‘সাম্প্রতিক ঘটনায় বৈশ্বিক মেরুকরণ কম, জাতিসংঘের স্বাধীন তদন্তই প্রত্যাশিত’
বাংলাদেশে চলমান ছাত্র আন্দোলন এবং সে আন্দোলনকে ঘিরে সৃষ্ট সংঘাত, প্রাণহানি, জ্বালাও পোড়াও বিশ্বের নজর কেড়েছে সন্দহাতীতভাবে। বিশ্বের কোনো অংশে কিংবা দেশে এমন কোনো ঘটনা ঘটলে তা নিয়ে বিশ্ব মোড়লদের মধ্যে মেরুকরণ দেখা যায়। চলতি ঘটনায় কি তেমনটা দেখা গেছে? এসব ঘটনার তদন্ত কীভাবে হবে?
সম্প্রতি নির্বাহী আদেশে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে কতটুকু পড়বে? এমন সব প্রশ্ন নিয়ে বার্তা২৪.কম মুখোমুখি হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিনের।
শুক্রবার বার্তা২৪.কম-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘বৈশ্বিক মেরুকরণটা বাংলাদেশের অন্য আন্দোলনে বেশি ছিল, এই আন্দোলনে তা কম।’
বার্তা২৪.কম: কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে বাংলাদেশে উদ্ভূত অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে বহির্বিশ্বের সরব প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আপনি কি এতে কোন মেরুকরণ দেখেন?
অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন: মেরুকরণের বিষয়গুলো তো থাকবেই। তবে আন্দোলনকারী ও সরকার এখন মুখোমুখি। সরকার আন্দোলনকারীদের দমনে বিভিন্ন পলিসি ব্যবহার করেছে। কোন পলিসিই আর কাজ হচ্ছে না। ছাত্ররা তাদের অধিকার গণতন্ত্র, স্বাধীনভাবে কথা বলা এবং সর্বশেষ তাদের যে ৯ দফা দাবি, সেই দাবিতে তারা সোচ্চার। দেশ আমাদের সবার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্ররা স্বাধীনতার পতাকা, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে রচিত গান নিয়ে তারা আন্দোলন-স্লোগান করছে। তারা দেশকে ধারণ করেছে কিন্তু সরকারকে নয়। বিদেশের মধ্যে যারা সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে চাইবে, দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বা সম্পর্কের ভিত্তিতে তারা হয়ত এক পক্ষ সমর্থন করবে। আর যারা গণতন্ত্র, মানবাধিকার-এগুলো সমুন্নত থাকুক; সরকার যাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়-এই চিন্তায় যে দেশগুলো আছে তারা অবশ্যই আন্দোলনকারীদের সমর্থন করবে। আমার কাছে একটা আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে-ভারতে একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। সেখানকার পত্রপত্রিকাগুলোও কোটা আন্দোলনকারীদের সমর্থন করেছে। বাংলাদেশের শিল্পীসমাজ থেকে শুরু করে উদীচী ও অন্যরা যারা বাম ঘরানার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে জানতাম, তারাও তো আজকে মাঠে। আমার দৃষ্টিতে বৈশ্বিক মেরুকরণটা বাংলাদেশের অন্য আন্দোলনে বেশি ছিল, এই আন্দোলনে কম। এই আন্দোলনে ছাত্রদের অধিকারের নৈতিক সমর্থন দিচ্ছেন সবাই। আপনি যদি যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলতে চান তবে বলব, আমাদের সরকারও তাদের সরাসরি দায়ী করছে, কারণ মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে বক্তৃতা-বিবৃতি, সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নোত্তরে এটি স্পষ্ট, তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি টানাপোড়েন তা কয়েক বছর ধরে প্রকট হয়েছে নির্বাচনগুলোকে কেন্দ্র করে। সেটা সরকার ক্ষমতার আসার পরেও মনে করেছিল, ডোনাল্ড লু’র সফরের মাধ্যমে দু’দেশের সম্পর্ক উন্নত হবে। মনে রাখতে হবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো কখনও সম্পর্ক ছিন্ন করে না। তাদের সম্পর্ক হচ্ছে-রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের, সরকারের সঙ্গে নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের ক্ষতি হবে এমন কিছু করবে না, এজন্য হয়ত তারা ধীরে পদক্ষেপ নেয়। এখনকার যে বিষয়টা হচ্ছে-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, ইউরোপিয় ইউনিয়নসহ যে পার্টনারগুলো আছে তারা কখনও ছাত্রদের রক্তের উপরে রেখে সরকারকে সহযোগিতা করবে না।
বার্তা২৪.কম: বাংলাদেশের অর্থনীতি বহুলাংশে বহির্বিশ্বের উপর নির্ভরশীল। রেমিটেন্স ও দাতাদের সহযোগিতাসহ আমাদের বৈদেশিক আমদানি-রফতানি সবকিছুই। চলমান ঘটনাগুলোর কি প্রভাব পড়তে পারে?
অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন: প্রভাব যে পড়েছে তা স্পষ্ট। আপনি দেখুন, বাংলাদেশের রিজার্ভের দিকে যদি দৃষ্টি দিই, তবে ফরেন রেমিটেন্সের বিশাল ধস নেমেছে। ছাত্রদের পক্ষে তারাও আন্দোলন করছে, সরকার যতই বলুক লিগ্যাল চ্যানেলে টাকা পাঠাতে-তারা কিন্তু প্রত্যাখ্যান করেছে। ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ করায় একটি বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি হয়েছে। আপনি কিনবেন, বেচতে পারবেন কম। এছাড়া ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট সহজে কেউ করতে চাইবে না। এই যে কেপিআইগুলো ধ্বংস হচ্ছে আন্দোলনে, কে চাইবে বিনিয়োগ করে ঝুঁকিতে পড়তে। ইউরোপিয় ইউনিয়ন ইতিমধ্যে অংশীদারিত্ব চুক্তি বাতিল করেছে। আইএমএফ থেকে যে কিস্তিগুলো বাকী আছে, সেগুলোও কিন্তু আটকে যেতে পারে। সবমিলেই পরিস্থিতি বেশ সংকটজনক।
বার্তা২৪.কম: এই সংকটের কোন রাজনৈতিক সমাধান দেখেন কি?
অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন: রাজনীতি তো এখন নেই। এটাকে রাজনীতি বলে না। রাজনৈতিক অথরিটির জায়গায় যারা আছেন তারা সব ধ্বংস করে দিচ্ছেন। তারাই আজকে পরিস্থিতিকে, আন্দোলনটিকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছেন। সহজেই এর সমাধান পাব না। অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বাংলাদেশের যে ইমেজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে যে অভিযোগ উঠছে, আমি তা মনে করি না। নষ্ট হয়ে গেছে সরকারের ইমেজ। দেশের গণমানুষ ও ছাত্রসমাজকে আমরা ভুল বুঝেছিলাম। তারা অধিকারের জন্য সোচ্চার হয়েছে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক চেতনা তাদের মধ্যে আছে বলেই তারা দেশকে রক্ষা করতে চাইছে।
বার্তা২৪.কম: ছাত্র আন্দোলনের চলমান ঘটনা প্রবাহের মাঝেই জামায়াত নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন কি প্রভাব ফেলতে পারে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে?
অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন: জামায়াত তো পরোক্ষভাবে দীর্ঘদিন ধরে নিষিদ্ধই ছিল। তারা কি তাদের নামে কোন কর্মসূচি কিছু করতে পেরেছে? কিন্তু জামায়াতের সংখ্যা তো কমে নাই। গেল নির্বাচনের সময় কেন তাদের অনুষ্ঠান করতে দিয়েছে সরকার, আমরা জানি না। জামায়াতের অনুষ্ঠান করতে দিলেও বিএনপির অনুষ্ঠান ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে। জামায়াতের অনুষ্ঠানে তাদের অংশগ্রহণ দেখেছেন? সরকার তো সবসময়ই চায় শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার একটা মেগা পরিকল্পনা হিসাবে জামায়াতকে এখন নিষিদ্ধ করেছে। জামায়াতকে অনেক আগেই নিষিদ্ধ করতে পারতো সরকার। সরকার এখন যে আইন দিয়ে নিষিদ্ধ করেছে তা বহুআগেই করতে পারতো। বহির্বিশে^ এর প্রভাব যদি বলি তবে, ইসলামিক রাষ্ট্রগুলো..জামায়াত তো শুধু রাজনৈতিক দল নয়। জামায়াতের রাজনৈতিক মতাদর্শ অনেকে পছন্দ করবে আবার করবে না। তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু তাদের অনেকগুলো অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান আছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তাদের অর্থায়ন করে। সেই জায়গাটাতে একটা বড় ধরণের সমস্যা তৈরি হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও জামায়াতের একটা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পর্ক আছে। একটা সময় যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, জামায়াত সন্ত্রাসী সংগঠন নয়, একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে তাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। এই যে তাদের একসেস...মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বড় একটি বলয়ে এই সিদ্ধান্ত টানাপোড়েন সৃষ্টি করবে।
বার্তা২৪.কম: সাম্প্রতিক আন্দোলন-সহিংসতায় নিহত শিক্ষার্থীসহ বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে আন্তর্জাতিক আগ্রহকে স্বাগত জানিয়েছে সরকার। আপনি বিষয়টিকে কিভাবে দেখেন?
অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন: ঘটনাগুলোর প্রাথমিক তদন্ত তো ইতিমধ্যে হচ্ছে। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, এতগুলো মৃত্যুতে পুলিশের গুলিতে কারোর মারা যাওয়ার তথ্য নেই, আমরা আশ্চর্য হয়ে যাই! সরকার তো এখানে বোকার মতো কাজ করেছে। আমরা প্রকাশ্য দিবালোকে দেখছি পুলিশ গুলি করছে। সরকার বলছে, পুলিশ কোন গুলি করে নাই। তাই যদি হয় এতগুলো মৃত্যু কই থেকে হলো? অবিশ্বাস তো তৈরি হয়েছে সেখান থেকেই। এখান থেকে বিশ্বাস সৃষ্টি হলে গণমানুষ ও সিভিল সোসাইটি আর আন্তর্জাতিক তদন্ত চাইত না হয়ত। এখানে জাতিসংঘ তদন্ত করলে, স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে হবে। সেই তদন্তে এই দেশের নিরপেক্ষ সিভিল সোসাইটি, মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে সহযোগিতা করতে হবে। সরকার জাতিসংঘের আগ্রহকে স্বাগত জানিয়েছে-এ প্রসঙ্গে বলতে হবে, জাতিসংঘকে স্বাগত জানিয়ে...তাদের ফেব্রিকেটেড ইনফরমেশন দিয়ে কনভিন্স করার জন্য তো ফরেন মিনিষ্ট্রি অলরেডি বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের বোঝানোর চেষ্টা করছে। ওই ধরণের যদি তদন্ত হয় তবে ছাত্র সমাজ মেনে নেবে না। জাতিসংঘ যদি স্বাধীনভাবে সঠিক তদন্ত করে সেই তদন্তের রিপোর্টও মানুষ বুঝতে পারবে। আমি যে ঘটনা দেখেছি, রিপোর্টে তা এসেছে-তাহলেই তা গ্রহণযোগ্য হবে। জাতিসংঘকে সেভাবে কাজ করার সুযোগ দিচ্ছে কিনা সেটাই বড় বিষয়। সঠিক তদন্ত হলে আসল সত্য উদঘাটিত হবে।
সম্পাদনা: মাহমুদ মেনন, এডিটর-অ্যাট্-লার্জ, বার্তা২৪.কম