যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নতুন মাত্রা ও 'আশার আলো'

  • ড. মাহফুজ পারভেজ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নতুন মাত্রা ও 'আশার আলো'

যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নতুন মাত্রা ও 'আশার আলো'

নানা ইস্যুতে বৈরীভাবাপন্ন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বিপরীতমুখী অবস্থান সর্বজনবিদিত। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম শক্তিধর এই দুই দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের সম্পর্কের মধ্যে সমস্যা ও মতপার্থক্যের শেষ নেই। ইন্দোপ্যাসিফিক থেকে দক্ষিণ চীন সাগর, এমনকি বিশ্বের গণতন্ত্র ও শাসনধারা সম্পর্কেও দেশ দুটি ভিন্ন ভিন্ন মনোভাব পোষণ করে এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনা ও কৌশল প্রণয়ন করে তৎপরতা চালায়। মিলের চেয়ে অমিল বেশি হওয়ার পরেও যুক্তরাষ্ট্র ও চীন নিজেদের মধ্যে সংলাপ স্তব্ধ করে দেয় নি এবং সমঝোতার পথ রুদ্ধ করে রাখে নি। বরং যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নতুন মাত্রার ফলে বিশ্বব্যাপী 'আশার আলো' সঞ্চারিত হয়েছে।

এই নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রশান্ত মহাসাগরীয় শহর সান ফ্রান্সিসকোতে নিজেদের মধ্যে বিরাজমান বহুবিধ সমস্যার সমাধানে এক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। যদিও আলোচনায় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মূল সমস্যাগুলোর কোনোটারই চট করে সমাধান করা সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না, তথাপি সমঝোতার পথে আশার আলো হাতছাড়া করেনি বিপুলকায় দেশ দুটি।

বিজ্ঞাপন

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সাম্প্রতিক কালে দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে নানামুখী উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছিল। সান ফ্রান্সিসকোতে বৈঠকের পর সেই পরিস্থিতির কিছুটা হলেও প্রশমিত হয়েছে বলা যায়। অ্যাপেক বৈঠকের ফাঁকে দুই রাষ্ট্রনেতার সাক্ষাত থেকে দুটি উল্লেখযোগ্য সুফল পাওয়া গিয়েছে বলে পর্যবেক্ষকগণ মনে করছেন।

প্রথমত, একাধিক মজবুত চুক্তি, যার মধ্যে রয়েছে মিলিটারি পর্যায়ের সরাসরি আলোচনা এবং আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যাপারে যে ঝুঁকি ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত সমস্যা আছে, তা নিয়ে আলোচনা করা।

বিজ্ঞাপন

দ্বিতীয়ত, উভয় দেশই তাদের সম্পর্ক গড়ে তুলতে ধাপে ধাপে পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেছে। ২০২২ সালে বালিতে যখন দুই দেশের শীর্ষনেতা বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন, তখন এই লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে “গুপ্তচর বেলুন” ঘটনার জেরে বালির সেই ঐক্যমত ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।

এইসব ঘটনা বিবেচনায় রেখেও বলা যায় যে, এবার আশার আলো আবারও দেখা যাচ্ছে। বরং এবার আরও বেশি শক্ত ও মজবুত মাটিতে সম্পর্কের ভিত গড়ে তোলার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বিবদ-মনোভাবাপন্ন দেশ দুটির মধ্যে। এখন এই সমঝোতার উদ্যোগ কতদিন এটি স্থায়ী হয় এবং কতটুকু ফলপ্রসূ হয়, সেটাই মূলত দেখার বিষয়।

বিশেষত আগামীতে কিছু রাজনৈতিক ঘটনার ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্কের মধ্যে অনেক প্রভাব পড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। যেমন, আগামী বছরের জানুয়ারিতে তাইওয়ানে নির্বাচন হবে। এই নির্বাচনের ফলাফল থেকে অঞ্চলটিতে উত্তেজনার পারদ আরও চড়তে পারে। তাইওয়ান সম্পর্কে উভয় দেশই নিজেদের অবস্থানের কথা বারংবার স্পষ্ট করে দিয়েছে। চীন কোনো প্রকার হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে নিজেদের বক্তব্য পেশ করেছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা বর্তমান অবস্থার যে কোনো পরিবর্তনের বিরোধিতা করবে।

