কচুরিপানাতত্ত্ব

  • এরশাদুল আলম প্রিন্স
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

আমরা অধম। তাই অনেক কিছুর মর্যাদাই বুঝি না। আমরা বঙ্গসন্তান দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝি না, কান থাকতে কানের মর্যাদা বুঝি না। জীবন ও সংসারে এমন অনেক কিছুই আছে যার মর্যাদা আমরা বুঝি না, হেলায় হারাই। আমাদের জীবনে কচুরিপানাও সে রকমই একটি জিনিস যা এতোদিন আমরা হেলায় হারিয়েছি। জীবকূলে কেবল গরুই এই মহামূল্য কচুরিপানার মর্যাদা উপলব্ধি করে তার সদ্ব্যবহার করেছে। তাই গরুকে গরু বলে যারা অবহেলা করে তাদের হুঁশ হওয়ার সময় এসেছে। কারণ, গরু ওই কচুরিপানার মর্যাদা বুঝেছে, কিন্তু আমরা বেহুঁশ বঙ্গসন্তানরা কচুরিপানার মর্যাদা আজও উপলব্ধি করতে পারিনি। তবে, শেষমেষ এই মহামূল্যবান সম্পদের মর্যাদা অনুধাবনের ব্যর্থতা ও অপমান থেকে আমাদের মুখ রক্ষা করেছেন আমাদেরই পরিকল্পনা মন্ত্রী। মন্ত্রী মহোদয় রাজ গবেষক ও রাজকর্মচারীদের প্রশ্ন করেছেন, গরু কচুরিপানা খেতে পারলে আমরা মানুষ কচুরিপানা খেতে পারবো না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গবেষকরা এখন ব্যস্ত। কচুরিপানা মানুষ খেতে পারবে কিনা বা খাওয়া সম্ভব কিনা সেটা একটা সরল গবেষণা ও এর একটা উত্তর হয়তো গবেষকরা সহজেই বের করতে পারতেন। কিন্তু গরু কচুরিপানা খেতে পারলে মানুষ কেন খেতে পারবে না তার উত্তর খুঁজে পাওয়া গবেষকদের জন্য বেশ কঠিনই বটে।

এদিকে গবেষণার কোনো ইতিবাচক ফলাফল আসার আগেই বঙ্গনারীরা কচুরিপানার নানা রেসিপি তৈরির কথা ভাবছেন। কচুরিপানা দিয়ে গরুর গোশত, মাছের ঝোল, কচুরিপানার কোপ্তা, ট্যাংরা মাছ দিয়ে কচুরিপানার চচ্চরি, কাচ্চি বিরানীর সঙ্গে কচুরিপানার সালাদ-কচুরিপানার আরও কত পদ নিয়ে বউঝিরা এখন ব্যস্ত। অনলাইন গণমাধ্যম কচুরিপানার রেসিপি নিয়ে পাঠকের কাছে হাজির। তারা পিছিয়ে থাকবে কেন? আমাদের বৈচিত্রহীন খাদ্য তালিকায় কচুরিপানার আগমনে যেন প্রাণ সঞ্চার হলো। খাবার টেবিলে বহুযুগ পরে সবার মুখে যেনো হাসি ফুটলো।

বিজ্ঞাপন

খাদ্য হিসেবে কচুরিপানার অভিষেককে অধিকাংশ বঙ্গসন্তানরাই স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু বাঙালি পরশ্রীকাতরও কম নয়। কিছু মানুষ কচুরিপানা নিয়ে নানা হাস্যরস ও নেতিবাচক বালখিল্যতায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সামাজিক গণমাধ্যমে তারা নানা ব্যঙ্গাত্মক কথা ছড়িয়ে কচুরিপানার অপরা সম্ভাবনার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছেন। জাতি হিসেবে আমাদের উন্নয়নের মূল অন্তরায়, আমরা নিজেরা কিছু করতে পারি না, কিন্তু কোনো গুণীজন কিছু বললে তার বিরুদ্ধে লেগে যাই।

তবে ব্যতিক্রমও আছে কম নয়। অনেকেই কচুরিপানার অপরাপর সম্ভাবনা নিয়ে নানা পরিকল্পনা করছে। একজন দেখলাম, তিনি কচুরিপানার একটি বিশাল শোরুম করার জন্য জায়গা খুঁজছেন। ফেসবুকে জায়গা চেয়ে আবেদন করেছেন। কচুরিপানার নানা রেসিপি নিয়েতো ইতোমধ্যে কাজ করছেন অনেকই। কচুরিপানার চাষ, সরবরাহ, বাণিজ্য নিয়েও ভাবছেন অনেক। দেশের লাখো বেকার কচুরিপানা চাষে ও বাণিজ্যে লাভবান হতে পারেন। দুই এক সপ্তাহের মধ্যই হয়তো শাইখ সিরাজ বাড়ির ছাঁদে কচুরিপানার চাষ নিয়ে ধারাবাহিক কিস্তি শুরু করবেন। তবে, আগে ভাগেই সরকারে কাছে একটি আবেদন-কচুরিপানার দাম যাতে পেঁয়াজের দামকেও ছাড়িয়ে না যায় সে বিষয়টি একটু দেখা।

