ভোটের ভবিষ্যৎ!

  • শুভ কিবরিয়া
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

সদ্য শেষ হওয়া ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে যারা বিজয়ী হয়েছেন তারা মোট ভোটারের ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ সমর্থন পেয়েছেন। কথাটা উল্টোভাবে বললে বলা যায়, ভোটারদের ৮৫ থেকে ৮৩ শতাংশ তাদের সমর্থন দেন নাই। সংখ্যালঘু ভোটারদের সমর্থন নিয়েই তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে সেবা দেবার অধিকার লাভ করলেন। আবার এই ভোট নিয়েও বিতর্ক আছে বিস্তর।

বিরোধী দল বিএনপি এই নির্বাচনকে ‘তামাশা’ হিসেবে অভিহিত করে এই ভোটের প্রতিবাদে পরদিন হরতাল ডেকেছে। বলা যায় বিরোধী দল বিএনপিও হরতাল নিয়ে এক ধরনের ‘তামাশা’ই করেছে।

বিজ্ঞাপন

সরকারি দল অবশ্য এই ভোটকে সংঘাতমুক্ত, রক্তপাতহীন, শান্তিপূর্ণ ভোট বলেছে। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের মতে, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন খুবই শান্তিপূর্ণ হয়েছে। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া কোনো মারামারি বা রক্তক্ষয় হয়নি। ভোটের মাঠে একপক্ষ ব্যতীত অন্য পক্ষগুলোকে দেখা যায়নি। সরকারি দলের নেতা মাহবুব-উল-আলম হানিফের ভাষ্যমতে, ইভিএমে ঢাকা সিটির যে নির্বাচন হয়েছে, গত ১০০ বছরে এ রকম অবাধ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়নি।

দুই.

বিজ্ঞাপন

যদিও এই ভোটের বড় বিতর্কের বিষয় ছিল শতভাগ ইভিএম বা মেশিনে ভোট। দেশের দুইজন বিশিষ্ট নাগরিক ভোট দিতে যেয়ে ইভিএমের যান্ত্রিক বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন। এরকম ঘটনা আরও হয়তো ঘটেছে। কিন্তু তারা হয়েছেন মিডিয়ার বড় খবর। বিশেষ করে খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের আঙ্গুলের ছাপ তার প্রিয় ইভিএম মেশিন রিজেক্ট করেছে। পরে তাকে অ্যানালগ কায়দায় ভোট দিতে হয়েছে। আরেকজন বিশিষ্ট নাগরিক বয়োজেষ্ঠ্য আইনজীবি, রাজনীতিবিদ ড. কামাল হোসেনকে প্রায় আধাঘন্টা ধরে মেশিনের সাথে কসরত করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চাউর হয়েছে।

তিন.

এখন প্রশ্ন হলো ভোটাররা ভোট দিতে আসছেন না কেন? বাংলাদেশের গত দেড় দশকের ভোটের ইতিহাস বলছে, ভোটের ফলাফল ভোটারদের মতামতের ওপর এখন আর নির্ভরশীল নয়। ভোটকে যারা নিয়ন্ত্রণ করেন বা ভোটকাজ যারা পরিচালনা করেন, তারা ফলাফলকে যেভাবে দেখতে চান, বাস্তবে তাই ঘটে। ফলে, নিজের এনার্জি, নিজের পয়সা খরচ করে ভোটকেন্দ্রে যেয়ে নিজের স্বাধীন মতামত দেবার সুযোগ নেই বলে বা সেটা করতে গেলে যে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপদ দেখা দিতে পারে, সেটা এড়াতেই ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যাচ্ছেন না। আবার খোদ ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদেরও ওভাবে ভোটকেন্দ্রে হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে না, কেননা তারা জানেন ফলাফল কী হবে? তাদের উপস্থিতি না থাকলেও ভোট যারা পরিচালনা করেন, সেই মেশিনারি, তাদের অভাব পূরণ করে, সরকারি দলের প্রার্থীকেই জিতিয়ে আনবেন। সেটাই তাদের হয়তো ভোটকেন্দ্রে যেতে অনুৎসাহী করছে।

তাত্ত্বিকভাবে যে কোনো দেশে ভোট আসলে একটা সিস্টেম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ভোট পরিচালনার জন্য যে নির্বাচন কমিশন থাকে, তাদের স্বকীয়তা, সক্ষমতা, আইন প্রতিপালনে বাধ্যবাধকতা ভোটকে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। সরকারে যারা থাকে তারা ভোটে জিততেই চাইবে। তারা যদি অন্যায় পথে সেই কাজটা করতে চায়, তবে তাদের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায় একদিকে নির্বাচন কমিশন, অন্যদিকে মাঠে ক্ষমতা জারি রাখতে পারে এরকম শক্তিশালি বিরোধী দল। কখনো কখনও স্বাধীন, শক্তিমান, ন্যায়ানুগ গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজ এককভাবে অথবা সম্মিলিতভাবেও গ্রহণযোগ্য ভোটের জন্য সহায়ক হতে পারে। তবে বড় অ্যাক্টর হচ্ছে নির্বাচন কমিশন।

সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে নির্বাচন কমিশনকে আরও জনভিত্তি ও জনআকাংখার সাথে জোরালে করে তোলা যায় কিনা? ভোটারদের আরও বেশি করে ভোটকেন্দ্রে আনা যায় কিনা? ভোটারদের জন্য ভয়হীন একটা পরিবেশ তৈরি করা যায় কিনা? এখানে অনেক ইনোভেশনের সুযোগ আছে। যদিও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে তা সে ডান হোক বা বাম হোক বা মধ্যপন্থি বুর্জোয়া দল হোক না কেন, কোথাও দলের মধ্যেও নেতা নির্বাচনে, মুক্ত ভোটের কদর নাই। সেখানে আছে সিলেকশন। আবার ভোটের মাঠে তা সে এমপি হোক, উপজেলা চেয়ারম্যান হোক কিংবা ইউপি চেয়ারম্যান হোক দলের প্রার্থী ভোটে নির্বাচিত হয় না, হয় নেতার ইচ্ছায়। সেখানেও সিলেকশন। তাহলে ভোটাররাই বা ইলেকশনে আগ্রহী হবে কেন? এখানেও কাজ করার সুযোগ আছে।

চার.

তাহলে ভোটের ভবিষ্যৎ কি? আমরাই কি এই জায়গায় আটকে আছি। না। পশ্চিম-পূর্ব, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সব জায়গাতেই নানাভাবে ভোটকে প্রভাবিত করার একটা জোয়ার শুরু হয়েছে। ভারতের সুনমাখ্যাত নির্বাচন কমিশন অফিসকেও কালিমালিপ্ত করে ফেলেছে হিন্দুত্ববাদী ঝান্ডা। আমেরিকায় কম ভোট পেয়েও, ট্রাম্পের নয়ামডেল রাশিয়ার সহায়তা নিয়ে হিলারিকে কুপোকাত করেছে বলে সেদেশে ভোটঘটনা আদালতের বারান্দায় ঘোরাফেরা করছে। তবে, পশ্চিমা জগতের সাথে আমাদের তফাৎ হচ্ছে, সেখানে রাষ্ট্রনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তারা এমন একটা সিস্টেমের মধ্যে আনতে পেরেছে, যেখানে দূষণ একটা মাত্রার নিচে নামতে পারবে না। ভোটদূষণও খুব একটা নিম্নগামী হবার আগেই বাধা পেয়ে যাবে।

তবে জনতুষ্টবাদী বা পপুলিস্ট জাতীয়তাবাদী শাসনের যে জোর পৃথিবীর অনেক দেশেই বইছে। তাকে গণতন্ত্রমুখি করতে পারে একমাত্র ভোটের সুযোগ। মানুষ যদি অধিকমাত্রায় ভোটের মাঠে যায়, তার ইচ্ছেমত দল বা মত বা প্রার্থিকে ভোট দিতে পারে এবং ভোটের ফলাফল সেই মতকেই প্রতিফলিত করার অবারিত সুযোগ পায়, তবেই দুনিয়াজোড়া এই কতৃত্ববাদী শাসন জমানা গণতান্ত্রিক মুডে ফিরবে। নইলে মানুষের ক্ষোভ-ক্রোধ-হতাশাকে পুঁজি করবে চরমপন্থা। তার বড় টার্গেটে পরিণত হবে, কথিত গণতান্ত্রিক ভাব নেয়া রাজনৈতিক দলগুলোই। সেইটা বড় বিপদ আনতে পারে।

ফলে, ভোটের ভবিষ্যৎ আলো না অন্ধকারে ফিরবে, সেটা তৈরি হচ্ছে এখনকার খেলোয়াড়দের ঘুঁটির চালের পথেই।

পুনশ্চ: লেখাটা যখন শেষ করছি, তখন নিউইয়র্ক টাইমসে নোয়া হারারির লেখার একটা শিরোনাম খুব মন কাড়লো। তিনি তার লেখার শিরোনাম দিয়েছেন, ‘ইউ ক্যান ভোট বাট ইউ ক্যান নট চুজ।’ আমরা এখন সেই মুডেই আছি।

শুভ কিবরিয়া: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক