন সেটা কেমন কথা? মৌসুমী ফল আম গ্রীষ্মপ্রধান দেশে জন্মে। সাধারণত: শীত শেষ হবার সাথে সাথে আমের মুকুল বের হয় এবং তারপর তিন থেকে চার মাসের মধ্যে আম পেকে যায়। তবে আজকাল কৃষিতে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি প্রয়োগের ফলে সারা বছর আম উৎপাদন শুরু হয়েছে। তবে সেসব আমের গুণগত মান ও স্বাদ মৌসুমী আমের মতো হয় না।

আমাদের দেশে কাঁঠাল জাতীয় ফল হলেও আম প্রধান ফল। প্রতিবছর আমের মৌসুমকে ঘিরে আমচাষি ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে সরকারকে নানা নীতি-পরিকল্পনা নিতে দেখা যায়। আমের ভোক্তাদের জন্য সেসব নীতি গণমাধ্যমে আগেভাগে বেশ জোরেশোরে প্রচার করা হয়। এর মধ্যে আমের উৎপাদন বাড়ানো, যত্নসহকারে বাগানের পরিচর্যা, গাছে সময়মত স্প্রেকরা, হার্ভেষ্টিং, ফল সংরক্ষণ, ভেজালমুক্তভাবে বাজারজাত করণ, বিদেশে রফতানিকরণ ইত্যাদি।

ভাল জাত ও মানের আমের উৎপাদনের সাথে আমচাষি ও ব্যবসায়ীদের ভাল দাম ও বেশি মুনাফা জড়িত থাকায় আজকাল আম নিয়ে অনেক গবেষণা হচ্ছে। আমচাষ লাভজনক হওয়ায় অনেক কৃষক শস্যদানা আবাদ বাদ দিয়ে ফসলি জমিতে মৌসুমী ও বারোমাসী আম চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ওয়েজ আর্ণারের যুগে পদার্পণ করেও কৃষিকে অদ্যাবধি আমাদের জাতির মেরুদণ্ড বলা হয়। কিন্তু কৃষিজমির বেশিরভাগ মালিক শহরে বসবাস করে। বর্তমানে যাদের ৫-১০ বিঘা পৈত্রিক কৃষিজমি আছে ও সঙ্গে একটি চাকরি বা সহযোগী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে তারা যে কোন প্রয়োজন বা উছিলা দেখিয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরে বসতি গাড়েন। এই শ্রেণির মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা, মর্যাদা ও রাজনৈতিক সুবিধা লাভের আশায় তাদের সব কৃষিজমি ও ভিটেবাড়ি হাতছাড়া করতে চান না। এজন্য আমাদের দেশে প্রান্তিক কৃষক ও বর্গাচাষিদের সংখ্যা বেশি। শস্যদানার জমি প্রান্তিক কৃষকদের হাতে সহজে প্রদান করা হলেও আমের বাগানগুলো শহুরে মালিকরা বছরের শুরুতে আগেভাগেই ফঁড়িয়াদের নিকট বিক্রি করে দেন।

এই প্রবণতা দিন দিন বেড়ে চলেছে। আমাদের দেশে বর্তমানে আমবাগানের মালিকরা শহরে বসবাস করেন এবং তাদের নিযুক্ত পছন্দনীয় গরিব প্রান্তিক চাষিদের নিকট চুক্তি ভিত্তিতে সেসব জমি ও বাগান ইজারা দিয়ে থাকেন। এছাড়া মৌসুমী পড়িয়া ব্যবসায়ীরা ভিনজেলা থেকে এসে আমের মুকুল বের হবার আগেই বাগানগুলো চুক্তিভিত্তিক ইজারা নিয়ে আমের ব্যবসা পরিচালনা করেন।

খুব কম আমবাগান মালিক আছেন যারা গ্রামে থেকে নিজেরাই আমচাষ করেন। তাই যারা আম চাষ করে ও দিনরাত কষ্ট করে বাগান পাহারা দিয়ে থাকে প্রকৃতপক্ষে আমের লাভ তাদের হাতে যায় না। আমচাষি ও প্রকৃত আমের বাগানের মালিক ভিন্ন ভিন্ন জন। কার্যত: এভাবে আমের উৎপাদন ও বিপণনের লাভ মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের দখলে চলে যায়।

