‘কোটা না মেধা? মেধা, মেধা’, ‘আঠারোর হাতিয়ার, গর্জে ওঠো আরেকবার’...; এমন নানা স্লোগানে-আন্দোলনে চলমান ‘বাংলা ব্লকেড’। এটা ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের বর্ধিত রূপ। এই আন্দোলনের নতুনভাবে গড়ে ওঠত না, যদি না গত জুনে আসত হাইকোর্টের একটি রায়, যেখানে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের এই রায় কোটা ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে এনেছে। যদিও হাইকোর্টের এই রায় স্থগিতের আবেদন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। আপিল বিভাগ এ বিষয়ে দেবে সিদ্ধান্ত।
এই ছাত্রআন্দোলনে আগের মতোই নেতৃত্বে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তবে এদের পেছনে সত্যি যে কেউ নেই, এটাও বলার সময় আসেনি। ছয় বছর আগের কোটা সংস্কার আন্দোলন দেখিয়েছিল, সেই আন্দোলন থেকে নতুন কিছু ছাত্রনেতার জন্ম। বিশেষ করে নুরুল হক নুর। নুর এরপর ডাকসুর ভিপি হয়েছিলেন। একটা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন। কিছুদিন ছিলেন বেশ আলোচনায়, কিন্তু উদ্দেশ্যহীন রাজনৈতিক কর্মসূচি ও অযথা কথকতায় এখন তিনি হারিয়ে যাওয়ার দলে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে নতুন রাজনৈতিক দলের জন্ম হলেও ওই আন্দোলন থেকে ঠিক কজন মেধার ভিত্তিতে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন, সেই প্রশ্ন ওঠেছিল। ফলাফল অজানা। যদিও ওই আন্দোলনের নেতৃত্বে যারা ছিলেন তাদের কারোর এরপর সরকারি চাকরির পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার খবর কোনো মাধ্যমে আসেনি। তবে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাদের অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার খবর বেরিয়েছে। আন্দোলনের প্রধান নেতা নুরুল হক নুর রাতারাতি বিপুল বিত্ত বৈভবের মালিক হওয়ার সচিত্র সংবাদ এসেছে বিভিন্ন মাধ্যমে। আন্দোলনের জন্যে দেশ-বিদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ এবং সেই অর্থের তছরুপের সংবাদও এসেছে। এবং এই অর্থ তাদের আন্দোলন-পরবর্তী রাজনৈতিক দলকে যে কীভাবে ধ্বংস করেছিল, তার সাক্ষীও আমরা হয়েছি।
২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং বর্তমান আন্দোলন নিয়ে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া বাদ দিয়ে এখন কোটাবিরোধী আন্দোলন করে। সেখানে মেয়েরাও করে। এখানে আমার একটা প্রশ্ন আছে। যারা এর আগে কোটাবিরোধী আন্দোলন করেছিল, তারা যে পাবলিক সার্ভিস কমিশনে কতজন পরীক্ষা দিয়েছিল আর কতজন পাস করেছিল? সেই হিসাবটা একটু বের করা দরকার। তারা দেখাক যে পরীক্ষা দিয়ে তারা বেশি পাস করেছিল। মেয়েরা বেশি পাস করে বেশি চাকরি পেয়েছে কি-না। সেটা আগে তারা প্রমাণ করুক।’ বিষয়টিকে প্রধানমন্ত্রী আদালতের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ‘হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে এভাবে আন্দোলন করা এটা তো সাবজুডিস। কারণ আমরা সরকারে থেকে এভাবে কিন্তু কোনো কথা বলতে পারি না। হাইকোর্ট রায় দিলে হাইকোর্ট থেকেই আবার আসতে হবে। কিন্তু আজকে আন্দোলনের নামে যেটা আবার করা হচ্ছে, পড়াশোনার সময় নষ্ট করা এটারও কোনো যৌক্তিকতা আছে বলে আমি মনে করি না।’
প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, ‘হাইকোর্ট রায় দিলে হাইকোর্ট থেকেই আবার আসতে হবে’। এখানে সরকার যা করেছে তা হলো হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল। অর্থাৎ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা যা চাইছে সেটাই এখন পর্যন্ত করেছে সরকার। কোটা নিয়ে হাইকোর্টের সাম্প্রতিক যে রায়, সেটা সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেই রায়। ছয় বছর আগের কোটা সংস্কার আন্দোলনের পর সরকার আন্দোলনরতদের দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করেছিল। হাইকোর্ট এবার যা করেছে সেটা হচ্ছে, সরকারের সিদ্ধান্তকেই বদলে দিয়েছে। এখানে কি তবে সরকারের অবস্থান এবং আন্দোলনরতদের অবস্থান এক নয়?
কথা হলো, কোটা নিয়ে আলোচনায় বারবার মুক্তিযোদ্ধা কোটা সামনে আসে কেন? কেন মুক্তিযোদ্ধা কোটা নাম শুনলেই একদল লোক এভাবে তেড়েফুঁড়ে আসে? জেদের বশে আগেরবার সরকার সকল কোটা বাতিলের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা কোটাও বাতিল করেছিল। অথচ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের আজীবন সম্মান করবে দেশ, এবং এটাই তো যৌক্তিক, এটা হওয়া উচিত নিয়ম। হতে পারে, মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকা নিয়ে বিভ্রান্তি আছে, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার অভাব নাই দেশে, তাই বলে কি মুক্তিযোদ্ধাদের এভাবে অপমানের কেন্দ্রে নিয়ে আসবে এই প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা? কোটা সংস্কার, কোটা বাতিলের নাম ওঠলেই কেন বারবার আক্রোশের শিকার হবেন মুক্তিযোদ্ধারা? জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি এই অপমানকে আমরা নেমকহারামি হিসেবে কি মনে করব না?
কোটা নিয়ে আন্দোলন এবং এবারের এ অস্থির পরিস্থিতি সরকার-সৃষ্ট নয়। হাইকোর্টের রায় পরবর্তী এ প্রতিক্রিয়া। যে আন্দোলন, যে দাবি-দাওয়া এটা মেনে নেওয়ার কর্তৃপক্ষ সরকার নয়; এটাকে মেনে নেওয়া কিংবা পর্যালোচনার কর্তৃপক্ষ দেশের উচ্চ আদালত। সরকারের যে ভূমিকা সেটা আন্দোলনকারীদের দাবিকেই সমর্থন করছে। রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে। সরকার চাইলেও আদালতকে উপেক্ষা করে নতুন কোনো পরিপত্র প্রকাশ করতে পারবে না।
কোটা নিয়ে চলমান যে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি এটা সাবজুডিস বা বিচারাধীন বিষয়। সরকারের কোটা বাতিলের পরিপত্রের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের রায়। এর নিষ্পত্তি স্বাভাবিকভাবেই আদালত থেকেই আসতে হবে। এখানে রাষ্ট্রপক্ষের ইতিবাচক ভূমিকার প্রয়োজন আছে সত্য, তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে হবে আদালত থেকেই। আদালতের ক্ষমতা আর আদালত ইস্যুতে সরকারের সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় এখানে সরকারের দায় দেখি না। তবু এই সময়ে ক্ষীণ স্বরে হলেও অনেকেই বলতে চাইছেন, তেরোর সেই গণজাগরণ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ছিল। এটা সর্বৈব মিথ্যা। কারণ যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল গণদাবি, এবং এই গণদাবি মানতে সরকার আইনের সংশোধন করেছিল।
আন্দোলনের মুখে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন দণ্ডের রায় পরিবর্তন করে ফাঁসিতে রূপান্তর করেনি। বরং পরবর্তীতে ফাঁসির রায় এসেছিল বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই। ওখানে সরকার আইনের সংশোধন করেছে, আদালতের রায়কে প্রভাবিত করেনি। ফলে এখন যারা তেরোর গণজাগরণকে সামনে আনতে চাইছেন, তারা সঠিক কাজ করছেন না, যৌক্তিক কথা বলছেন না।
কোটা নিয়ে যে অচলাবস্থা তার সমাধান সরকারের হাতে নেই। এটা বিচারাধীন বিষয়। কোটা নিয়ে সরকারের অবস্থান এবং আন্দোলনকারীদের অবস্থান বিপরীত মেরুতে নয়। যে আদেশ এসেছে হাইকোর্ট থেকে সেটা সরকারের পরিপত্রকেই বাতিল ঘোষণা করে। হাইকোর্টের সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে সরকার। আন্দোলনকারীরা যা চাইছে, সরকারও চাইছে তাই।
এটা নিয়ে রাজনীতি না করে আমরা বরং দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের জন্যেই অপেক্ষা করি।