পাঠক-ঘোষকের পার্থক্য নির্ধারিত স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে
বাংলাদেশের জন্ম-ইতিহাসের সঙ্গে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির কর্মসূচিভিত্তিক যোগ নেই। থাকার কথাও নয়। বাংলাদেশ-জন্মের সঙ্গে বিএনপির নাম নিয়ে কোন নেতারও রাজনৈতিক সংযোগ নেই; থাকার কথাও নয়। পরে দলটিতে যোগ দেওয়া কেউ কেউ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত থাকলেও বিএনপির নামে কেউ ছিল না স্বাভাবিকভাবেই।
বিএনপির রাজনৈতিক সৌভাগ্য যে দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সুযোগ এসেছিল বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণার পাঠের। মেজর জিয়া যে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন তাও নয়, এর আগে আবদুল হান্নানসহ একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন। এবং জিয়াউর রহমানের সে পাঠ ছিল মার্চের ২৭ তারিখে, এবং বঙ্গবন্ধুর পক্ষে। অর্থাৎ এরআগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা হয়ে গেছে। গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বয়ং স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত স্বাধীনতা দিবসও তাই ২৬ মার্চ।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা স্বভাবই ইতিহাস স্বীকৃত, এবং দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মিডিয়া ও ইতিহাসবেত্তা কর্তৃক বর্ণিত। তবু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার সঙ্গে জিয়াউর রহমানের নাম নিয়ে আসা হয়। তাকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ দাবি করা হয়। বিএনপি জোর গলায় সে দাবি করে। বাংলাদেশ-জন্মের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর অবদানের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের তুলনাও এ নিয়ে করেন অনেকেই। অথচ তারা ভালো করেই জানেন, বাংলাদেশ কেবল নয় মাসের এক সশস্ত্র যুদ্ধের পরিণতি নয়, এর পেছনে আছে দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা।
বাংলাদেশকে কেবল নয়মাসের এক যুদ্ধের ফল হিসেবে ভাবলে খণ্ডিত ইতিহাস অথবা ইতিহাসের বিকৃতি হয়। অস্বীকার করা হয় বায়ান্ন, বাষট্টি, ঊনসত্তর, সত্তর, একাত্তরের অসহযোগ থেকে সকল কিছুই। অথচ এগুলোই ছিল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিজয়ের প্রাথমিক সোপান। কেবল হুট করে স্বাধীনতার ঘোষণা হয়ে গেল আর বাংলাদেশ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল—এ ধারণা যৌক্তিক নয়! তবু সমানে চলে এ চর্চা, আর সুশীল সমাজও প্রশ্রয় দিয়ে চলে সেটা, অথবা বলা যায় তাদের মুখ থেকেই আসে সেসব।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ইতিহাস স্বীকৃত। ভয়াল কালরাত্রির পর একাত্তরের ২৬ মার্চে গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্তের দেওয়া স্বাধীনতার ঘোষণা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম কর্তৃকও প্রচারিত। তবু দেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয় আসলেই অনেকেই নিয়ে আসেন জিয়াউর রহমান কর্তৃক কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের ঘোষণা পাঠের বিষয়টি। অথচ ঘোষণা আর পাঠ—এ দুইয়ের মধ্যকার যে বিশাল পার্থক্য সেটা ক’জনই বা অনুধাবন করেন। ধারণা করা যায়, রাজনৈতিক রঙ লাগানো এবং রঙ থেকে দূরে থাকার কারণে এসব করে থাকেন তারা। অথচ এটা দেশের প্রকৃত ইতিহাসকে বিতর্কিত করার প্রবণতা।
জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ এবং স্বাধীনতার ঘোষণা রেডিওর মাধ্যমে জানানোর বিষয়টির আগেও আরও অনেক আওয়ামী লীগ নেতা করেছেন, কিন্তু ক’জনই বা আলোচনায় আসেন। বলা যায়, তাদের কেউই আলোচনায় আসেন না। যে আবদুল হান্নান ২৬ মার্চের বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার পাঠ জিয়াউর রহমানের আগে করেছিলেন, তিনি কেন আলোচনায় আসেন না? তার আলোচনায় না আসার কারণ কি তার নেতৃত্বে পৃথক কোন রাজনৈতিক দল স্বাধীনতার আগে-পরে গঠন হওয়া? ২৬ মার্চ একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার বিষয়টি মাইকে করে যারা জানাচ্ছিল তারাও কি তবে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি রাখে? আবদুল হান্নানসহ আরও কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা, মাইকে ঘোষণা প্রচারকারীগণ যদি ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ হিসেবে আলোচনায় না আসেন তাহলে কেন জিয়া এককভাবে আসবেন? এটা সাদামাটা এবং সাধারণ বোধের বিষয়।
জিয়া জীবদ্দশায় কখনই নিজেকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ দাবি করেননি। তার মৃত্যুর পর মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে নিজেদের দলের নেতাকে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়াতে বিএনপি নেতারাই তাকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ হিসেবে দাবি করেন। ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ জিয়া এই বিষয়টি পরে বিএনপির রাজনৈতিক সুবিধা হাসিলের উপকরণ এবং আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একতরফা প্রচারণার বিপরীতে ব্যাপক প্রচার ও জনপ্রিয়তা পায়। আওয়ামী লীগ বিরোধী এক প্রবল মত সমাজে প্রচার থাকার কারণে জিয়াকে বঙ্গবন্ধুর সমান্তরাল মুক্তিযুদ্ধের এক নেতা হিসেবে দেখার প্রবণতা বাড়ে। এই সুযোগটা লুফেও নেয় বিএনপি ও সে আদর্শের বুদ্ধিজীবীরা।
পঁচাত্তরের পনের আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী একটা ধারার জন্ম নেয়। মুক্তিযুদ্ধের যতখানি প্রচার ছিল সেখানে বঙ্গবন্ধুকে ছোট করতে অথবা অবমূল্যায়ন কিংবা তার অবদানকে খাটো করতে একের পর এক প্রচারণা চলতে থাকে। আর এসব প্রচারণার ভিড়ে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ হিসেবে প্রচারের আলোয় চলে আসেন জিয়া। জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল সরকার ও বিরোধীদলের ভূমিকায় নানা সময়ে থাকার কারণে অনেকেই আবার নিজেদেরকে ‘নিরপেক্ষ’ প্রমাণের অভিপ্রায়ে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ বলে জিয়াকেও উচ্চারণ করতে থাকেন। আর বর্তমানে সেই প্রচারণার ফল পাচ্ছে বিএনপি। এখন কেউ জিয়াকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ হিসেবে অস্বীকার করলে একশ্রেণির লোক অস্বীকারকারীকেই সন্দেহ করে, আওয়ামী লীগের আদর্শের অনুসারী বলে মনে করে।
জিয়াউর রহমানকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ হিসেবে এই যে প্রচারণা সে প্রচারকারীদের কেউই দাবি করতে পারে না ২৬ মার্চে জিয়া কোন ঘোষণা দিয়েছেন কিনা। একাত্তরের ২৬ মার্চে জিয়া কোথায় ছিলেন সেটাও জানে না কেউ। এই না জানাদের সকলেই জানে উত্তাল মার্চের সকল ঘটনা, পতাকা উত্তোলন, সোহরাওয়ার্দীতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণসহ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনাসহ সকল কিছু। তারা জানে ২৬ মার্চে গ্রেপ্তার হন বঙ্গবন্ধু, তার আগে দিয়ে যান স্বাধীনতার ঘোষণা।
দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রামের পর একাত্তরের মার্চের ২৭ তারিখ পর্যন্ত জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধিকার ও মুক্তির সংগ্রামের কোন পর্যায়েই ছিলেন না। ছিলেন কেবল একবারই কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পড়ার সময়ে। এরপর মুক্তিযুদ্ধকালীন এগার সেক্টর কমান্ডারের মধ্যে একজন ছিলেন জিয়াউর রহমান। তবু জিয়ার নাম বারবার নিয়ে আসা হয়। মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমান অসম সাহসী কোন ভূমিকা রেখেছেন, এমন নজির কিংবা প্রমাণ নাই। তবু তিনি আলোচনায়। কারণ একটাই জিয়াউর রহমানের নামের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের যোগ আছে, যা অন্য সেক্টর কমান্ডারদের সঙ্গে ততটা নাই। ততটা আলোচনায় নাই মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি আতাউল গণি ওসমানী। এটা যে স্রেফ রাজনৈতিক চক্র সেটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
