চার কোটির আছে চৌদ্দ কোটির কই?
বাংলাদেশের চার কোটি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ইউরোপের সমান। এই চার কোটি মানুষ দাম দিয়ে ভাল জিনিসপত্র কিনতে পারে। সম্প্রতি ১৮তম জাতীয় ফার্নিচার মেলা উদ্বোধনের সময় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এমনটি দাবি করে বক্তব্য দিয়েছেন। আমাদের দেশের মানুষের মাথাপিছু কামাই ২৮০০ ডলার। ২০৪০ সালে আমাদের মাথাপিছু কামাই অস্ট্রেলিয়ার মতো সাড়ে ১২ হাজার হবে। ফার্নিচার ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্য তিনি ‘ভালমানের ফার্নিচার বানাতে পারেন’ বলে পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি মধ্যবিত্তের কথাও স্মরণে রাখতে বলেছেন। দেশের আসবাবপত্র ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে রাখা এই বক্তব্য এই খাতকে লাভজনক করতে আরও বেশি উদ্দীপ্ত করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে এক হিসেব অনুযায়ী আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যা ১৮ কোটি। তন্মধ্যে চার কোটি মানুষ ভালমানের ফার্নিচার ক্রয় করার জন্য ক্ষমতাবান হয়েছে জেনে বেশ ভাল লাগলেও বাকি চৌদ্দ কোটি মানুষেরা কিভাবে তাদের প্রয়োজনীয় ফার্নিচার ক্রয় করতে পারবে সে বিষয়ে কিছু বলেননি।
এমন সময় তিনি এই বক্তব্য দিয়েছেন যখন দেশের সাধারণ মানুষ মৌলিক চাহিদা পূরণের নিমিত্তে অতি প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনতে বাজারে গিয়ে হতাশ হয়ে বাড়িতে ফিরে আসছেন। প্রতিদিন এই ধরণের কষ্টকর সংবাদ গণমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে।
বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ সেসব কথা গণমাধ্যমে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে শুনেও না শোনার ভান করে ক্রমাগতভাবে উপেক্ষা করে চলেছেন। দৈনন্দিন বাজার তদারকির জন্য নিযুক্তরা জনগণের ওপর এক ধরণের আইওয়াশ করে চলেছেন। তারা বাজারে গিয়ে লোক দেখানো খবরদারি করে ক্ষান্ত দিয়েছেন। কোন পণ্যে দাম কমানোর কোন লক্ষণ জানা যায়নি। ক্যামেরার আগমন ঘটলে কোন কোন বাজারে কিছুটা দাম কমানোর কথা প্রকাশ করা হচ্ছে। কিন্তু সরকারি লোকজন আড়ালে চলে গেলে আবারও বাজারের দ্রব্যমূল্য আগের মতো অথবা আগের চেয়ে আরও বেশি দাম চাওয়া হচ্ছে। এত চার কোটি বিত্তবানদের কোনরূপ অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু নিম্নআয়ের বা দরিদ্র মানুষের করুণদশা শুরু হয়েছে। নিম্নআয়ের মানুষেরা নিত্যপণ্য ক্রয়ের ক্ষমতা হারিয়ে অল্প খেয়ে অথবা না খেয়ে নিজের সঙ্গে প্রবঞ্চনা করে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছেন।
লেখকের পরিচিত একজন গত কয়েকবছর ধরে প্যাডেলের রিকশা চালাতো। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় তার ডান পায়ের পাতা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যায়। সে আর রিকশা চালাতে পারে না। অন্যের কাছে সাহায্য নিয়ে চিকিৎসা করার পর আবারও রিকশা নিয়ে রাস্তায় নেমেছে সে। কিন্তু বয়সের কারণে আগের মতো পায়ে শক্তি নেই। তার শক্তিহীন পা দিয়ে প্যাডেল ঘুরানো খুবই কষ্টকর। তার সাথী রিকশাচালকরা এখন অনেকে অটোরিকশা চালায়। তাদের বেশি আয় হয়। কিন্তু সে নিজে অটোরিকশা চালাতে ভয় পায়। তাই তার প্যাডেল রিকশায় ব্যাটারি লাগিয়ে কোনরকমে জীবিকা নির্বাহ করছিল। কিন্তু ব্যাটারিচালিত সাধারণ প্যাডেল রিকশা দ্রুতগতির হওয়ায় সেটা চালানোও তার জন্যে খুব