বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষার প্রশ্নপ্রত্র ফাঁসে গ্রেফতার বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীকে গ্রেফতারের পর প্রশ্নফাঁসে তার স্বীকারোক্তি, লেবাস ও অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ আল্লাহর রাস্তার দান করা নিয়ে তুমুল আলোচনা সমালোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে। তাকে বাটপার আখ্যায়িত করে অনেকেই পোস্ট দিচ্ছেন ধার্মিকরা বাটপার হয় না, বাটপাররাই ধার্মিক সাজে।
এখানে কয়েকটি শব্দ নিয়ে আগে আলোচনা করবো। পরবর্তীতে এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে কী বলা আছে এবং ইসলামে এর ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করবো।
ধর্ম শব্দটির আভিধানিক অর্থ, ‘যা ধারণ করে।’ ধৃ ধাতু + মন্ (প্রত্যয়) মিলেই ধর্ম । ধৃ ধাতুর অর্থ ধারণ করা। তাহলে ধর্ম অর্থ যা দাঁড়ায় তা হলো, মানুষের হৃদয় বা মন যা ধারণ করে তাই-ই ধর্ম। অর্থাৎ বাইরের লেবাস ধর্ম নয়।
বাটপাররা বাটপারি করতে গেলে একটি বিশ্বাসযোগ্যতার প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে তারা লেবাসকে ব্যবহার করে। এতে করে বাটপারি করার পথ সহজ হয়। এতে করে প্রকৃত ধার্মিকরা বিব্রত হন। কেননা শার্ট-প্যান্ট, স্যুট পরে দুর্নীতি করলে কেউ পোষাকের দোষ দেয় না, কিন্তু জুব্বা-পাঞ্জাবী পরে দুর্নীতি করলে পোষাকের দোষ হয়।
বাটপার শব্দের অর্থ - প্রতারণা করা, ডাকাত, লুটেরা, চোখের উপর যে চুরি করে। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে চোরের উপর বাটপারি। অর্থাৎ বাটপাররা চোর থেকেও ভয়ংকর। বাংলা একাডেমির সহজ বাংলা অভিধানের ২৬৬ পৃষ্ঠায় বাটপার অর্থ বলা আছে প্রতারক, ঠগ, লুটেরা।
ধর্ম সংস্কৃত শব্দ। আরবিতে ধর্মকে ‘দ্বীন’ বলা হয়। ইসলামি শরিয়াতে পরিভাষায় ‘দ্বীন’ হলো এক আল্লাহ তায়ালার প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাস রেখে তাকওয়া ও পরহেজগারিতা অর্জন করাকে ‘দ্বীন’ বলে।
ধোঁকা দেওয়া বা প্রতারণা করা ইসলামে নিষিদ্ধ তথা হারাম। প্রতারণার বিষয়ে ইসলাম খুবই কঠোর। একাধিক হাদিসে হযরত মুহম্মদ (স.) বলেছেন, ‘যে আমাদের ধোঁকা দেয় তথা প্রতারণা করে সে আমার উম্মতের দলভূক্ত নয় (মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ) ।
প্রশ্নফাঁস না হলে হয়তো ওই চাকুরিটি অন্যজনের হতে পারতো। সেক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র ফাঁস অপরাধটি হলো হক্কুল ইবাদ বা বান্দার অধিকার হরণের শামিল। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি ভয়ংকর এক অপরাধ। যে অপরাধ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ক্ষমা না করলে স্বয়ং আল্লাহও ক্ষমা করেন না।
প্রশ্নফাঁসে আবেদ আলী গ্রেফতারের পর সাংবাদিকদের বলেন, প্রশ্নফাঁসে অর্জিত অর্থ তিনি আল্লাহ রাস্তার দান করেছেন। ধোঁকা বা প্রতারণার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ দিয়ে দান-সহযোগিতা, ধর্মীয় কাজ কুরবানি, মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ, জনসাধারণের জন্য রাস্তাঘাট-কালভার্ট নির্মাণ কোনোটিই বৈধ নয়। আর এতে সাওয়াবও মিলবে না।
কেননা দান-সহযোগিতা, সমাজ সংস্কারসহ জনকল্যাণমূলক কাজ কোনো ব্যক্তির জন্য আবশ্যক নয়। আর ধোঁকা বা প্রতারণা ইসলামে হারাম ও নিষিদ্ধ কাজ।
প্রতারণা রাষ্ট্রীয় আইনেও জঘন্য অপরাধ। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৪১৫ ধারায় প্রতারণার সংজ্ঞা ও ৪২০ ধারায় এ অপরাধের শাস্তি বর্ণনা করা হয়েছে। যা সর্বোচ্চ ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়াও একই আইনের ৪০৬, ৪০৮ এবং ৪০৯ ধারায় বিশ্বাস ভঙ্গের অপরাধের শাস্তির কথা বর্ণিত আছে। দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারাটি বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশনের সিডিউলভূক্ত। এ অপরাধে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
গতরাতে এখানে তখন ৯টা। বাংলাদেশ থেকে মেয়ের ফোন, ‘বাবা কী করো?’
-বিতর্ক দেখবো বলে লিংক খুঁজছি।
-ও আমিতো দেখছি কেবলই শুরু হলো।
- লিংকটা দাও।
- চলো একসাথে দেখি। আমি স্ক্রিন শেয়ার করছি।
এরপর যোগাযোগ প্রযুক্তির কল্যাণে টানা দেড়ঘণ্টা ভূগোলকের দুই প্রান্তে বসে বাবা-মেয়ে একসাথে দেখলাম যুক্তরাষ্ট্রের ৬০তম প্রেসিডেন্সিয়াল লড়াইয়ে দুই প্রার্থীর বিতর্ক।
সে যেনো এক অসম লড়াই। একদিকে তথ্যবহুল সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনায় সমৃদ্ধ ও যুক্তিনির্ভর উপস্থাপনা। আরেক দিকে একই কথা বারবার বলে যাওয়া। একই চর্বিত চর্বন। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখনই কথা বলছিলেন, আমার কাছে হাঁসের প্যাকপ্যাক ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছিলো না। সেটাই যখন ভাবছিলাম- মেয়ে বললো, ‘লোকটার মধ্যে ব্যবল সিনড্রম প্রকট। কি বলে কিছুই বোঝা যায় না। সব প্রশ্নেই যেনো তার একটাই উত্তর।’
বিতর্কের শুরুটাই হয় অস্বাভাবিকতা দিয়ে। বিতর্ক মঞ্চে যখন ঘোষিত হলো দুই প্রার্থী অর্থাৎ সাবেক প্রেসিডেন্ট ও রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প ও বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ডেমোক্র্যাট কমলা হ্যারিসের নাম, আর দুজন ঢুকলেন মঞ্চে, তখন রীতিমাফিক নিজের পোডিয়াম ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলেন কমলা, উদ্দেশ্য প্রতিপক্ষের সাথে করমর্দন। কিন্তু ট্রাম্প তার পোডিয়ামেই দাঁড়িয়ে থাকলেন। অগত্যা কমলা এগিয়ে গেলেন ট্রাম্পের পোডিয়ামের কাছে আর হলো একটা অসম করমর্দন। একই ছাদের নিচে দুই প্রার্থীর প্রথম মোলাকাতটা ছিলো রীতিমতো বেখাপ্পা। মেয়ে বললো, ‘বাবা এটাতো রীতিমতো অভদ্রতা’।
তবে মোটের ওপর এবারের বিতর্কে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অপেক্ষাকৃত ভদ্রোচিত থাকতে দেখা গেছে। কটুকাটব্য একটু কমই করেছেন। কমলাও ছিলেন মার্জিত। কেবল ছুড়ে মারছিলেন বাঁকা হাসির তীক্ষ্ণ তীর। ধন্যবাদ দিতে হবে মাইক মিউটেড রাখার সিদ্ধান্তকে। তবে সে হাসি দেখে ট্রাম্পের যে পিত্তি পুড়ে যাচ্ছিলো তা তার মুখভঙ্গিতেই ছিলো স্পষ্ট। মনে পড়ছিলো সেই টিকটক ভিডিওটির কথা! মাইক খোলা থাকলে ট্রাম্প হয়তো বলেই ফেলতেন- ‘তুই হাসছ ক্যারে! তুই হাসছ ক্যারে’!! মেয়ে বললো, ‘বাবা কমলা কিন্তু পাঁজি আছে… দেখো কেমন অর্থপূর্ণ বাঁকা হাসি দিচ্ছে।’
যাক জোক্স অ্যাপার্ট। আসুন দেখি বিতর্কটাই কেমন ছিলো। আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে- এই বিতর্কে কমলারই জয় হয়েছে। তারই ঝোলায় ঢুকেছে বিতর্কের সিংহভাগ সুফল। যার প্রমাণ আমরা দেখেছি বিতর্ক পরবর্তী এবিসি জরিপেও। দেখানো হয়েছে সুইং স্টেটগুলোর ছয়টির মধ্যে এক জর্জিয়া ছাড়া বাকি সবগুলোতেই নীলকে এগিয়ে দিয়েছেন জরিপে অংশগ্রহণকারীরা। কারণ একটাই- বিতর্কের মোক্ষম মূহূর্তগুলোর সুবিধা কমলা হ্যারিস নিয়ে নিয়েছেন একচ্ছত্রভাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কমলা হ্যারিসের পারফরম্যান্স ছিলো নান্দনিক, মনকাড়া ও গোছানো। নারীর শরীরে নারীর অধিকার, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার দাবি ও যৌক্তিকতা তুলে ধরে গর্ভপাতের অধিকার বিরোধী ট্রাম্পকে সত্যিকার অর্থেই ঘায়েল করতে পেরেছেন তিনি। ট্রাম্প অবশ্য পই পই করে বলে যাচ্ছিলেন, সাত মাস, নয় মাসেও নাকি গর্ভপাত হচ্ছে, তাই এটা নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন।
আলোচনায় অবধারিতভাবে এসেছে বর্ণবাদ প্রসঙ্গ। যা নিয়ে কথা বলতে কমলাকে আবেগতাড়িত হতে দেখা গেছে বারবার। নিজেকে বর্ণবাদী নন প্রমাণ করার ব্যর্থ চেষ্টা ছিলো ট্রাম্পের।
এসবে অবশ্য তার আগ্রহও ছিলো না। বার বার তিনি কথা বলতে চেয়েছেন অর্থনীতি আর অভিবাসন নিয়ে। আর অদ্ভুত এক গল্প, যা আগে কেউ শোনেনি। বলেছেন তার কাছে নাকি তথ্য আছে- নব্য অভিবাসীরা নাকি মানুষের কুকুর বেড়াল চুরি করে খেয়ে ফেলছে!!! পাল্টা একটি কথাও বলেননি কমলা। শুধুই হেসেছেন। কারণ তিনি জানেন, ফ্যাক্ট চেকেই ধরা পড়বে এ এক ঢাঁহা মিথ্যাচার।
দুই প্রার্থীই একে অন্যকে দোষারোপ করেছেন এই বলে যে, আমেরিকাকে বিভক্ত করে দেয়া হচ্ছে। সেতো হচ্ছেই। মূলত যুক্তরাষ্ট্র রেড আর ব্লুতে বিভক্ত। এখানকার অঙ্গরাজ্যগুলোকে রেডস্টেট আর ব্লুস্টেট বলেই চেনে সকলে। গুটিকয় যে রয়েছে সুইং স্টেট, সেগুলোকে লাল কিংবা নীল রঙ দেওয়ার জন্যই প্রতি চার বছর অন্তর লড়াই। তবে কিছু বিষয় থাকে যা গোটা আমেরিকার। যেমন গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত, বাজার দর, অর্থনীতি, যুদ্ধ কিংবা যুদ্ধে সহযোগিতা, স্বাস্থ্যসেবা, অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ এসবই গুরুত্ব পায় বিতর্কে।
১০ সেপ্টেম্বরের বিতর্ক ভিন্ন কিছু ছিলো না। পেনসিলভেনিয়ার ফিলাডেলফিয়ার ন্যশনাল কনিস্টিউশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত এই বিতর্কে কোনো লাইভ দর্শক ছিলো না। ফলে হাততালি শোনা যায়নি। কিংবা আসেনি কো দুয়ো ধ্বনি। এবারের বিতর্কে নতুন কিছু নিয়মও বেঁধে দেওয়া হয়েছিলো যার অন্যতম ছিলো মাইক মিউটেড রাখা। একজন কথা বললে অন্যজন মাঝপথে কিছু বলতে পারবে না। তাও একবার কড়া ভাষায় কমলাকে স্মরণ করে দিয়েছেন ট্রাম্প, তিনি কথা বলছেন, তো মাঝে কথা বলা যাবে না। শুনে বিষ্ময়ের হাসি হাসেন কমলা। বস্তুত তিনি কিছু বলছিলেনও না। ফলে পুরো বিতর্কটি ঝঞ্ঝামুক্তভাবে শেষ হতে পেরেছে। কিন্তু স্বভাবসুলভ ভাবে কিছু ঘৃণা ছড়িয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। মার্জিত উপায়ে কম ঘৃণা ছড়াননি কমলাও।