বিজ্ঞাপন

এদিকে ইতিহাসবিদরা কচুরিপানার ভুলে যাওয়া গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আমাদের সামনে নতুন করে তুলে নিয়ে আসছেন। এদেশে কচুরিপানার ছিল এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।

এই বঙ্গভূমিতে কচুরিপানার শুভ আগমনের সঠিক দিনক্ষণ জানা যায় না। এ বিষয়ে গবেষকদের মধ্যে মতানৈক্য আছে। তবে অধিকাংশ গবেষকই মনে করেন, এক ব্রাজিলীয় পর্যটক ১৮শ' শতাব্দীর শেষভাগে বাংলায় কচুরিপানা নিয়ে আসেন। এর পর খুব দ্রুতই দেশের পুকুর, ডোবা, নালা, জলাশয় সব কচুরিপানায় ভরে যায়। এমনকি নদ-নদীতে চলাচলও অসম্ভব হয়ে পড়ে। খেতের ফসলও বিনষ্ট হয়। ইতিহাস বলে, ১৯২০ সালের মধ্যে দেশের প্রায় প্রতিটি জলাশয় কচুরিপানায় ভরে যায়।

এমতাবস্থায় কচুরিপানার দৌরাত্ম্য হ্রাসে বৃটিশ সরকারকে আইনও প্রণয়ন করতে হয়েছে। সে সময় বাংলার জলাভূমি আইন, মিউনিসিপ্যালিটি আইন, স্থানীয় সরকার আইন এবং স্থানীয় গ্রাম সরকার আইন। সংশোধন করে কচুরিপানার বংশবৃদ্ধি রোধ করা হয়। এমনকি ১৯৩৬ সালে দেশে কচুরিপানা আইন জারি করা হয়। এ আইনের মাধ্যমে বাড়ির আশেপাশে কচুরিপানা রাখা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। এমনকি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত কচুরিপানা পরিষ্কার অভিযানে অংশ নেওয়াকে নাগরিক কর্তব্য ঘোষণা করা হয়। জেলার ম্যাজিস্ট্রেটরা স্বেচ্ছাসেবী নাগরিকদের নিয়ে কচুরিপানা দমনে ডোবা নালায় অভিযান চালিয়েছেন। কিন্তু তারপরও কচুরিপানাকে নির্বংশ করা যায়নি।

কচুরিপানা দেশের রাজনীতিতেও একটি ইস্যু হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯৩৭ সালে দেশে একটি নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনের ইশতেহারেও কচুরিপানা জায়গা করে নেয়। ইশতেহারে বাংলাকে কচুরিপানামুক্ত করার জন্য রাজনৈতিকদলগুলো প্রতিশ্রুতি দেয়। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক নির্বাচনে জয়ী হয়ে ওয়াদা পূরণে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি কচুরিপানার বিরুদ্ধে জোরদার অভিযান পরিচালনা করেন। কিন্তু পুরো বাংলাতো অনেক পরের কথা, তার এলাকা দক্ষিণবঙ্গকেও তিনি কচুরিপানামুক্ত করতে পারেননি। তবে তিনি সার হিসেবে কচুরিপানার ব্যবহারকে উৎসাহিত করেন। লাউ, কুমড়াসহ বিভিন্ন চাড়া গাছের সার হিসেবে কচুরিপানার ব্যবহারের ফলে এর প্রকোপ কিছুটা কমে বৈকি।

ফলে মন্ত্রী মহোদয় কচুরিপানা নিয়ে যে গবেষণার কথা বলেছেন তার ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি আছে।

কচুরিপানার আরও বহু ব্যবহার এই বাংলায় হচ্ছে, হবে। কবি সাহিত্যিকরা কচুরিপানা নিয়ে গান কবিতাও কম লেখেননি। কিন্তু অধিকাংশ কবিতাই নৈরাশ্যবাদী। তারা ব্যর্থ জীবনকে কচুরিপানার সঙ্গে তুলনা করেছেন। প্রেমিকরা ছ্যাকা খেয়ে নিজেদের কচুরিপানার সঙ্গে তুলনা করেছেন। কচুরিপানার বৈরাগ্য ব্যবহার হয়েছে এদেশে কম নয়। এই প্রথম কচুরিপানার একটি ইতিবাচক ও সম্ভাবনাময় ব্যবহারের কথা তুলে ধরেছেন মন্ত্রী।

রাজ সভায় অনেকেই পদ পায়। কিন্তু সবাই আবুল ফজল, বীরবল, গোপাল ভাড় হয় না। কেউ কেউ হয়। তাদের কিছু কিছু রস-কৌতুকের শানে নুজুল বুঝতে আমাদের আজও বেগ পেতে হচ্ছে। এ জাতি একদিন হয়তো ঠিকই কচুরিপানা খাবে, কিন্তু মন্ত্রীর কথায় আজ হাস্যরস করছে। বড়ই পরিহাস, পরিতাপ!

পুনশ্চ: মন্ত্রীর কথাটি একটি নির্দোষ মন্তব্য। তিনি কথা প্রসঙ্গে কচুরিপানার খাদ্য সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা করা যায় কিনা সে বিষয়টি নিয়েই কথা বলেছেন মাত্র। সামাজিক মাধ্যমে ভাসমান প্রতিক্রিয়াই এই লেখার উপজীব্য।

এরশাদুল আলম প্রিন্স: কলামিস্ট