চোখে দেখা ‘চট্টগ্রাম গণহত্যা দিবস’
অবশেষে চট্টগ্রাম গণহত্যা মামলায় দীর্ঘ তিন দশক পর ২৪ জানুয়ারি ২০২০ এ রায় হলো ৫ জনের ফাঁসি এবং ৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। ৩২ বছর আগের ঘটনা। উত্তাল পুরো বাংলাদেশ-আন্দোলন ও প্রতিবাদে মানুষ একত্রিত। বাংলার জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে এরশাদের স্বৈরশাসনের অবসান চাই-একটাই শ্লোগান ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক’। পুরো বাংলা চষে বেড়াচ্ছেন গণমানুষের নেত্রী শেখ হাসিনা-যেখানে যাচ্ছেন-সেখানেই মানুষের ঢল। এরূপ পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা আসলেন চট্টগ্রামে-২৪ জানুয়ারি ১৯৮৮। গভীর কালো সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে একটি মাত্র আশার বাতি জ্বলছে-তা হলো শেখ হাসিনা। মানুষ ভরসা পাচ্ছে-বাংলার পরিত্রাণ আসবে নেত্রীর হাতেই।
সে সময়কার স্মৃতি আজও স্মৃতিপটে উজ্জ্বল। ঠিক হলো বিমানে যাত্রা ২৪ জানুয়ারি। নেত্রীর সঙ্গে জোটনেতা তোফায়েল আহমেদ, আমীর হোসেন আমু ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দসহ কয়েকজন। তার মধ্যে আমিও ছিলাম।
তখন আওয়ামী লীগ ’৭৫ এর নির্মম আঘাত, বিভিন্ন ষড়যন্ত্র ও প্রতিকূলতার মধ্যে বিপর্যস্ত, দল বাঁচিয়ে রাখার এবং সংগঠিত করার প্রাণান্ত চেষ্টা। যদিও ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করেছিল। আশা ছিল দেশটাকে কঠিন দুর্যোগের মধ্যে ফেলে নয়-কোনোভাবে সমঝোতা ও সুবুদ্ধির মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র ফেরত আনা যায় কিনা। কিন্তু স্বৈরাচার ও স্বৈরশাসনের দৌরাত্ম্যে এবং স্বাধীনতার ইতিহাস সুবিধাবাদীর হাতে বিকৃতির আবহে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে রাস্তায় নামতেই হলো।
সে সময় আওয়ামী লীগের অবস্থা ছিল ‘দিন আনে দিন খায়’। শেখ হাসিনা প্রবল চেষ্টায় দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। মনে পড়ে যাত্রার আগের দিনে তিনি আমাকে কয়েকটি বিমানের টিকিট দিতে বলেছিলেন। তখন আওয়ামী লীগের সকল কর্মীর সহযোগিতার হাত ছিল সাধ্যমত প্রসারিত।
আজকের অবস্থা তখন অচিন্তনীয় ছিল। বর্তমানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দল সুসংগঠিত সংগঠন-কৌশলে, দূরপাল্লায় ও দূরদৃষ্টিতে এবং আর্থিক কাঠামোয়। কিন্তু এ যাত্রা সহজ ছিল না। দল ছিল অনিশ্চয়তায় দোদুল্যমান, নেতৃত্বহীনতায় পঙ্গু, হীনমন্যতা ও অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষত-বিক্ষত, আর্থিক অসচ্ছল এবং তদুপরি অপরিকল্পিতভাবে ‘বাকশাল’ এর আত্মপ্রকাশ। সে সময় আবির্ভূত হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। কঠিন সংকল্প, অবিচল নিষ্ঠা, ধৈর্য ও দীর্ঘ অধ্যবসায় দিয়ে পুনর্গঠিত করলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সহস্র সাধারণ ত্যাগী নেতা ও কর্মীরা উজ্জীবিত-নিজ নিজ ক্ষুদ্র সামর্থ্য ও সাংগঠনিক তৎপরতায় হলো তাঁর সহযাত্রী। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সব নেতা কর্মীরা ত্যাগী, নেত্রীর নেতৃত্ব ও নিশ্চিত সাহস ও অনুপ্রেরণায়-সবাই মিলে সাধ্যমত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ চালিয়েছে, শক্তি যুগিয়েছে।
