আবেদ আলীর অপরাধও তামাদি হয়নি
কুয়াকাটা সৈকতে বিছিয়ে রাখা তোশকে দাঁড়িয়ে একজন শ্মশ্রুমণ্ডিত প্রৌঢ় নামাজ পড়ছেন। বিপরীতমুখী বাতাস আলতো করে ছুঁয়ে যাচ্ছে তাকে। বাতাসের গতিবেগ ধারণা করা যায় পাঞ্জাবির একটা অংশ উড়ে যাওয়া দেখে, এই বাতাসে সমস্যা হচ্ছে না তার; বরং একটা অতিলৌকিক পরিবেশের তৈরি হয়েছে। মাথার ওপরের নীল আসমানের দেখা মিলছে দৃশ্যজুড়ে, যতখানি ধরতে পেরেছে ক্যামেরার ফ্রেম।
চমৎকার এক দৃশ্য। স্রষ্টার সান্নিধ্য চাওয়া এক ‘নেক বান্দার’ এই ছবি ধারণ করেছে তার কাছের কেউ। এরপর এটা এসেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আরেকটা দৃশ্য উড়োজাহাজের। ভ্রমণরতদের ধর্মীয় বিধি ও আচার প্রতিপালনে ছাড় আছে যদিও, তবু তিনি উড়োজাহাজের সিটে বসেই নামাজ পড়ছেন। সেই দৃশ্যটাও ধরা পড়েছে আরও এক ক্যামেরায়। আরেক দৃশ্য গাড়ির মধ্যে। স্টিয়ারিংয়ে হেলান দেওয়া মাথা। মনে হচ্ছিল ক্লান্তিতে ঘুম পাচ্ছিল জনৈক বৃদ্ধের। কিন্তু না, এটাও নামাজের দৃশ্য। পেছন থেকে কেউ লুকিয়ে ছবিটা তুলে ফেলেছে; আর তিনিও লুকিয়ে তোলা সেই ছবি প্রকাশ করে দিয়েছেন ফেসবুকে।
উল্লিখিত ঘটনাগুলোর মূল চরিত্রে যিনি তিনি বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (বিপিএসসি) চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী জীবনের। প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন। তিনি একা নন, তার সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৭ জন, যাদের অনেকেই বিপিএসসি সংশ্লিষ্ট। আছেন তার ছেলে ছাত্রলীগ নেতা সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়ামও। গ্রেপ্তারদের মধ্যে আরও রয়েছেন পিএসসির উপপরিচালক মো. আবু জাফর ও মো. জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবির, অফিস সহায়ক খলিলুর রহমান ও অফিস সহায়ক (ডেসপাস) সাজেদুল ইসলাম, সাবেক সেনাসদস্য নোমান সিদ্দিকী, ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী বর্তমানে ব্যবসায়ী আবু সোলায়মান মো. সোহেল, অডিটর প্রিয়নাথ রায়, ব্যবসায়ী মো. জাহিদুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী শাহাদাত হোসেন, ঢাকার ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত মো. মামুনুর রশীদ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মেডিকেল টেকনিশিয়ান মো. নিয়ামুন হাসান, ব্যবসায়ী সহোদর সাখাওয়াত হোসেন ও সায়েম হোসেন এবং লিটন সরকার নামের এক যুবক।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, গ্রেপ্তার অনেক, কিন্তু আলোচনা কেবল একজনকে নিয়েই; এবং তিনি সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী জীবন। তাকে নিয়ে চর্চাও হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আলোচনার একটা বিষয় মূলত তার ধর্ম পালন। একজন পেশাদার দুর্বৃত্ত কীভাবে ধর্ম নামের স্পর্শকাতর বিষয়কে সামনে এনে অন্যায়গুলো করে গেছে সে কারণেই। প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি নিয়ে গত রোববার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে চ্যানেল টোয়েন্টিফোর। সামাজিক মাধ্যমে একটা ক্লিপ বের হয়েছে যেখানে সৈয়দ আবেদ আলী বলছিলেন, ‘প্রশ্ন ফাঁসের টাকাগুলো তিনি খরচ করেছেন আল্লাহর রাস্তায়।’