তবে পুরো বিতর্কে সবচেয়ে নোংরা হয়ে এসেছ হাইতিয়ান অভিবাসীদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা যে তারা প্রতিবেশীদের কুকুর বেড়াল চুরি করে খেয়ে ফেলছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের এমন বক্তব্যের একটা কড়া প্রতিবাদ প্রত্যাশিত ছিলো কমলা হ্যারিসের পক্ষ থেকে, যা অবশ্য দেখা যায় নি। তবে ভালো লেগেছে বিতর্কের উপস্থাপকের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে- না এ কথা সত্য নয়। সিটি মেয়রের বরাত দিয়ে তিনি বলেছেন, এমন কোনো ঘটনার কথা কারোই জানা নেই।
অর্থনীতি নিয়েই ট্রাম্পের আক্রমণটা ছিলো বেশি। বাইডেন প্রশাসন দেশের অর্থনীতিকে যে ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় নিয়ে গেছে সে কথা তুলে ধরেছেন। কমলা অবশ্য প্রতিবাদে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের এবারের প্রতিদ্বন্দ্বী বাইডেন নন, স্বয়ং তিনি। আর তার রয়েছে 'অপরচুনিটি ইকোনমি' নামের নতুন এক পরিকল্পনা যা, মধ্যবিত্তকে ঘিরে তৈরি। তাদের জীবন-জীবিকা নিশ্চিত করাই এর মূল লক্ষ্য। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ইনকাম ট্যাক্সে সহযোগিতা ছাড়াও সার্টআপে উৎসাহিত করতে প্রণোদনা প্যাকেজের সরাসরি ঘোষণা ছিলো কমলার।
যুদ্ধপ্রসঙ্গ খুব স্পষ্ট করেই এসেছে। সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে গাজা যুদ্ধ নিয়ে। এখানে রাজনীতি করার চেষ্টা দুই প্রার্থীর পক্ষ থেকেই ছিলো। যাতে ইসরাইলকে পক্ষে টানার চেষ্টা ছিলো। ট্রাম্পতো বলেই ফেললেন, কমলা প্রেসিডেন্ট হলে ইসরাইলের অস্তিত্বই থাকবে না। যেনো তিনিই একমাত্র ইসরাইলের রক্ষাকর্তা। আর কমলা যেভাবে এই বক্তব্য প্রতিহত করলেন, ‘না না না আমি ইসরাইল বিরোধী নই’, তাতেই স্পষ্ট হলো এই যুদ্ধে দুই পক্ষই প্যালেস্টাইন বিরোধী। কমলা যে এই যুদ্ধে বাইডেন নীতিই আপহোল্ড করবেন তা তিনি স্পষ্ট করেই বললেন, শুধু মিন মিন করে এইটুকু জানাতে চেষ্টা করলেন যে, প্যালেসটাইনে মানবতা ভুলণ্ঠিত হচ্ছে যার অবসান তিনি চান।
স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে প্রশ্ন ছিলো কমলার কিছু নিজস্ব পরিকল্পনা আছে যা তিনি বলেছেন। আর ওবামাকেয়ারতো রয়েছেই ডেমোক্র্যাটদের জন্য। কিন্তু ট্রাম্প ওবামাকেয়ারের ঘোরবিরোধী সে কথা বললেন। প্রশ্ন ছিলো তোমার কি পরিকল্পনা রয়েছে? ট্রাম্পের উত্তর- আমরা ভালো ভালো পরিকল্পনা হাতে নেবো। এখনই কিছু বলতে পারছি না।
এসবে হাসির পাত্র হয়েছেন ট্রাম্প। কিন্তু হাসার কেউ ছিলো না। কারণ দর্শক ছিলো না। দুই উপস্থাপক তো হাসতে পারেন না। কেবল হেসেছেন কমলা। নানাভাবে হেসেছেন, নানা মুখোভঙ্গিতে। তাতে ট্রাম্পের প্রতি কখনো সন্দেহ, কখনো অবজ্ঞা, কখনো উপহাসই প্রকাশ পেয়েছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিক থেকে একটাই এক্সপ্রেশন ছিলো- চরম অবজ্ঞা। যেনো তিনি কমলার দিকে তাকাতেই নারাজ ছিলেন। পুরো ভিডিও আরেকবার দেখলে দেখা যাবে খুব কমই দৃষ্টি বিনিময় হয়েছে দুই তার্কিকের। ট্রাম্পের চোখবন্ধ, শুণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা কিংবা নীচের দিকে তাকিয়ে থাকার দৃশ্যটাই বেশি মনে পড়ে। ফলে কোন উচ্চবাচ্য ছিলো না।
সবমিলিয়ে একটি নির্ভেজাল সাবলীল বিতর্ক হয়েছে একথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু কতটা গভীরের আলোচনা হয়েছে? দুই পক্ষ আগামী চার বছর তাদের রাজনৈতিক দর্শন কী হবে তা কতটা তুলে ধরতে পারলেন? তা স্পষ্ট হলো না। কিংবা বিতর্কটি কি আদৌ বুদ্ধিদীপ্ত কিছু ছিলো? কমলার কাছে কিছু প্রত্যাশা ছিলো কিন্তু তা কি পূরণ হলো?
মেয়ে বললো, 'বাবা প্রতিপক্ষ শক্ত না হলে তুমি কখনো বুদ্ধিদীপ্ত কিছু তুলে ধরতে পারবে না।' হয়তো ওর কথাই ঠিক। কিন্তু আরেকটি প্রশ্ন তো থেকেই যায়- বিতর্কের এই সুযোগ কতটুকুই নিতে পারলেন কমলা হ্যারিস। সকলেতো ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা আগে থেকেই জানেন, কিন্তু কমলাকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে নতুন করে দেখছেন। তার সুযোগ ছিলো নিজের কথাগুলো বলার।
তাই প্রশ্ন- হতে পারে এই বিতর্কে কমলা হ্যারিসের জয় হলো, কিন্তু এর প্রভাব কি নভেম্বরের নির্বাচনে আদৌ পড়বে? সেকথা সময়ই বলে দেবে। আমেরিকানদের সে জন্য ৫ নভেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
বাই দ্য ওয়ে- এবারে কিন্তু আর কোনো বিতর্ক হবে না। এরপর সরাসরি ভোট। শিগগিরই শুরু হয়ে যাবে আগাম ভোট। সুতরাং কমলা হ্যারিস নাকি ডোনাল্ড ট্রাম্প এই নিয়ে আগামী কিছুদিন ভোটের মাঠ গরম থাকবে তাতে সন্দেহমাত্র নেই।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ঐতিহাসিক ও বহুমাত্রিক। আবার এই দুই নিকট-প্রতিবেশীর মধ্যকার সম্পর্ক অত্যন্ত স্পর্শকাতরও বটে। ফলে উভয় দেশের সম্পর্ক ভারসাম্য, ন্যায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে ইতিবাচক পথে অগ্রসর হওয়া দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য খুবই জরুরি। বিশেষত, উত্তর-পূর্ব ভারত ও পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সঙ্কট এবং মিয়ানমারে অব্যাহত সশস্ত্র গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে উভয় দেশকেই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের পথে অগ্রসর হওয়াই মঙ্গলজনক। কিন্তু এই সম্পর্ক নষ্ট করতে উভয় দেশের সদিচ্ছার পরেও নানামুখী ষড়যন্ত্র রয়েছে। এজন্য উভয় দেশকেই সজাগ থেকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ইতিবাচক গন্তব্যে এগিয়ে নেওয়া আবশ্যক।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের এক মাস পূর্তি উপলক্ষ্যে বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। ভাষণে ভারতসহ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক চান জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, তবে সেই সম্পর্ক হতে হবে ন্যায্যতা এবং সমতার ভিত্তিতে। ভারতের সঙ্গে আমরা ইতোমধ্যে বন্যা মোকাবিলায় উচ্চপর্যায়ের দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার আলোচনা শুরু করেছি । দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমি সার্ক রাষ্ট্র গোষ্ঠী পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নিয়েছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ যেন একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বিশ্বের কাছে সম্মানের সঙ্গে পরিচিত হয়। দেশের পরিকল্পনা যেন দেশের মানুষ কেন্দ্রিক হয়, কোনও নেতা বা দল কেন্দ্রিক নয়।
ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এগিয়ে নিতে কাজ করে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নতুন পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে তিনি সাংবাদিকদের আরও বলেন, ‘আমি আগেও বলেছি দুই দেশের জন্য প্রযোজ্য শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা অর্জনের জন্য আমরা বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি। আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার জন্য কাজ করে যাব।’
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বাংলাদেশের ক্ষমতার পরিবর্তনের পর পরই নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। উভয় দেশই আশা করেছে যে, বাংলাদেশ-ভারতের ঐতিহাসিক ও নিবিড় সম্পর্ক অটুট ও অব্যাহত থাকবে। কিন্তু এইসব আশাবাদ তখনই সফল হবে, যখন দুই দেশের সম্পর্ক বিনষ্টের নানা ষড়যন্ত্র দমন করা যাবে এবং উচ্চপর্যায় থেকে হটকারিতা পরিহার করা সম্ভব হবে।
প্রসঙ্গত বলা দরকার যে, দক্ষিণ এশিয়ার জটিল ভূ-রাজনীতিতে সম্পর্ক উন্নয়নের মাত্রা যেমন আছে, সম্পর্ক অবনতির প্রবণতাও রয়েছে। রয়েছে নানামুখী চক্রান্ত যা বিভিন্ন দেশের সম্পর্ককে বিঘ্নিত করতে প্রকাশ্য ও গোপনে কাজ করে। সরকারগুলোতে এজন্য অত্যন্ত সতর্ক ও সজাগ থাকা অপরিহায।
দৃষ্টান্ত স্বরূপ উল্লেখ্য করা যায়, ভারতীয় মিডিয়ার আচরণের বিষয়গুলো। বাংলাদেশে যখন ছাত্রগণআন্দোলন হয়, তখন তাদের প্রচারণা নিয়ে নানা সন্দেহ দেখা দেয়। বিশেষত, ছাত্র-জনতা, এমনকি, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা যখন হিন্দু বাড়ি ও মন্দির পাহারা দিয়ে দুষ্কৃতিকারীদের মোকাবেলায় সাফল্য দেখাচ্ছিল, তখন ভারতীয় মিডিয়ায় উস্কানীমূলক প্রচারণা লক্ষ্য করা গেছে। শান্তির পক্ষে না দাঁড়িয়ে অশান্তির প্ররোচণা সে সময় ভারতীয় মিডিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ ও অবিশ্বাসযোগ্য করেছিল।
হতাশার বিষয় হলো, তৃতীয় শ্রেণির প্রোপাগান্ডা ভিত্তিক নিম্নস্তরের মিডিয়ায় সঙ্গে পুরনো ও পেশাগত সংবাদমাধ্যমও সুর মেলাতে দেখা গেছে। সেই সঙ্কুল পরিস্থিতির পর এখনও ভারতের নানা মিডিয়ায় এমন খবর প্রকাশ পাচ্ছে, যা শুধু আপত্তিকরই নয়, সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর। যেমন, ইন্ডিয়া টুডের-এর মতো পত্রিকার ভিডিও রিপোর্টে বলা হচ্ছে, নতুন সরকার ভারতের জন্য হুমকি, নতুন সরকারের অধীনে বাংলাদেশ হয়ে গেছে পাকিস্তান ২.০। এমনকি, কিছু কথিত ‘বাংলাদেশী জঙ্গি‘র সাক্ষাতকার প্রচার করে উত্তেজনাও ছড়ানো হচ্ছে। ভারতের সরকার এসব দেখতে না, এটা বিশ্বাস করা মুস্কিল। ভারতের মাটিতে ও ভারতের মিডিয়ায় এ ধরনের বাংলাদেশ-বিরোধী প্রচারণা বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে ভারতের সদিচ্ছার বিষয়টি চরমভাবে বিতর্কিত হবে এবং পরিণামে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা কোনও দেশের জন্যই কাম্য বা কল্যাণকর হবে না।
ভারতের দিক থেকে এই বাস্তবতা অবশ্যই বিবেচনায় রাখা দরকার যে, বাংলাদেশের একটি ভারত-বিরোধী রাজনৈতিক স্রোত বহু আগে থেকেই রয়েছে। তাছাড়া, বিগত হাসিনা সরকারকে সাধারণভাবে মনে করা হয় ভারতপন্থী। আর বর্তমানে হাসিনা রয়েছেন ভারতের আশ্রয়ে। ফলে ভারতের মাটিতে বা মিডিয়ায় বাংলাদেশ বিরোধী উস্কানী তৈরি করা হলে বাংলাদেশের জনমনে এর প্রতিক্রিয়া হবে মারাত্মক, যা ভারত-বিরোধিতার মাত্রাকে আরও বাড়াবে।
উচ্চপর্যায় থেকে হটকারি মন্তব্যও অনেক সময় পারস্পরিক সম্পর্কের হানি ঘটায় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণ হয়। যেমনটি হয়েছে সাম্প্রতিককালে। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং কে ক্ষমা চাইতে হবে মন্তব্য করে বিএনপি চেয়াপারসনের উপদেষ্টা ও বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক বলেছেন, আপনারা মন্ত্রী আমিও কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। আপনি যে বক্তব্য দিয়েছেন সেজন্য আপনাকে ক্ষমা চাইতে হবে। বাংলাদেশের মানুষের মন বড়। তারা ক্ষমা করতে জানে। সুতরাং বাংলাদেশ নিয়ে তাচ্ছিল্য করে বক্তব্য দিবেন না সেটা কেউ মেনে নেবে না।
সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে রাজধানীতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ১২ দলীয় জোটের উদ্যোগে আয়োজিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ ভারতের আগ্রাসী বক্তব্যের প্রতিবাদে’ বিক্ষোভ সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন। তাছাড়া, ভারত বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পক্ষে নয় বরং শেখ হাসিনার ‘জমিদারি’ ফেরত দিতে কাজ করছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ভারতের সরকার বা মিডিয়ার পক্ষ থেকে অহেতুক বিতর্ক ও উস্কানি সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক বক্তব্য বা মিথ্যা প্রচারণা পরিস্থিতিকে নাজুক করবে। সেসব বুমেরাং হয়ে ভারত বিরোধিতায় পযবসিত হবে। ভারত বিরোধীরা সমালোচনা ও বিরোধিতার হাতিয়ার পাবে। সম্পর্ক ভালো করার বদলে নষ্ট করার প্রচেষ্টা বা বিরোধিতা করার অস্ত্র হাতে তুলে দেওয়ার মতো অপরিপক্ব কাজ কোনও কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন ও সুবিবেচনার পরিচয় হতে পারে না। বরং এগুলো বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিনষ্টের ষড়যন্ত্র স্বরূপ। অতএব, ভারতের মাটিতে বা মিডিয়ায় বাংলাদেশ বিরোধী উস্কানী ও মিথ্যাচার সম্পর্কে উভয় দেশের সচেতন মানুষ, বস্তুনিষ্ট মিডিয়া ও সরকারকে সর্তক থাকা দরকার এবং নানা ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ভারসাম্য, ন্যায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে আরও এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে সচেষ্ট থাকা প্রয়োজন।
ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।
প্রতিটি মানুষই গর্ভধারিণী মাকে ভালোবাসে। এতোটাই ভালোবাসে যে, সেই ভালোবাসার সাথে পৃথিবীর অন্য কোনো ভালোবাসার তুলনা হয় না, সে সুযোগও নাই। পিতার একাধিক স্ত্রী থাকার কারণে কারো যদি একাধিক মা থাকে, সেক্ষেত্রেও অন্যান্য মায়ের তুলনায় গর্ভধারিণী মায়ের সম্পর্কের অনুভূতিগত গভীরতা ভিন্ন মাত্রার হয়। ‘জন্ম’ অনেক বড়ো ব্যাপার। জন্মের সাথে যার সম্পর্ক সে সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য, তুলনাহীন। জন্মের পর সদ্যজাত শিশুকে গর্ভফুল থেকে আলাদা করার জন্য নাড়ী কেটে দেওয়া হয়। নাড়ী কেটে বিচ্ছিন্ন করার বিষয়টি দৃশ্যমান কিন্তু নাড়ীর যে অদৃশ্য বন্ধন, তা কখনো কাটা সম্ভব হয় না। এই অদৃশ্য বন্ধনই পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী বন্ধন।
প্রতিটি মানুষের নিজস্ব দৃষ্টিতে, অনুভূতিতে, সর্বগুণ বিবেচনায়, সর্বদিক বিবেচনায় তার মা-ই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা। নিজস্ব অনুভূতিগত দৃষ্টি ও বিবেচনার বাইরে গিয়ে সর্বম্বাভাবিক বিবেচনায় যদিও সেই মা হয়তোবা একজন অখ্যাত নারী, একজন তুচ্ছাতিতুচ্ছ অতিক্ষুদ্র মানুষ। এই পৃথিবীর কয়েক কোটি কুকুর আছে, মানুষের কাছে যাদের মূল্য হয়তো ওই মায়ের থেকে বেশি। ওই কুকুরগুলোর কুকুরাধিকার ওই মায়ের মানবাধিকারের চেয়ে বেশি সংরক্ষিত। তবুও তিনি তার মা, তার কাছে তার মা-ই সেরা মা।
অনেকের মা-ই হয়তো তাকে ঠিকমতো খাওয়াতে পারেনি, পরাতে পারেনি, পরিচর্যা করতে পারেনি। মা সন্তানকে অনেক মেরেছে, বকেছে, অভিশাপ দিয়েছে। সন্তান মায়ের উপরে অভিমান করেছে, কটূকথা বলেছে, ঝগড়া করেছে, দোষারোপ করেছে, অভিযোগ করেছে। কিন্তু কোনো সন্তানই মায়ের থেকে ভালো কাউকে বাসতে পারেনি। জন্মদানের মহাত্ম্য কখনো ম্লান হয় না, জন্মঋণ কখনো পরিশোধ করা যায় না, জন্মসম্পর্ক কখনো ছিন্ন করা যায় না। এজন্য সন্তানের কাছে ‘মা’ পৃথিবীর সর্বসেরা নারী ও মানবী; আর এজন্যই সকল দেশের সেরা ভূমি, আমার জন্মভূমি।
বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের প্রেক্ষাপট:
১৯০৫ সালের পূর্বে ব্রিটিশ-ভারতে ‘বঙ্গ প্রদেশ’ বা ‘বাংলা প্রেসিডেন্সি’ নামে যে প্রদেশটি ছিল তার অন্তর্ভুক্ত অঞ্চল ছিল সমগ্র বাংলা (বর্তমান বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলা), বিহার, উড়িষ্যা, মধ্য প্রদেশ ও আসামের কিছু অংশ। প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধির কথা বলে লর্ড কার্জন ১৯০৩ সালে এই বিরাট প্রদেশকে দুইভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি উত্তর ও পূর্ব বাংলাকে আসামের সাথে সংযুক্ত করে একটি নতুন প্রদেশ সৃষ্টি করেন এবং নবগঠিত সেই প্রদেশের নামকরণ করেন পূর্ব বাংলা ও আসাম। অপরদিকে পশ্চিম বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সমন্বয়ে আরেকটি প্রদেশ গঠন করে তার নাম দেওয়া হয় ‘বাংলা প্রদেশ'। এই বিভাজনটি ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ নামে পরিচিত। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর থেকে বঙ্গভঙ্গ আইন কার্যকর হয়।
বাংলাকে এভাবে ভাগ করাটা তখনকার জনসাধারণ মেনে নেয়নি, ফলে বঙ্গভঙ্গ রোধ করার জন্য ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পক্ষে, অর্থাৎ বাংলা বিভক্তির বিরুদ্ধে, বাংলাকে একীবদ্ধ রাখার জন্য ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি রচনা করেন। গানটির মূল পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়নি, ফলে গানটি রচনার সুনির্দিষ্ট তারিখ জানা যায় না। সত্যেন রায়ের লেখা থেকে জানা যায়, ১৯০৫ সালের ৭ই আগস্ট কলকাতা টাউন হলে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আয়োজিত একটি প্রতিবাদসভায় গানটি প্রথম গাওয়া হয়। ওই একই বছরের ৭ই সেপ্টেম্বর মোতাবেক ২২শে ভাদ্র, ১৩১২ বঙ্গাব্দে ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বাক্ষরে গানটি ছাপা হয়। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “বাউল” নামক গ্রন্থে গানটি অন্তর্ভুক্ত আছে।
গগন হরকরা বা গগন চন্দ্র দাস ছিলেন একজন বাংলা লোকসংগীত শিল্পী, সংগীত রচয়িতা ও বিশিষ্ট বাউল গীতিকার। তাঁর জন্ম বাংলাদেশের শিলাইদহের নিকটস্থ আড়পাড়া গ্রামে। পেশায় তিনি ছিলেন চিঠি বিলিকারী। শিলাইদহ ডাকঘরে চিঠি বিলি করতেন। শিলাইদহে অবস্থানকালীন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর বিশেষ অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে। তাঁরা দুজনে প্রায়ই আলাপ-আলোচনা ও সংগীত চর্চা করতেন। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’র সুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সংগ্রহ করেছিলেন গগন হরকরার রচিত ও সুরারোপিত গান "আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনে মানুষ যে রে" গানের সুর হতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেও সে কথা বলে গিয়েছেন।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী রাজনীতিক, স্বদেশী কর্মী ও বিপ্লবীরা বাঙালি জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার জন্য গানটিকে ব্যাপকভাবে প্রচার করেন। ব্যাপক আন্দোলনের মুখে ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজ শাসক লর্ড হার্ডিঞ্জের শাসনামলে দিল্লীর এক সভাতে ব্রিটিশ রাজা পঞ্চম জর্জের উপস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়।
বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সাথে গানটির ঐতিহ্যগত ও বৈপ্লবিক সম্পর্ক:
১. সার্বিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে বাঙালির প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৫৩-৫৪ শিক্ষাবর্ষের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের অভিষেকসহ অন্যান্য নানা অনুষ্ঠানে গানটি বারবার গীত হয়েছে।
২. একুশের প্রভাত ফেরির অন্যতম গান হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা গানটি’ ১৯৫৩ সাল থেকেই গীত হয়ে আসছিল।
৩. মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ২৮ জুন কুড়িগ্রামের রৌমারী ট্রেনিং ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের গাওয়া ‘আমার সোনার বাংলা’র ভিডিও আমাদের প্রাণে এখনও শিহরণ জাগায়। মুক্তিযুদ্ধের অনেকগুলো জনপ্রিয় গানের মধ্যে এটি একটি অন্যতম জনপ্রিয় গান।
৪. স্বাধীনতা প্রাপ্তির পূর্বে, ১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘জীবন থেকে নেওয়া’ সিনেমায় গানটি স্থান পায়। জহির রায়হান নির্মিত ওই সিনেমায় তৎকালীন স্বাধীনতা আন্দোলনকে রূপকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। ফলে গানটি স্বাধীনতা আন্দোলনের একটা শক্ত ও অমোচনীয় সাংস্কৃতিক ভিত্তি হয়ে আছে।
৫. ১৯৭১ সালের ৩রা জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগ এক সমাবেশের আয়োজন করে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে চেতনা জাগানোর নিমিত্তে সেই সমাবেশে এই গানটি গাওয়া হয়।
৬. ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের আগে গানটি গাওয়া হয়।
৭. ১৯৭১ সালের ২৩শে মার্চ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা প্যারেডে গানটি গাওয়া হয়।
৮. বাংলাদেশের প্রবাসী মুজিবনগর সরকার আয়োজিত অনুষ্ঠানে গানটি গাওয়া হয় এবং প্রবাসী মুজিবনগর সরকার গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
৯. মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত পরিবেশন করা হতো। মুক্তিযুদ্ধের সময় গানটির যন্ত্রসুর করেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সুরকার অজিত রায়।
১০. স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়ন হলে, এর ৪.১ অনুচ্ছেদে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির প্রথম ১০ চরণ (মোট চরণ ২৫ চরণ) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১১. গানটির প্রথম ১০ ছত্র কণ্ঠসংগীত এবং প্রথম ৪ ছত্র যন্ত্রসংগীত; সামরিক বাহিনীতে ব্যবহার করা হয়।
১২. ’৬৯-এর উত্তাল গণ-অভ্যুত্থানের কাল পেরিয়ে ’৭০-এর নির্বাচন ও ’৭১-এ মুক্তিসংগ্রামের ব্রত নিয়ে সংগঠিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ’৭১-এর ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের ক্যান্টিনে জাতীয় সংগীত সংক্রান্ত আলোচনায় সর্বসম্মতিক্রমে গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্ধারণের প্রস্তাব গ্রহণ করে।
১৩. ঢাকায় ৩ মার্চ ১৯৭১-এ অনুষ্ঠিত প্রতিবাদী জনসভায় গানটি গীত হয়।
১৪. ১৩ই জানুয়ারি, ১৯৭২ তারিখে মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকে এ গানটির প্রথম দশ চরণ সদ্যগঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচিত হয়।
এখানে কয়েকটি মাত্র উল্লেখ করো হলো। বস্তুত স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে এ গানটির এরকম শত-সহস্র সংশ্লিষ্টতা আছে।
শ্রোতা জরিপ ও বিশ্ব মঞ্চে আমাদের জাতীয় সংগীত:
১. ২০০৬ সালে বিবিসি বাংলার শ্রোতা জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ২০টি গানের মধ্যে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি প্রথম স্থান অধিকার করে।
২. বেইজিং অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাজানো ২০৫টি দেশের জাতীয় সংগীতের মধ্যে ‘সেরা দশ’ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত দ্বিতীয় স্থান লাভ করে।
বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি:
গবেষক ও সাংবাদিক হাসান শান্তনুর লেখা থেকে জানা যায় এ পর্যন্ত কমপক্ষে তিন বার সরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের আলোচনা হয়েছে।
১. ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতি পদে বসে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. দ্বীন মুহাম্মদকে চেয়ারম্যান করে গঠিত ওই কমিটি কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’, ফররুখ আহমদের ‘পাঞ্জেরি’ কবিতাকে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব দেয়।
২. রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৯ সালের ৩০ এপ্রিল ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে বাদ দিয়ে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’ গানটিকে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব করা হয়। মোশতাকের সরকার পাল্টা ক্যু ও জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ায় সে প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
৩. ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে চারদলের জোট সরকারের আমলে, ২০০২ সালের ১৯ মার্চ তখনকার দুই মন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদ জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের জন্য প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছে যৌথ সুপারিশপত্র জমা দেন। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ওই যৌথ প্রস্তাবটিকে আমলে নেননি।
৫ই আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের সাম্প্রতিক দাবি:
সাম্প্রতিককালে সুনির্দিষ্ট চিহ্নিত মহলের কিছু ব্যক্তিবর্গের মধ্য থেকে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের কানাঘুষা ও আলাপ-আলোচনা শোনা যাচ্ছে। আমি একটি উদাহরণ দিয়ে আলোচনাটা করার চেষ্টা করছি। গত ৩রা সেপ্টেম্বর ২০২৪ সালে, জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতকে ‘স্বাধীনতার অস্তিত্বের পরিপন্থী’ আখ্যা দিয়ে তা পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী। তিনি জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের পাশাপাশি বাংলাদেশের সংবিধানকেও নতুন করে রচনার দাবি জানান।
আমান আযমী বলেন, ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ-রদ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। এই জাতীয় সংগীত দুই বাংলা এক করার জন্য জাতীয় সংগীত। আমরা কি দুই বাংলা এক হতে চাচ্ছি? আমরা কি স্বাধীন বাংলাদেশ রাখতে চাই, নাকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অঙ্গীভূত রাজ্য হতে চাই?
তিনি বলেন, আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ চেয়েছি, স্বাধীন বাংলাদেশে থাকতে চাই। এই জাতীয় সংগীত আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের পরিপন্থী। আমি জোর দাবি জানাচ্ছি, আমাদের নতুন জাতীয় সংগীত তৈরি করা হোক।
জনাব আযমী বাহাত্তরের সংবিধানকে অবৈধ আখ্যা দিয়ে বলেন, ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ জনগণের কাছ থেকে ম্যান্ডেট নিয়েছিল পাকিস্তানের সংবিধানের অধীনেই পাকিস্তান রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য, স্বাধীন সংবিধান রচনা করে নয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে, আমরা যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছি-আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু তারা জনগণের কাছ থেকে নতুন সংবিধান প্রণয়নের কোনো ম্যান্ডেট নেয়নি। সুতরাং এই সংবিধান আমার দৃষ্টিতে বৈধ নয়। নতুন করে একটা কমিটি করে নতুন সংবিধান তৈরি করা হোক, এটা বাতিল করা হোক।
জনাব আযমীপন্থীরা নানাভাবে নানা যুক্তি তুলে ধরে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি তুলছেন এবং সেইসাথে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও স্বাধীনতা অর্জনের প্রকৃত সত্যকে মনগড়া ও অর্পিত অপ্রকৃত দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে চাইছেন। যেমন- এই গানটিতে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটা নাই, আছে ‘বাংলা’, ফলে এটা পশ্চিম বাংলা নাকি পূর্ব বাংলা সেটার পার্থক্য করা যায় না। এরকম আরও অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত যুক্তি তুলে ধরা হচ্ছে।
জনাব আযমী সাহেবের বক্তব্য ও যুক্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য তো নয়ই বরং এটা খুবই ঘৃণ্য এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, প্রেক্ষাপট এবং বর্তমান দেশকে অস্বীকার করার মতো চরম মৌলিক উপাদান সম্বলিত ও সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। এই বক্তব্যের বিপরীতে কথা বলতেও রুচিতে বাধে। তারপরেও দু/চারটি কথা বলতে হচ্ছে। কারণ, এইরকম আসার বক্তব্যকে মহাবাণী হিসেবে গ্রহণ করে, তাকে সমর্থন করার মতো বুদ্ধিবৃত্তিক বন্ধ্যত্বের প্রাদুর্ভাবে আক্রান্ত লোকজনের সংখ্যা এ দেশে কম নয়।
প্রথমেই বলে রাখি, আযমী সাহেব বলেছেন, “আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ চেয়েছি, স্বাধীন বাংলাদেশে থাকতে চাই।” এই কথাগুলোর প্রথম অংশ সত্য নয়। আযমী সাহেবরা তখন স্বাধীনতা চাননি। কথাগুলোর পরবর্তী অংশ সত্য কিনা তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে, তারা কীভাবে থাকতে চান; স্বাধীনভাবে, নাকি কারো ছায়াতলে!
১৯৭০ সালের নির্বাচন হয়েছিল পাকিস্তানের অধীনে। স্বভাবতই সেই নির্বাচনের ম্যান্ডেট ছিল পাকিস্তানকেন্দ্রীক। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হবার পর স্বাধীনতার আগের সেই পাকিস্তানকেন্দ্রীক ম্যান্ডেট কার্যকর থাকার প্রশ্নই আসে না। স্বাধীন দেশে স্বাধীন সংবিধান রচনা হবে সেটাই স্বাভাবিক। জনাব আযমী সাহেব, স্বাধীন দেশে পাকিস্তানের সংবিধান কার্যকর রাখার পক্ষে এবং বাংলাদেশের সংবিধান রচনার বিপক্ষে কথা বলেছেন। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য বক্তব্য হতেই পারে না। এই যুক্তি তুলে ধরে, তিনি ও এই ধারার মানসিকতাধারীরা কী চাইছেন, সেটা বোঝার জন্য বোধ হয় খুব বেশি বুদ্ধি খরচার দরকার নাই।
আমার সোনার বাংলা গানটি বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটে রচিত বলে এটা বাংলাদেশের ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে না, জনাব আযমী সাহেবের এ যুক্তিটিও একটি খোঁড়া এবং অগভীর জ্ঞান থেকে উত্থিত সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক ধ্যানধারার প্রতিনিধিত্বকারী যুক্তি। এর মাধ্যমে তিনি ইতিহাস ঐতিহ্যকে অস্বীকার করেছেন। এই গানটির সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের যে সম্পর্ক আছে, তার কয়েকটি উদাহরণ ইতোমধ্যে দিয়েছি, পরে আরও বিস্তারিত বলব।
ভারত বিভক্তি: এক জগাখিচুড়ি, না হয়েছিল জাতির ভিত্তিতে, না হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে:
১৯৪৭ সালে জওহরলাল নেহেরু, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এবং সরদার ভল্লভভাই প্যাটেল-সহ কংগ্রেস নেতাগণ ব্রিটিশ-ভারতকে এক রেখে, একজাতির একদেশ দাবি করেছিলেন। তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ তখন বলেছিলেন, "হিন্দু মুসলিমদের একই জাতীয় পরিচয়ে পরিচিত করা একটা স্বপ্নমাত্র।" মি. জিন্নাহ তখন দ্বি-জাতি তত্ত্ব দিয়েছিলেন। এর আগে ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে পাঞ্জাবের রাজধানী লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের প্রথমদিন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কুখ্যাত দ্বি-জাতি তত্ত্বের ঘোষণা দেন। তিনি ধর্ম ও জাতিকে এক করে ফেলেছিলেন, কিন্তু ধর্ম ও জাতি এক নয়। একটি ধর্মে বিভিন্ন জাতির মানুষ থাকতে পারে, আবার একটা জাতিও বিভিন্ন ধর্মের লোকের সমন্বয়ে গঠিত হতে পারে। জনাব জিন্নাহ, ধর্মকে জাতি হিসেবে নিয়ে ভারত বিভাজনের মূল ব্লেন্ডারটা করেছিলেন। জনাব জিন্নাহর কারণে, শেষ পর্যন্ত ভারত বিভক্তিটা- না হয়েছিল জাতির ভিত্তিতে, না হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। জাতির ভিত্তিতে হলে দুই বাংলা এক থাকার কথা, ধর্মের ভিত্তিতে হলে কাশ্মীরের পুরোটাই পাকিস্তানের অংশ থাকার কথা। ফলে জগাখিচুড়ি করে ভারত বিভক্ত হয়েছিল এবং এই জগাখিচুড়ির দায় জনাব জিন্নাহর।
ব্রিটিশ শাসিত বাংলা দুইভাগে ভাগ হয়েছিল বলে তাদের কৃষ্টি, ভাষা, সংস্কৃতি ভাগ হয়ে যায়নি। ফলে বঙ্গভঙ্গের আগে দুই বাংলার যে কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ভাষা ও ঐতিহ্য ছিল তা পরিবর্তন হয়ে যায়নি। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি অখণ্ড বাংলার প্রতিনিধিত্ব করেছিল বলে, খণ্ডিত বাংলায় সেটা পরিবর্তন হয়ে যায়নি। কারণ, গানটিতে যে অখণ্ডতার কথা বলা হয়েছে সে অখণ্ডতা শুধু ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা নয়, স্বজাতির আত্মিক ও সাংস্কৃতিক অখণ্ডতাও বটে। বাংলাদেশ থেকে বহির্বিশ্বে অন্য কোনো দেশে গিয়ে কেউ নাগরিকত্ব নিলে তাঁর কৃষ্টি, সংস্কৃতি পরিবর্তন হয়ে যায় না, তার নাগরিকত্ব, জাতীয়তা পরিবর্তন হয় কিন্তু জাতি পরিবর্তন হয় না। বরং এখানে যে প্রশ্নটি করা যায় তা হলো- ভারতকে বিভক্তির সময়ে কেন বাংলাকে অখণ্ড রেখে বিভক্ত করা হলো না? একটা জাতির মধ্যে ছুরি চালিয়ে, তাকে কেটে কেন দুভাগ করা হলো? বাংলাকে এভাবে ভাগ করার দায় তো রবীন্দ্রনাথের নয়, এ দায় জিন্নাহর। ফলে, জনাব আযমী যদি তাঁর বক্তব্যে জিন্নাহকে দায়ী করতেন, সেটা বরং গ্রহণযোগ্য হতো। ফলে এই কারণ দেখিয়ে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের বিষয়টি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটে রচিত হলেও এ গানটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এবং বহুল ব্যবহৃত একটি গান। আন্দোলনের পরতে পরতে গানটি গাওয়া হয়েছে। মানুষকে উজ্জীবিত করার জন্য এর অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের আবহাওয়া, ঋতুর বৈশিষ্ট্য, আবেগ, সংস্কৃতি সবকিছুর সাথে গানটির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য।
পশ্চিম বাংলার সাথে আমাদের অনেককিছুরই মিল আছে বলে তার সবকিছুকে বাদ দিতে হবে এমন চিন্তা কোনো সুচিন্তা হতে পারে না। ওরা বাংলায় কথা বলে, এজন্য আমরা বাংলায় কথা বলা ছেড়ে দেবো? ওরা ‘মা’ বলে, এজন্য আমরা ‘মা’ বলব না? একাধিক দেশের সাথে নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতির মিল থাকাটা গর্বের, এটাকে অগর্বের বলে প্রচারের মধ্যে ক্ষুদ্র সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকটতা দায়ী। যুগ যুগ ধরে ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার দিকে তাকালে দেখা যাবে, তারা তাদের কৃষ্টি, ভাষা ইত্যাদিকে দখলদার ভূখণ্ডের উপরে চাপিয়ে দিয়ে তাদের নিজেদের কৃষ্টির মতো করতে চেয়েছে। সেটা গর্বের বলেই চেয়েছে। পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রকৃতিগতভাবে আপনা-আপনিই যে মিল রয়েছে তা গর্বের হতে পারে, অগর্বের বা বিভেদের হতে পারে না। সারা পৃথিবী যদি আমাদের ভাষা ও কৃষ্টির মতো বা তার কাছাকাছি হতো সেটা হতো আরও গর্বের। আমরা আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেবার কাজটি করতে পারি কিন্তু এটাকে সঙ্কুচিত করে এমন প্রয়াস নিতে পারি না।
বাংলার বাঘ, বাংলার বাঘিনী, বাংলার দামাল ছেলে, বাংলা মায়ের সন্তান, বঙ্গ জননী ইত্যাদি শব্দগুলোর বহুল ব্যবহার আছে। শব্দগুলোকে বাংলাদেশের বাঘ, বাংলাদেশের বাঘিনী, বাংলাদেশের দামাল ছেলে, বাংলাদেশের মায়ের সন্তান, বঙ্গদেশের জননী বলার প্রয়োজন নাই। আবার “দেশনেত্রী” শব্দটিও আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত। এখানে বলার প্রয়োজন নাই “বাংলাদেশ নেত্রী”। কবিতা, গান ও অনেক সম্মানসূচক শব্দাবলী উচ্চারণের সময়ে অনেক ক্ষেত্রেই শব্দের প্রচ্ছন্নতা বা অ্যাবসট্রাক্ট, সংক্ষিপ্ত রূপ ইত্যাদি ভাষার সৌন্দর্য বর্ধন করে। এগুলো হলো সেরকম বিষয়। ফলে গানটিতে ‘বাংলা’ শব্দ আছে কিন্তু ‘বাংলাদেশ’ শব্দ নাই, এ কথাগুলো যারা বলছেন, তাদেরকে বড়োজোর বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বলা চলে। যদি সেটা তারা মানতে রাজি না হন, তবে মানতে হবে, তাদের এসব কথা বলার পিছনে অন্য কোনো দুরভিসন্ধি ও ক্ষুদ্রতা ক্রিয়াশীল।
‘আমি নয়ন জলে ভাসি’ কথাগুলোর অর্থ কেউ যদি বোঝে- নয়নের জলে কী বন্যা হয়, যে সেই জলে ভাসবে? এটা যে বুঝছে তার সমস্যা, কথাগুলোর সমস্যা না। ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা’- এই কথাগুলোর বিরোধিতায় একশ্রেণির মানুষ দ্রোহী হয়ে বলে, মুসলমানরা আল্লাহর কাছে ছাড়া আর কারো কাছে মাথা নত করতে পারে না। বোধগত অর্থ না বুঝাতে পারার এই যে বুদ্ধিবৃত্তিক বন্ধ্যত্ব, এটার দায় তো লেখকের নয়। এটা যে বুঝতে পেরেছে না তার সমস্যা এবং এটাকে যারা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য ভুলভাবে বোঝাচ্ছে তাদের দোষ।
জাতীয় সংগীতের উপরে বার বার কেন এ কুঠারাঘাত:
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকেই পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির শাসকগণ এবং তাদের সমর্থকগণ, বাঙালির প্রাণসঞ্জীবনী রবীন্দ্রনাথ ও তার গানের উপরে বার বার কুঠারাঘাত করেছে, নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এর কারণ বহুমুখী। এরমধ্যে হিন্দু বিদ্বেষ ও ঐতিহাসিক সত্যকে চাপা দিয়ে অর্পিত সত্যকে প্রতিষ্ঠা করা-বিষয়ক কারণ দুটি অন্যতম।
হিন্দু বিদ্বেষের বিষয়টিকে যদি আলোচনা করতে চাই তবে এর মূলভিত্তিতে যেতে হবে, যেখানে পাকিস্তানের জাতির পিতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্ত্ব বিষয়ক প্রসঙ্গটি প্রাসঙ্গিক। জনাব জিন্নাহ সাহেব তার রাজনৈতিক জীবনে ধর্মকে কাজে লাগিয়েছেন এবং ধর্মকে জাতি বানিয়ে ধর্মবানতাকে উস্কে দিয়ে নিজেকে ধর্মবান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে সফল হয়েছেন। তিনি বিলেতে লেখাপড়া করেছেন এবং বিলেতি জীবনচর্চায় অভ্যস্ত ছিলেন। মুসলিম প্রীতি প্রচার করে নিজেকে খাঁটি মুসলিম হিসেবে দেখানোর মধ্যে তাঁর ব্যক্তিগত কারণ লুকায়িত ছিল।
জিন্নাহর পিতামহ প্রেমজিভাই ঠাকর ছিলেন হিন্দু। তিনি ছিলেন ভারতের গুজরাটের কাঠিয়াওয়ারের গোন্ডাল রাজ্যের পানেলি মতি গ্রামের বানিয়া সম্প্রদায়ের লোহানা উপ-বর্ণের উপজাত। তিনি মাছের ব্যবসা করতেন বলে নিরামিষ হিন্দু লোহানা উপজাত থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। তিনি মাছের ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে আবার তাঁর বর্ণে ফিরে আসার চেষ্টা করেন কিন্তু লোহানা উপজাত তাকে গ্রহণ করেনি। একারণে ক্রুদ্ধ হয়ে, প্রেমজিভাই ঠাকর তাঁর চার ছেলেসহ ইসলাম গ্রহণ করেন এবং স্থায়ীভাবে বোম্বেতে চলে আসেন, সেখান থেকে পরবর্তীতে পাকিস্তানের করাচিতে চলে যান।
প্রেমজিভাই ঠাকরের চার ছেলের মধ্যে বড়ো ছেলের নাম ছিল পুঞ্জলাল ঠাকর। এই পুঞ্জলাল ঠাকর ছিলেন জিন্নাহর পিতা। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর জিন্নাহর পিতা পুঞ্জলাল ঠাকর, পুঞ্জাভাই জিন্নাহ নাম ধারণ করেন। পুঞ্জাভাই জিন্নাহর স্ত্রী মিথিবাইয়ের গর্ভে সাত সন্তানের জন্ম হয়, যারমধ্যে জিন্নাহ ছিলেন সবার বড়ো। জিন্নাহর বাবা পুঞ্জাভাই জিন্না ছিলেন খোজা ইসমাইলি ফিরকা বিশ্বাসের অনুসারী প্রথম প্রজন্মের মুসলমান, যদিও তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম তাদের ধর্ম বিশ্বাস শিয়া ইসলামের দিকে নিয়ে যায়।
জনাব জিন্নাহ বিলেতে লেখাপড়া করেন, তাঁর জীবন ধারায় ইসলামের চেয়ে বিলেতি চর্চা প্রধান ছিল। বিলেতে গিয়ে ছেলের মনমানসিকতা পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কা থেকে জিন্নাহর মা বিলেতে যাবার আগেই নিজের পছন্দমত মেয়ের সাথে তাঁর বিয়ে দেন। জিন্নাহর প্রথম স্ত্রীর নাম ছিল এমিবাই। তিনি ছিলেন জিন্নাহর দূর সম্পর্কের চাচাত বোন। তিনি ব্রিটিশ ভারতের গুজরাটের রাজকোট জেলার পানেলি মতি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার নিজারি ইসমাইলি শিয়া মুসলিম পটভূমির গুজরাটি খোজা ছিলেন। বিয়ের সময় জিন্নাহর বয়স ছিল ১৬ বছর এবং এমিবাইয়ের বয়স ছিল ১৪ বছর। জিন্নাহর মায়ের আশঙ্কা সত্য হয়েছিল। বিলেতে যাবার পর জিন্নাহ তাঁর স্ত্রীর আর কোনো খোঁজ-খবর নেননি। জিন্নাহর বিলেতে থাকা অবস্থায়ই তাঁর প্রথম স্ত্রী এমিবাইয়ের মৃত্যু হয়।
জিন্নাহর দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন দ্বিতীয় ব্যারোনেটের কন্যা রতনবাই পেটিট। রতনবাইয়ের পরিবার পার্সি সম্প্রদায়ের অন্তর্গত জরথুস্ট্রিয় ধর্মের অনুসারী ছিলেন। পেটিট পরিবার ছিল অত্যন্ত ধনী, নামী, সুশিক্ষিত এবং উচ্চ পাশ্চাত্য। রতনবাই পেটিটের পিতামহ দিনশ মানেকজি পেটিট ভারতের প্রথম তুলা মিল প্রতিষ্ঠা করেন। শিল্প, বাণিজ্য এবং জনহিতৈষীতে অনন্য অবদানের কারণে তিনি ব্যারোনেটসি উপাধি অর্জন করেছিলেন। এই বিয়ের কারণে পেটিট পরিবার তাদের মেয়ে রতনবাইকে অস্বীকার করে। জিন্নাহ ও রতনবাইয়ের বয়সের ব্যবধান ছিল চব্বিশ বছর।
রতনবাঈয়ের গর্ভে তাদের একমাত্র কন্যা দিনার জন্ম হয়, ১৯১৯ সালের ১৫ই আগস্ট। ১৯৩৮ সালে উনিশ বছর বয়সী দিনা এক পার্সি যুবকের প্রেমে পড়েন। এ সময়ে জিন্নাহ ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে পাকিস্তানের সর্বেসর্বা নেতা হতে চলছেন। ফলে জিন্নাহ নিজে অমুসলিম পার্সিকে বিয়ে করলেও ক্ষমতার মোহে বিভোর হয়ে মেয়েকে অমুসলিমের সাথে বিয়ে দিতে অস্বীকার করেন। বাবার নিষেধ সত্ত্বেও মেয়ে দিনা, পার্সি বংশোদ্ভূত এবং পরে ভারতীয় হওয়া নেভিল ওয়াদিয়াকে বিয়ে করেন। নেভিল ওয়াদিয়ার জন্ম ইংল্যান্ডের লিভারপুলে, স্যার নেস ওয়াদিয়া এবং লেডি ইভলিন ক্লারা পাওয়েল ওয়াদিয়ার ঘরে। ১৯৪৩ সালে দিনা-নেভিলের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে এবং তারপর থেকে দিনা তাঁর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বোম্বেতে নিজের পিতামহের বানানো পৈত্রিক নিবাসে বসবাস শুরু করেন। দিনা কখনো তাঁর পিতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর পরিচয় দেননি, তাঁর সাথে কোনো সম্পর্ক রাখেননি।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়। জিন্নাহ তখন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল। প্রবল পরাক্রমশালী ব্যক্তি। তিনি মেয়ে দিনাকে তাঁর কাছে পাকিস্তানের করাচিতে চলে আসতে বলেন। মেয়ে দিনা তখন বাবাকে প্রশ্ন করেন- আমার মায়ের কি হবে? তুমি কী আমার মায়ের কবর বোম্বে থেকে পাকিস্তানে নিয়ে যেতে পারবে? তিনি জিন্নাহর মৃত্যুর পর পিতার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ১৯৪৮ সালে একবারমাত্র পাকিস্তান গিয়েছিলেন। দিনা জিন্নাহর ছেলে অর্থাৎ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নাতি বর্তমান ভারতের অন্যতম শীর্ষ ধনী ওয়াদিয়া গ্রুপের মালিক নাসলি ওয়াদিয়া। দিনার মেয়ে ডায়ানা ওয়াদিয়া। নাসলি ওয়াদিয়ার দুই সন্তান- জাহাঙ্গীর ওয়াদিয়া এবং নেস ওয়াদিয়া। ভাগ্যের এক নির্মম পরিহাস- লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান আদায় করে নেওয়া জিন্নাহর সব উত্তরাধিকারই ভারতীয় নাগরিক, পাকিস্তানে তাঁর কেউ নেই।
পাকিস্তানের জাতির পিতার জন্ম, বিবাহ ও পরিবারে হিন্দু ও অমুসলিম সংশ্লিষ্টতা আছে বলে সেটাকে কাউন্টার করার জন্য একশ্রেণির মানুষ বাংলাদেশের জাতির পিতার সাথে ওই একই ধরনের হিন্দু ও অমুসলিম সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা করেন এবং কাল্পনিক সম্পর্ক তৈরি করে তার প্রচার-প্রচারণাও করেন। যারা এই কাজটি করেন তারা পাকিস্তানপন্থী এই ধারার সাথে সম্পর্কিত। দ্বি-জাতিতত্ত্ব নামক অগ্রহণযোগ্য ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িকতার যে বীজ জিন্নাহ সাহেব ও তাঁর সমর্থকগণ বপন করেছিলেন, সেই বীজের বংসপ্রবাহ সেই থেকেই হিন্দু বিরোধিতা করে আসছে।
বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অনেকে হিন্দু মনে করেন, যদিও তিনি হিন্দু ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ ছিলেন কুশারী এবং পরবর্তীতে ব্রাহ্মসমাজে দীক্ষিত। গানের সুরকার গগন হরকরা ছিলেন হিন্দু। হিন্দু বিরোধিতার সেই ধারার লোকজনই তাদের ধারাকে প্রবাহিত করার জন্য জাতীয় সংগীতের পরিবর্তন চায় এবং সে পরিবর্তনের পক্ষে নানান যুক্তি তুলে ধরে, যাকে যুক্তি না বলে কুযুক্তি বলাই যুক্তিযুক্ত।
এ দেশের মুসলমানদের আরেকটি ধারা আছে, যেটা মওদুদী ধারা। মওদুদী ধারার অনুসরণকারীরাও হিন্দু বিদ্বেষী এবং হিন্দুবিরোধী। শুধু হিন্দু বিদ্বেষী ও হিন্দুবিরোধী বললে কম বলা হবে, এরা মূলত ইসলাম ধর্ম বাদে অন্যান্য সকল ধর্ম বিদ্বেষী ও বিরোধী। মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী ভারতের বর্তমান তেলেঙ্গানা রাজ্যের হায়দ্রাবাদের আওরঙ্গবাদ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট লাহোরের ইসলামিয়া পার্কে সামাজিক-রাজনৈতিক ইসলামি আন্দোলনের অংশ হিসেবে জামায়াতে ইসলামী হিন্দ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯২৮ সালে মিশরে হাসান আল বান্না মুসলিম ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠা করেন। এটি প্রথম দিকে প্যান-ইসলামিক, ধর্মীয় এবং সামাজিক আন্দোলন হিসাবে গঠিত হলেও পরবর্তীতে রাজনৈতিক অঙ্গনে অগ্রসর হয়। এদের আন্দোলনের উদ্দেশ্য হলো শরিয়া আইন দ্বারা শাসিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। বিশ্বব্যাপী এদের বিখ্যাত স্লোগান হলো- ইসলামই সমাধান। মওদুদী মুসলিম ব্রাদারহুডের আদর্শের সাথে সমন্বয় করে জামায়াত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
মওদুদী তথা জামায়াত ব্রিটিশের কাছ থেকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল এবং ভারতবর্ষের মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান সৃষ্টিরও বিরোধিতা করেছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের পর জামায়াত দলটি ভারত ও পাকিস্তানে যথাক্রমে জামায়াতে ইসলামী হিন্দ ও জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান নামে পৃথক স্বাধীন সংগঠনে বিভক্ত হয়। স্বাধীনতার পূর্বে ব্রিটিশের কাছ থেকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রাপ্তির বিরোধিতা এবং পরে উগ্র ধর্মীয় উস্কানিমূলক কার্যক্রমের ফলে মওদুদী তাঁর জন্মভূমি হায়দ্রাবাদ ও ভারতে নিষিদ্ধ হয়ে পড়েন এবং পাকিস্তানে চলে আসেন। তিনি যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন, পরবর্তীতে সেই পাকিস্তানকেই ইসলামিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। এই নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি কিছু ধর্মীয় উস্কানিমূলক কার্যক্রম করেন যা পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করে।
কাদিয়ানি নামে পরিচিত আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণার দাবি করে তীব্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির জন্য ১৯৫৩ সালের ৮ই মে পাকিস্তানের আদালত মওদুদীর ফাঁসির আদেশ দেয়। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে দাঙ্গা ঘটিয়ে শত শত মৃত্যুর জন্য তাকে দায়ী করে ফাঁসির আদেশ দিয়েছিল সে সময়ের পাকিস্তান সরকার। এই দাঙ্গার ফলে ১৯৫৩ সালের ৬ মার্চ পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি হয়। পরে অবশ্য সামরিক সরকার ১৯৫৫ সালের ২৯ এপ্রিল মওদুদীকে ছেঁড়ে দেয়। অদ্ভুত ব্যাপার হলো- মাওলানা ভাসানী ও আজাদ পত্রিকার সম্পাদক মওলানা আকরাম খাঁ মওদুদীর ফাঁসির আদেশের বিরোধিতা করেছিলেন। তাদের প্রতিবাদের মুখেই মওদুদীর ফাঁসির আদেশ বাতিল করে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আর পরে তো ছেড়েই দেওয়া হয়।
মওদুদী ও তাঁর দল জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশের স্বাধীনতারও বিরোধিতা করেছিল। যদিও পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর এ দেশে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ নামে জামায়াতের সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু হয়। জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান এবং জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকে এবং মওলানা গোলাম আজম সেই লিয়াজোটি রক্ষা করে চলে। পাকিস্তান এই সংগঠনটির মাধ্যমে যুদ্ধে হেরে যাবার প্রতিশোধ নেবার জন্য তাদের কৌশল বাস্তবায়ন করতে থাকে। নানাবিধ সেসব কৌশল ও নীতির মধ্যে পূর্ব থেকে চলমান হিন্দু বিরোধিতার ধারাটিও ক্রিয়াশীল থাকে। এদের মতে, ভারতের রাজনৈতিক চালবাজিতে পাকিস্তান ভেঙে দুটো রাষ্ট্র হয়েছে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ যে, আশিকার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছে এবং তারই ধারাবাহিকতায় একপর্যায়ে তা স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নিয়ে, সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়েছে- এই সত্যকে তারা গৌণভাবে দেখে। ভারত পাকিস্তানকে ভেঙেছে- এই ক্ষোভ থেকে তারা সবাই ভারত বিরোধী, পক্ষান্তরে হিন্দু বিরোধী।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মুসলমানেরা নিজেদের দেশে, সমাজে সততা, ন্যায়নিষ্ঠা, ন্যায়পরায়ণতা রক্ষা ও প্রতিষ্ঠার বিষয়ে একেবারে নিষ্প্রভ থাকলেও ভারত ও হিন্দু বিরোধিতার বিষয়ে এরা খুবই সরব থাকে। এর কারণ, আর কিছু নয়, পূর্ব থেকে চলে আসা জিন্নাহ এবং মওদুদীবাদের রাজনৈতিক ধারার প্রতিফলন।
কেন স্বাধীনতা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন ইত্যাদির প্রতি এরা ক্ষুব্ধ:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ও স্বাধীনতা অর্জনের সাথে বাংলাদেশের ইসলামপন্থী দলগুলোর অবস্থান ও সংশ্লিষ্টতা একবারেই নেতিবাচক এবং বিরোধী। স্বাধীন দেশ তার স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসকে গর্বের সাথে ধারণ করবে, পালন করবে, উদযাপন করবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই কাজগুলি করতে গেলে বাংলাদেশের ইসলামপন্থী দলগুলোর সেই সময়ের বিরোধী অবস্থান ও সংশ্লিষ্টতা সামনে চলে আসে। এজন্য তারা সেই ইতিহাসগুলিকে মুছে ফেলতে চায়। এজন্য তারা ঐতিহাসিক সত্যকে চাপা দিয়ে অর্পিত সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য চেষ্টারত। জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের বিষয়টি সেই প্রচেষ্টা ও দুরভিসন্ধিরই অংশ। সংবিধান পরিবর্তন, জাতীয় পতাকার পরিবর্তন, স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে যুক্ত সকল ব্যক্তি ও ইতিহাসের পরিবর্তন ও সবকিছুকে মুছে দেবার উন্মত্ততা সেই ধারাবাহিক প্রচেষ্টারই প্রতিফলন।
পৃথিবীর কয়েকটি দেশের জাতীয় সংগীত, যেখানে দেশপ্রেমের ছিটেফোঁটাও নাই:
ইংল্যান্ডের জাতীয় সংগীত রচিত হয় ১৭৪৫ খ্রিস্টাব্দে এবং ১৯০০ শতাব্দীর গোঁড়ার দিকে গানটি জাতীয় সংগীতের মর্যাদা লাভ করে। গানটির বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় অনেকটা এরকম-
“রানিকে রক্ষা কর ভগবান
রানি আমাদের হোক আয়ুষ্মান
জয়ী কর তাঁরে; দাও তাঁরে যশ
দাও দাও তাঁরে বিমল হরষ
সুখ শান্তিতে রাজ্য করুক, এই কর ভগবান
জাগো জাগো প্রভু! জাগো জাগো ভগবান!