মনে পড়ে আশির দশকে শেষের দিকে যখন তিনি ক্ষমতায় নেই এমনকি ঐ সময় বিরোধীদলীয় নেত্রীও না, তিনি আসলেন রংপুরে বিভাগীয় কর্মী সমাবেশে। তাঁর দিক নির্দেশনা, কঠিন প্রস্তুতি, সংগ্রাম ও আন্দোলনের রূপরেখা তিনি ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন পুরো বাংলাদেশে। প্রায় ৫ হাজার কর্মী ও স্থানীয় নেতাদের সমাবেশ। আমিও পৌঁছেছি রংপুর। ঐ সময়ে আমার আর একটি উদ্দেশ্য ছিল। বারবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য সুহৃদ ও শুভানুধ্যায়ী জনাব আনিসুল হক চৌধুরী আমাকে পরামর্শ দিচ্ছিলেন, আমার নির্বাচনী এলাকার নিভৃত নিজ গ্রামে অবস্থিত বাসস্থান ছাড়াও কাজের সুবিধার্থে মিঠাপুকুর উপজেলা সদরে আর একটি বাসস্থান নির্মাণ করা প্রয়োজন। ঐ নতুন বাড়ির কাজ শুরু করার সিদ্ধান্তে ঐ সময় সাড়ে তিন লক্ষ টাকা নিয়ে এসেছিলাম।
উত্তরাঞ্চলের আওয়ামী লীগ কর্মী ও নেতারা নির্যাতিত ও আর্থিকভাবে শক্তিশালী নয় এবং রংপুর দরিদ্র এলাকা। কিন্তু আমাদের যথোপযুক্ত সমাবেশ করতেই হবে, এবং দূরদূরান্তের সব নেতাকর্মীদের অন্ততপক্ষে একবেলা খাওয়াতে হবে। অন্যরাও এগিয়ে এলো। সব বন্দোবস্ত হলো এবং আমার হাতের টাকাও খরচ হয়ে গেলো। নেত্রী এবং আগত নেতৃবৃন্দের জন্য স্থানীয় সার্কিট হাউজে বিশেষভাবে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হলো এবং অতিথিদের সবাই সময় করে খেয়ে এসেছেন। আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত এক নাগাড়ে সভা চালালেন কিন্তু পুরোদিন খেলেন না। শুধুমাত্র শসা খেয়ে দিনটি অতিবাহিত করলেন। শুধু নামাজের সময়ে তিনি পাশের শিল্পকলা ভবনে সভা থেকে উঠে গিয়ে নামাজ আদায় করলেন। তাঁর এই ত্যাগ, তিতিক্ষা, কঠিন অধ্যবসায়, অবিচল নিষ্ঠা ও দৃঢ় সংকল্প তিনি সঞ্চারিত করলেন পুরোদেশে।
আজ দল একতাবদ্ধ, একতাবদ্ধ দেশ। আজ আমরা স্বর্ণ সম্ভাবনায়। বিশ্বসভায় বাংলাদেশ এক আলোচিত নাম-মানবিক দেশ, উন্নয়নশীল দেশ, অসীম সম্ভাবনার দেশ ও উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত।
২৪ জানুয়ারি ১৯৮৮ আমরা সকালে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে পৌঁছালাম। বিমানবন্দর লোকে লোকারণ্য। আমাদের ও নেত্রীর জন্য খোলা ট্রাকের বহর। নেত্রী এক ট্রাকে এবং আমি অন্য এক ট্রাকে। নেত্রী কি মনে করে জানি না তিনি আমাকে তাঁর ট্রাকে ডেকে নিলেন। আমরা জনসভার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম লালদিঘীর পথে। ১৫ দলীয় জোটের ঐ প্রস্তাবিত সভায় তিনি ছিলেন প্রধান অতিথি।