অপুষ্ট আম আগেভাগে পেড়ে ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে পাকিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে বাজারজাত করণ চলে। এসব আম পাকিয়ে ফরমালিন মেখে সংরক্ষণের মাধ্যমে অসময়ে দীর্ঘদিন বাজারে বিক্রি করা হয় । যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বিরাট হুমকিস্বরুপ। প্রতিবছর এসব ভেজাল আম চিহ্নিত করে বুলডোজার দিয়ে পিষে ধ্বংস করতে দেখা যায় এবং জরিমানা করা হয়। যেটা সবার জন্য দৃষ্টিকটু ব্যবসায়ীদের জন্য আর্থিকভাবে ক্ষতিকর। এসব প্রতারণা ও ক্ষতি ঠেকাতে সরকারিভাবে নির্দিষ্ট সময়ে আম পাড়ার জন্য ক্যালেন্ডার তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। একক জাতের আমের জন্য এককটি সময়সীমা বা লগ্ন নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। সর্বপ্রথম মে ৪ তারিখে গুটি আম ও সর্বশেষ আগস্টের ২০ তারিখে ইলামতি আম পাড়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতে পরিপক্ক ও সুমিষ্ট আম হাতে পেয়ে ভোক্তা অধিকার কিছুটা সংরক্ষিত হয়েছে বলে মনে করা হয়।

তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতির আচরণে অনেক বৈসাদৃশ্য শুরু হয়ে যাওয়ায় ক্যালেন্ডার অনুযায়ী আম পরিপক্ক হচ্ছে না। আম পাড়ার জন্য তৈরি ক্যালেন্ডারে এবছর প্রথমেই গড়মিল লক্ষ্য করা গেছে। যেমন, গুটি আম পাড়ার জন্য মে মাসের ৪ তারিখ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু রাজশাহী এলাকার গুটি আমে পরিপক্কতা আসেনি বিধায় আমচাষিরা কেউ গুটি আম পাড়েননি। অভিজাত আমের রাজধানী বলে খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমচাষিরা বলেছেন, আমাদের এলাকায় গাছে আম পাকা শুরু হলে তারপর আম নামানো হবে। তাই এবছর আম পাড়ার নির্দিষ্ট তারিখ নিয়ে বিপত্তি দেখা দিয়েছে।

অপরদিকে বর্তমান রংপুর, নওগাঁ, ঠাকুরগাঁও পার্বত্য চট্টগ্রামে এলাকায় হাঁড়িভাঙ্গা, আম্রপালি ও সূর্য্যাপুরি আম সুস্বাদু আমের বাজারে বিশাল জায়গা করে নিয়েছে। এগুলোর উৎপাদন, বিপপন ও ভোক্তা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু আম পাড়ার ক্যালেন্ডারে ক্রমবর্ধিষ্ণু এসব আমের উল্লেখ নেই বলে তারা কিছুটা হতাশ।

আমের মৌসুম শুরু হলেই কুরিয়ার সার্ভিসের ব্যবসা সরব হয়ে উঠে। অনেকে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবকে অভিজাত আম পাঠায়। কেউ কেউ নেতা-মন্ত্রী বা চাকরিস্থলের বড় বসকে খুশি করার জন্য কুরিয়ারে আম পাঠানোর আবদার মেটাতে গিয়ে হিমশিম খায়। কারণ, তাদেরকে ভাল জাতের আম ও পরিমাণে বেশি করে পাঠাতে হয়। এটা ঠিকমতো মেটাতে না পারলে অনেক সরকারি চাকরের প্রমোশন ও ভাল জায়গায় বদলি হয় না বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। আমের জেলাগুলোতে মানুষের আনাগোনা বাড়ে, বহু শ্রমিকদের কাজের সুযোগ তৈরি হয়, বাজারে গতি বাড়ে ও স্থানীয় ও জাতীয় অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠে। রাজশাহী এলাকায় প্রতিবছর ‘ম্যাঙ্গ ট্যুর’ গতিপ্রাপ্ত হয়।

করোনার সময় থেকে অনলাইনে আম কেনা-বেচার প্রবণতা শুরু হলেও বর্তমানে অনলাইনের মাধ্যমে আম কেনা-বেচার ব্যবস্থা ব্যবসা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ভিডিও কলের মাধ্যমে সরাসরি আমের বাগান থেকে পছন্দনীয় জাত ও গাছের আম পাড়া, ওজন দেয়া, প্যাকেটজাত ও প্রেরণ করার প্রবণতা বেড়ে গেছে। এজন্য বাগানে আমের মুকুল আসার পর থেকে ভিডিও দেখিয়ে ক্রেতা আকর্ষণ করে তার ফলোআপ করার মাধ্যমে অগ্রিম বিক্রির চুক্তিও করেছে কিছু অনলাইন প্রতিষ্ঠান।

