ইরান-আমেরিকা উত্তেজনা: কার লাভ, কার ক্ষতি?
কাসিম সোলাইমানিকে হত্যার মধ্য দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে নতুন খেলা শুরু করেছেন শেষাবধি তার রেশ কোথায় দাঁড়াবে, সেটা এখনো অজানা।
তবে এটা বলা যায়, কাসিম সোলাইমানিকে হত্যার মধ্য দিয়ে দু’টো গুটির চাল খেলেছেন ট্রাম্প। প্রথমত, ইরানকে একটা কড়া বার্তা দিয়েছেন। বলতে চেয়েছেন, আমরা চাইলে অনেক কিছুই করতে পারি। তোমার প্রতিরক্ষার সেরাজনকে ছলে-বলে কৌশলে খুন করে আসতেও আমাদের একটু সময়ও লাগে না।
দ্বিতীয়ত, আমেরিকান ভোটারদের ট্রাম্প জানাতে চেয়েছেন, যতক্ষণ তোমরা ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট রাখবে, ততক্ষণ অল ইজ ওয়েল- সব ঠিক আছে।
এখন প্রশ্ন, সব কি আসলেই ঠিক আছে?
আমেরিকার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় ইরানের অর্থনীতির প্রায় রুদ্ধ দশা। সে দেশের তরুণ সমাজ ফুঁসে উঠেছে। ১৯৭৯ সালের পর ইরানের খামেনিতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটা বড় গণতান্ত্রিক আন্দোলন দানা বেধে উঠছিল জোরেসোরে। ক্ষমতাধর আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি এবং তার মোল্লাতন্ত্র কঠোরতার সঙ্গে মোকাবিলা করেও দমাতে পারছিল না এ আন্দোলন। ইরানের জনগণের ক্ষোভের চোখ সরানোর জন্য তাই জাতীয়তাবাদের জিগির তোলা ছিল খুব জরুরি। ট্রাম্প সেটা করে দিলেন সহজেই, জেনারেল কাসিম সোলাইমানিকে খুন করে। কাসিম সোলাইমানির জানাজায় আয়াতুল্লাহ খামেনির কান্না সেই জাতীয়তাবাদী আবেগকে এতটাই প্রবল করে তোলে যে কাসিমের শবমিছিলে পদদলিত হয়ে অর্ধশতাধিক মানুষ মৃত্যুবরণও করেন। কাসিমের খুনকে ইরানের আমজনতা তাদের জাতীয়তাবাদী গৌরব খুন হিসেবে ধরে নিয়েছেন। ফলে তাদের সব ক্ষোভ রূপ নিয়েছে আমেরিকাবিরোধি জাতীয়তাবাদী ক্রোধে। ইরানের ওপর আমেরিকানদের হামলা ইরানের সবাইকে এক ভাবতে শেখাবে। ইরানের জাতীয়তাবাদী চেতনাকে আরো একীভূত করবে। সরকারের বিরুদ্ধে তরুণ ইরানিদের যত ক্ষোভই থাক না কেন, ট্রাম্প দ্বারা ইরানের অপমান তারা সইবে না। বুকের জ্বালা বুকে রেখেই তারা ঘরের শত্রুর পেছনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়াবে বড় শত্রু ট্রাম্পকে মোকাবিলায়। ফলে কাসিম সোলাইমানি হত্যা এক অর্থে গোটা ইরানি সমাজকে ইরানের বর্তমান শাসকদের পেছনেই ঐক্যবদ্ধ করবে। সোলাইমানি হত্যার ইস্যু কাজে লাগিয়ে ইরানের বর্তমান শাসক দেশের অভ্যন্তরীণ সব সমস্যা থেকে জনগণের মনোযোগ অন্যত্র সরানোর সুযোগ কাজে লাগাবেন। সেই অর্থে সোলাইমানি হত্যা আয়াতুল্লাহ খামেনি গংকে দেশের অভ্যন্তরে আরো শক্তিশালী করে তুলবে।
দুই.
অন্যদিকে ইরান-আমেরিকা দ্বৈরথকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাবে। ইতোমধ্যে ইরানের বিরুদ্ধে আরো কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন ট্রাম্প। আমেরিকাবাসীকে বোকা বানিয়ে ট্রাম্প এখন যুদ্ধ-যুদ্ধ আওয়াজ জাগিয়ে একদিকে অস্ত্র ব্যবসায়ী লবিস্টদের তুষ্ট করছেন, অন্যদিকে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদকে তুঙ্গে তুলে আগামী নির্বাচনে নিজের জন্য বিশেষ ফায়দা নিতে চাইছেন। ইরানি জেনারেল সোলাইমানিকে খুন করে ট্রাম্প আমেরিকার অভ্যন্তরে তার বিরুদ্ধে ওঠা ইমপিচমেন্ট থেকে জনগণের দৃষ্টি ঘোরাচ্ছেন। আসন্ন নির্বাচনে আমেরিকান জাতীয়তাবাদী হাওয়াকে নিজের পক্ষে কাজে লাগিয়ে আমেরিকাজুড়ে ট্রাম্পজোয়ার জাগানোর চেষ্টা চলবে।
ইরাকের শিয়া সরকার এবং বর্তমান ক্ষমতাসীন কাঠামো ইরানের বিশেষ স্নেহধন্য। ফলে ইরাকের জনগণের একাংশ এই শিয়া আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল। বিশেষ করে ইরাক সরকারের বিরুদ্ধে যে জনমত তৈরি হচ্ছিল, তাও স্তিমিত হয়ে পড়বে এই ঘটনায়। সে অর্থে ইরাকের মাটিতে ইরানের আধিপত্য আরো নিরংকুশ হয়ে পড়বে এখন।
এখন দেখা যাক ইরাকের মাটিতে ইরানি জেনারেলকে হত্যার পর কি কি ঘটনা ঘটেছে:-
০১. ইরাকের মার্কিন ঘাঁটিতে ইরান ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে ৮০ জন আমেরিকান সৈন্য হত্যার দাবি করেছে। আমেরিকা তা অস্বীকার করেছে। আবার এই হামলায় কোনো ইরাকি নাগরিক মারা যাননি বলে ইরাকও দাবি করছে। বলা হচ্ছে, হামলার আগে ইরাককে এ বিষয়ে অবহিত করে ইরান। কোনো কোনো খবরে দাবি করা হচ্ছে, ইরাক এই তথ্য আমেরিকানদের আগেভাগেই জানিয়ে দেয়। এটা সত্য হলে বলা ভালো খোদ ইরানি কর্তাব্যক্তিরা আমেরিকান ঘাঁটিতে হামলা চালালেও আমেরিকান সৈন্য হয়তো হত্যা করতে চায়নি। কৌশল হিসেবে এটা খুবই ভালো, কেননা এতে আমেরিকান গৌরবে আঘাত করে ইরানি জনগণকে একদিকে যেমন তুষ্ট করা গেছে, অন্যদিকে আমেরিকার পাল্টা ব্যবস্থার হাত থেকে আপাতত রক্ষাও পাওয়া গেছে।
০২. ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কোনো মার্কিন বা ইরাকি সেনা নিহত হয়নি- ইরানের হামলার পর আনুষ্ঠানিক বক্তৃতায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই দাবি করেন। এই বক্তৃতায় ট্রাম্প বলেন, তাদের মধ্যপ্রাচ্যের তেল-গ্যাস প্রয়োজন নেই। তারা এখনই তেল-গ্যাস উৎপাদনে শীর্ষে আছে। ট্রাম্প তার ভাষণে বলেন, ইরান সম্ভবত গুটিয়ে গেছে। অবশ্য এটা সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ এবং বিশ্বের জন্য খুব ভালো কিছু।
০৩. কাসিম সোলাইমানিকে হত্যার পর আমেরিকার সৈন্যদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে ইরানের সংসদ। পারমাণবিক চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলেছে ইরান। আর ইরাকি সংসদ প্রস্তাব পাস করেছে এই বলে যে ইরাকের মাটি থেকে মার্কিন সেনাসহ সব বিদেশি সৈন্যদের চলে যেতে হবে। দু’টোই খুব গুরুত্বপূর্ণ।
০৪. কাসিম সোলাইমানি খুন ও ইরাকের মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের হামলার পর অরেকটি বড় ঘটনা ঘটেছে। সেটা হলো বুধবার (০৮ জানুয়ারি) ভোরে ইউক্রেন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৩৭ বিমান তেহরানের ইমাম খামেনি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করার পর বিমানবন্দর থেকে ৪৫ কিলোমটার দূরে বিধ্বস্ত হয়। ১৭৬ আরোহীর সবাই নিহত হন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৮২ জন ইরানের, ৬৩ জন কানাডার, ১১ জন ইউক্রেনের, চারজন আফগানিস্তানের, তিনজন জার্মানির ও তিনজন বৃটেনের নাগরিক। ১১ জন ক্রু নিহত হয়েছেন, এরা সবাই ইউক্রেনের নাগরিক। এই বিমান বিধ্বস্ত হওয়াটা কি নিছক দুর্ঘটনা? নাকি, কোনো পক্ষের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার শিকার, তার কোনো হদিছ মিলছে না।
তিন.
