তদবির নির্ভর সাফল্য ও সামাজিক বঞ্চনা

  • প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

ছবি: বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম

আমাদের উন্নয়ন কাজের নীতি আছে কিন্তু গতি নেই। কারণ নীতিমালার পারস্পরিক যোগসূত্র নেই। সেখানে অভাব রয়েছে আন্তরিকতা ও নৈতিকতার। এজন্য কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা মোটেও সম্ভব হয় না।

আজকাল যেকোনো কাজ বিনা তদবিরে সম্পন্ন করা কঠিন হয়ে ওঠে। এভাবে সব জায়গায় তদবির কাজের স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ করে দেয়। সেজন্য দ্রুততার সাথে কোনো কাজের অগ্রগতি লাভ করা সবার পক্ষে সহজ কাজ নয়।

বিজ্ঞাপন

উন্নয়ন প্রচেষ্টার প্রায় সকল ক্ষেত্রে লবিং বা তদবির নামক ভূত-প্রেত এক চরম মায়াজালের বেষ্টনী সাজিয়ে ফেলেছে। এই বেষ্টনীতে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে নানা উপপাদ্য। যেগুলো ঘুষ-দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, এলাকাপ্রীতি, এলামনাই প্রীতি, ব্যক্তিপূজা, দলপুজা ইত্যাদি নানা আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যা ও সংকটের জন্ম দিয়েছে ও সেগুলোর লালন-পালন করে চলেছে প্রতিনিয়ত।

এগুলোর একটু ব্যত্যয় ঘটলে শুরু হয় হয়রানি। প্রতিটি কাজে অযথা কালক্ষেপণ করা এই হয়রানির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কালক্ষেপণের সাথে যুক্ত করা হয় বাজেট সংকট ও অপচয়।

বিজ্ঞাপন

তদবির ও ঘুষ-দুর্নীতি পরস্পরের সাথে অঙ্গীভূত হয়ে পড়েছে। কোনো কাজের স্বাভাবিক ফাইল হাতে এলেই তা এখন শুধু আর লাল ফিতাতেই সীমাবদ্ধ থাকে না, সেটা ভাগ-বাটোয়ারার মাধ্যমে নিষ্পত্তির জন্য দালালদের কবজায়ও বন্দী হয়ে পড়ে। শুরু হয় দর কষাকষি।পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ের মধ্যে পরে ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। এই চরম অবস্থার জন্য উন্নয়ন কাজে হযবরল অবস্থা সূচিত হয়েছে এবং উন্নয়ন কাজে অযথা কালক্ষেপণ থেকে উন্নয়ন ব্যয় বহুগুণে বর্ধিত হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া সব ধরণের নিয়োগ, বদলী, প্রমোশন সবকিছুতে বিশৃঙ্খলা ও হতাশা ঢুকে পড়েছে।

যে কোনও কাজকে তার আপন নীতিতে নড়তে দেয়া উচিত। অযাচিত হস্তক্ষেপ করা কোনোভাবেই সমীচীন নয়। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্বের এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা তালিকায় নেই বলে অনেকে সমালোচনায় মুখর। কিন্তু একথা কেউ বলেন না যে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মোটেও স্বাধীন নয়। এখানে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া বা গবেষণা করার উপায় নেই। সুদূরাতীত থেকে এখানে শিক্ষক-কর্মকতা-কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয় তদবিরের মাধ্যমে। সেই তদবিরের মধ্যে থাকে ঘুষ-দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, এলাকাপ্রীতি, এলামনাই প্রীতি, ব্যক্তি ও দলপ্রীতির মায়াজাল। স্বভাবত:ই এদের কাছে জাতি ভাল কিছু কি আশা করতে পারে?

অধিকন্তু অন্যায় তদবির দিয়ে অপরের হক বা তকদির নষ্ট করে ফেলা হয়। তদবির কারো জন্যে আশা কারো জন্যে চরম বঞ্চনার ব্যাপার। তদবির দিয়ে মেধাকে অবমূল্যায়ন করা হয়। এতে দেশের মেধা বাইরে পাচার হয়ে যায় ও দেশের কাজ ও সেবার মান কমে যায়। এভাবে একটি দুর্বল জাতি ও নষ্ট প্রশাসনিক সেবা কাঠামো তৈরি হয়।

কেনাকাটা করতে ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমণ, সন্তানদের বিনা স্কলারশিপে বিদেশে পড়াশুনা করতে পাঠানো, চিকিৎসার নামে, ধর্মীয় কাজ করার নামে বিদেশে যাওয়াও আজকাল বড় বড় তদবিরের অংশ। এসব কাজে সর্ষের মধ্যেই অবস্থান করে দৈত্য-দানবরা। তাই অবৈধ তদবিরকারীরা সবসময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। বড় বড় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে বড় কাজ বাগিয়ে নেওয়ার তাগিদে তদবিরের জন্য আজকাল মোটা অঙ্কের বাজেট প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। এজন্য বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতাদেরকেও কখনো কখনো ব্যবহার করা হয়। কিন্তু উন্নত দেশে অভ্যন্তরীণ কাজের জন্য প্রচলিত সিস্টেমই যথেষ্ট। ওরা জবাবদিহিতা পালন করলেও আমাদের দেশে ছোট-বড় সব কাজের জন্য উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত পেতে অপেক্ষা করতে হয়। উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত পেতে অপেক্ষা করতে গিয়ে শুরু হয় তদবির নামক পরামর্শ ও সেসব পরামর্শ নিতে গিয়ে ঘুষ-দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ইত্যাদির যন্ত্রণা ও যাতনা শুরু হয়ে যায়। ফলে কাজের গতি শ্লথ হয়ে যায়। কমজোরি ক্লাইন্টের পক্ষে এসবের চাহিদা সামাল দেয়া অসম্ভব হলে কখনো কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে শক্তিমানরা আরো শক্তিশালী হবার সুযোগ লাভ করে ও দুর্বলরা আরো দুর্বল হয়ে হতাশ হয়ে পড়ে। তাই একটি ন্যায়ানূগ ও কল্যাণকর সমাজের জন্য তদবির এক অভিশাপ।

তাই আমাদের সবার সন্তানদেরকে আত্মনির্ভরশীল হবার শিক্ষা দিতে হবে। পরিশ্রম করে অর্জন করার মানসিকতা তৈরি করাতে হবে। এখন ভালভাবে টিকে থাকার জন্য অন্যায় ও চোরাই পথ পরিত্যাজ্য করার প্রত্যয় নেবার দিন এসেছে। কেউ কোনো কাজের জন্য অন্যায়ভাবে তদবির করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নীতি গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। দেশের সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে অটোমেশনের মাধ্যমে শক্তিশালী করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে বিশ্বের দরবারে অবস্থান সুদৃঢ় করতে হলে আমাদের নিজ নিজ মেধা, শ্রম, যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতার মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রমাণ রাখতে হবে। গুপ্ত ও তদবিরের পঙ্কিল পথ পরিত্যাগ করতে না পারলে তাতে দুর্নীতির পথই প্রশস্ত হবে।

 

প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।