বিদেশনির্ভরতা ও বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতি

  • মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

বিদেশনির্ভরতা ও বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতি

বিদেশনির্ভরতা ও বাংলাদেশের সমকালীন রাজনীতি

গণতান্ত্রিক চর্চা ধরে রাখতে হলে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাটা হলো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একটি অংশ। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা বা না করাকে যদি রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় তখন আমার বিবেচনায় সেটি ভুল রাজনৈতিক কৌশল। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হয়েছে। নির্বাচনে যাওয়ার জন্য যে শঙ্কাটা তৈরি হয়েছে সেটি হল এটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে কি হবে না? যারা বিরোধী মতবাদের লোক আছেন তারা বলছেন, বিএনপিকে বাদ নির্বাচন করলে সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। আর সরকারের কথা হলো নির্বাচনে কোন দল অংশগ্রহণ করল কি করল না সেটি বিষয় না, বিষয় হলো জনগণ অংশগ্রহণ করছে কিনা। সেক্ষেত্রে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলো কিনা তা দেখতে হবে-যাচাই করতে হবে জনগণের অংশগ্রহণের উপর ভিত্তি করে। বিএনপি’র নির্বাচন বিমূখতা তৈরি হয়েছে, তারা মনে করছে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তাদের আর অন্য কোনো রাস্তা আছে কিনা। আমার কাছে মনে হয়েছে, সেই রাস্তা খুঁজতে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র  এবং পশ্চিমা বিশ্বের ওপর একটু বেশিই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে তারা। বিএনপি’র সঙ্গে তাদের সখ্যতা দেখা যাচ্ছে এবং পশ্চিামাদের সঙ্গে সে সখ্যতার কারণে নির্বাচন অবাধ, অংশগ্রহণমূলক করার অজুহাতে মার্কিনিরা আমাদের এই নির্বাচনে নগ্ন হস্তক্ষেপ করতেও উদ্যত হয়েছে, যা এরই মধ্যে দৃশ্যমান।

যদি আমরা দেখি অতীতে যেখানে মার্কিন হস্তক্ষেপমূলক নির্বাচন হয়েছে সেখানে বিএনপি সুবিধা পেয়েছে। পুরনো পথে দলটির সেই রাজনৈতিক কৌশল ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সেটি হল নির্বাচনে তারা সরাসরি যেতে প্রস্তুত না। তাদের রাজনৈতিক কৌশল হচ্ছে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপমূলক পরিস্থিতির মধ্যে তারা নির্বাচনে যেতে চায়, যাতে করে তাদের ক্ষমতায় যাওয়া নিশ্চিত হয়। সেক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি রাশিয়ার একটি গুরুতর অভিযোগ, বাংলাদেশের বিরোধী দলের সাম্প্রতিক সংঘাতমূলক অবরোধ-হরতাল সহিংসতার রাজনীতির পরিকল্পনায় বিএনপি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় রাষ্ট্রদূতকে জড়িয়ে ফেলেছেন। এটি নিশ্চিতভাবেই একটি দেশের অভ্যন্তরীন নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় ধরণের হুমকি। কারণ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়কে প্রভাবিত করার জন্য যদি কোনো বিদেশি রাষ্ট্রদূত আমাদের রাজনীতিবিদদের নিয়ে একসঙ্গে পরিকল্পনা করেন বা সরকার উৎখাত এর পরিকল্পনা করেন; তাহলে তা জাতীয় নিরাপত্তাকে প্রচন্ডভাবে আঘাত করে। সেরকম একটা বাস্তবতার ভেতর আমরা দেখতে পাচ্ছি, ২৮ অক্টোবর সমাবেশের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্টের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ। সেই দৌড়ঝাঁপ থেকে মানুষের মনে বিএনপি’র মার্কিন সংযোগের বিষয়ে এই বিশ্বাস আরও প্রবল হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিএনপিকে সমর্থন করছে, এই কারণে বিএনপি ক্ষমতায়িত হবে-এটা যখন মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে তখন অনেক মিথস্ক্রিয়া তৈরি হতে দেখব জনগণের মধ্যে।

বিজ্ঞাপন

নির্বাচনে কেবলমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের বন্ধু রাষ্ট্ররা হস্তক্ষেপমূলক আচরণের মাধ্যমে অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ প্রশস্ত হতে পারে না। অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ‘নিষেধাজ্ঞা অস্ত্র’ ব্যবহার করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। বলা যেতে পারে এই অস্ত্রগুলো বাংলাদেশের রাজনীতির একাংশকে ভয় দেখানোর জন্যই হয়তো ব্যবহার করা হয়েছে। ভয়-ভীতি দেখিয়ে যখন কোনো নির্বাচনকে প্রভাবিত করা হয় তখন সেটাকে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে কোনো সহায়ক ভূমিকা বলে মনে করা যায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই অপতৎপরতার বিপরীতে বাংলাদেশের অন্য ব্ন্ধু রাষ্ট্ররা পাশে দাঁড়িয়েছে। তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এরকম হস্তক্ষেপ সর্মথন করে না। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বিশ্ব মোটামুটি বিভাজিত, এক রকম স্নায়ুযুদ্ধের মতো।

