আগুনের কী দোষ!
আগুনের কী দোষ!
রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছেন ৪৬ জন। সারাদেশে ওঠেছিল শোকের মাতম। শোক হয়েছিল সর্বজনীন। কিন্তু সেই শোক স্তিমিত হয়ে এটা এখন সর্বজনীন থেকে হয়ে পড়েছে ব্যক্তিগত। প্রাণ হারানো স্বজনদের স্বজনেরাও এখন কেবল শোকাহত। বাকি সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন স্বাভাবিক জীবনযাপনে। এটাই বোধহয় স্বাভাবিক!
গ্রিন কোজি কটেজের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মামলা হয়েছে। ঘটনার পরের দিনই পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। আসামি অজ্ঞাতপরিচয়। এরইমধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কয়েকজনকে আটক করেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তারা সিদ্ধান্ত নেবে, এদের মামলার আসামি করা হবে কি না! ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা জোনের সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ সালমান ফার্সি মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, 'বেইলি রোডের আগুনের ঘটনায় কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। যাচাই-বাছাই শেষে আগুনের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হবে।' পুলিশ এরই মধ্যে যাদের আটক করেছে, তাদের মধ্যে আছেন ওই ভবনে ‘চুমুক’ নামের একটি খাবার দোকানের দুই অংশীদার আনোয়ারুল হক ও শফিকুর রহমান এবং ‘কাচ্চি ভাই’ নামে খাবারের দোকানের ম্যানেজার জয়নুদ্দিন জিসান।
আটকদের মধ্যে এখন পর্যন্ত যারা, তাদের পরিচিতি দেখে তাৎক্ষণিক মনে হচ্ছে, প্রথম দুজন ছোট একটা খাবারের দোকানের দুই অংশীদার। অন্যজন ‘কাচ্চি ভাই’ নামের বড় একটা খাবারের চেইনশপের মোটে ম্যানেজার। এখন পর্যন্ত বড় দোকানের মালিকপক্ষ এবং বহুতল ভবনের মালিকপক্ষ পর্যন্ত পৌঁছার চেষ্টা করেনি পুলিশ।
প্রাপ্ত খবরে জানা যাচ্ছে, বহুতল এই বাণিজ্যিক ভবনে অনুমোদিত নকশা মেনে চলা হয়নি। ভবনের স্থপতি মুস্তাফা খালিদ পলাশ সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, 'মূলত অফিস হবে জেনে সেই কাঠামোতে ওই ভবনটি তৈরি করা হয়েছিল। অথচ ভবনটি ব্যবহার করা হয়েছে, রেস্তোরাঁ হিসেবে। রাজউক থেকে এ বিষয়ে কোনো অনুমোদন ছিল না। সে কারণে রেস্তোরাঁ হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ-সুবিধা ছিল না ভবনটিতে।' তিনি নিজের দায় এড়াতে এখন কথাগুলো বলছেন কি না জানি না, তবে নির্মিত ভবনে যে ত্রুটি ছিল সেটা তার বক্তব্যে পরিস্কার।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেছেন, 'ভবনটিতে কোনো অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে ভবন কর্তৃপক্ষকে তিনবার চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।' রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, 'বেইলি রোডের যে ভবনে আগুন লেগেছে, ওই ভবনের কেবল আটতলায় আবাসিকের অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। বাকি এক থেকে সাততলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক অনুমোদন নেওয়া হলেও সেখানে কেবল অফিস কক্ষ ব্যবহারের জন্য অনুমোদন ছিল। কিন্তু রেস্টুরেন্ট শোরুম বা অন্য কিছু করার জন্য অনুমোদন নেওয়া হয়নি।'
বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজ নামের ভবনে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির ঘটনার পর গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আরও বেশি সজাগ হওয়া উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেইলি রোডের ভবনে অগ্নিনির্গমন পথ না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘আমরা অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের ব্যবস্থা করেছি। তবুও মানুষ এতটা সচেতন নয়। একটি বহুতল ভবনে আগুন দেখেছেন, যার কোনো অগ্নিনির্গমন পথ ব্যবস্থা নেই।’
৪৬ প্রাণহানি আর আরো অনেকের প্রাণ সংকটে থাকার এই সময়ে এসে এখন শোনা যাচ্ছে, ‘নাই-নাই’ ধ্বনি, ‘নিয়ম না মানার’ অভিযোগ! এই অভিযোগগুলো কোথায় ছিল আগে! কেন সময়মতো ব্যবস্থা নেয়নি কোনো কর্তৃপক্ষ! এখন তাদের অভিযোগগুলো স্রেফ দায় এড়ানোর অজুহাত নয় কি! ফায়ার সার্ভিস, রাজউক, সিটি করপোরেশন, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়সহ যত বিভাগ/দপ্তর/ মন্ত্রণালয়/ প্রতিষ্ঠান বিবিধ অনুমোদন প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকে, তারা কীভাবে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে!