বিএনপি জিয়াউর রহমানকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ দাবি করে, অনেকেই আবার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিতর্কিত না করার অজুহাতে সেটা মেনে নেওয়ার নসিহতও দেন। কিন্তু তাদের কি এটা মনে হয় না বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস যদি হয় ২৬ মার্চ তাহলে ২৭ মার্চ ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ কীভাবে হয়? দিবস পালন তো সেদিনই হয় যেদিন ঘটনা ঘটে। ছোট্ট সাদামাটা এক উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। আমরা কি ১৫ ডিসেম্বরকে বিজয় দিবস হিসেবে পালন করতে পারব? এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। ধরেন, আপনার জন্মতারিখ ৩০ ডিসেম্বর, আপনি কি ২৯ ডিসেম্বরকে আপনার জন্মদিন হিসেবে পালন করতে পারবেন? সেটা কী হাস্যকর হয় না! আপনি যদি জিয়াউর রহমান কর্তৃক কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পড়াকে স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মূল ভাবেন তাহলেতো আপনারা সেই দলের পর্যায়ে পড়েন যারা নিজের জন্মদিনের আগের দিনকেই প্রকৃত জন্মদিন ভাবেন!
একাত্তরের ২৫, ২৬ ও ২৭ মার্চকে আলাদাভাবে যদি চিহ্নিত করেন তবে দেখুন পঁচিশ তারিখের রাত সাড়ে ১১টার দিকে অপারেশন সার্চ লাইট নাম নিয়ে পাকিস্তানিরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ২৬ তারিখের প্রথম প্রহরে অর্থাৎ সোয়া বারটার পর বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তারের আগে স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। ওই দিনই আবদুল হান্নান সহ আরও কয়েকজন সে ঘোষণা ফের পাঠ করেন; ২৭ মার্চ জিয়াউর রহমান বেতারকেন্দ্র থেকে একইভাবে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। বলতে পারেন, জিয়া ঘোষণা করেছেনতো। হ্যাঁ, সেটা করেছেন তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে এবং সেসময় তার মত পদস্থ এক সামরিক কর্মকর্তার মুখ থেকে সেসব প্রচারের দরকারও ছিল। কৃতিত্ব যে তার ছিল না সেটা কেউ বলছে না, বলছে কেবল এই ঘোষণা পাঠের একক কৃতিত্ব না নেওয়ার বিষয়ে।
২৭ মার্চের বেতার ঘোষণা পাঠের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ দাবি করলেও দেশবাসীর মত বিএনপিও ২৬ মার্চকে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করে থাকে। এবারও করেছে। জিয়াউর রহমান একাত্তরের ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণার পুনর্পাঠ করেছিলেন, এটা অসত্য নয়। অসত্য হলো তার ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ হিসেবে যে দাবি করা হয় সেটা। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিএনপির কৃতিত্ব দখলের যে দাবি সেটা নড়বড়ে হয়ে যায় তাদের নিজেদের কর্তৃক ২৬ মার্চকে স্বাধীনতা দিবস পালনের আয়োজনেই।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে খণ্ডিতভাবে উপস্থাপন ইতিহাস বিকৃতিই। জিয়াউর রহমান ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ নন, তিনি অন্য অনেকের মত একজন পাঠক—এটাই প্রকৃত ইতিহাস। আর প্রকৃত ইতিহাস পাঠে কারও সম্মান কমে না, বরং বাড়ে। বিএনপিও সেটা একদিন বুঝতে পারবে, সে বিশ্বাস রাখতে চাই।
কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক।