উত্তরায় আবার ছাদ থেকে পড়ে গেল এক কিশোরী

  • গওহার নঈম ওয়ারা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

গওহার নঈম ওয়ারা, ছবি: বার্তা২৪.কম

গওহার নঈম ওয়ারা, ছবি: বার্তা২৪.কম

বাংলাদেশের নগরায়নের একটা অন্যদিকও আছে। এখানকার উঁচু উঁচু ভবনগুলো থেকে টুপটাপ মানুষ পড়ে যায়। মারা যায়। নির্মাণ শ্রমিক, রং মিস্ত্রি, টাইলস মিস্ত্রি, হাত ফসকে, দড়ি ছিঁড়ে, বিদ্যুতের ঘা খেয়ে ছিটকে নিচে পড়ে আহত হন। পরে হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাদের মৃত ঘোষণা করেন। শূন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা, শ্রমিকদের আর্থিক ও সামাজিক অসহায়ত্ব, মালিকদের উদাসীনতা নানাবিধ কারণে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটে থাকে, যাকে আমরা দুর্ঘটনা বলে প্রচার করি।

সবাই যে পড়ে যান কাউকে যে ফেলে দেয়া হয়না বা ঝাঁপিয়ে পড়তে বাধ্য করা হয় না, সেটা হলফ করে বলা যাবে কি? ছাদে উঠতে মানা। লম্বা রেলিং। তারপরও মানুষ হরদম পড়ে যাচ্ছে। মাস কয়েক আগে সাভারে পোশাক কারখানার এক নারী শ্রমিকের করুণ পরিণতির কথা লেখা হয়েছিলো। প্রতি বছর ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জের পোশাক কারখানার নারী শ্রমিকরা তাদের কারখানার উঁচু ছাদ থেকে লাফিয়ে ‘আত্মহত্যা’ করেন।

বিজ্ঞাপন

কখনো বলা হয় অসতর্ক মুহূর্তে পা ফসকে পড়ে গেছে। মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণেও অনেকে পাহাড় সমান কারখানার ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েন বলে মালিক পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়। আমরা মেনে নিই। এইসব অসমাপ্ত জীবনের গল্পের কোন ফলোআপ হয় না। নির্মাণ শ্রমিক, ইমারত শ্রমিক, পোশাক শ্রমিকের সাথে সাথে শিশু কিশোর গৃহকর্মীদের ছাদ থেকে পড়ে যাওয়ার খবর প্রায়ই শোনা যায়। এসব খবরেরও স্থায়িত্ব বড় কম।

একুশের নানা খবর আর ওয়েস্টিন, নরসিংদী, এস্কট ব্যবসার আচমকা খবরাখবরের জঙ্গলে উত্তরার এই মর্মান্তিক খবরটা হয়তো চোখেই পড়তো না। কানাডা প্রবাসী এক বন্ধুর ফেসবুক মন্তব্যে বিষয়টি নজরে আসে। তিনি বিষয়ের বিশেষ বর্ণনায় না গিয়ে পুলিশের মন্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। পুলিশের মন্তব্যে তার হয়তো মনে হয়েছিলো এ ডালেও ময়লা (কালো) কিছু আছে। পুলিশের কর্মকর্তা তদন্ত শুরুর আগেই নাকি বলে দিয়েছেন ‘মেয়েটি যে বাড়িতে কাজ করত, সেখানে সে হাসিখুশি থাকতো, তারা তাকে অনেক আদর করত।’ দৈনিক ইত্তেফাক কথিত পুলিশ অফিসারের বয়ানে জানাচ্ছে ‘প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি, ঐ বাসার সবাই তানজিনকে আদর করতেন। নিয়মিত নতুন জামা-কাপড়ও কিনে দিতেন।’

বিজ্ঞাপন

হতভাগ্য কিশোরীর নাম তানজিন। এসেছিলেন সেই শালনা থেকে, চরম দরিদ্র জেলাগুলির একদম তলানিতে থাকা সুনামগঞ্জের একটা হাওর জনপদ শালনা। শালনার গরীব মানুষ আবদুল হাকিম ২০১৫’এর ভয়াবহ বন্যার পর তার পরিবারের সবাইকে এর একসাথে রাখতে পারেননি। অনেকের মতো তাকেও সন্তানদের পাঠিয়ে দিতে হয় কাজের খোঁজে শহরে নগরে। তানজিন আর ফিরতে পারেনি। বর্তমান ব্যবস্থায় দুর্যোগের আগের অবস্থায় ফেরা হয়না কিছুতেই।

কথিত ‘রিকভারি’ ‘রেজিলেন্স’ যতই গালভরা কর্মসূচির বুলি আমরা কপচাই না কেন সাধারণ মানুষ আর আগের অবস্থায় ফিরতে পারে না। তানজিনেরও ফেরা হয়নি। ভাই-বোন, মা-বাবার সাথে আর একসাথে বসে ভাত খাওয়া হয়নি এক ওয়াক্তও। ‘আদর, জামাকাপড় আর চাইনিজের বেঁচে যাওয়া খাবারের প্যাকেট’ ধরিয়ে দিলে সব অভাব দূর হয় না দারোগা বাবু। জেলখানাতেও খানা কাপড় মেলে।

কানাডা প্রবাসী বন্ধুর আশংকা একেবারে অমূলক নয়। উত্তরার এবারের ঘটনাটা প্রথম থেকেই কিশোরী ছাড়া অন্য কারো সম্পর্কে যাতে কেউ কোন প্রশ্ন না তুলতে পারে সেদিকে কারো কারো বিশেষ যত্নবান থাকার আলামত আছে। একটি জাতীয় দৈনিক ছাড়া বিস্তারিত খবর কারো অনলাইন বা ছাপা পাতায় ছিল না। পুলিশের বরাত দিয়ে সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে ‘ওই কিশোরীকে সচরাচর ছাদে যেতে দেয়া হতো না। এমনকি ওই ভবনের কেউই তেমন ছাদে যায় না।’ তার মানে কি একটা কদাচিৎ ঘটা ঘটনা ঘটে গেছে ? কারো কিছু করার ছিল না।

গত নয় মাসে উত্তরার কিশোরী গৃহকর্মী পতনের এটা দ্বিতীয় ঘটনা। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে ভোরে (১ মে ২০১৯) রুবি (১৭) ও হালিমার (১৪) মৃতদেহ পাওয়া যায় পাশের একটা একতলা বাড়ির ছাদে। দুই কিশোরী কাজ করতেন উত্তরার কবি জসিমউদ্দিন সড়কের একটি ছয়তলা বাড়িতে। ছয়তলাতেই থাকতেন তারা এক গার্মেন্টস ব্যবসায়ীর বাসায়।

এই ছয়তলা থেকে কিভাবে তারা লাশ হয়ে পাশের বাড়ির একতলার ছাদে গিয়ে পড়ল তার রহস্যের কূল-কিনারা আজো হয়নি। তখন শোনা গিয়েছিলো ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজে নাকি দেখা গিয়েছে , ওইদিন রাত ৩টা ৩২ মিনিটে ব্যাগ কাঁধে দুই গৃহকর্মী বের হয়ে ছাদের সিঁড়ির দিকে যাচ্ছেন। তারপর আর কিছু ছিলনা সেই ক্যামেরায়। তখন অবশ্য পুলিশ জানিয়েছিল ‘ছয়তলা ভবনের ছাদ থেকে দুই কিশোরীকে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়েছে, না ছাদ থেকে লাফ দিয়ে তারা আত্মহত্যা করেছে, তা জানার চেষ্টা চলছে।’ এবারের মতো বলে বসেনি পোশাক, খাবার, আদরে মোড়া ছিল তাদের জীবন।

এবারের মৃত গৃহকর্মীর গৃহমালিক হাই প্রোফাইল তারকা দম্পতি হওয়ার জন্যেই কি ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়ার এই প্রচেষ্টা। তারকা বা আমাদের চেনা-জানা হলেই যে তারা তাদের অপ্রাপ্তবয়স্ক গৃহকর্মীদের সাথে মানবিক আচরণ করবেন সেটা ধরে নিয়ে তদন্তে নামা ঠিক হবে না। আমাদের দেশে তারকাদের হাতে শিশু কিশোর গৃহকর্মী নিগ্রহের ভুরি ভুরি নজির আছে। নজির আছে আপোষ-মীমাংসার। অপ্রাপ্ত বয়সের একটা মানুষকে বন্ধ বাড়িতে রেখে রাত দিন কাজ করানোটাইতো অন্যায় আইন, তাকে অপরাধ বলুক আর নাই বলুক।

পাঠকদের জানা আছে, ভারতে গৃহকর্মী সরবরাহে নামকরা প্রতিষ্ঠান মুম্বাইয়ের পোর্টাল বুকমাইবাই’ এর কথা। গত বছর থেকে প্রতিষ্ঠানটি বলিউডের তারকাদের বাড়িতে আর গৃহকর্মী সরবরাহ করছে না। তাদের মতে, এই আলো–ঝলমল ব্যক্তিরাই নিষ্ঠুরতায় সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন। তিন কোটি রুপির গাড়িতে চড়া এক অভিনেত্রী নাকি তাঁর গৃহকর্মীকে না খাইয়ে রাখতেন, বড়জোর চা-বিস্কুট খেতে দিতেন। যে প্রতিষ্ঠান তাদের বিজ্ঞাপনে বলে: ‘হীরা তুচ্ছ, বউকে একটা গৃহকর্মী উপহার দাও’, এমন আগ্রাসী বিজ্ঞাপনদাতারাও তারকাদের বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নির্যাতনের মাত্রা কোন পর্যায়ে পৌঁছালে গৃহকর্মীর ব্যবসায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত নাখোশ হয়।

গওহার নঈম ওয়ারা, লেখক ও গবেষক