এর পাশাপাশি, ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে নির্বাচনী প্রচারের উল্লেখযোগ্য অংশজুড়ে থাকবে চীনের ব্যাপারে নানা দলের মতামত। চীন ইস্যু যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার সম্পর্কের প্রভাব মার্কিন নির্বাচনে কিরূপ প্রভাব বিস্তার করবে ও ভোটারদের উপর কেমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে, সেটাও একটি তাৎপর্যবাহী বিষয়।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের গবেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার দীর্ঘমেয়াদী সুসম্পর্কের ক্ষেত্রে মূল বিষয় হলো, সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে, দুই দেশ তাদের মধ্যে যে সব পার্থক্য রয়েছে, সেগুলোকে কীভাবে দেখছে। চীনা নেতা জিনপিং যেমনটা বলেছেন, মূল প্রশ্ন হলো, তারা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) আমাদের শত্রু না পার্টনার, সেটা দেখা। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে প্রতিযোগিতামূলক হিসাবে বর্ণনা করে, জিনপিং তারও সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, এই অবস্থানের ফলে ভুল নীতি নির্ধারণ করা হবে, বিভ্রান্তিকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে এবং অবাঞ্ছিত ফলাফল দেখা যাবে। তাই তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নীতিগত ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এবং সীমা লঙ্ঘনের মতো কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেছেন, যার মধ্যে রয়েছে তাইওয়ান এবং রপ্তানি সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রণ।

অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে আদতে একটা প্রতিযোগিতা আছে এবং এখন এটি দায়িত্বের সাথে পরিচালনা করাই মূল চ্যালেঞ্জ। এই পার্থক্যগুলো ছাড়াও, আরেকটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এই উপলব্ধি যে, প্রতিযোগিতা থেকে যাতে সংঘাত তৈরি না হয়, তা প্রতিরোধ করার জন্য উচ্চ-পর্যায়ের এনগেজমেন্ট এবং চ্যানেল উন্মুক্ত রাখা।

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার সমঝোতামূলক, উদার ও খোলামেলা মনোভাব যদি সত্যই কাজ করে, তাহলে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক রাজনীতির দ্বন্দ্বমুখর পরিস্থিতিতে। রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতাও মীমাংসার পথ খুঁজে পাবে আন্তর্জাতিক রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে। আঞ্চলিক পরিসরে ভারতও চলে আসতে পারে চীনের কাছাকাছি।

বিশেষত, উভয় দেশের সীমান্ত বরাবর 'প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা' নিয়ে চলতে থাকা অমিমাংসিত সমস্যা যখন চতুর্থ শীতকালে প্রবেশ করছে, এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের ইতিবাচক ধারা থেকে ভারত-চীন সম্পর্ক একটা স্পষ্ট শিক্ষা নিতে পারে। সম্পর্ক উন্নয়ন ও আলোচনা থেকে যে সমস্যার সমাধান হতে পারে, এমনটা উভয় বিবদমান দেশ আশা করতে পারে, যার গুণবাচক ফলাফল বৃহত্তর এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তির বাতাবরণ তৈরি করতেও সহায়ক হবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন যেটা উপলব্ধি করেছে, তা হলো, বিশ্বের দুই শক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক যখন তলানিতে চলে যায়, তখন তার মেরামতি করার জন্য ধাপে ধাপে পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার এবং আলাপ-আলোচনার ধারা সব সময়ই উন্মুক্ত রাখা প্রয়োজন। বিভিন্ন বিবাদ মীমাংসায় এগুলোই পরীক্ষিত পদ্ধতি। বাংলাদেশ যদি আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে এ পথ অনুসরণ করতে পারে এবং আলোচনা ও সমঝোতার পথ খুলে রাখতে সচেষ্ট হয়, তাহলে আশার আলোর দেখা পাওয়া অসম্ভব নয়।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।