সৌদি বিমানের মুম্বাই ‘অবতরণ’ বিতর্কের নেপথ্যে আসলে কি?
ছবি: বার্তা২৪.কম
গেল মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪) সৌদি এয়ারলাইন্সের একটি বিমানকে বিশ্বের ব্যস্ততম মুম্বাই বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণের অনুমতি দেওয়া না দেওয়া নিয়ে গত ৩ দিন নানা খবর প্রকাশিত হচ্ছে দেশে ও বিদেশে। প্রকাশিত এসব খবর নিয়ে বাংলাদেশের স্যোশাল মিডিয়ায় তুমুল চর্চা ও চরমভাবে ‘ভারত বিদ্বেষ উসকে দেওয়ার চেষ্টা’ খবরটি সম্পর্কে আরও জানতে আগ্রহী করে তুললো। বিশেষ করে বাংলাদেশের তথাকথিত এক শ্রেণির অ্যাক্টিভিস্ট (যাদের বিভিন্ন সময়ে নানা অপতথ্য ছড়িয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা করতে দেখা যায়) যখন এই বিতর্কে অংশ নিয়ে অবতরণের ‘অনুমতি দেওয়া’পাকিস্তানকে ‘অতি মানবিক’হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টায় সক্রিয় হয় তখন সন্দেহ বাড়ে।
‘দ্য নিউজ’-সহ পাকিস্তানভিত্তিক বিভিন্ন সংবাদপত্রের বরাত দিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে যে খবর বেরিয়েছে তাতে দাবি করা হয়, ওই সৌদি বিমানের পাইলট প্রথমে ভারতের মুম্বাইয়ের বিমানবন্দরে মানবিক অবতরণ চেয়ে এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলারের কাছ থেকে অনুমতি চায়। কিন্তু যাত্রীর জাতীয়তা ও অন্য তথ্য জানার পর প্লেনটিকে তাৎক্ষণিকভাবে মুম্বাইয়ে অবতরণের অনুমতি দেওয়া হয়নি।
খবরে আরও উল্লেখ, আবু তাহির নামে ৪৪ বছর বয়সী ওই বাংলাদেশি যাত্রীর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটায় মুম্বাইয়ে অবতরণের অনুমতি না পেয়ে পাকিস্তানের করাচির এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলারের কাছে অনুমতি চান। ঢাকা থেকে উড্ডয়ন করা রিয়াদগামী সৌদি এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটটিকে করাচিতে জরুরি অবতরণের সুযোগ দেওয়া হয়। অনুমতি পাওয়ার পর বুধবার সকাল ৭টা ২৮ মিনিটে বিমানটি করাচির জিন্নাহ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করে ও পাকিস্তানের বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের মেডিকেল টিম ওই যাত্রীর চিকিৎসা দেন এবং পরে প্লেনটি আবার করাচি থেকে রিয়াদের উদ্দেশে যাত্রা করে।
পাকিস্তানের গণম্যাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা খবরটিতে কোন তথ্যসূত্র কিংবা সংশ্লিষ্টদের কোন বক্তব্য নেওয়া হয়নি। তথ্যসূত্রহীন একটি খবরকে প্রভূত গুরুত্ব দিয়ে যেভাবে দ্রুততার সঙ্গে বাংলাদেশের কিছু গণমাধ্যম এবং স্যোশাল মিডিয়া মরিয়া হয়ে প্রচার করলো তাতে কয়েকটি দিক স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রথমতঃ বাংলাদেশের জনসাধারণের মাঝে ভারতবিদ্বেষ উসকে দেওয়া। অন্যদিকে পাকিস্তানকে ‘মানবিক’দেশ হিসেবে প্রচার করা এবং বাংলাদেশ ও ভারতের বিদ্যমান সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করা।
বিষয়টি সত্যাসত্য জানতে ভারতের কুটনৈতিক সূত্রগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে যা জানা যাচ্ছে তা হচ্ছে, সৌদি এয়ারলাইন্সের ওই উড়োজাহাজটিকে অবতরণের অনুমতি দিয়েছিল মুম্বাই বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। ওজন কমাতে বিমানটি জ্বালানি ডাম্পিংও শুরু করে। কিন্তু পরে সেটি আবার ঘুরে যায় এবং ঘোষণা করে যে কোম্পানির নিজস্ব নীতির কারণেই বিমানটি মুম্বাইয়ে অবতরণ করবে না। কুটনৈতিক সূত্র এও জানায় যে, ফ্লাইটটিতে বাংলাদেশি অসুস্থ যাত্রী আবু তাহিরের জন্য মেডিকেল টিম সহ সমস্ত সম্ভাব্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের জন্য প্রস্তুত ছিল মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।
