প্রবাসী শ্রমিকদের কান্না

  • ফরিদুল আলম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

গত এক বছর ধরে উদ্বেগজনক হারে ফেরত আসছেন বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশের শ্রমিকরা। এ বছরের একমাস না যেতেই শুধু সৌদি আরব থেকে ফেরত আসা শ্রমিকের সংখ্যা ২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে যে, গত এক বছরে ৬৪ হাজারের বেশি বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিক দেশে ফেরত এসেছেন। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে তাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে অথবা ফেরত আসতে বাধ্য করা হয়েছেন। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরব থেকে ফেরত আসা শ্রমিকের সংখ্যা এক বছরের মধ্যে ২০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।

আমরা যদি লক্ষ্য করি, ১৬ কোটির বেশি জনসংখ্যা অধ্যুষিত এ দেশের ১ কোটির বেশি মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বৈধ বা অবৈধভাবে নানা পেশায় কর্মরত রয়েছেন। তাদের শ্রম আর ঘামের বিনিময়ে কষ্টার্জিত অর্থে একদিকে এদেশের অর্থনীতি যেমন সমৃদ্ধ হচ্ছে, এর বাইরে এই ১ কোটির বেশি পরিবার খেয়ে পড়ে টিকে রয়েছে। বাংলাদেশে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নামে পৃথক একটি মন্ত্রণালয় থাকলেও বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের প্রায় সবাই মূলত নিজেদের প্রচেষ্টায় সেখানে গেছেন।

বিজ্ঞাপন

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শ্রমিকরা বিদেশে গেছেন বিভিন্ন ব্যক্তি অথবা বৈধ-অবৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির হাত ধরে। এক্ষেত্রে সরকারের দিক থেকে খরচ সংক্রান্ত নির্দিষ্ট নীতিমালা থাকলেও ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হয় এই বিদেশ যাত্রার পেছনে। উপরন্তু যে ধরনের কাজ এবং মজুরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের বিদেশে প্রেরণ করা হয়, সেখানে যাবার পর অধিকাংশেরই স্বপ্নভঙ্গ হয়। যারা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে যাচ্ছেন এদের মজুরি ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার বেশি না; উপরন্তু নির্দিষ্ট নিয়োগকর্তার সিদ্ধান্তের বাইরে গেলে অথবা কাজ ছেড়ে দিলে থানায় জিডি করে তাদের ধরিয়ে দেয়া হয়।

বর্তমানে সৌদি আরব থেকে যারা ফেরত আসছেন এদের অধিকাংশের ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ যেমন রয়েছেন ১০ থেকে ১২ বছর অবস্থান শেষে ফেরত আসছেন আবার কেউ কেউ ২ থেকে ৩ মাস আগে সেখানে গেলেও ‘আকামা’ বা ‘ওয়ার্ক পারমিট’ সংক্রান্ত জটিলতার কারণে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে দেশে আসতে বাধ্য হচ্ছেন।

বিজ্ঞাপন

এই প্রবণতা গত কয়েক বছর ধরে চললেও সাধারণের মধ্যে যেমন সচেতনতা বাড়েনি, সেই সঙ্গ যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বিদেশে কর্মী পাঠানোর নামে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে ফেরত আসা ব্যক্তিরা অভিযোগ করছেন তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বাংলাদেশের দূতাবাসের কাছ থেকে কোনো ইতিবাচক সহায়তা পাওয়া যায় না।

সম্প্রতি উদ্বেগজনক হারে শ্রমিকদের ফেরত আসা নিয়ে সরকারের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যে, এ ধরনের জটিলতার ক্ষেত্রে সকল দায় বহন করবে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো। কিন্তু বাস্তবে তাদের কোনো জবাবদিহিতার আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না।

এখানে আরও উল্লেখ করা সঙ্গত যে, আমাদের দেশের মোট প্রেরিত জনশক্তির ৪০ শতাংশের বেশি সৌদি আরবে অবস্থান করলেও সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি সরকার তাদের শ্রম ও অর্থনৈতিক নীতি পরিবর্তন করেছে। তেলের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা অর্থনীতিতে বিকল্প সৃষ্টি করতে তারা এখন নিজেদের দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিজেদের কর্মী নিয়োগ করতে ‘আকামা’ ফি বৃদ্ধি করেছে।