আপাতত এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা ট্রাম্পকে নিজ দেশে আর আয়াতুল্লাহ খামেনির মোল্লাতন্ত্রকে নিজ দেশে বিশেষ সুবিধা দিলেও মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর অনেক দেশকেই বিপাকে ফেলবে। বিশেষ করে তেলের বাজারে এই উত্তেজনার ছাপ পড়েছে ইতোমধ্যে। ভবিষ্যতে আরো পড়বে। অন্যদিকে বৈশ্বিক জ্বালানি তেল সরবরাহের একটি বড় অংশ পরিবহন করা হয় হরমুজ প্রণালী দিয়ে। যার নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশেই ইরানের হাতে। ইরান এই রুট বন্ধ করে দিলে বড় ধরনের বিপাকে পড়বে গোটা বিশ্ব। কারণ বৈশ্বিক মোট গ্যাসের এক-তৃতীয়াংশ ও জ্বালানি তেল সরবরাহের এক-চতুর্থাংশই হয় এ পথ দিয়ে। ফলে জ্বালানি তেলের বাজার অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়তে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও সৌদি আরবের সঙ্গেও ইরানের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটবে। এছাড়া এর প্রতিক্রিয়া ঘটবে ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, লেবানন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে। ইরান মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছায়াযুদ্ধের আরো বিস্তার ঘটাবে। সিরিয়ার মতো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরানের সাফল্য ছড়িয়ে যাবে। চীন-রাশিয়া ইরানকে সহায়তা করবে। ফলে একদিকে আমেরিকার নয়া আধিপত্যবাদ, অন্যদিকে রাশিয়া-চীনের মিত্রতা নিয়ে ইরানের ছায়াযুদ্ধ গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থির করে তুলতে পারে। সৌদি আরব এর বড় টার্গেট হবে। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে আমেরিকান জনগণ ও আমেরিকার সামরিক-বেসামরিক স্থাপনা হামলার টার্গেট হবে। মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি মিত্ররা বড় ধরনের চাপে পড়বে।
ইরাক এখন নয়া যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে, যুদ্ধের হুমকিতে থাকবে। এখানেই ইরানি জেনারেলকে হত্যা করা হয়েছে, আবার ইরাকের মাটিতেই আমেরিকান সৈন্যদের টার্গেট করেছে ইরান। ফলে ইরাক অন্যদের যুদ্ধের বলি হতে চলেছে। ইরান-ইরাক দুই দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থার আপাতত উন্নতির সম্ভাবনার বদলে দুই দেশেই বর্তমান শাসকদের জাঁকিয়ে বসার সুযোগ করে দিচ্ছে ইরান-আমেরিকা দ্বৈরথ।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট এতদিন প্রতিরক্ষা জোট ন্যাটোকে উপেক্ষা, অবজ্ঞা করে এলেও এখন তা অধিকতর জাগ্রত করার কথা ভাবছেন। কিন্তু ট্রাম্পের ঝড়ো রাজনীতি ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোকে সেদিকে অগ্রসর করবে বলে মনে হয় না। আবার ইরান পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা দেয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য সেটা সুখকর হবে না। ইরান-আমেরিকা যত বাড়বে, বিশ্ব রাজনীতিতে চীন ও রাশিয়া নতুন করে ততই প্রভাব বাড়াতে উদ্যোগী হবে। সেটাও পশ্চিমা বিশ্বের জন্য স্বস্তির নয়।
বাংলাদেশের মতো যেসব দেশ ইরান ও আমেরিকা দুই দেশের সঙ্গেই মিত্রতা রাখতে চায়, বর্তমান ঘটনাপ্রবাহ তাদের জন্য নতুন কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। মধ্যপ্রাচ্য বড় সংঘাতে জড়িয়ে পড়লে কিংবা ইরানের ছায়াযুদ্ধ বিস্তৃত হলে অথবা আমেরিকার হামলা বাড়লে মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়তে পারে। ফলে বাংলাদেশের জন্য দুই রকমের সংকট বাড়বে। এক. প্রবাসী আয় কমবে, প্রবাসী শ্রমিকদের ফিরে আসার হার বাড়বে। দুই. তেলের দাম বাড়লে আমদানি ব্যয় বাড়বে, অভ্যন্তরীণ ব্যয় বাড়বে।
জেনারেল কাসিম সোলাইমানি হত্যা তাই ট্রাম্প ও খামেনিকে বিশেষ সুবিধা দিলেও তা বিশ্বের বহুদেশের জনগণের জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে।
লেখাটা শেষ করছি, আমেরিকার সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো-বাইডেনের উক্তি দিয়েই। তিনি যথার্থই বলেছেন ট্রাম্পের এই হত্যাকাণ্ড মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ‘গোলাবারুদের আস্তানায় ডিনামাইট’ ছোড়ার প্রতিক্রিয়া ঘটাবে। আর যার প্রভাব পড়বে গোটা দুনিয়ার অর্থনীতি ও রাজনীতির ওপর।
লেখক: শুভ কিবরিয়া, নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক।