প্লেয়িং ফিল্ড কতটা লেভেল?
সরস্বতী পূজার কারণে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন পেছানোর দাবি ছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সে দাবি নাকচ করে দিয়েছে। আশা ছিল হাইকোর্ট বিষয়টি বিবেচনা করবেন। কিন্তু নির্বাচন পেছানোর জন্য রিট খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে ক্ষুব্ধ করবে। কারণ সরস্বতী পূজা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের গুরুত্বপূর্ণ পূজা। সাধারণত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই পূজা উদযাপিত হয়। আর নির্বাচনের বেশিরভাগ ভোট কেন্দ্রই হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। তাই এবার হিন্দু শিক্ষার্থীরা নির্বিঘ্নে সরস্বতী পূজা করতে পারবেন না।
হাইকোর্টে রিট খারিজ হয়ে যাওয়ার পর ৩০ জানুয়ারিই অনুষ্ঠিত হচ্ছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। ১০ জানুয়ারি প্রতীক বরাদ্দের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে জমজমাট নির্বাচনী প্রচারণা। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদ দিলে এখন পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচারণা ভালোই হচ্ছে। ঢাকা দক্ষিণে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস ভোট চাইতে তার প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি প্রার্থী ইশরাক হোসেনের বাসায় গেছেন। সেখানে গিয়ে তিনি উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছেন। ঢাকা উত্তরে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আতিকুল ইসলাম তার প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি প্রার্থী তাবিথ আউয়াল সম্পর্কে বলেছেন, আমাদের সম্পর্ক চাচা-ভাতিজার। আমরা চাই এই উষ্ণতা, আন্তরিকতা বজায় থাকুক শেষ পর্যন্ত।
তবে নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে দুই দলের নেতাদের মধ্যে কথার লড়াই চলছে। তবে এবার সরকারি দল, আক্রমণকেই প্রতিরক্ষার উপায় হিসেবে নিয়েছে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে সরকারি দলের অভিযোগই বেশি। সেই বিতর্ক নিয়ে তারা নির্বাচন কমিশন পর্যন্ত গেছে। কিন্তু তাতে বিতর্ক কমেনি, বরং বেড়েছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচন আচরণ বিধিমালা, ২০১৬ এর ২২ এর ১ উপধারা অনুযায়ী, সরকারি সুবিধাভোগী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নির্বাচনী প্রচারণা ও কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবেন না। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির তালিকায় মন্ত্রীরা তো আছেনই, আছেন এমপিরাও। বিপত্তিটা এখানেই। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এমপিও নন, মন্ত্রীও নন। তাই তিনি দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণায় অংশ নিতে পারছেন। কিন্তু সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এমপি এবং মন্ত্রী। তাই তার পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় নামা সম্ভব নয়। যদিও তিনি দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে ভোট না চাইলেও প্রতিদিনই নির্বাচন নিয়ে নানা কথা বলছেন। সেই ওবায়দুল কাদেরই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, বিএনপির মহাসচিব নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারলে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পারবেন না কেন? এ কেমন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড? আপাত দৃষ্টিতে প্রশ্নটিকে খুব ন্যায্য মনে হতে পারে। কিন্তু এটা আসলে কুতর্ক। ওবায়দুল কাদের নিজেও সেটা জানেন। কারণ নির্বাচনী আচরণ বিধি তারাই প্রণয়ন করেছেন। এই প্রশ্নটা নির্বাচনের আগে না তুলে বিধিমালা প্রণয়নের আগে তোলা উচিত ছিল। প্রশ্নটি যে অনর্থক, এটা ওবায়দুল কাদের জানেন, তবু করেছেন মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য। মানুষকে বোঝানোর জন্য যে, দেখুন আওয়ামী লীগ কত ছাড় দিচ্ছে।
নির্বাচন পরিচালনার জন্য বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুই সিটিতে কমিটি গঠন করেছে। উত্তর সিটিতে বিএনপির কমিটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ এবং দক্ষিণে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। এ দুজনই বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা, স্থায়ী কমিটির সদস্য। ব্যারিস্টার মওদুদ সাবেক প্রধানমন্ত্রী, ড. মোশাররফ সাবেক মন্ত্রী। কিন্তু এখন তারা মন্ত্রী হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না, এমপিও না। তাই তারা অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নন। তাই তারা নির্বিঘ্নে প্রচার চালাতে পারছেন। কিন্তু উত্তরে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনার নেতৃত্ব দিচ্ছেন তোফায়েল আহমেদ আর দক্ষিণে আমির হোসেন আমু। বর্তমানে মন্ত্রিসভায় না থাকলেও তারা দুজনই সংসদ সদস্য। তাই আচরণবিধি অনুযায়ী তাদের নির্বাচনী প্রচারণা এবং কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবেন না। নির্বাচন সমন্বয় করা নির্বাচনী কার্যক্রম কিনা, সেটাই নিয়েই তর্ক।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলে দিয়েছেন, এমপিরা সমন্বয়ের কাজও করতে পারবেন না। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করছেন, নির্বাচনী প্রচারণা ছাড়া সবই করতে পারবেন এবং তারা সেটা করছেনও। তাই আচরণবিধি লঙ্ঘিত হচ্ছে প্রতিদিনই। অবশ্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার সমন্বয়ের ব্যাপারে আপত্তি করলেও মন্ত্রী-এমপিদের রাজনৈতিক কার্যক্রমে বাধা নেই বলে জানিয়েছেন। মানে তারা চাইলেও ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারবেন।
সিইসি উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, চাইলে মন্ত্রী-এমপিরা মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারবেন। তার মানে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিরা নির্বাচনী এলাকায় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সরকারের গুণগান গাইতে পারবেন। শুধু ভোটটুকু না চাইলেই হলো। সিইসিই আসলে আচরণবিধি লঙ্ঘনের কৌশলটা শিখিয়ে দিলেন। ওবায়দুল কাদেরের মত আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদলও নির্বাচন কমিশনের কাছে বিএনপির নেতাদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রীদের প্রচারণায় অংশ নেয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। দাবি করেছেন, সাবেক মন্ত্রীরাও অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তারাও আসলে জেনে-বুঝেই তর্কটা করছেন। এই তর্ক তোলার সময় তো এখন নয়। আওয়ামী লীগের আপত্তি থাকলে প্রণয়নের সময়ই এটাই ফয়সালা করে রাখার দরকার ছিল। আওয়ামী লীগ আসলে আগ বাড়িয়ে অভিযোগ করে বিএনপিকে চাপে রাখতে চায়। কৌশল হিসেবে মন্দ নয়।
খেলার ফলাফল যাই হোক, মাঠটা তো সমতল হতে হবে। ফুটবলে কিন্তু মাঝপথে দুই দল প্রান্ত বদল করে। ক্রিকেটে টস করে। শুধু নির্বাচন বা খেলা নয়; জীবনের সকল ক্ষেত্রেই সমতা বা ন্যায্যতা দরকার। আমি অবশ্য বরাবরই সমতার চেয়ে ন্যায্যতাকে বেশি গুরুত্ব দেই। নির্বাচনী আচরণবিধি করাই হয়েছে নির্বাচনের মাঠ সমতল রাখার জন্য। আর স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এটা আরও বেশি জরুরি। কারণ স্থানীয় সরকার নির্বাচন সরাসরি সরকারের অধীনেই হয়। তাই সরকারি দলকে একটু বেশি সতর্ক থাকতে হয়, একটু বেশি ছাড় দিতে হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ করছে উল্টো। একের পর এক অভিযোগ করে তারা ব্যতিব্যস্ত করে ফেলছে নির্বাচন কমিশন ও বিএনপিকে। অথচ সরকারি দল চাইলে আরও সংযত থাকতে পারতো। একদম কোনো প্রশ্ন উঠবে না, এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা অসম্ভব ছিল না। আওয়ামী লীগ যতই তর্ক করুক, মন্ত্রী আর সাবেক মন্ত্রী সমান গুরুত্বের নয়। আওয়ামী লীগের গত সম্মেলনে দল ও সরকারকে আলাদা করার একটা প্রশংসনীয় উদ্যোগ দেখা গেছে। চাইলে এই নির্বাচনেও সেটার প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব ছিল। মন্ত্রী-এমপি নন, এমন অনেকে এবার দলে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেয়েছেন। চাইলে তাদের দিয়েও নির্বাচন পরিচালনা সম্ভব ছিল। তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমুর মত সিনিয়র নেতাদের এই বিতর্কে টেনে না আনলেও চলতো।
৩০ জানুয়ারি জনগণ কী রায় দেবে, কে নগর পিতার দায়িত্ব পাবেন; সেটা জনগণই ঠিক করুক। আমরা খালি চাই, জনগণ যেন স্বাধীনভাবে সেটা ঠিক করতে পারে, মাঠটা যেন সমান থাকে।
প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