কেন বাংলাদেশের রোগীরা বিদেশে যান?

  • ড. মাহফুজ পারভেজ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

কেন বাংলাদেশের রোগীরা বিদেশে যান?

কেন বাংলাদেশের রোগীরা বিদেশে যান?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একটি স্বাস্থ্যব্যবস্থা ঠিকভাবে কাজ করার জন্য ছয়টি বিষয় নিশ্চিত করা প্রয়োজন—প্রয়োজনীয় অর্থায়ন, জনবল, চিকিৎসাসরঞ্জাম, তথ্য-উপাত্ত, সেবাদানের সঠিক নির্দেশিকা ও যথাযথ ব্যবস্থাপনা। এর যেকোনো একটির অনুপস্থিতিতে অন্যটি ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না।

বাংলাদেশে উপরোক্ত শর্তগুলো কত কম বিদ্যমান রয়েছে, তা সকলেরই জানা। যে কারণে প্রায়ই চিকিৎসাহীনতা ও ভুল চিকিৎসার শিকার হন সাধারণ মানুষ। এবং একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী সুচিকিৎসার আশায় বিদেশে যান।

বিজ্ঞাপন

এসব বিষয় যখন আলোচনা করছি, তখন স্মরণ করা যেতে পারে যে, ১৭৯৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর কলকাতায় বিলাতের অনুরূপ মিউনিসিপ্যাল স্বাস্থ্যবিধি চালু হয়। সেটাই ছিল বঙ্গদেশের স্বাস্থ্য খাতে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ। তারপর প্রায় সোয়া দুইশত বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। আর আমরা এখনও একটি টেকসই স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার অনুপস্থিতির মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছি। সাধারণ চিকিৎসার ক্ষেত্রেই মানসম্মত কাঠামো গড়তে পারনি। ডেঙ্গু বা করোনার মতো বিশেষ জরুরি পরিস্থিতিতে প্রাণান্তকর অবস্থায় নিপতিত হচ্ছি। উন্নত চিকিৎসা দূরস্থ, শুধুমাত্র ঠাঁই পাওয়ার আশায় মরণাপন্ন রোগী নিয়ে ছুটতে হচ্ছে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে।

সামগ্রিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রোগীদের বিরাট অংশ চিকিৎসার জন্য বাইরে যাওয়ার বিষয়টি বাস্তবতার অংশ হয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশি সাধারণ রোগীদের সিংহভাগের কাছে বিদেশে চিকিৎসা মানে কলকাতা। তারপরের গন্তব্য চেন্নাই। কেউ কেউ দিল্লি বা মুম্বাইয়ের হাসপাতালে ভিড় করেন। অনেকেই আরও অগ্রসর চিকিৎসা সুবিধার খোঁজে কেরালা পর্যন্ত চলে যান।

বিজ্ঞাপন

উচ্চবিত্তের রোগীরা থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া যেতে পছন্দ করেন। যাদের সামর্থ্য বেশি, তারা চলে যান আরও উন্নত দেশে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিদেশে চলে গেলেই সুচিকিৎসা পাওয়া যায় সব সময়? ভুল চিকিৎসা ও মেডিকেল মাফিয়ার খপ্পরে প্রাণ ও অর্থ হারান অনেকেই। নিরাময়ের জন্য, কষ্ট লাঘবের জন্য রোগীরা দেশের ভেতরে ও বাইরে এক চিকিৎসক থেকে আরেক চিকিৎসকের কাছে, এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে দৌড়াতে থাকেন। নিরুপায় মানুষ অপচিকিৎসা বা বিকল্প চিকিৎসা যেমন ঝাড়-ফুঁক, কবিরাজের দ্বারস্থ হয়। ক্যানসার ধরা পড়ার পরে বা দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত রোগীদের বিশেষায়িত চিকিৎসার খোঁজ করা প্রত্যাশিত। কারণ, অত্যাধুনিক প্রাগ্রসর (হাই-এন্ড) চিকিৎসা সেবা এখনও আমাদের দেশে অপ্রতুল। যতটুকু গড়ে উঠেছে তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

অত্যাধুনিক প্রাগ্রসর চিকিৎসা গ্রহণের জন্য তাই আমাদের দেশের রোগীদের প্রায়ই বিদেশে যেতে হয়। বিদেশের তালিকায় প্রথমত পড়ে ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশও আছে অতি ধনীদের পছন্দের তালিকায়। বিদেশগামী বাংলাদেশি রোগীদের সবচেয়ে বড় গন্তব্য পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। উচ্চমানের চিকিৎসা সুবিধার পাশাপাশি এর কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের স্থলপথে যোগাযোগ। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল থেকে ঢাকায় যেতে যত সময় লাগে, ভারতে যেতে তার চেয়ে কম সময় লাগে। ভারত ও বাংলাদেশের মানুষের খাবার-দাবার, ভাষা এবং সংস্কৃতির রয়েছে অনেক মিল। এক বছরের গড় হিসাবে দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে ২ লাখ ২১ হাজার ৭৫১ রোগী চিকিৎসার উদ্দেশে ভারতে গেছেন। তারা খরচ করেছেন আনুমানিক পাঁচ হাজার কোটি টাকা। প্রতি বছর বাংলাদেশি রোগীদের ভারতমুখী স্রোত বেড়েই চলেছে। এর কারণ দেশের চিকিৎসা সেবায় জনগণের আস্থাহীনতা, অরাজক অবস্থা, নিম্নমানের সেবা ও উচ্চ খরচ।

বাংলাদেশের রোগীরা ভারতে যান জটিল হার্ট সার্জারি, ক্যানসারের চিকিৎসা, অঙ্গ প্রতিস্থাপন, বন্ধ্যত্ব চিকিৎসা, অস্থি ও অস্থিসন্ধির অপারেশন, স্নায়ুরোগ, কিডনি রোগ, মেডিক্যাল চেকআপ প্রভৃতির জন্য। এসব ক্ষেত্রে সঠিক চিকিৎসক ও সঠিক হাসপাতাল নির্ধারণ করতে না পারলে বিপদ দেখা দেয়। এজন্য সঠিক তথ্য জেনে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য বিরাট বড় বাজার। এই বাজার থেকে শত শত কোটি টাকা আয় করলেও ভারতীয় হাসপাতালগুলো বাংলাদেশের রোগী ও বাজারের ক্ষেত্রে যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছেনা। প্রকৃত তথ্য সরবরাহ ও স্বচ্ছতার দিক থেকে বাংলাদেশি রোগীদের সঠিকভাবে সাহায্য করাও হচ্ছেনা। বিরাট বিরাট কর্পোরেট হাসপাতালগুলো একতরফা ব্যবসা করলেও বাংলাদেশের রোগীদের জন্য বাংলাদেশে বিপণন ব্যবস্থার বিকাশ করার ও তথ্যসেবা বৃদ্ধির কথাও ভাবছেনা।

স্থিতিশীলভাবে দীর্ঘমেয়াদে ব্যবসা করতে হলে ভারতীয় হাসপাতগুলোকে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আরও মনোযোগী হয়ে বিভিন্ন ধরনের বাস্তবভিত্তিক কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।