বিপজ্জনক। উপরন্তু নানা রোগব্যাধি একসঙ্গে দেহে আক্রমণ শুরু করায় এখন সে শয্যাশায়ী। মানুষের নিকট থেকে সাহায্য নিয়ে ডাক্তার দেখিয়েছে সে। কিন্তু ওষুধের দাম বেশি হওয়ায় তা কিনেতে পারছে না। তার স্ত্রী অপরের বাড়িতে কাজ করে। সেটা দিয়ে তাদের জীবন-জীবিকা চলে না। ডাক্তার তাকে ভাল খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু বাজারে ভাল খাবারের অগ্নিমূল্য তাদের মরণদশা তৈরি করেছে। তার কান্নাকাটি শুনে অনেকে সহযোগিতা করলেও সেটা খুবই যৎসামান্য হওয়ায় তারা বেঁচে থাকা নিয়ে খুব হতাশ।
এটা শুধু একজনের কথা লিখে জানানো হলো। এ ধরণের অতিদরিদ্র পরিবারের সংখ্যা অগণিত যারা নিয়মিত সাহায্যের জন্য হাত পাততে আসেন। এর সাথে যুক্ত হয়েছে অব্যক্ত বেদনাধারী অসংখ্য নিম্নআয়ের পরিবার। যারা ভালখাদ্য কেনা দূরে থাক জরুরি চিকিৎসার কথাটাও অপরের নিকট প্রকাশ করতে লজ্জা পাচ্ছেন। মরণাপন্ন এমন অসংখ্য নূরালম ভাই (ছদ্মনাম), সুলেখা ভাবীরা কাঁদছেন জীবন বাঁচানোর জন্য। কে দেখবে তাদের? শুধু কান্না তাদের জীবনসঙ্গী।
দেশের সবকিছুই বিত্তবানদের কাজের গতি বাড়ানোর জন্য তৈরি হচ্ছে। নিত্যপণ্যের ব্যবসাপাতি তাদের করায়ত্তে বন্দি হয়ে আছে। তাদের হাতে চাল, আলু, পেঁয়াজ, ডাল, আটা, মাছ, মুরগি, ডিম দুধ, শাক-সবজি সবকিছুই কপাটবন্দি হয়ে পড়েছে। তারা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। সরকার শুধু ডিমের বন্দিত্ব ঘোচাতে চারকোটি ডিমের জন্য এলসি খোলার জন্য একমাস আগে নোটিশ জারি করা হয়েছে। পত্রিকান্তরে জানা গেছে, মাস পেরিয়ে গেলেও আমদানিকৃত সেই ডিম অদ্যাবধি দেশের সীমান্তে ঢুকতে পারেনি। এই হলো- নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের আসল চিত্র!
দ্রব্যমূল্য সন্ত্রাসের এই করুণ চিত্র ঠেকানোর কোন মন্ত্রই কোন কাজে আসছে না। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও কর্তৃপক্ষ নিজেরাও নিরুপায়। তারাও এই ব্যাপারে হতাশা প্রকাশ করে চলেছেন।
ভারতীয় ডিম ও পাকিস্তানি মুরগির চেনা কারবারিরা অচেনা থাকার ভান করে তাদেরকে কুপোকাত করে ফেলেছেন। মৌসুমের পাঁচ টাকা দরের গোল আলু ৫০ টাকা, কাঁচামরিচ ১২০ টাকা ও পেঁয়াজ পুনরায় ১০০ টাকা কেজি দরে উঠেছে। গরিবের প্রোটিনখ্যাত ব্রয়লার, তেলাপিয়া, পাঙ্গাশ ইত্যাদিরও দাম বেড়েছে লাগামহীনভাবে। জাতীয় মাছ ইলিশ সেটাও বহু আগে চলে গেছে বিত্তবানদের করায়ত্ত্বে।
সারা পৃথিবীর মোট ইলিশ উৎপাদনের ৭০ শতাংশ বাংলাদেশে হয়ে থাকে। বাকিটা মিয়ানমার, ভারত ও থাইল্যান্ড ও অন্যান্য দেশে ধরা হয়। আমাদের দেশে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ৩০%। তবুও জাতীয় মাছ ইলিশকে চোখে দেখার ও একটু চেখে দেখার উপায় নেই। দরিদ্র বা নিম্নআয়ের মানুষ সাধারণত: সুপারবাজারে ঢোকেন না। খোলা কাঁচাবাজারে যেসব ফ্রোজেন ইলিশ সাজানো থাকে তার দাম অবিশ্বাস্য! নিম্নআয়ের মানুষ সেটার দিকে চেয়ে চেয়ে দেখে খালি ব্যাগ নিয়ে ঘরে ফিরে আসে।
জাতীয় মাছ ইলিশ আহরণের সঙ্গে সঙ্গে সিন্ডিকেটের নজরবন্দি হয়ে নানা হাত ঘুরে কোল্ড স্টোর নামক কারাগারের অভ্যন্তরে হিমশীতল পরিবেশে চলে যায়। সেটা নানা কায়দায় পুনরায় বিত্তশালীদের রসনা বিলাসের সামগ্রী হবার সুযোগ পায়। দেশের সব দামি খাদ্যপণ্যই যেন বিত্তবানদের ভোগের জন্য উধাও হয়ে বড় ছোট সবধরণের হিমঘরে ঢুকে পড়ে। বাজারের কৃত্রিম সংকট বিত্তশালীদের রসনা পূজার জন্য সৃষ্ট এক আজিব আজাব বা গজব হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে!