গত বছর পর্যন্ত এই ফি ছিল মাসে ৬০০ রিয়েল, এ বছর থেকে এটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০০ রিয়েল। এক্ষেত্রে যারা সেখানে অবস্থান করছেন তারা তাদের উপার্জিত অর্থ থেকে এই ফি দেয়ার পর যা থাকবে তার পরিমাণ খুবই নগণ্য। আর এ কারণে অনেকের মধ্যে এক ধরনের প্রবণতা দেখা যায় নির্দিষ্ট কর্মক্ষেত্রের কাজ সেরে অতিরিক্ত কাজের অন্বেষণ করতে, আর এখানটাতেই ধরা খাচ্ছেন বেশিরভাগ মানুষ। সেই সঙ্গে নারী কর্মী যারা যাচ্ছেন এদের বেশিরভাগ বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে কাজ করছেন এবং বছরের পর নানাভাবে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। সমস্যাটি অনেক দিনের পুরনো হলেও এ নিয়ে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হয়নি।

আমাদের নিকটবর্তী অপর দেশ মালয়েশিয়া আমাদের শ্রমশক্তি প্রেরণের অন্যতম গন্তব্য হলেও ২০১২ সালের পর থেকে সেখানে সরকারিভাবে শ্রমশক্তি প্রেরণের যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল সেটা হোঁচট খায় রিক্রুটিং সংস্থাগুলোর দৌরাত্মের কারণে। সেসময় জি টু জি পদ্ধতিতে শ্রমিক প্রেরণের কথা থাকলেও কিছু রিক্রুটিং এজেন্সি এতে বাধ সাধলে ২০১৬ সাল থেকে জি টু জি প্লাস পদ্ধতিতে সরকারদ্বয়ের বাইরে বিভিন্ন এজেন্সিগুলো এতে সম্পৃক্ত হয়। এরপর থেকে অভিযোগ উঠতে থাকে শ্রমিকদের কাছ থেকে এজেন্সিগুলো মাত্রাতিরিক্ত টাকা আদায় করলেও মানসম্মত শ্রমিক সেখানে প্রেরণ করা হচ্ছে না। ফলত বন্ধ হয়ে যায় মালয়েশিয়ায় শ্রমিক প্রেরণ। আজ পর্যন্ত তা বন্ধ রয়েছে। সম্প্রতি মালয়েশিয়া সরকার বাংলাদেশ থেকে বিনা ব্যয়ে শ্রমশক্তি আমদানি করার কথা ঘোষণা করলেও এর পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে সেটাও শুরু হয়নি।

বাংলাদেশের রপ্তানিকৃত জনশক্তির বিশাল অংশের গন্তব্য সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ইরাক, লিবিয়া, বাহরাইন, ওমান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কোরিয়া, ব্রুনাই, মরিশাস, স্পেন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া ইত্যাদি কয়েকটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এর বাইরে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশ লেবাননেও প্রায় দেড় লক্ষ বাংলাদেশি শ্রমিক কাজে নিয়োজিত।

আগেই বলেছি, সংখ্যার দিক দিয়ে একটি বড় অংশের মানুষ বিভিন্ন দেশে বাস করলেও তারা প্রতিনিয়ত ঝুঁকির মধ্যে দিন যাপন করে নীরবে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন।

আজ সময়ের দাবি হচ্ছে, আমাদের এক্ষেত্রে একটি সুষ্ঠু সমন্বয়ের ব্যবস্থা করা, যার মাধ্যমে দেশের আরও অধিক সংখ্যায় শ্রমিক কেবল মালয়েশিয়া কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেতে পারে, যা আমাদের অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন তথা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের বিচরণকে আরও মসৃণ করতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় প্রতিদিন প্রবাস থেকে আমাদের শ্রমিকরা ফেরত আসছেন, তাদের কান্নায় বাতাস ভারী হচ্ছে। এর ভাষা বোঝা খুব জরুরি।

ফরিদুল আলম: সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।