আমরা মনেকরি, বাংলাদেশের নির্বাচনের বিষয়টি হচ্ছে সম্পূর্ণ আমাদের জনগণের বিষয়। এর কোনো সংকট তৈরি হলে সেই সংকট নিরসনে বাংলাদেশের জনগণ বা রাজনৈতিক দলগুলো ভূমিকা রাখবে। এখানে বিদেশিদের ভূমিকা রাখার কোনো সুযোগ নেই। আমরা যেটা দেখছি, প্রথমে তারা মনে করেছিল, বিদেশি হস্তক্ষেপের হুমকি দেখে হয়তো বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পিছিয়ে দেবে। এই উত্তেজনার মধ্যে যখন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়েই গেল তখন তারা মনে করল তফসিল তো বন্ধ করা গেল না! যদি নির্বাচন সময় মত না হয় তবে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে। ২৯ জানুয়ারি হচ্ছে সর্বশেষ সময়, এর ভিতরে নির্বাচন না হওয়ার জন্য একটি রাজনৈতিক অপকৌশল হয়তো চলছিল আন্তর্জাতিকে যোগসাজশে।

বিজ্ঞাপন

নির্বাচন যদি না হয় তখন সৃষ্ট সাংবিধানিক সংকট উত্তরণ ঘটানোর জন্য একটি অনির্বাচিত সরকার দেশের ক্ষমতা নেবেন-এই রকম চিন্তাধারা থেকেই এই রাজনৈতিক কৌশল ‘নির্বাচনে না যাওয়া’। প্রথম যে ধাপটি আছে আমার মনে হয়, যারা নির্বাচনের পক্ষে নন, তারা এখানে তাদের যে রাজনৈতিক অস্ত্র ব্যবহার করেছেন সেগুলো ব্যর্থ হয়েছে। এখন দ্বিতীয় পর্যায় হলো এই নির্বাচনের আগে দেশের যে শান্তিশৃঙ্খলার বিপর্যয় ঘটানো। সেই জন্য আমরা দেখতে পাচ্ছি, হরতাল-অবরোধের নামে সহিংসতা করা হচ্ছে। গাড়ি পোড়ানো হচ্ছে, মানুষের মৃত্যু ঘটছে, ট্রেনে আগুন দেওয়া হচ্ছে। এগুলো সবই হচ্ছে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে। তবে জনগণের কাছে তা একেবারেই সর্মথন পায়নি। ফলশ্রুতিতে এসব কর্মসূচির প্রভাব অনেকটাই কমে গেছে। আন্দোলন-কর্মসূচির নামে সহিংসতার এই অস্ত্রটি আগামী দিনে খুব সফল থাকবে বলে মনে হয় না।

এখন তৃতীয় ধাপ হলো নির্বাচন নির্বাচনকে প্রতিহত করা। সেই প্রতিহত করতে গেলে বড় ধরণের সহিংসতা করতে হবে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে। সেই কৌশল চরিতার্থ করতে বাংলাদেশে যে একটা বড় ধরণের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে তা দ্ব্যর্থহীন ভাবেই বলা যায়। বাংলাদেশের নির্বাচনকে ঘিরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিভাজিত হয়ে পড়েছে তা আমরা ইতিমধ্যেই দেখতে পাচ্ছি। একপক্ষ নির্বাচনকে অবাধ এবং সুষ্ঠু করার জন্য তারা তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন। তারা এটি সুসম্পন্ন করতে সহায়তাও করছেন। আরেক পক্ষ বিভিন্ন অজুহাতে নির্বাচনের পরিবেশকে জটিল করে তুলতে উদ্যত। তবে অতীতের ইতিহাস থেকে আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের ভাগ্য নির্ধারণে দেশের জনগণ নিজেরাই ভূমিকা রেখেছে। ১৯৭১ সাল থেকে যতগুলো ক্রাইসিস বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে সবগুলোতেই জনগণের স্বতোস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। সেখানে বিদেশের ওপর ভর করে রাজনৈতিক কৌশল তৈরি করা ভোটের রাজনীতি নয়। যারা ভোটের রাজনীতিতে না গিয়ে বিদেশনির্ভর রাজনীতির কৌশল করছেন তারা ভোটের পক্ষে থাকবেন না সেটাই স্বাভাবিক। 