মাত্র কয়েক মাইল রাস্তা। যাওয়ার সময় যে অভূতপূর্ব দৃশ্য তা ভোলার নয়। রাস্তার দুপাশে এবং পার্শ্ববর্তী ঘরবাড়িতে মহিলা-পুরুষ, ছাত্র-ছাত্রী, শিশু কিশোর অগণিত মানুষ। চারদিকে শুধু পুষ্প বৃষ্টি এবং স্লোগান। মনে হয় সেদিন পুরোদেশ ভেঙে পড়েছিল রাস্তার উপরে শেখ হাসিনাকে অভিবাদন, অভ্যর্থনা ও সমর্থন জানানোর জন্য। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এরূপ আবেগ ও ভালোবাসার জোয়ার আর কোনো দিন আমার চোখে পড়েনি। আধা ঘণ্টার রাস্তা আমরা ৩ ঘণ্টায় অতিক্রম করলাম।
ক্রমে ক্রমে পৌঁছলাম ডিসি হিলের পাদদেশে লালদীঘি ময়দানে। চারদিকে জনতার ভিড় ভেঙে ছুটে আসছে জনতা। শেখ হাসিনা হাত নাড়িয়ে অভিনন্দনের জবাব দিচ্ছেন এবং আমাদের ট্রাকগুলো মন্থর গতিতে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে মূল মাঠে। হঠাৎ দেখি জনাব আখতারুজ্জামান চৌধুরী, তিনিও ঐ ট্রাকে ছিলেন, আমার হাত ধরে টানছেন, বলছেন-গুলি হচ্ছে। আমি অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে ঘুরলাম-কেননা গুলি হতে হলে অবশ্যই তার পূর্ব সতর্কবার্তা ঘোষণা করতে হবে-আমার আমলা জীবনের অভিজ্ঞতা বাস্তবতার কাছে হার মানলো।
মুহূর্তের মধ্যে চারদিকে লুটিয়ে পড়েছে অনেকে। অনেকের মগজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে চারদিকে। জনাব মোশাররফ হোসেন প্রাক্তন মন্ত্রী আহত-গাড়ী থেকে নিচে পড়ে গেছেন।
আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম কয়েকজন পুলিশ মাত্র দশ বারো হাত দূর থেকে আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনার দিকে রাইফেল তাক করেছে-তারা বলছে ‘গুলি করি, গুলি করি’। সে মুহূর্ত মনে হলো অনন্তকালের জন্য সময় স্তব্ধ হয়ে গেল, চরম পরিণতি এই এলো বলে। কিন্তু কানে এলো নেত্রীর বজ্রকঠিন কণ্ঠ, ধমক দিলেন ‘‘কাকে গুলি করবে? বন্দুক নামাও”। মুহূর্তের মধ্যে যেন তড়িৎ স্পর্শে বজ্রাহত তারা রাইফেল নামিয়ে ফেললো। আমার মনে হয় পুলিশদেরকে মাদক খাইয়ে সেদিন কর্তব্যে নিয়োজিত করা হয়েছিল-এবং তারা চরম নির্দেশ নিয়েই এসেছিল। তা না হলে কি করে সম্ভব-তারা সরাসরি বন্দুক উঁচিয়ে নেত্রীকে বলছে-‘গুলি করি, গুলি করি’।
স্পষ্টতই তাদেরকে মাদক সেবন করানো হয়েছে এবং তারা সরাসরি নির্দেশ পালন করছিল। দেখলাম নেত্রীর অসীম সাহস, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব। রাইফেলের গুলির মুখে দৃঢ়তা ও অবিচল বিচক্ষণতা সত্যি অভাবনীয় এবং আমার জন্য নূতন এক অভিজ্ঞতা। মনে হয় সেদিন আর এক জন্ম হলো।
জননেত্রী শেখ হাসিনা শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি বয়ে চলেছেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন এবং তার দায়ভার। তিনি বহুবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন, চেষ্টা হয়েছে বারবার তাঁকে হত্যা করার। তাঁর সাহসিকতা, ঝুঁকি নেওয়ার তেজস্বীতা, দৃঢ় সংকল্প তাঁকে অনন্য করেছে।
ডিসি কোর্ট এবং পার্শ্ববর্তী অফিস থেকে সব আইনজীবী এবং সাধারণ মানুষজনেরা ছুটে আসলেন এবং আমাদের সবাইকে নিয়ে আসলেন বার লাইব্রেরিতে। সে রাতে আমরা রাত্রিযাপন করলাম জনাব আখতারুজ্জামান চৌধুরীর বাড়িতে।
