নির্বাচন ভারতে, আফসোস এখানে
ভারতের লোকসভা নির্বাচন শেষ হয়েছে। ফের সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। বিজেপি সরকার গঠন করলেও এবার দলগতভাবে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। নির্বাচন-পূর্ব জরিপ, বুথফেরত জরিপে বিজেপির বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের আভাস মিললেও প্রকৃত চিত্র ভিন্ন।
ভারতের নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, বিজেপি এককভাবে পেয়েছে ২৪০ আসন, কংগ্রেস পেয়েছে ৯৯ আসন। তবে বিজেপি নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স–এনডিএ জোট পেয়েছে ২৮৬টি। অপরদিকে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোটের মোট আসনসংখ্যা ২০২। অর্থাৎ বিজেপিকে সরকার গঠন করতে শরিকদের সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। আগের নির্বাচনে অবশ্য বিজেপি এককভাবে সরকার গঠনের জন্যে প্রয়োজনীয় আসন পেয়েছিল। ৫৪৩ আসনের লোকসভায় সরকার গঠন করতে ন্যূনতম ২৭২ আসনের প্রয়োজন হয়।
বিজেপির ফের নির্বাচনে জয়ের বিষয়টি অনুমিত ছিল, তবে বিজেপিবিরোধী জোট ও কংগ্রেসের বিপুল অগ্রগতিও লক্ষণীয়। এছাড়াও আলোচিত পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের ফলাফল। আলোচনায় রয়েছে অভিনেতা দেব, রাজ বাব্বর, শত্রুঘ্ন সিনহা, হেমা মালিনি, কঙ্গনা রানৌত, রচনা ব্যানার্জি, দুই বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেটার কীর্তি আজাদ ও ইউসুফ পাঠানের জয়। এছাড়া বিনোদনজগতের আরও বেশ কজন অভিনেতা-অভিনেত্রী জয় পেয়েছেন।
ভারতের নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের বিপুল আগ্রহ। কে কোথায় কীভাবে জিতলেন, কারা যাচ্ছে সরকারে, কারা হচ্ছে বিরোধীদল, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় মোদির সরকার কি পুরো মেয়াদে টিকতে পারবে—চলছে এ আলোচনাও। আলোচনা আছে সামাজিক মাধ্যমে, গণমাধ্যমে, এমনকি জনপরিসরেও। অথচ এই ভারতকে নিয়ে বাংলাদেশের অনেকেই বিভক্ত; কেউ অনুরাগী, আবার কেউবা বিরাগী।
নরেন্দ্র মোদি টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর পর এটা দ্বিতীয় উদাহরণ দেশটিতে। ভারতের নতুন সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমন্ত্রিত অতিথি। শনিবার মোদির শপথ অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনার উপস্থিতির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন প্রধানমন্ত্রীর উপ প্রেস সচিব এম এম ইমরুল কায়েস। এরআগে নির্বাচনের ফলাফলে নরেন্দ্র মোদির বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির টেলিফোনে আলাপ হয়েছে। মোদি প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের অভিনন্দন বার্তা পেয়েছেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও অভিনন্দনের জবাব দিয়েছেন, সোশ্যাল হ্যান্ডল এক্স-এ; প্রধানমন্ত্রীকে সরকার গঠনের দিনে আমন্ত্রণ জানিয়ে। ফলে নির্ধারিত সূচি বদল হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর। জুনের তৃতীয় সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরের কথা থাকলেও শপথ গ্রহণের দিনেই যাচ্ছেন। নির্ধারিত সফরসূচি এগিয়ে এনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত এবং নরেন্দ্র মোদিকে যে বার্তা দিলেন, এর ফল সুদূরপ্রসারী নিশ্চিতভাবেই।
নরেন্দ্র মোদির বিজেপি নির্বাচনে না জিতলে কি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এভাবে ভারত সফরে যেতেন? এই সম্ভাবনাও ছিল। কারণ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ভিত্তি নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এই সম্পর্ক ঐতিহাসিক এবং এটা বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতা-সমর্থন থেকে উৎসারিত। এখানে ক্ষমতায় কে, কোন দল এই হিসাব মুখ্য নয়; অন্তত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগের কাছে।