যারা বাংলাদেশের নির্বাচনের অতি আগ্রহ দেখিয়ে এখানে একটি অচলাবস্থা তৈরি করার পক্ষে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে, তাদের বিপরীতে রাশিয়ার পররাষ্ট্র দপ্তরের সাম্প্রতিক স্টেটমেন্ট মানুষ বিশ্বাস করছে। আমরা এও দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশের একটি মতাদর্শের রাজনৈতিক শক্তি পশ্চিমাদের যেসব তথ্য সরবরাহ করেছিল বলে শোনা গেছে, এর অনেক কিছুরই সত্যতা নেই তা বিলম্বে হলেও তারা (পশ্চিমারা) হয়তো বুঝতে পারছে। এখানে অনেক গল্প হয় এবং নির্বাচন কেমন হয়েছে-এসমস্ত আলোচনা হয়। আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থায় ভোটাধিকার প্রয়োগের যে অধিকার সেটি যদি থামিয়ে দেওয়া হয় তাহলে সেটি আমাদের ভবিষ্যতে সংকট তৈরি করবে। 

সেক্ষেত্রে জনগণ এবং যে-সব রাজনৈতিক দল দেশের কথা চিন্তা করেন, স্বার্থের কথা চিন্তা করেন তাদেরকে অবশ্যই দেশের মানুষ ভালোভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করুক-এটি নিশ্চিত করেই তার পক্ষে হাঁটতে হবে। এখন ভোটের সমর্থন থাকলেও ভোটের ফলাফল উল্টে দেওয়ার যে ঘটনার কথা বলা হয় সেটিতো আমরা ১৯৭০ এর নির্বাচন যদি দেখি, যেটি পাকিস্তান সামরিক জান্তার মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছিল-সেই ঐতিহাসিক নির্বাচনেই তার উত্তর মিলবে । ভোটের সুনামি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ছিল বলেই তিনি ঐ অবস্থাতে নির্বাচনে গেছেন। সেখানে নির্বাচনে যাওয়ার রীতি থেকে বুঝা যায়, জনসমর্থনের সংকটের একটা ভীতি রয়েছে, সেই ভীতি থেকেই নির্বাচন বানচালের একটা রাজনীতির উপস্থিতি আমরা দেখতে পাচ্ছি। এই  রাজনীতিকে বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করছে। এগুলোর মাধ্যমেই সহিংসতার জন্ম হয়েছে। আমি মনে করি, সহিংসতা থেকে বেরিয়ে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথ প্রশন্ত করার মধ্য দিয়ে দেশের নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও প্রগতির দিকে আমরা ধাবিত হবো। সেজন্য এটি বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করা।  জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনে ভোটারদের স্বাধীনতায় কোনো হস্তক্ষেপ যেমন কাম্য নয়, তেমনি নির্বাচন প্রতিরোধে সহিংসতার ব্যবহারও সমানভাবে পরিত্যাজ্য। এবং গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে ভোটাধিকার প্রয়োগের বিকল্প নেই বলেই মনে করি।

নিঃসন্দেহে প্রত্যেকটি দেশ চায় তার পার্শ্ববর্তী এলাকা, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের কথা যদি বলি; বিশেষ করে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে-সেখানে দেখব কিভাবে অতীতে বাংলাদেশের মাটিকে ব্যবহার করে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ভারতের বিরুদ্ধে অস্থিরতা তৈরি করেছে। সম্ভবত সেই নিরাপত্তা ক্ষেত্রে, পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে যদি দুই দেশ শান্তিপূর্ণ অগ্রগতির পথে হাঁটতে চায় তাহলে অবশ্যই প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের বিকল্প নেই। আমরা দেখে আসছি, ভারত এ বিষয়ে বরাবরই সচেষ্ট থেকেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ একটি শান্তিপূর্ণ, জঙ্গিমুক্ত এবং বিদেশি উপস্থিতি মুক্ত একটি দেশ। এরকম একটা বাংলাদেশ বন্ধুপ্রতীম ভারত প্রত্যাশা করে। বিশেষ করে যখন নতুন করে কোনো সরকার গঠন হয় তখন সর্বাগ্রে সেখানে বিদেশিদের উপস্থিতির ঝুঁকি বেড়ে যায়। তৃতীয় শক্তির উপস্থিতি ভারতীয় সীমানা বা আধিপত্য এলাকার মধ্যে হলে নিশ্চিতভাবেই এটি ভারতের ঝুঁকি তৈরি করবে। 

