লড়াইটা অকালেই থেমে গেল
আওয়ামী লীগের ২১তম সম্মেলনের আগের রাতে ফোন করেছিলাম। বললেন, দাদা, রাজনীতিতে ছিলাম, আছি, থাকবো। তবে শরীরটা ভালো না। শ্বাসকষ্টটা বেড়েছে। আমি বললাম, তাহলে আপনি সম্মেলনে যাইয়েন না। প্রায় আঁতকে উঠলেন, কী বলেন, আওয়ামী লীগের সম্মেলন, আর আমি যাবো না। আমি বললাম, তাহলে ভালো একটা মাস্ক লাগিয়ে যাইয়েন, যাতে ধুলা ঢুকতে না পারে। বললেন, সেটাও সম্ভব না। মাস্ক লাগালে নেতাকর্মীরা দূরের মনে করে। মনে করে ভাব হয়ে গেছে। এমনই আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ ছিলেন অ্যাডভোকেট ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পী।
সোহরাওয়ার্দীর ধুলা তার শ্বাসকষ্ট আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল, যা তাকে টেনে নেয় হাসপাতাল পর্যন্ত। কেবিন থেকে আইসিইউ, আইসিইউ থেকে লাইফ সাপোর্ট, তারপর মৃত্যু। অবশ্য হাসপাতালে তিনি আগেও ছিলেন। ২০১৬ সালে এই শ্বাসকষ্ট নিয়েই ভর্তি হয়েছিলেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে। পরে ব্যাংকক থেকেও চিকিৎসা নিয়ে এসেছিলেন। শ্বাসকষ্টের সমস্যা আমারও আছে। আমি ধুলাবালির ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকি।
কিন্তু রাজনীতির কারণে তিনি পারেন না। তাই তাকে ডাক্তার আর ঔষধের পেছনে দৌড়াতে হয়। আমি নিয়মিত অধ্যাপক আলী হোসেনকে দেখাই। পরে বাপ্পী আপাকেও তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দেই। কিন্তু নিয়ম না মানলে শুধু ঔষধে সবসময় কাজ হয় না। ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পীর ক্ষেত্রেও হয়নি।
তার নাম আমি বিভিন্ন সময়ে শুনেছি। তার সাহসের অনেক গল্প শুনেছি। কিন্তু তার কিছুটা আগেই ক্যাম্পাস ছেড়ে দেয়ায় পরিচয় ছিল না। মারদাঙ্গা ইমেজের কারণে আমি একটু দূরে দূরেই থাকতাম। তখন তিনি সম্ভবত সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল বা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর। একদিন আমার ইনবক্সে হ্যালো বললেন। আমি ভয়ে ভয়েই সাড়া দিলাম। একে তো অপরিচিত, তাও আবার মারদাঙ্গা নেত্রী, তুখোড় আইনজীবী। তিনি বেশ স্বচ্ছন্দ। বললেন, আমি আপনার মিরপুরের বাসায় গেছি। আমি একটু অবাক হলাম। পরে জানলাম বাসায় আসার কাহিনী। আমার স্ত্রী মুক্তি শিকদারের বড় বোন জলি কবির ঢাকা সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ছিলেন, ছিলেন মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী। তিনি প্রায়ই নানান কর্মসূচি শেষে মিরপুরে আমাদের বাসায় চলে যেতেন ছোট বোনের সাথে সময় কাটাতে। যাওয়ার সময় সাথে তার কোনো না কোনো রাজনৈতিক সহকর্মী থাকতেন। তাদের সাথে আমার দেখাই হতো না।
কারণ জলি আপা যখন যেতেন, তখন আমি অফিসে থাকতাম। আমি ফেরার আগেই তারা চলে যেতেন। তাই ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পী আমাদের বাসায় গেলেও আমার সাথে পরিচয় হয়নি। বাসায় ফিরে মুক্তিকে বললাম, তার কাহিনী। শুনে মুক্তি একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো। সড়ক দুর্ঘটনায় অকালেই চলে যাওয়া বড় বোন জলি কবিরের কথা মনে পড়লো। জানালো, বাপ্পী আপা একসময় কুমিল্লায় মোগলটুলিতে তাদের বাসার কাছেই ভাড়া থাকতেন। তার আরেক বোন রত্নার সহপাঠী। তারপর দ্রুতই মুক্তির সাথে বাপ্পী আপার যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হলো। মুক্তি যেন ফিরে পেলো তার হারানো বড় বোনকে। দ্রুতই তিনি হয়ে গেলেন আমাদের পরিবারের সদস্য। আমার সাথে যোগাযোগ তেমন না হলেও মুক্তির সাথে তার বোনের নিত্য যোগাযোগ। তারপর কত আড্ডা, কত গান, কত স্মৃতি, কত পরিকল্পনা ইয়ত্তা নেই। তিনি অনেকবার ভরা বর্ষায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ধরন্তি বলে একটি জায়গায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। হয়তো কোনোদিন যাবো, তাকে মনেও পড়বে। মানুষকে ভালোবাসার, আপন করে নেয়ার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তার। মৃত্যুর পর অনেকেই অ্যাডভোকেট ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পীর অনেক দোষ খুঁজে বের করছেন।
সাংবাদিকদের সাথে তার ভালো সম্পর্ক ছিল, এটাও তার দোষ। সাংবাদিকদের বাসায় দাওয়াত দিয়ে খাওয়াতেন, এটাও তার দোষ। যারা রাজনীতি করছেন এবং যারা সাংবাদিকতা করছেন; দুই পক্ষকেই সাবধান করে দিচ্ছি; আপনাদের মধ্যে যেন ভালো সম্পর্ক না থাকে। থাকলে আপনাদের কথা শুনতে হবে। খাওয়ানো পর্যন্ত ঠিক ছিল, কেউ কেউ এমনও বলছেন, তিনি টাকা দিয়ে সাংবাদিকদের সাথে সম্পর্ক ভালো রাখতেন। টাকা দিয়ে সম্পর্ক রাখা যায় বা ভালো রাখা যায়; এই ভাবনাটাই অদ্ভুত। সম্পর্ককে যারা টাকা দিয়ে মাপেন, তাদের চিন্তার সঙ্কট আছে। আমার সাথে ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পীর ভালো সম্পর্ক ছিল। সেটা যতটা না পেশাগত, তারচেয়ে বেশি পারিবারিক। একটা ছো্ট উদহারণ দেই। তিনি নিয়মিত বিভিন্ন টেলিভিশনের টক শো’তে যেতেন। আমি নিজেও একটা টেলিভিশনে টক শৌ উপস্থাপনা করি। কিন্তু তিনি কখনো আমার অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে আসেননি। হয় তিনি টাকা দিয়েও আমার টক শো’তে আসতে পারেননি অথবা আমি টাকা দিয়েও তাকে আনতে পারিনি।
যিনি রাঁধেন, তিনি চুলও বাঁধেন; এটা যেমন সত্যি। আবার যিনি রাজপথে-সংসদে বিপ্লবী, তিনিও রাঁধেন; এটাও সত্যি। ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পী রাঁধতে ভালোবাসতেন, মানুষকে খাওয়াতে ভালোবাসতেন। একবার পহেলা বৈশাখে তার বাসায় একশো পদের ডিনার নিয়েও সমালোচনা হচ্ছে দেখি। আরো অনেকের মতো চাইলে তিনি ঢাকা ক্লাব বা গুলশান ক্লাবে খাইয়ে দিতে পারতেন। তাতে খরচ অনেক বেশি পড়তো, কিন্তু সমালোচনা হতো না। বাসায় ডেকে একশো পদ দিয়ে খাওয়ানোটাই দোষের হয়ে গেছে। বাসায় খাওয়ানোতে খরচ অনেক কম হয়েছে, কিন্তু পরিশ্রম অনেক বেশি হয়েছে। একশো আইটেমের প্রতিটা তার নিজের বানানো। হয়তো চাল এসেছে নড়াইল থেকে, সিদল শুঁটকি এসেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে বা কোনো উপাদান হয়তো ময়মনসিহংহ থেকে এসেছে। একজন ব্যস্ত রাজনীতিবিদ নিজ হাতে একশো পদ রান্না করে প্রিয়জনদের খাইয়েছেন; আমি ভেবেছি এটা প্রশংসার বিষয়। এখন দেখছি, যারে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা। রাজনীতিবিদদের আসলে শত দোষ।
আগেই বলেছি তিনি রাঁধতে ভালোবাসতেন। হয়তো আমার বা মুক্তির পছন্দের কিছু রান্না করেছেন; ফোন করে বলতেন, ড্রাইভার পাঠিয়ে দিয়েন। বৃষ্টি এলে ফোন করতেন, দাদা খিচুড়ি রান্না করেছি। চলে আসেন। এটা অবশ্য আমারই বলা ছিল। তার ৪ নম্বর ন্যাম ভবনের সাত তলার ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসে ঝুম বৃষ্টিতে মানিক মিয়া এভিনিউ আর সংসদ ভবনের মোহনীয় রূপ দেখার অনুভূতিটাই অন্যরকম।
তার হাতের রান্না শুধু আমরা নই, এটিএন নিউজের অনেকেই খেয়েছে। রিপোর্টাররা বলতো, অনেকদিন বাপ্পী আপার চ্যাপা ভর্তা খাই না। বললেই পাঠিয়ে দিতেন। এটিএন নিউজে তার সেই ভর্তার নাম ছিল, ছুটির দরখাস্ত। কারণ প্রচণ্ড ঝালের সেই চ্যাপা ভর্তা খেলে অনেকে পরদিন অফিসে আসতে পারতো না।
তার রান্না করা চ্যাপা ভর্তার মতোই কড়া ছিল তার রাজনীতি। রাজপথে, সংসদে, টেলিভিশন টক শো’তে- তার স্টাইল ছিল মারদাঙ্গা। তিনি ছিলেন কড়া আওয়ামী লীগার। এমন আওয়ামী লীগার দেশে আরো আছে। কিন্তু ফজিলাতুন্নেসা অন্যদের চেয়ে আলাদা ছিলেন, স্টাইল যাই হোক তিনি কথা বলতেন যুক্তি দিয়ে, তথ্য দিয়ে। আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত আসনের সাংসদদের মধ্যে টেলিভিশন টক শো’তে অংশ নেয়ার মতো ছিলেন হাতেগোণা কয়েকজন। তার মধ্যে তিনি ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পী একজন। সংরক্ষিত আসনের সাংসদদের মধ্যে অধিকাংশই বাবা, স্বামী বা পারিবারিক পরিচয় বা অন্য পেশার প্রতিনিধি হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন। ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পী একদম মাঠ থেকে রাজনীতি করে, আন্দোলন করে উঠে আসাদের একজন।
১/১১এর কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ তিনি। নিজেকে আরো যোগ্য করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা ছিল তার। সংসদের বক্তৃতার আগে প্রচুর হোমওয়ার্ক করতেন। অংশ নিতেন সংসদের সংকল কর্মকাণ্ডে। নিয়মিত নানা বিষয়ে নোটিশ দিতেন। পরপর দুইবার সংসদ সদস্য ছিলেন। এরপর আরো বেশি সময় দিতে চেয়েছিলেন সংগঠনকে। আসলে তিনি ছিলেন সার্বক্ষণিক রাজনীতিবিদ। প্রতিটি আচার আচরণে সদা সতর্ক থাকতেন। কড়া আওয়ামী লীগার হওয়া নিয়ে আমার সাথে মাঝে মাঝে লেগে যেতো। তার সংসদের কোনো বক্তৃতা শুনে হয়তো আমি লিখতাম, এত কড়া বত্তৃতা না দিলেও পারতেন। বা আমার কোনো লেখায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কিছু থাকলে তিনি লিখতেন, দাদা, এতটা কড়া না হলেও পারতেন। কখনো কখনো রাজনৈতিক দ্বিমত ছিল, তবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা-ভালোবাসাটা অটুট ছিল আমৃত্যু।
তার মৃত্যুটা নিয়ে আমার একটু আক্ষেপ আছে। আইসিইউতে নেয়ার পর থেকেই আমি দেশের বাইরে নেয়ার জন্য পরামর্শ দিচ্ছিলাম। মৃত্যুর আগের দিন ভারতের চেন্নাই অ্যাপোলোতে নেয়ার ব্যাপারে সব চূড়ান্ত করা হয়। কিন্তু তার আগেই তিনি চলে গেলেন। আমার খালি আফসোস ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পীকে দেশের বাইের নেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পাঁচদিন লাগলো কেন?
তার দল ১১ বছর ধরে ক্ষমতায়। কিন্তু তার মধ্যে বরাবরই একটা ফাইটার বাস করতো। আদর্শের প্রশ্নে একরোখা ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রশ্নে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে তার লড়াই ছিল আপসহীন। ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পী রাজপথে, আদালতে, সংসদে, টক শো’তে লড়াকু ছিলেন। কিন্তু তার জীবনের লড়াইটাই থেমে গেল মাত্র ৪৯-এ! হায় জীবন এত ছোট কেন!
প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