দ্রব্যমূল্য সন্ত্রাসের এই আজিব আজাবের শিকার দরিদ্র ও নিম্নআয়ের চৌদ্দ কোটি মানুষ! এর দায়ভার কে নেবে? এই পরিবেশে তাদের পক্ষে কথা বলারও কেউ নেই। অজানা কারণে প্রচারমাধ্যমে তাদের কথা তেমনভাবে ফুটে উঠে না।
যাদের এই দায়ভার নেবার কথা তারা মুচকি হেসে বলেন, শুধু চার কোটি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আছে! জনবান্ধব দাবি করা একটি বড় রাজনৈতিক তথা শাসক দলের সদস্যদের মুখ থেকে এমন বক্তব্য শুধু হাস্যকর নয়- বড়ই নিষ্ঠুর ও মর্মান্তিক!
অধিকিন্তু, কর্তৃপক্ষ কড়াভাবে সেসব মূল্যসন্ত্রাসী সিন্ডিকেটের গায়ে হাত দেবার সাহস পায় না। মজুতদারিরা তাদের কথায় নড়ে না। অথচ এসব ব্যক্তিরা তাদের পাশে সবসময় ঘুরঘুর করে। এসব ধনী ও অসৎ বিত্তশালী ব্যবসায়ীদের তোয়াজ-তোষণ করা সরকারি কর্তৃপক্ষ সন্ত্রাসীমূল্যে ছেয়ে যাওয়া নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় এর কষ্টগুলো মরণাপন্ন অসংখ্য নূরালম (ছদ্মনাম), সুলেখা ভাবীরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। বাকিদের কথা বলার দরকার নেই। আপনারা নিজ নিজ দরজার পাশেই খোঁজ নিলে সেটা জানতে পারবেন।
দেশে উৎপাদিত নিত্যপণ্যের কমতি নেই। ভোগ্যপণ্যে মজুতেরও কোন ঘাটতি নেই বলে প্রতিদিন সংবাদ জানা যায়। এরপর কেন ঘাটতি, কেন সংকট তা বোধগম্য নয়। জনবিচ্ছিন্ন সরকারি নীতির মধ্যে আধুনিক ভোগবাদী সমাজের অসম ব্যবস্থা কতটা নিষ্ঠুর তা আমাদের বাজারের ক্রমাগত দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধির অপতৎপরতা এবং সেটার কোনরূপ কার্যকরী সমাধান না হওয়ার প্রবণতা দেখে সহজেই বোঝা যায়। সাধারণত: মনে করা হয় বৃষ্টি-বন্যা কমে গেলে দাম আবার কমে যাবে। কিন্তু এ বছর নিত্যপণ্যের বাজারের ক্ষেত্রে তেমন কোন লক্ষণ নেই। চার কোটির জন্য কল্যাণমূলক কাজ করলেও সেটা যদি বাকি চৌদ্দ কোটি মানুষের কল্যাণে পরোক্ষভাবেও কাজে লাগানো সম্ভব না হয় তাহলে সেই কাজের কোন স্বার্থকতা নেই। এমন কাজের প্রাকৃতিক বরকত আশা করাটাও বৃথা।
‘সবার জন্য আমরা সবাই’-এটাই সভ্য সমাজের স্লোগান। কিন্তু ডিজিটাল যুগের ছোঁয়ায় ব্যাপক আয়বৈষম্য ও ক্রয়ক্ষমতার ব্যবধান সৃষ্টি হওয়ায় মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ কমে গেছে। তাই যার মুখে যখন যা আসে তৎক্ষণাৎ সেটা ব্যক্ত করে মানুষকে হেয় করা হয়, ব্যঙ্গ করার চেষ্টা করা হয়। এভাবে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ উবে গিয়ে সর্বজনীন নিত্যপণ্য ক্রয়ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে যাওয়া একটি হীন সমাজব্যবস্থা কি সভ্য মানুষ হিসেবে কেউ কামনা করে?
লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।