আবেদ আলী জীবনের যে কাহিনী এরইমধ্যে সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে মাত্র আট বছর বয়সে তিনি মাদারীপুর থেকে ঢাকা এসে কুলির কাজ নিয়েছিলেন। এরপর গাড়ি চালনা শেখে তিনি এক পর্যায়ে পিএসসির গাড়িচালক হয়েছিলেন। এরপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এলাকায় তিনি নিজেকে পরিচয় দিতেন শিল্পপতি হিসেবে। দান খয়রাতও করতেন বেশ। মাদারীপুরের ডাসার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থীও হতে চেয়েছিলেন তিনি। তবে সেটা হওয়া হয়নি তার। তার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ ছিল, পুত্র সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়ামেরও আছে। পুত্র ছাত্রলীগের বড় পদ বাগিয়ে নিয়েছেন, যদিও গ্রেপ্তারের পর পদ গেছে তার।
সৈয়দ আবেদ আলী জীবন যখন গ্রেপ্তার হয়েছেন, তখন তিনি সরকারি প্রতিষ্ঠানটির গাড়িচালকের চাকরিতে নাই। অবসর জীবন যাপনে তিনি। এই সময়ে তিনি নিজ খরচে মসজিদ বানিয়েছেন, এলাকার ঈমাম সাহেবকে হজে পাঠিয়েছেন। নিজেও হজ করেছেন, এবং জীবনে বারবার মক্কা-মদিনায় যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছেন। প্রশ্ন ফাঁসের মতো অপরাধ করে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়ে এখন তিনি এই অর্থ একদিকে ধর্মীয় কাজে খরচ করছেন, অন্যদিকে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের কাজে খরচা করে যাচ্ছেন। তবে অপরাধ যে কখনো তামাদি হয় না, এটা ফের প্রমাণ হলো অবসরের এক যুগ পর ধরা পড়ার মাধ্যমে।
আবেদ আলীর সাথে আরও যারা ধরা পড়েছেন তাদের কয়েকজন পিএসসির উচ্চপদের। তবে আলোচনায় আসতে পারেননি তারা। তবে আলোচনায় না আসলেও এই প্রশ্ন ফাঁস চক্রে যে সরকারি প্রতিষ্ঠানটির ছোট-বড় পদের অনেকেই জড়িত সেটা প্রমাণ হয়। আস্থা-ভরসা রাখার মতো প্রতিষ্ঠানের অভাবের বিষয়টি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
সিভিল সার্ভিসে পরীক্ষাসহ অন্তত ৩০টি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত ছিলেন আবেদ আলীরা, এমনই অভিযোগ। প্রশ্নপত্র ফাঁস করে এরা টাকা কামাই করেছেন, অন্যদিকে আরেকটা শ্রেণি রয়েছে যারা প্রশ্নপত্র কিনে নিয়ে চাকরিতে ঢুকেছেন। এরা কারা? এদেরকে বের করা কি অসম্ভব? বিক্রেতার দেখা যখন মিলল, তখন ভোক্তার সাথে তাদের নিশ্চয়ই সম্পর্ক আছে। এই চক্র নিশ্চিতভাবে ১৭/২০ কিংবা জনাত্রিশেকের নয়। বিশাল এক চক্র আছে এখানে; এই চক্রে যেমন সরবরাহক আছেন, তেমনি আছেন ভোক্তাও। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এই দিকে দৃষ্টি দিতে পারে।
সামাজিক মাধ্যমে আলোচ্য আবেদ আলীর ধর্ম পালন নিয়ে শুরু করেছিলাম, শেষাংশে এসে বলি—ধর্ম পালন তার অপরাধ নয়। অপরাধ বরং নিজের অন্যায্য কাজগুলোকে ঢাকতে ধর্মের ব্যবহার। প্রশ্ন ফাঁসের টাকা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করেছেন তিনি—এই প্রকাশ্য দাবির মাধ্যমে তিনি ধর্মকে ছোট করেছেন। অন্যায় পথে উপার্জিত অর্থ দিয়েও পুণ্য অর্জন করা যায়, এই বার্তা দিতে চেয়েছেন তিনি। এটা নিশ্চিতভাবেই আরেক অপরাধ। অন্যায় পথে উপার্জিত অর্থ যেকোনো রাস্তায় ব্যয় করলেও সেটা শুদ্ধ হয় না, এই বার্তা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
আবেদ আলীর দুর্নীতি, আবেদ আলীর ভুল চিন্তা এক্ষেত্রে আমাদের জন্যে সমাজ-গবেষণার, মানুষের সংস্কৃতি-চিন্তা গবেষণার প্রপঞ্চ হতে পারে। এটা নিয়ে সচেতনতামূলক বার্তা প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। মসজিদে-মন্দিরে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং জনপরিসরে সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে বলতে হবে অপরাধ কখনো তামাদি হয় না; দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ কোনোভাবেই শুদ্ধ হয় না।