সনদধারী বেকারদের নতুন বছর কেমন চাই?

  • প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম, ছবি: বার্তা২৪.কম

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম, ছবি: বার্তা২৪.কম

দেশে এখন উচ্চ শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা শতকরা ৪০ ভাগ। এ সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফলে তাদের পরিবার যেমন হতাশ, সেই সঙ্গে সরকারি কর্তৃপক্ষও কীভাবে এ সমস্যার সমাধান করবে, তা ভেবে পাচ্ছে না।

কারণ, সনদধারী বেকারদের সংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চাকরির বাজার সম্প্রসারণ কঠিন ব্যাপার।

বিজ্ঞাপন

আমাদের দেশের ছোট্ট পরিসরে তৈরি অবকাঠামোর মধ্যে এ পর্যন্ত যে চাকরি সেবাদান প্রক্রিয়া চালু রয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় বড় অপ্রতুল। বিসিএস, ব্যাংক, প্রতিরক্ষা বাহিনী, ছোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, তৈরি পোশাক, বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও এনজিও ইত্যাদি মিলে যেসব কর্মক্ষেত্র ও পরিষেবা খাত রয়েছে, এসবের বাইরে ভালো কিছু লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এসব খাতে খুব বেশি জনবল লাগে না, চাওয়াও হয় না। অথচ প্রতিটি পদের জন্য প্রতিযোগিতা করেন লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার। চাকরি পাওয়াই সবার লক্ষ্য। এর জন্য বাঁধভাঙ্গা প্রতিযোগিতায় হিমশিম খাওয়ার অবস্থা।

একটি পদের জন্য লড়াই হাজারো জনের। অনেকে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অবৈধ পথ খোঁজেন। এর থেকে জন্ম নেয় তদবির বা লবিং আর দুর্নীতি।

কৃষি প্রধান দেশ হলেও আমাদের কৃষকের সন্তানরা আর কৃষিকাজে আগ্রহী নন। কারণ জমি চাষ করে প্রতি বছর বিরাট ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন তারা। আবার সংবাদ মাধ্যমে জানা গেছে, বাংলাদেশে শতকরা ৮০ ভাগ রাজনীতিবিদ ও সংসদ সদস্য ব্যবসায়ী। তারা জনগণের ধরা মাছ নিজেদের বলে চালিয়ে দিয়ে জনগণকে দেন। যার নাগাল শুধু নিকটস্থ চাটুকাররাই পেয়ে থাকেন, সাধারণ জনগণ পান না। এভাবে সমাজে একটি বঞ্চিত শ্রেণি হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ছে। ফলে দেশে ভাতের আবাদ হলেও তার সঠিক সংরক্ষণ ও সুষম বন্টন নেই। চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত ও হতাশ।

একজন প্রান্তিক ধান চাষির বার্ষিক উৎপাদন ও আয় আর একজন ছোট চাকরিজীবীর বার্ষিক আয়ের ব্যবধান অনেক। এমন বৈষম্যের মুখে কল্যাণ অর্থনীতির সূত্র গোলমেলে হয়ে পড়েছে। এছাড়া গত ১০ বছর ধরে চেষ্টার পরও অনেক ক্ষেত্রেই আছে লাগামহীন দুর্নীতির সুযোগ। এক দিকে শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কাজ নেই, অপরদিকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মনের মত ভালো কাজ ও ব্যক্তি মর্যাদা নেই। ফলে উপযুক্ত কাজের অভাবে বিদেশে মেধা পাচার হয়ে যায়, আর ফিরে আসে না।

দেশে প্রান্তিক কৃষক ও চাকরিজীবীদের মাসিক আয়ের ফারাক দেখে কৃষকরা হতাশ হয়ে ভিটেমাটি বা কৃষি জমিটুকু বন্ধক রেখে বা বিক্রি করে ঘুষ দিয়ে হলেও তাদের সন্তানদের জন্য সরকারি চাকরি বাগাতে চান। চাকরি না হলে ঘুষের টাকাটাও অনেক সময় উদ্ধার করতে পারেন না। পরে আদরের সন্তানকে জীবন বাজি রেখে অবৈধ পথে বিদেশে পাঠাতেও কুণ্ঠিত হচ্ছেন না তারা। কিন্তু সেখানেও বিপত্তি। অবৈধ বলে দেশে ফিরে আসতে হচ্ছে। দেশে চাকরি নেই, বিদেশে গেলেও বিপদ। তাহলে সনদপ্রাপ্ত শিক্ষিত বেকার ছেলেমেয়েরা কোথায় ঠাঁই নেবেন?