পুরো বাংলাদেশ স্তম্ভিত। চট্টগ্রাম মুহূর্তে ভুতুড়ে শহরে পরিণত হলো। ঢাকা শহরও তাই শুনেছি। মন্ত্রীরা জনরোষের ভয়ে তাদের সরকারি বাসভবন থেকে পালিয়ে গেছেন।
দীর্ঘ ৩২ বছর পূর্বের এ ঘটনায় ২৪ জন মুহূর্তের মধ্যে নিহত হন এবং প্রায় দুই শতাধিক নেতাকর্মী আহত হন। এটা ছিল গণহত্যা। গণহত্যা পূর্ব পরিকল্পিত ও শেখ হাসিনাই নিঃসন্দেহেই ছিলেন আসল লক্ষ্য। নিহতদের কারও লাশ পরিবারকে নিতে দেয়নি সে সময়কার স্বৈরশাসকের সরকার। সাক্ষ্য ও প্রমাণ গোপন ও বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে সবাইকে বালুয়ার দীঘি শ্মশানে জঘন্য নির্মমতায় পুড়িয়ে ফেলা হয়। এরশাদের পতনের পর ১৯৯২- এর ৫ মার্চ আইনজীবী মো: শহিদুল হুদা বাদী হয়ে ৪৬ জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করেন। কিন্তু বিএনপি আমলে মামলার কার্যক্রম এগোয়নি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে মামলা পুনরুজ্জীবিত হয়। হত্যায় নির্দেশ দাতা হিসেবে তৎকালীন চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদাকে প্রধান আসামি করা হয়।
দীর্ঘ ৩২ বৎসর পর গত ২০ জানুয়ারি ২০২০- এ ৫ পুলিশের ফাঁসি হুকুম হলো এবং ৫ জনের ১০ বৎসর কারাদণ্ডাদেশ দেয়া হলো। প্রধান আসামি মির্জা রকিবুল হুদা ইতোমধ্যে মৃত এবং তৎকালীন পেট্টোল ইন্সপেক্টর জেসি মন্ডল ফেরারী।
সেদিন শেখ হাসিনার আসার পথে তিনটি ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছিল- কোতয়ালী মোড়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে ও লালদিঘী এলাকায়। প্রথম ব্যারিকেডটি সরিয়ে নেওয়া হয় এবং তা ছিল কৌশল। রায়ে বর্ণিত হয়েছে, তৎকালীন পুলিশ কমিশনার রকিবুল হুদা দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের ওয়ারলেস সেটে নির্দেশ দিচ্ছিলেন ‘‘যত পারো গুলি কর। সবাইকে শোয়ায়ে ফেল...’’।
আদালতের রায়ে ৫ জনের ফাঁসি ও ৫ জনকে ১০ বৎসর দণ্ড দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন- মুহূর্তের উত্তেজনায় সংঘটিত অপরাধ-নাকি এ ছিল দীর্ঘদিন চর্চিত ধারাবাহিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন প্রচেষ্টা? এর পিছনে কি ছিল না গভীর ষড়যন্ত্র? '৭৫ এর মতো শুধু ক্ষমতা গ্রহণই নয়-বরং ইতিহাস চিরকালের জন্য পরিবর্তন প্রচেষ্টা! পুলিশের রাইফেলের গুলি বেরিয়েছিল নির্দিষ্ট লক্ষ্যে তা কি ছিল না গভীর ষড়যন্ত্রের পরিণতি? কিন্তু সৌভাগ্য তা লক্ষ্যভ্রষ্ট এবং অসীম সাহসের নিকট পরাজিত হয়। কোনো কোনো ঘটনা শুধুমাত্র ঘটনা নয়, এর অন্তরালে থাকে অন্তঃস্রাবী বহুমাত্রিক স্রোত। কিন্তু কোনো কোনো সময় তা ভেদ করা দুঃসাধ্য।
লেখক- এইচ এন আশিকুর রহমান, এমপি, ২৩-রংপুর ৫ (মিঠাপুকুর), রংপুর, সভাপতি- জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ কোষাধ্যক্ষ-বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