যখন কংগ্রেস ছিল ক্ষমতায় তখনো আওয়ামী লীগের সাথে তাদের সুসম্পর্ক ছিল। অটল বিহারি বাজপেয়ীর বিজেপি সরকারের সময়ে সম্পর্ক তেমন নিবিড় ছিল না ঠিক, তবে বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক ছিল না। নরেন্দ্র মোদি যখন প্রথমবার ক্ষমতায় আসেন তখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নিয়ে নানা কথা হচ্ছিল। বিজেপির নির্বাচনি জয়ে বিএনপি নেতারা মিষ্টিমুখ করেছিলেন, অমিত শাহ বেগম খালেদা জিয়াকে ফোন দিয়েছিলেন এমন মিথ্যা তথ্য প্রচার হয়েছিল ঠিক, কিন্তু ঠিকই আওয়ামী লীগের সঙ্গে মোদির বিজেপির সুসম্পর্ক গড়ে ওঠেছে। এবং এটা এমন এক পর্যায়ে পড়েছে যখন পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে চেষ্টা করছিল, তখন ভারত আওয়ামী লীগ সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে। এখানে সম্পর্ক তাই দল-দল, ব্যক্তি-ব্যক্তিতে নয়, সম্পর্ক বাংলাদেশ-ভারত দুই রাষ্ট্রের মধ্যে। এখানে ক্ষমতায় কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোট গেলেও একই প্রতিক্রিয়া দেখাত বাংলাদেশ। এবং এটাই বাংলাদেশের কূটনীতির ধর্ম; সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো ও জনপরিসরে ভারত নিয়ে ভিন্নমুখী অবস্থান থাকলেও দেশটির নির্বাচনি ফলাফল আমাদের আলোচনার কেন্দ্রে। সঙ্গে আছে আফসোসের চিহ্নও। বিশেষত নানামুখী আলোচনা, বিরোধপূর্ণ অবস্থান থাকলেও তারা তাদের নির্বাচন ব্যবস্থা, নির্বাচনি পরিবেশকে তাদের জনগণের আস্থার মধ্যে রাখতে পারলেও এখানে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সদ্য সমাপ্ত চার ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচন; কিন্তু দেশের নির্বাচন নিয়ে, নির্বাচনি ফলাফল নিয়ে, প্রার্থীদের অংশগ্রহণ নিয়ে, ভোটারদের ভোট প্রদান নিয়ে কোন আগ্রহই ছিল না। চারধাপে দেশের বেশিরভাগ এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতারাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন, কিন্তু সেই তুলনায় আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকেরাই ভোট প্রদানে অংশ নেননি। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী কোন ধাপেই ভোট পড়ার হার চল্লিশ শতাংশে পৌঁছায়নি। সংসদ নির্বাচনে ভোট পড়ার হার আশানুরূপ ছিল না।
আমাদের নির্বাচন নিয়ে আমরা যখন এত উদাসীন, তখনো আগ্রহ রয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশের নির্বাচন নিয়ে। দেশের গণমাধ্যমগুলো ভারতের নির্বাচনের ফলাফলের যে কভারেজ দিয়েছে-দিচ্ছে, তার কিছুই ছিল না দেশের নির্বাচন নিয়ে। এখানে গণমাধ্যমগুলোকে দোষ দেওয়ার কিছু নেই, কারণ যেখানে মানুষের আগ্রহ থাকবে সেটাই ফলাও করে প্রকাশিত হবে, এবং এটাই স্বাভাবিক।
ভারতের রাজনীতি নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে বিরোধীদের অভিযোগ আছে সত্য, কিন্তু আগে নির্বাচন সুন্দর হয়নি বলে কেউ নির্বাচন বর্জনের পথে হাঁটেনি। ফলে আমেরিকাসহ পশ্চিমাবিশ্বের কেউ দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের সাহসের চেষ্টা করেনি, নির্বাচন কেমন হবে সে ফর্মুলাও দিয়ে বসেনি, নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে ভিসানীতি বদলায়নি, হুমকিধমকি দিতে পারেনি। এর কারণ দেশের মধ্যে তারা যেমন তেমন, আত্মসম্মানের প্রশ্নে তারা একজোট, এবং চিন্তায়ও অভিন্ন। ভারতের নির্বাচন আমরা আগ্রহ নিয়ে দেখি, শেখার থাকলেও আগ্রহ কম সে দিকে কেবল!