শত্রু দলিতে হও হে অধিষ্ঠান
নষ্ট কর হে শত্রুর ছল
নাশো দুষ্টের বুদ্ধি ও বল
হে চির-শরণ, বিপদে মোদের অভয় কর হে দান”
একটি দেশের জাতীয় সংগীতের ওপর শ্রদ্ধা জানিয়েই বলছি, গানটিতে দেশ বন্দনার লেশ মাত্র নেই। নেই দেশের মানুষের জন্য কল্যাণকামনা। আদ্যোপান্ত রানির মঙ্গল প্রার্থনা করা হয়েছে এতে। দেশ ও জাতির পারস্পরিক সম্পর্কসূত্রের উল্লেখ এখানে সুদূর কল্পনাতেও স্থান পেয়েছে বলে মনে হয় না। তাই বলে তারা তাদের জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করছে না।
ফ্রান্স থেকে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পটভূমিতে ১৭৯২ সালের এপ্রিল মাসে একটি কবিতা রচনা করা হয়। ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে ওই কবিতাটি ফ্রান্সের জাতীয় সংগীত হিসেবে গণ্য হয়। এটি রাইনের সৈন্যবাহিনীর যুদ্ধের গান হিসেবে পরিচিত। গানটির বাংলা অনুবাদটি এরকম–
“ফরাসি ভূমির সন্তানসবে আয়রে আয়রে আয়
কীর্তিলাভের শুভ অবসর যায় রে যায় বহিয়া যায়
অত্যাচারের উদ্যত ধ্বজা রক্তে করিয়া স্নান
আমাদের পরে বৈর সাধিতে হয়েছে অধিষ্ঠান
শুনিছো কি সবে কী ভীষণ রবে কাঁপায়ে জলস্থল,
দম্ভের ভরে গর্জন করে শত্রু সৈন্যদল!
তারা যে আসিছে কেড়ে নিতে বলে তোমার সকল ধন,
গ্রাসিতে শস্য—ক্ষেত্র নাশিতে পুত্র ও পরিজন
ধর হাতিয়ার ফ্রান্সের লোক, বাঁধ দল, বাঁধ দল!
চল রে চল চল রে চল!
ঘৃণা শোণিতে হবে কি সিক্ত মোদের ক্ষেত্রতল!”
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গানটি শুধুমাত্র যুদ্ধের বারতা দেয়। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর একটি দেশের এ জাতীয় আক্রমণাত্মক জাতীয় সংগীত ঔপনিবেশিকতার ইতিহাসকেই পুনর্জাগরুক করে। এটি পরিবর্তনের কথা কেউ বলে না।
১৮২৩ সালে রচিত একটি গান ১৮৪৪ সালে হাঙ্গেরির জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃত হয়। সার্বজনীনতা আর জাতিসত্তার পরিচয়হীন এই গানটিও যেন যুদ্ধের ডঙ্কা বাজায়। মূল গানের বাংলা ভাষান্তর—
“দেশের দশের ডাক শোন ওই
ওঠ ওঠ ম্যাগিয়ার
এই বেলা যদি পারো তো পারলে
নইলে হলো না আর
মুক্ত হবে? না রইবে অধীন
বুঝে চিনে লও পথ
ম্যাগিয়ার আর রবে না অধীন
করিনু এই শপথ
আমরা সবাই করিনু শপথ
লয়ে দেবতার নাম
আর রবো না অধীন প্রভু!
পুরাও মনস্কাম।”
স্বাধীনতা লাভের প্রায় দুইশ বছর পরও অধীনতা থেকে মুক্তির ক্রমাগত প্রার্থনা কতখানি যৌক্তিক ও সৌন্দর্যমণ্ডিত। এখনো এটিই তাঁদের জাতীয় সংগীত।
জাপানের জাতীয় সংগীত পৃথিবীর প্রাচীনতম কবিতা। ৭৯৪ সালে থেকে ১১৮৫ সাল পর্যন্ত যা বারবার সম্প্রসারিত এবং পরিবর্তন করা হয়েছে। মূল সংস্কারক হেইকান কাল। প্রথম চারটি লাইন তুলে ধরলেই পাঠকদের কাছে পরিষ্কার হবে এর সারমর্ম–
“অযুত যুগ ধরি বিরাজো মহারাজ
রাজা হোক তব অক্ষয়
উপল যতদিন না হয় মহীষর
প্রভূত শৈবালে শোভাময়”
এই সংগীতটি পরিবর্তনের জন্য জাপানের জনগণ কোনো দাবি তোলে না।
৫ই আগস্টের শ্রাবণ বসন্ত এবং তথাকথিত দ্বিতীয় স্বাধীনতা:
দেশ দুনিয়ায় বহু ধরনের স্বাধীনতা আছে- বাক স্বাধীনতা, কর্ম স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা ইত্যাদি ইত্যাদি। সব স্বাধীনতারই দরকার আছে, সব স্বাধীনতাই গুরুত্বপূর্ণ, তবে কোনো স্বাধীনতাই ভূখণ্ডগত স্বাধীনতার সাথে তুলনীয় নয়। লেখার শুরুতে গর্ভধারিণী মায়ের ভালোবাসার উদাহরণ দিয়ে যে কথাগুলো বলে লেখাটি শুরু করেছিলাম সেই রেফারেন্স দিয়ে আবারও বলি- গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচার পতন একটা বড়ো অর্জন কিন্তু এটা স্বাধীনতা নয়। এটাকে স্বাধীনতা বলার প্রশ্নই আসে না। স্বৈরাচার পতনকে কোনোভাবেই ১৯৭১ সালে অর্জিত ভূখণ্ডগত স্বাধীনতার সাথে তুলনা করা যায় না। এটা ধৃষ্টতা, রাজনৈতিক আক্রোশের উলঙ্গ ও উৎকট বহিঃপ্রকাশ। ১৯৭১ সালে অর্জিত ভূখণ্ডগত স্বাধীনতা এই ভূখণ্ডের সবচেয়ে বড়ো অর্জন। অন্য কোনো অর্জনই এই অর্জনের সাথে তুলনীয় নয়। এই তুলনা যারা করছেন তারা ওই স্বাধীনতাবিরোধী ধ্যানধারণার চর্চাকারী ও সমর্থক।
কোটা আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধার কোটা বাতিলের দাবির মাধ্যমে। সেটা পরবর্তীতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং শেষে এক দফার স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয় এবং সফল হয়। এই আন্দোলনে যারা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন তাদেরকে শহিদের মর্যাদা দিয়ে তাদের পরিবারের চাকরি, বাসস্থান ইত্যাদি দেবার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এটি একটি ভালো ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে শহিদ ও মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সম্মানিত করার কথা বলা হচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধের স্মারক, ভাস্কর্য ইত্যাদি নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে। নিজেদের কলঙ্কিত অতীত মুছে ফেলার জন্য জাতির অতীত গৌরবকে মুছে ফেলার এ উৎকট কর্মযজ্ঞ দেশকে ভালো কিছু দেবে না। এতে চলমান বৈষম্যগুলো আরও প্রকট হবে। আক্রোশী হয়ে বৈষম্য দূর করা সম্ভব নয়।
ইতোপূর্বেও আমরা পতিত সরকার দেখেছি। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ সরকারের পতিত হওয়া, এক-এগারোর গণঅভ্যুত্থানে বিএনপি সরকারের পতিত হওয়া আমরা দেখেছি। পতিত হবার পরে তপস্যা করে নির্বাণ লাভ করে নিষ্পাপ মহামানব হয়ে এরা আবার ফিরে আসেনি, বরং যা ছিল তারসাথে আক্রোশ ও সর্বগ্রাসী ক্ষুধার জিঘাংসা নিয়ে ফিরে এসেছে। এটা অশনি। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমরা দেখেছি। কোনো গণঅভ্যুত্থানের ফসলই দীর্ঘমেয়াদে জনমুখী হয়নি।
স্বৈরাচার পতনের পর দেশ বিনির্মাণের জন্য গণঅভ্যুত্থানকারীগণ আদালতের মাধ্যমে শাস্তি পাওয়া খুনি, দাগী শীর্ষ সন্ত্রাসীদের প্রয়োজনীয়তাকেও খুব প্রবলভাবে অনুভব করছেন এবং সে কারণে তাদেরকেও পাইকারি হারে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। সবাইকে নিয়ে কাজ করার আনন্দটা আসলেই অন্যরকম। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাদের থেকেও এদের মূল্য বেশি দেবার মতো এমন উদারতা কয়জন দেখাতে পেরেছে? সারা দেশব্যাপী এমন অসংখ্য উদারতার স্বেচ্ছা-প্যাকেজের যে মহাসমারোহ চলছে তাতে আমরা অচিরেই আফগানিস্তান, সিরিয়া, প্যালেস্টাইনের মতো উন্নত রাষ্ট্রের তকমা লাগাতে পারবো।
তথ্যসূত্র:
১. জাতীয় সংগীত: পুরনো তর্ক, নতুন পরীক্ষা, নবনীতা তপু, বিডিনিউজ২৪.কম, ৫ই সেপ্টেম্বর ২০২৪
২. বাঙলা বাঙালী ও বাঙালীত্ব, আহমদ শরীফ
৩. বাঙালীর জাতীয়তাবাদ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
৪. বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলন- শতবর্ষ স্মারক সংগ্রহ
৫. বাংলাদেশে রবীন্দ্র সংবর্ধনা- বাংলা একাডেমি
৬. ভ্রান্তি অবসানে আর কালক্ষয় নয়- ড. সাখাওয়াৎ হোসেন (দৈনিক সমকাল- ২৬ আগস্ট ২০১৮)
৭. বাঙালির সংস্কৃতি রক্ষায় ঐক্য - এম আর খায়রুল উমাম
৮. শুদ্ধ সুরেই জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হোক- শীলা মোমেন (দৈনিক সমকাল- ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮)
৯. জাতীয় সংগীত গাইতে হবে শুদ্ধ ভাবে- আ.ব.ম রবিউল ইসলাম (দৈনিক সংবাদ, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮)
১০. দেশ-বিদেশের জাতীয় সঙ্গীতের কথা- হাবিবুর রহমান স্বপন
১১. বিতর্কে জাতীয় সংগীত– ‘আমি নয়ন জলে ভাসি’, অজয় দাশগুপ্ত, বিডিনিউজ২৪.কম, ৫ই সেপ্টেম্বর ২০২৪
১২. জাতীয় সঙ্গীত বদল - বিতর্কের উদ্দেশ্য কি? মীনাক্ষী ভট্টাচার্য, সহমন, ১৯শে ডিসেম্বর, ২০২০
১৩. শ্রীলঙ্কা মাতা, উইকিপিডিয়া
১৪. আমার সোনার বাংলা, উইকিপিডিয়া
১৫. সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গান, বিবিসি.কম
১৬. জাতীয় সংগীতের সময় দাঁড়াতে হয়, জানেনা অনেকেই, ওবায়দুল্লাহ সনি, নিউজরুম এডিটর, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম, ফেব্রুয়ারি ৩, ২০১২
১৭. বঙ্গভঙ্গের গান ‘আমার সোনার বাংলা’ যেভাবে জাতীয় সংগীত করা হয়, যুগান্তর ডেস্ক, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪
১৮. ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের কারণ ও ফলাফল, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
১৯. জিন্নাহ পরিবার, উইকিপিডিয়া
২০. দ্বি-জাতিতত্ত্ব, উইকিপিডিয়া
অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান, লেখক ও গবেষক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