ফায়ার সার্ভিসের তথ্যের বরাত দিয়ে গণমাধ্যম জানাচ্ছে, গ্রিন কোজি কটেজের নিচতলায় স্যামসাং ও গেজেট অ্যান্ড গিয়ার নামে দুটি মুঠোফোন ও ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম বিক্রির দোকান এবং শেখলিক নামের একটি ফলের রস বিক্রির দোকান ও চুমুক নামের একটি চা-কফি বিক্রির দোকান; দ্বিতীয়তলায় 'কাচ্চি ভাই' নামের রেস্তোরাঁ; তৃতীয়তলায় ইলিয়ন নামের পোশাকের ব্র্যান্ডের দোকান; চতুর্থতলায় খানাস ও ফুকো নামের দুটি রেস্তোরাঁ; পঞ্চমতলায় পিৎজা ইন নামের রেস্তোরাঁ; ষষ্ঠতলায় জেসটি ও স্ট্রিট ওভেন নামের দুটি রেস্তোরাঁ; ছাদের একাংশে অ্যামব্রোসিয়া নামের রেস্তোরাঁ এবং সপ্তমতলায় হাক্কাঢাকা নামের একটি রেস্তোরাঁ ছিল। ভবনে লাইনের গ্যাস সংযোগ ছিল না, বলে সবাই গ্যাসের সিলিন্ডার ব্যবহার করতো এবং সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, কেবল দোতলা বাদে প্রতি তলার সিঁড়িসহ সবখানে গ্যাসের সিলিন্ডার রাখা ছিল।
চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, আগুনে নয়, বেশির ভাগেরই মৃত্যু হয়েছে ধোঁয়ায় শ্বাসনালী পুড়ে গিয়ে। তাদের বক্তব্যে জানা যাচ্ছে, আগুনের ধোঁয়া বেরোনোর পথ ছিল না কাচঘেরা এই ভবনে। ফলে যারা ছাদে উঠতে পারেননি তাদের বেশির ভাগই মারা গেছেন অক্সিজেনের অভাবে। রাজধানীসহ বড় বড় শহরের বহুতল ভবনগুলোর বর্তমান যে অবস্থা, তার বেশির ভাগই কাচঘেরা। গ্রিন কোজি কটেজ ট্র্যাজেডি বলছে, অন্য কোথাও এমন অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটলে একই পরিণতি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
বৃহস্পতিবার রাতের আগুনের এই ঘটনা নজিরবিহীন নয়। আগেও রাজধানীসহ দেশের নানা জায়গায় বারবার আগুন লেগেছে, অগণন লোকের প্রাণ গেছে। বারবার লাশ ঠেলেছে দেশ! বারবার শোকে কাতর হয়েছে মানুষ! নিমতলীর রাসায়নিক বোঝাই গুদামঘর, তাজরীন গার্মেন্টস, সেজান জুস কারখানা, বিএম ডিপো থেকে সীমা অক্সিজেন কিংবা বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ; এর আগে-পরে-মধ্যে আরো অনেক ঘটনায় সংশ্লিষ্ট মানুষ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বেপরোয়া অবহেলায় অনেকের প্রাণ গেছে। তাদের কিছুই হয়নি। প্রতি ঘটনা শেষে তদন্ত কমিটি হয়েছে। তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দিয়েছে। প্রতিবেদনে কিছু সুপারিশ দিয়েছে। কিন্তু কোনো সুপারিশ প্রতিপালন হয়েছে বলে জানা নেই। লক্ষণীয় বিষয় হলো, যারা সুপারিশ দিয়ে থাকে, তারা আবার কোনো না কোনোভাবে কোনো কর্তৃপক্ষের। তারাও দায়িত্বশীল। প্রতিবেদনের পর আর কোথাও সেই সুপারিশ নিয়ে তাদের কথা বলতে দেখিনি আমরা।
আগুনের ধর্ম পোড়ানো। আগুনে মানুষ মরেছে, মরছে অগণন। কিন্তু এসব ঘটনাকে কেবল 'আগুনে মৃত্যু' বলে দায় এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ সামান্যই। পুরান ঢাকায় কেমিক্যাল, নয়া ঢাকায় গ্যাস সিলিন্ডার আর বায়ুরোধী কাচঘেরা ভবনগুলো প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে। এই অবস্থা সৃষ্টি করেছে মানুষ। এই অবস্থার পথ দেখাচ্ছে, মানুষের নেতৃত্বে থাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান/ বিভাগ/ দপ্তর। বেইলি রোডের আগুনে-ধোঁয়ায় মানুষ মারা গেছে, বলছে সবাই। কিন্তু সত্যি কি তাই! এমন মৃত্যুর জন্য দায়ী মূলত আগুন আর ধোঁয়া নয়, মানুষই! মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে মানুষকে! আর মানুষ-হত্যার অবাধ সুযোগ দিয়ে গেছে অপরাপর মানুষই!