প্লিজ, এবার থামুন

  • প্রভাষ আমিন
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

প্রভাষ আমিন, ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

প্রভাষ আমিন, ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

থামতে জানাটা কখনো কখনো চলার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। ক্রিকেটে যেমন সময়মত অবসর নিতে না পারায় অনেক মহানায়ক ভিলেনে পরিণত হয়েছেন। এমনকি ভারতে এক সময় প্রায় ঈশ্বরের মর্যাদায় পূজিত শচিন টেন্ডুলকারকেও একসময় শুনতে হয়েছে, এ লোক যায় না কেন? যেমন ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের আগে মাশরাফি ছিলেন বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মানুষ। যে কোনো গণভোটে প্রায় শতভাগ ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা তার ছিল। কিন্তু খেলা থেকে অবসর নেয়ার আগেই একটি দলের হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে রাতারাতি জনপ্রিয়তার অনেকটাই খোয়ান তিনি। এরপর বিশ্বকাপে ম্লান পারফরম্যান্স তার জনপ্রিয়তার পতনকে আরো দ্রুততর করে। অথচ নির্বাচনের আগে বা নিদেনপক্ষে বিশ্বকাপের আগে অবসর নিলে মাশরাফি বাংলাদেশের সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিদের একজন হয়ে থাকতে পারতেন।

তাই বলি, থামতে জানাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। শুধু খেলার মাঠে নয়, জীবনের সব ক্ষেত্রে। আবার ভবিষ্যতে চলার গতি নির্বিঘ্ন করতে কখনো কখনো কৌশলগত কারণে সাময়িকভাবে হলেও থামতে হয়। কথাগুলো মনে এলো বুয়েটের আন্দোলন প্রসঙ্গে।

বিজ্ঞাপন

আজ (সোমবার) সকালে পত্রিকায় দেখলাম, ভর্তি পরীক্ষার জন্য দুদিন শিথিল করা বুয়েট শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কাল মঙ্গলবার থেকে আবার শুরু হচ্ছে। রোববার রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা আবরার ফাহাদ নামে এক শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হত্যা করে। সোমবার সকাল থেকেই বুয়েটে গড়ে ওঠে অভূতপূর্ব এক স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। আন্দোলনটি বুয়েট-কেন্দ্রিক হলেও ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। প্রায় সাত ঘণ্টা পিটিয়ে আবরারকে হত্যার যে নির্মমতা, তা ছুঁয়ে যায় গোটা দেশের মানুষকে। তাই বুয়েটের আন্দোলনকে ঘিরে এক প্রবল আবেগের ঢেউ খেলে যায় সারাদেশে। তাই সবার স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ছিল এই আন্দোলনের প্রতি। বুয়েটের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাও ছুটে গেছেন তাদের প্রিয় ক্যাম্পাসে। একাত্মতা প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবির প্রতি।

প্রধানমন্ত্রী নিজেও বুয়েটের শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সহানুভূতি জানিয়েছেন। ছাত্ররা আন্দোলন শুরুর আগেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ছাত্রলীগের অভিযুক্ত ১০ নেতাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ছাত্র রাজনীতি বন্ধের বিষয়টিও প্রধানমন্ত্রী ছেড়ে দিয়েছেন বুয়েট কর্তৃপক্ষের হাতে।

বিজ্ঞাপন

গোটা আন্দোলনে আমি তেমন সংবেদনশীলতা খুঁজে পাইনি বুয়েটের ভিসি ড. সাইফুল ইসলামের আচরণে। মন্ত্রীর সাথে, সরকারের সাথে যোগাযোগ করছিলেন, এই অজুহাতে আবরার হত্যার পর শিক্ষার্থীদের সামনে আসতে ৩৬ ঘণ্টা সময় লেগেছে তার। উপাচার্য যত যুক্তিই দেন, তার এই বিলম্ব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। মন্ত্রী, সরকার বা প্রশাসনের সাথে যোগাযোগের চেয়ে বেদনা বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের পাশে থাকা তার জরুরি ছিল। মন্ত্রীর সাথে কথা বলার চেয়ে আবরারের জানাযায় অংশ নেয়াটা অনেক বেশি জরুরি ছিল। শিক্ষার্থীদের সাথে থেকেও তিনি এইসব প্রশাসনিক কাজ করতে পারতেন। বুয়েটের শিক্ষার্থীরা তার সন্তানের মত। সন্তানের নিষ্ঠুর মৃত্যুর পর যার শিক্ষার্থীদের সামনে আসতে ৩৬ ঘণ্টা লাগে, তার আসলে অভিভাবক থাকার যোগ্যতা নেই। অথচ বুয়েটের

শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে সামনে থাকতে পারতেন ভিসি নিজেই।

পরে অবশ্য ভিসি তার এই অসংবেদনশীলতাকে পুষিয়ে নিতে ছুটে যান কুষ্টিয়ায় আবরারের কবর জিয়ারত করতে। ঢাকায় ফিরে তিনি কথা বলেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। তিনি তার আগের ভূমিকার জন্য শিক্ষার্থীদের কাছে দুঃখপ্রকাশ করেন এবং শিক্ষার্থীদের সকল দাবি মেনে নেয়ার ঘোষণা দেন। আবরার হত্যা নিয়ে সরকার ও

পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই। আগেই লিখেছি, আন্দোলন শুরুর আগেই পুলিশ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এরইমধ্যে এজাহারভূক্ত ১৫ জনসহ মোট ১৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তদন্ত চলছে দ্রুতগতিতে। স্বল্প সময়ে চার্জশিট দেয়ার ব্যাপারেও আশ্বাস দিয়েছে পুলিশ। আর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বুয়েটে ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ, অভিযুক্তদের বহিষ্কার, র‌্যাগিং ও আইন হাতে তুলে নিলে কঠোর ব্যবস্থা, আবরারের পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেয়া,মামলার খরচ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

শিক্ষার্থীদের সাথে বৈঠকের পর অ্যাকশনে নেমেছে বুয়েট কর্তৃপক্ষ। ইতিমধ্যেই তারা বিভিন্ন হলে অবৈধভাবে অবস্থানকারীদের বের করে দিচ্ছে। শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের রুম সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ছাত্রলীগের অফিস হিসেবে ব্যবহৃত রুমটিও।

কিন্তু এতকিছুর পরও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা। ভর্তি পরীক্ষার জন্য দুদিন শিথিল করা হলেও মঙ্গলবার থেকে আবার আন্দোলন শুরুর ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এখন কোন দাবিতে আন্দোলন করছেন, আমার ধারণা আন্দোলনকারীরাও সেটা ভালো করে জানেন না। এখন তারা বলছেন, ভবিষ্যতে ছাত্র রাজনীতি করলে কি সাজা হবে তা নিশ্চিত করা, হলের তলায় তলায় সিসিটিভি স্থাপন, অবৈধদের হল থেকে কের করে দেয়া, আবরারের পরিবারকে দ্রুত ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি জানাচ্ছেন। তারা কি বুঝতে পারছেন না, আন্দোলনের বিশালতার কাছে

এই দাবিগুলো নেহায়েতই ছোট। এই ছোট ছোট দাবি জানিয়ে মূল দাবিগুলোকেই হালকা করা হচ্ছে।

সময়মত থামতে না জানলে অনেক বড় আন্দোলনও মুখ থুবড়ে পড়ে। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশেই এর জ্বলজ্বলে উদাহরণ আছে। সময়মত থামলে গণজাগরণ মঞ্চ এবং নিরাপদ সড়কের আন্দোলন শুধু বাংলাদেশ নয়; গোটা বিশ্বেই উদাহরণ হয়ে থাকতো। কিন্তু চুইংগামের মত লম্বা করতে গিয়ে দুটি মহৎ আন্দোলনকেই শেষ পর্যন্ত বিতর্কিত হতে হয়েছে।

আমরা চাই না, বুয়েটের আন্দোলনের তেমন কোনো পরিণতি হোক। আবরারের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাতে আমাদের সবার উচিত আরো সংযত ও সংবেদনশীল হওয়া। বুয়েটের শিক্ষার্থীরা ক্লাশরুমে ফিরে যাক। তবে বুয়েট

প্রশাসন কথা রাখে কিনা, তার প্রতি কঠোর নজর রাখতে হবে। আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার তদন্ত ও বিচার ঠিক পথে, দ্রুতগতিতে এগুচ্ছে কিনা; সেদিকেও নজর রাখতে হবে। কোথাও কোনো ব্যত্যয় হলে আবার রাজপথে নামার সুযোগ তো থাকছেই।

কথা দিচ্ছি, তখন আমরাও তাদের পাশেই থাকবো। কিন্তু এই মুহূর্তে বুয়েটের শিক্ষার্থীদের প্রতি অনুরোধ, তারা যেন আন্দোলন শেষ করে পড়ার টেবিলে, ক্লাশরুমে ফিরে যায়।

 

প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