আমের বাজারে গুণগত মান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এবং ভোক্তা অধিকার প্রতিষ্ঠায় এই ব্যবস্থা খুবই আশাপ্রদ। অনলাইনে আম, লিচু ও বিভিন্ন মৌসুমী ফল বিক্রি করতে গিয়ে অনেক শিক্ষিত বেকার যুবকের কর্মসংস্থান হয়েছে এবং তাদের প্রতিষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অনেকের খণ্ডকালীন কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। শুধু রসালো তাজা আম বা মিষ্টি ফলই নয়, ফলের জুস, আচার, আমসত্ত্ব, লজেন্স, ম্যাঙ্গবার ইত্যাদির উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কারখানা তৈরিতে সরকারি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বেকার যুবকদের জন্য সহযোগিতা বাড়ানোর চিন্তা করা প্রয়োজন। এটা আরও বিস্তৃত হলে আমের বাজারে ভোক্তা প্রতারণার প্রবণতা কমে যাবে, অসৎ ফড়িয়াদের অনৈতিক দৌরাত্ম্য দূর হবে এবং বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ কিছটা হলেও তৈরি হবে।

উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো পেরিয়ে উন্নত জাতের আম এখন সারা দেশে চাষ করা হচ্ছে। আমাদের দেশে মৌসুমের সময় রসালো ফলের দাম অনেক কমে যায়। আম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, তরমুজ প্রভৃতি রসালো ফলের প্রক্রিয়াজাত কারখানা খুব কম থাকায় প্রতিবছর আমাদেরকে বিদেশি ফলের জুস আমদানি করতে হয়। নিজেদের মাটিতে এত পুষ্টিকর ফল উৎপাদন হলেও শুধু প্রক্রিয়াজতকরণ ও সঠিক সংরক্ষণের অভাবে আমাদেরকে থাইল্যান্ডের আম, লিচু ও পেয়ারার জুস বাজার থেকে কিনে খেতে হয়। কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে দাবি করার পর এসব বিষয় আমাদের জন্য অত্যন্ত পীড়াদায়ক।

অধূনা বারোমাসী আম বলে ফরমালিনযুক্ত আম সারাবছর বাজারে পাওয়া যায়। প্রতিবেশী দেশের অপরিপক্ক আম আমাদের বাজারে অবৈধভাবে ঢুকে বারোমাসী আম বলে রাজধানীর অনেক অভিজাত মার্কেটে অসময়ে বিক্রি হতে দেখা যায়। এই অসাধু প্রবণতা রোধ করার জন্য সরকারি কর্তৃপক্ষকে সজাগ হতে হবে। এসব অপুষ্ট মৌসুমী ফলের অবৈধ ব্যবসা ঠেকানো জরুরি। তা-না হলে আমাদের দেশি আমের বাজার ক্ষতির সন্মুখীন হবে এবং যেটা আমাদের জনস্বাস্থ্যের জন্য বিরাট হুমকিস্বরুপ। বিশেষ করে শহুরে ধনী পরিবারের শিশুরা এসব ফলের বড় ভোক্তা হয়ে থাকে।

এছাড়া দিনক্ষণ বেধেঁ দিয়ে আম পাড়ার ক্যালেন্ডার তৈরি করা হলেও প্রকৃতির নিয়ম আলাদা হতে পারে। সেজন্যই হয়তো এবছর আম পাড়ার প্রচারিত সরকারি তারিখ বা নির্দিষ্ট লগ্ন নিয়ে প্রশ্ন ও বিপত্তি দেখা দিয়েছে। তাই প্রতিবছর কোন জেলার বা ভৌগলিক এলাকার জলবায়ু, পরিবর্তিত পরিবেশ এবং স্থানীয় কৃষকদের অভিজ্ঞতাকে মূল্যায়ন করে ফল পাড়ার ক্যালেন্ডার সাজাতে হবে। এ ব্যাপারে প্রকৃত অবস্থা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে গাছ থেকে পরিপুষ্ট ফল পেড়ে বাজারজাত করণ ও সেটা ভোক্তার হাতে সহজে পৌছানোর ব্যবস্থা করতে সরকারি নীতি-নির্দেশনাকে বেশি নমনীয় হতে হবে।

লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।

;