সম্প্রতি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের আয়োজন চলছে। এজন্য সরকারীভাবে নীতি প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। কোনটা আগে কোনটা পরে সংস্কারের আওতায় আসবে তা নিয়ে নানা মতামত ও পরামর্শ শোনা যাচ্ছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের জন্য সবার আগে দাবি রাখে কোন ক্ষেত্রগুলো তা নিয়ে অনেকটা হিমশিম খাবার মতো অবস্থা তৈরী হয়েছে।
সংস্কারের আগেই বিভিন্ন দাবি পূরণের জন্য দল বেঁধে মাঠে নেমে যাচ্ছে বঞ্চিত মানুষ। ফলে প্রতিদিন সূর্যের আলো ফোটার আগেই নানা সেক্টরে নতুন করে সমস্যার কথা শোনা যাচ্ছে। যেন সবার ভেতরে এত বছর ধরে শুধু সমস্যার পাহাড় জমা হয়েই ছিল। কেউ এতদিন তাদের সমস্যাগুলো মুখফুটে কারো কাছে প্রকাশ করার সুযোগ পায়নি বলে মনে হচ্ছে। তার মূল কারণ সব সেক্টরে বিভেদের দৌরাত্ম্য এতটাই ফাঁরাক তৈরি করেছিল যে, একটি বঞ্চিত শ্রেণি চরম হতাশ হয়েও তাদের কষ্টের কথা সাহস করে বলতে পারেনি। একটি ইতিবাচক পরিবেশের অভাব ও অজানা ভয় তাদেরকে সবসময় তাড়িয়ে বেড়িয়েছে।
মোটাদাগে, সেই বিভাজনটা চরম আয় বৈষম্যের। কোন কাজকর্ম না করে শুধু তোষণ-তোয়াজের মাধ্যমে কেউ টাকার পাহাড় গড়েছেন। কেউবা দলীয় লেজুড়বৃত্তি করে নিজের দুর্নীতি, জালিয়াতি ইত্যাদিকে আড়াল করে বিত্তশালী হয়ে উঠেছেন। অপরদিকে অবৈধ মজুতদারি, কালোবাজারি, দ্রব্যমূল্যস্ফীতি ঘটিয়ে একশ্রেণির ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফা হাতিয়ে নিয়ে নিম্নশ্রেণির মানুষকে শোষণের যাঁতাকলে নিষ্পেষণ করেছেন। যার প্রভাব সমাজে এখনও বিদ্যমান।
এর সাথে তাল মিলিয়ে বেড়ে গেছে অবৈধ ‘উপরি কামাই’ করার প্রবণতা। বিশেষ করে সরকারি চাকুরীজীবিদের অনেকের মধ্যে অবৈধ উপরি কামাই লিপ্সা এতটাই বেড়ে গেছে যে, তারা নিজেদের দায়িত্ব ভুলে গিয়ে বৈধ বেতনের পাশাপাশি আরো কতিপয় অবৈধ আয়ের পথ সৃষ্টি করে মানুষকে হেনস্থা শুরু করে দিয়েছিল। নিয়োগ, বদলি, প্রমোশনের ক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকা আয়ের গোপন সুড়ঙ্গ তৈরির কথা নতুন করে লিখে বলার অবকাশ নেই।
বিভিন্ন নির্মাণ কাজে কমিশনের নামে অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের পরিমাণ জাতিকে হতবাক করে তুলেছে। এর পাশাপাশি প্রতিটি সেবা ক্ষেত্রে কর্মচারীদেরকে খুশি করার নামে ঘুষ তথা অবৈধ আয়ের আঞ্জাম করে না দিলে কাজ সম্পন্ন করা দুষ্কর হয়ে উঠেছিল। এগুলোই ঘুষ-দুর্নীতি বা উপরি আয়ের রুট হিসেবে বিবেচিত। এর বৃহত্তর রূপের আবির্ভাব হয়েছিল জরুরি সরকারি ক্ষেত্রগুলোতে অসংখ্য ‘হোয়াইট কলার ক্রাইম’ নামে। যেটা আমাদের দেশে মেগা দুর্নীতিবাজ খেতাবে পরিগণিত হয়ে মানুষে-মানুষে আয়বৈষম্যকে পরিহাস করতে শুরু করেছে। যার প্রভাবে সামাজিক বৈষম্য চরমে উঠে গিয়ে একটি সুসংগঠিত সামাজিক আন্দোলন সূচিত হয়েছিল। কিছুদিন আগে সেসকল বৈষম্য ঠেকাতে সাধারণ মানুষ সামাজিক ‘ফায়ারওয়াল’ বা অগ্নিদেয়াল তৈরি করে বিদ্রোহী হয়ে রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছিল।
এর একমাস না পেরুতেই বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনসৃষ্ট সংস্কারকগণ মাঠে নামার সুযোগ পেয়ে গেছেন। যারা সংকল্পবদ্ধ হয়েছেন বিভিন্ন জরাজীর্ণতাকে মেরামত করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একটি গতিশীল সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে উপহার দেবার। কিন্তু অতিদ্রুত কীভাবে সেটা সম্ভব?
সেজন্য বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা-পর্যালোচনা শুরু হয়ে গেছে। এর পক্ষ-বিপক্ষ যাচাই-বাছাই করে বক্তব্যও শোনা যাচ্ছে। দেশের সংসদীয় নীতি নির্ধারকগণ ৫ আগষ্টের পর পদ হারিয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন। তবে দেশের বিজ্ঞ গবেষক ও অভিজ্ঞ পরামর্শকগণ মন খুলে কথা বলা, মতামত ও পরামর্শ দেবার সুযোগ পাবার সুবাদে সেমিনার সিম্পোজিয়াম সোচ্চার হয়ে উঠছে। এটাই মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা লাভের দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছে। এরসাথে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কোণঠাসা গুণী ব্যাক্তিগণ হাফ ছেড়ে বেঁচেছেন বলে মনে হচ্ছে।
মাত্র একমাস পূর্বে একদল ‘গুণী’ সাংবাদিক তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে নানা পরামর্শ দিতে গিয়েছিলেন। সেসব কথা এখানে আর নতুন করে বলার অপেক্ষা নেই। সম্প্রতি নতুন অন্তবর্তী সরকারের সাথে আরেকদল ‘গুণী’ সাংবাদিক তাদের মনের কথা প্রকাশ করতে পেরেছেন। কেউ কেউ প্রশ্ন করছেন-সেই ত্রিশজন কে ছিল আর এই ত্রিশজন কারা? এখন ‘সেই’ আর ‘এই’ নিয়ে বিতর্ক করার সময় নয়। তবে পরের দৃশ্যটি জাতিকে নতুন করে আশার আলো জাগাতে যাচ্ছে বলে বিশ্লেষকগণ মনে করছেন। পরবর্তী ত্রিশজনের কথা কিছুটা হলে এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করা যাক।
অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক সভায়, ‘গণমাধ্যমকে সরকারের ভুলগুলো ধরিয়ে দেবার আহবান করেছেন।’ তিনি ভুলগুলো ধরিয়ে দিয়ার পাশাপাশি সেগুলো শুধরানোর জন্য উপায় বাতলে দেয়ার পরামর্শ চেয়েছেন। কারণ, আমরা জানি কোন কিছুর ভুল ধরা না হলে সেটা শুধরানোর প্রশ্নই আসে না। ভুল চিহ্নিত করাটাই হলো সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ।
এতদিন ভুল যাতে কেউ না ধরে সেজন্য কঠিন পর্যবেক্ষণ চলতো। ভুল চোখে পড়তে পারে এমন ঘটনা বা অবস্থার প্রচারণা যাতে না হতে পারে সেজন্য গণমাধ্যমের উপর নজরদারি করা হতো। এমনকি সব ধরনের বড় সমস্যা থেকে রাষ্ট্রের কর্ণধারকে গোপনে-আড়ালে রাখার ব্যবস্থা হতো। এজন্য বহু অভিজ্ঞ সম্পাদক, গণমাধ্যমকর্মী সদা ভয়ে ভয়ে কাজ করতেন বলে জানা যেত। সবচেয়ে দুর্দিন গেছে মাঠ ও চারণ সাংবাদিকগণের ক্ষেত্রে। কেউ একটু বেশী নড়চড় করলে তার উপর নেমে আসতো ভয়ংকর রকমের চাপ, নির্যাতন আর হতাশা।
সেই চাপ ও কঠিন অবস্থা আর ফিরে চান না কোন মুক্তমনের গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ত্বগণ। সেসব নীতির দ্রুত অবলোপন চান তারা। অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা গণমাধ্যমের উপর যে উদার দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছেন তা একটি সত্যিকারের মুক্ত, গতিশীল, সক্রিয় বা ‘ভাইব্রান্ট’ গণমাধ্যম কাঠামো তৈরিতে সহায়ক হতে পারে। যেটা দেশের প্রশাসনিক সংস্কার ও নানা ক্ষেত্রে চলমান বৈষম্য নিরসনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রশ্ন হলো এই মূহুর্তে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কোনগুলো? কোন কোন সংস্কার দেশকে দুর্নীতির রাহু থেকে মুক্তি দিয়ে আর্থ-সামজিক বৈষম্য নিরসনে দ্রুত সাহায্য করতে পারে? অবশ্যই সংস্কার হতে হবে টেকসই ধরণের। এর জন্য নানা কমিশন গঠনের পদক্ষেপ চলছে। একজন রাষ্ট্রচিন্তাবিদ বলেছেন, সবার আগে প্রয়োজন সংবিধান সংস্কার। একটি সুঠাম আইন ও সাংবিধানিক কাঠামোর উপস্থিতি ব্যতিরেকে রাষ্ট্রীয় সংস্কার কাজে হাত দেয়া মুষ্কিল। অতীতের সকল কালাকানুন বিলোপ ছাড়া নতুন পরিবর্তন চাওয়া অবান্তর।
এর পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, পরিবেশ সুরক্ষা কমিশন, অর্থ ও সামাজিক নিরাপত্তা কমিশন পুনর্গঠণ করা প্রয়োজন। সামাজিক নিরাপত্তা কমিশনের আওতায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, তথ্যসুরক্ষা, চাকুরি, যুব-নারী-শিশু উন্নয়ন, সামাজিক অপরাধ, পরিবহন, স্থির দ্রব্যমূল্য, বয়স্ক কল্যাণ, বীমা, পেনশন ইত্যাদি সবকিছু অর্ন্তভূক্ত করা যেতে পারে। উন্নত বিশ্বে এসব কিছুই মানুষের কল্যাণে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে আওতায় বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
উল্লিখিত সবকিছুর মধ্যে জনগণকে নিজ নিজ কর্মঘন্টা নষ্ট না করার জন্য সজাগ ভূমিকা পালন করতে হবে। নিজ কাজের জবাবদিহিতা নিজেকেই নিশ্চিত করে অপরের ‘হক’ বা অধিকার ক্ষুন্ন না করার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। সকল প্রকার অবৈধ লোভ-লালসাকে জলাঞ্জলি দেবার মাধ্যমে অবৈধ উপায়ে ‘উপরি কামাই’ গ্রহণ থেকে বিরত থাকার জন্য প্রতিজ্ঞা করতে হবে।
অবৈধ ‘উপরি কামাই’ গ্রহণ থেকে সমাজে আয়বৈষম্য সৃষ্টি হয়, দ্রব্যমূল্যস্ফীত হয় এবং ভোগবৈষম্য ঘটে। কারণ সৎমানুষ উপরি কামইকে ঘৃণা করে। অসৎদের সাথে তুলনায় সৎ ব্যক্তির আয় কমে যাবার ফলে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সঞ্চয়, নিরাপত্তা ইত্যাদি সবকিছুতে হযবরল তৈরি হয়। উপরি কামই উপভোগকারীদের বিপরীতে চরম বৈষম্যের ঘেরাটোপে সৎ, দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ দীর্ঘদিন যাবত ভূগছেন। তাই একটি টেকসই সংস্কার সূচিত হোক সকল শ্রেণির মানুষের কল্যাণে।
লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন
ইমেইল: [email protected]