অনেকের ভাষ্য, আমাদের দেশে সস্তায় হাইব্রিড চাল, মাছ-মুরগি সবই পাওয়া যায়। বাজার ভর্তি খাদ্য সাজানো রয়েছে। বাসা ভাড়া পাওয়া যায়। হাসপাতাল হয়েছে অনেক দামি দামি। মানুষের গতি বেড়েছে। চাকরিতে অনেক পদ খালি। তাদের সঙ্গে একমত নই আমি বরং সমাজের অসঙ্গতিগুলো লক্ষ্য করলে বেশ হতাশ হই। কারণ, দেশের মোট জনসংখ্যার আয় বেড়েছে কতজনের? হয়তো কিছু মানুষের আয় বেড়েছে। গতি বেড়েছে কাদের? নিশ্চয়ই দালাল ও তদবিরকারী লোকগুলোর গতিই বেড়ে চলেছে! এসব লোক দেশের অর্থনীতিকে মৌসুমী ইঁদুরের মত শোষণ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠনগুলো ধ্বংস ও মূলধন নিঃশেষ করে দিচ্ছে। গেল সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সেমিনারে বক্তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এনবিআর বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা আর্থিক ডেফিসিটে ভুগছে। এছাড়া তাদের ধার-দেনা করার জায়গা সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় দেশের মেগা উন্নয়ন প্রকল্পগুলো চালু রাখতে বিশেষ সাহায্য পাওয়া জরুরি।

বাজারে অনেক কিছু থাকলেও আমার ক্রয় ক্ষমতা নেই। থাকলেও সেটা খুবই সীমিত। ধনীর জন্য দামি হাসপাতাল, বিদেশি ডাক্তার, বিদেশি দামি ওষুধ। এমনকি দেশের ভালো ডাক্তারদের ফিও বেশি। গ্রামে-গঞ্জে এমনকি জেলা শহরের স্থানীয় হাসপাতালে তারা থাকেন না। লাখ লাখ ফ্ল্যাট তৈরি হলেও সেগুলো নিম্ন আয়ের মানুষেরা পান না। পদ খালি থাকলেও ঘুষ-দুর্নীতি ছাড়া চাকরি যেন সোনার হরিণ। যা রয়েছে সামর্থ্যবানদেরই দখলে। এভাবে অর্থ ও ক্ষমতাশালীরা সমাজের সব সুবিধার ভোক্তা হয়ে উঠছেন এবং সনদধারী মেধাবী বিত্তহীনরা শত শত ভাইভা দিয়েও নানাভাবে বঞ্চিত হয়ে আরো দুর্বল ও হতাশ হয়ে পড়ছেন।

এক দিকে কর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীন ও সামঞ্জস্যহীন শিক্ষা ও সার্টিফিকেট, অন্য দিকে বৈষম্যপূর্ণ আর্থ-প্রশাসনিক কাঠামো, রাজনৈতিক ভাওতাবাজি দেশের অনৈতিক কাজের গতি বাড়িয়ে দিলেও মানুষের নৈতিক মেরুদণ্ড বাঁকা করে দিয়েছে।

উচ্চ শিক্ষার সঙ্গে গবেষণা, উন্নয়ন নীতি এবং পরিকল্পনার সংযোগ ঘটাতে হলে আমাদের পাবলিক, অ-পাবলিক সব বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারগুলো শক্তিশালী করার সময় এসেছে। যাতে লাখ লাখ সনদধারী বেকার তৈরি না হয়ে মানবসম্পদ তৈরি হয়। শিক্ষিত, জ্ঞানী ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে তৎপর হতে হবে। এজন্য নতুন বছরে সময় এসেছে জরুরি ভিত্তিতে সংশ্লিষ্টদের নতুন করে ভাববার।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।

বিজ্ঞাপন