আরেকটি হলো, ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চল বা সেভেন সিস্টারের উন্নয়নে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশটির জন্য। শুধু বাংলাদেশ এগিয়ে গেলে হবে না, ভারতের এই পিছিয়ে পড়া অঞ্চলকে এগিয়ে নিতে হলে অবশ্যই বাংলাদেশের সাথে কাজ করতে হবে। এবং এই অতীতের বেশ কিছু ঘটনা যদি আমরা পর্যবেক্ষণ করি তাহলে আমরা দেখব, বাংলাদেশ-ভারত সুসম্পর্ক বজায় রেখে উন্নয়নের পথে যে কৌশল তৈরি করেছে সেটি দু’দেশেরই প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে এটা বড় ধরণের ভূমিকা রেখেছে। অহেতুক সামরিক শক্তিতে অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ভারতের একটা ভূমিকা থাকলেও পরবর্তীতে আমাদের সাথে ভারতের যে অমিমাংসিত বিষয় আছে। সেই অমিমাংসিত বিষয় নিয়ে কোনো বিপাক সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে বড় ইস্যুতে বাংলাদেশ-ভারত শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করতে পেরেছে। এখানে কোনো ধরনের সমস্যা তৈরি হয়নি। ছোট যে বিষয়গুলো আছে সেসব বিষয়গুলো ক্রমান্বয়ে শান্তিপূর্ণ পথে সমাধান হবে বলেই আশা করা যায়। এগুলোকে ইস্যু করে বিবাদের একটা সূত্র হিসেবে গণ্য করার যে রাজনীতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দেখা যায় সেটিও কিন্তু ভুল রাজনীতি।

কারণ যদি ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করি সেখানে আমি দেখেছি পাকিস্তানে ভারতের ইতিবাচক সম্পর্ক না থাকার ফলে দেশটি একটি পঙ্গু রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সেক্ষেত্রে আমরা এবং ভারত যদি একসাথে উন্নয়নের কৌশল নিই এবং পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে যদি আন্তরিক থাকি তাহলে সেটি উভয় দেশের জন্য মঙ্গল হবে। বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের মতামত প্রকাশের সময় সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে এ অঞ্চলে তারা দ্বিতীয় পক্ষের কোনো হস্তক্ষেপ চায় না এবং বাংলাদেশের নির্বাচন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এখানে নির্বাচনকালে কোনো সংকট তৈরি হলে সমাধান করার দায়িত্ব বাংলাদেশের জনগণের-এটাতে তারা বিশ্বাস করে। সেই বিশ্বাসটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে একটা ভিত্তি দিয়েছে তা বলাই বাহুল্য। বন্ধু রাষ্ট্রগুলি যখন শান্তিপূর্ণ ও অবাধ নির্বাচনের পক্ষে ভূমিকা নেয় তখন সম্ভবত সেটি অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে একটি মাত্রা তৈরি করে। সেখানে প্রভাবশালী অন্য দেশগুলির হস্তক্ষেপের জায়গাটি সংকুচিত হয়ে যায়।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও আমরা দেখছি, বিদেশিনির্ভর রাজনীতি ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। ফলে যেসব রাষ্ট্র বাংলাদেশ নিয়ে একধরণের হস্তক্ষেপের চেষ্টা করে আসছিল, তারা সেই জায়গা থেকে অবস্থান পরিবর্তনের চেষ্টায় রয়েছে। তা হয়ত বাংলাদেশের কিছু রাজনৈতিক দলের পক্ষে দুঃসংবাদই বয়ে আনতে পারে। অবস্থার বাস্তবতায় বিদেশনির্ভর রাজনীতি দিয়ে ক্ষমতার পরিবর্তন অলীক কল্পনা বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। সম্প্রতি আমরা দেখতে পেলাম দেশের প্রধান তিন দলকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিঠি দিয়ে শর্তহীন সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে। এতে প্রতীয়মান হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়তো বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপট সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারছে না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস এবং এর আগামী দিনের পথচলার ম্যাপ সঠিকভাবে পড়তে পারেনি । এর কারণ হয়তো-যারা তাদের বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছিল, তাদের তথ্য পক্ষপাতদুষ্ট। এবং এ পক্ষপাতদুষ্ট তথ্যের শিকার হয়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেকেই অ্যাক্ট বা রিয়্যাক্ট করেছে। সেক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি, নির্বাচন সঠিকভাবে হওয়ার ক্ষেত্রে হঠাৎ করে ২৮ অক্টোবরের ঘটনার পরে যে চিঠি আসলো, উন্মুক্ত আলোচনার যে রিকোয়েস্ট, এটা কোনো দলকে খাদ দিয়ে উঠিয়ে আনার রিকভারি প্ল্যান ছিল হয়তো, যদিও তা বাস্তবায়িত হয়নি। এই উপলব্ধিটা দেশের সব রাজনৈতিক দলের নিজেদের স্বার্থেই বিবেচনায় নেওয়াটা জরুরি।

লেখক: সামরিক ও ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং নির্বাহী পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ‘ল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (আইসিএলডিএস)