ফিরে তাকাব সাম্প্রতিকতম কিছু ঘটনাবলির উপর। আমরা লক্ষ্য করেছি, ক্রিকেট খেলা নিয়ে গেল কয়েক মাস আগে কি ভয়ঙ্কর রকমের উন্মাদনা! স্যোশাল মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে ‘ভারতের পরাজয়ে বাংলাদেশি তরুণদের উন্মাদনা’ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়েছে। এবং এমন ভাবে তা করা হয়েছে যা রীতিমতো ‘ধর্মীয় ও পবিত্র নাগরিক দায়িত্ব’ হিসেবে বলার চেষ্টা করেছে কেউ কেউ। এতে করে ভারতেও বাংলাদেশ বিদ্বেষী প্রচারণায় সরব হয়ে উঠে একটা শ্রেণি। এবং বোঝা যায়-বিদ্বেষ ছড়ানোর প্রবক্তারা সফল হয়েছেন! যদিও কয়েক দিন উন্মাদনা চালিয়ে এক পর্যায়ে শান্ত হয় তারা। কিন্তু আসলেই কি ওরা থামে? ওরা থামে না। বিরোধিতার ইস্যু সৃষ্টির অপেক্ষায় থাকে তারা। এবং বেশ সংঘবদ্ধভাবেই বিদ্যুৎ গতিতে এই সব অপতথ্য ছড়ানোর কাজটি করে যায় তারা।
এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ভারতের সার্বিক সহযোগিতা এবং দেশটির অগণিত সেনাদের প্রাণদান ও তাদের জনগণের সীমাহীন দুঃখভোগের ইতিহাস রয়েছে। অভিন্ন নদী, সীমান্তে হত্যাসহ কিছু ইস্যুতে দেশটির সঙ্গে আমাদের সমস্যা আছে। কাঙ্খিত না হলেও বিশ্বজুড়েই তা প্রতিবেশি দেশের সঙ্গে এটি থাকে এবং এর সঙ্গে সুনির্দিষ্ট অনেক পরিপ্রেক্ষিতও জড়িত রয়েছে। কিন্তু বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশি হওয়ার কারণে নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশই যে ভাবে উপকৃত হয়েছে এবং হচ্ছে, তা বিশ্বে কমই দেখা যাবে। প্রতিবেশীর সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক দীর্ঘ মেয়াদে কতোটা খারাপ ফল বয়ে আনতে পারে তা মিয়ানমার, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের মতো দেশগুলোর দৃষ্টান্ত টানা যেতে পারে।
‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব-কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত আমাদের বৈদেশিক নীতির এই মূলমন্ত্রে পাকিস্তানের সঙ্গেও আমাদের কুটনৈতিক সম্পর্ক বিদ্যমান। সেখানে আমাদের দূতাবাসও রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান যে মূল্যবোধকে ধারণ করে তার সঙ্গে বাংলাদেশের ফাঁরাক বিস্তর। পাকিস্তান বাংলাদেশের বিষয়ে ‘মানবিক’ চরিত্র নিয়ে আবির্ভূত হবে তার কোন লক্ষণ নিকট অতীতে কিংবা ভবিষ্যতেও প্রত্যাশা করা কতটা দুরাশা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেখানে বিমান অবতরণে বাংলাদেশি যাত্রীর পরিচয়ে ভারতের কোন বিমানবন্দর ফিরিয়ে দেওয়ার মতো প্রচারণা শেষ পর্যন্ত ধোঁপে টিকে না। কেননা বাংলাদেশের যে পরিমাণ নাগিরক প্রতিদিন ভারতে যান, অনেক দেশে পুরো মাসে; এমনকি সারাবছরেও সেই পরিমাণ নাগিরিক যান না। নাগরিক যোগাযোগে বন্ধুপ্রতীম এই দুই দেশে আগামীতে জনগণের প্রত্যাশাকে সম্মান জানিয়ে ‘ভিসা’উঠিয়ে দেওয়ার আলাপ আলোচনাও আমরা বিভিন্ন সময়ে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে হতে দেখছি। সেখানে একজন মুমূর্ষ যাত্রীর জাতীয়তা ‘বাংলাদেশি’জানার পর তাকে বহন করা ফ্লাইট অবতরণের অনুমতি না দেওয়ার মতো হাস্যকর দাবি আর কি হতে পারে?
তবে সুনির্দিষ্ট কোন ঘটনা বা প্রেক্ষিত যদি থাকে নিশ্চয়ই ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তা তদন্ত করবে। আর যৌক্তিক কোন কারণ থাকলে বাংলাদেশের বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষও কোন ফ্লাইটকে অবতরণের অনুমতি নাও দিতে পারেন। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোন ঘটনার পুরোটা না জেনে এভাবে বিতর্ক উসকে দেওয়া যে বন্ধুত্বপূর্ণ কুটনৈতিক সম্পর্কে ফাটল ধরানোর এক অপচেষ্টা তা বেশ ভালোই অনুমেয়।