হাকিম সরে, হুকুমও নড়ে
আইন সবার জন্য সমান। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। বাংলাদেশে বিচার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ স্বাধীন। এমন কিছু মধুর বাণী আমরা প্রায়শই শুনি। শুনি, কিন্তু বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস করার মত যৌক্তিক কারণও ঘটে না। অধিকাংশ সময়েই অবিশ্বাসের কারণগুলো আড়ালে ঘটে। তবে গত মঙ্গলবার পিরোজপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে যা ঘটলো, তা আসলে প্রকাশ্য কিন্তু অবিশ্বাস্য। মধুর বাণীগুলোকে এখন তেতো লাগছে। আশা করি, পিরোজপুরের ঘটনার পর দায়িত্বশীল কেউ আর ‘আইন সবার জন্য সমান, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে’ এই কথাগুলো বলে আমাদের বিভ্রান্ত করবেন না।
ঘটনাটা একটু সংক্ষেপে বলে নেই আগে। পিরোজপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আবদুল মান্নান মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় দুর্নীতি মামলায় সাবেক সাংসদ এ কে এম এ আউয়াল এবং তার স্ত্রী জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী লায়লা পারভীনের জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। বেলা তিনটার দিকে আইন মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক ফ্যাক্সে আবদুল মান্নানকে ওএসডি করা হয়। চিঠি পাওয়ার পর আবদুল মান্নান যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ নাহিদ নাসরিনের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। বিকেল চারটায় নতুন জেলা ও দায়রা জজ সাবেক সাংসদ ও তার স্ত্রীর দুই মাসের জামিন মঞ্জুর করেন। কী বুঝলেন। এতদিন শুনে আসছি, হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না। আজ থেকে বুঝলাম, হাকিম সরে, হুকুম নড়ে।
মাত্র চার ঘণ্টায় আদালতের আদেশ বদলে যাওয়ার ঘটনার একটা কারণ আছে। দুপুরে সাবেক সাংসদ ও তার স্ত্রীর জামিন বাতিলের পরপরই তাদের সমর্থকরা পিরোজপুর শহরে বিক্ষোভ করেন এবং হুলারহাট ও পাড়েরহাট সড়কে গাছের গুড়ি ফেলে ও আগুন জ্বালিয়ে অবরোধ করে। তারা মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রী এডভোকেট শ ম রেজাউল করিমের সমর্থকদের অফিসে হামলা চালায় এবং মন্ত্রীর ছবি ভাঙচুর করে।
আইন তার নিজস্ব গতিতে চললে, যারা আদালতের আদেশের প্রতিবাদে ভাঙচুর করে, অগ্নিসংযোগ করে, রাস্তা অবরোধ করে; তাদের আইনের আওতায় আনার কথা ছিল। কিন্তু হলো উল্টো। সাবেক সাংসদের সমর্থকদের চাপে বদলে গেল হাকিম, উল্টে গেল আদেশ। আরেকটা ব্যাপার ঠিক বুঝলাম না, বর্তমান মন্ত্রীর ছবি ভাঙচুর করেছেন সাবেক সাংসদের সমর্থকরা। কে বেশি ক্ষমতাশালী মন্ত্রী না সাবেক সাংসদ? সড়ক অবরোধ করে আদালতের আদেশ উল্টে দেয়ার এই দৃষ্টান্ত যদি বিএনপি অনুসরণ করে, বেগম খালেদা জিয়া কি জামিন পাবেন? আমি জানি, দুটি মামলা এক নয়। সাবেক সাংসদের বিরুদ্ধে মাত্র মামলা হয়েছে। এখনও রায় হয়নি। আর বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী। তবুও পিরোজপুরের ঘটনা সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন ধারণা সৃষ্টি করতে পারে যে, চাপ দিয়ে, সড়ক অবরোধ করে, ভাঙচুর করে জামিন আদায় করা সম্ভব। পিরোজপুরের ঘটনা শুধু সাধারণ মানুষের মধ্যেই ভুল ধারণা সৃষ্টি করবে তা নয়, সারাদেশের বিচারকদেরও শঙ্কিত করবে। এরপরে কি আর কোনো বিচারক ক্ষমতাসীন বা প্রভাবশালী কারো বিরুদ্ধে রায় দেয়ার সাহস পাবেন।
শুরুতে যে মধুর বাণীগুলো লিখেছি, আমি আসলে কখনোই বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস না করার যথেষ্ট কারণ আছে। পিরোজপুরের ঘটনা তো সর্বশেষ উদাহরণ। কিন্তু আইন যে তার নিজস্ব গতিতে চলে না, আইন যে সবার জন্য সমান নয়, বিচার ব্যবস্থা যে স্বাধীন নয়; তার অসংখ্য উদাহরণ আছে আমাদের চারপাশে। ছোট ছোট উদাহরণগুলো আপনাদের অনেকের জানা; যারা ভুক্তভোগী, তারা তো আরো বেশি করে জানেন। বড় উদাহরণগুলো তো সবার জানা। একসময় এই বাংলাদেশে জাতির জনকের হত্যাকারীদের বিচার করা যাবে না, এমন আইন ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের প্রধান বাধা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে এবং বিচারের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে পরের পাঁচ বছরের জন্য বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাটি ফ্রিজে পাঠিয়ে দেয়। বিএনপির পাঁচ বছরে জাতির জনকের হত্যা মামলাটির কোনো নড়চড় হয়নি।
আমি বলছি না, বিএনপি অন্যায় করেছে বলে, আওয়ামী লীগকে অন্যায় দিয়েই তার জবাব দিতে হবে। কিন্তু আজ যখন বিএনপি নেতারা বা তখনকার আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ আইনের শাসনের কথা বলেন, ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেন; আমার হাসি পায়। আইনের নিজস্ব গতির আরেকটি উদাহরণ হলেন প্রয়াত স্বৈরশাসক এরশাদ। গণ আন্দোলনের
মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এরশাদের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগে মামলা হয়। বছর পাঁচেক কারাগারেও কেটেছে এই স্বৈচারাচারীর। তারপর তিনি কখনো আওয়ামী লীগ, কখনো বিএনপির সাথে জোট বেধে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছেন। কারাগারে থাকার দুঃসহ স্মৃতি তাকে এমনভাবে তাড়িয়ে বেড়াতো, তিনি আর কখনো কারাগারে যেতে চাইতেন না। আর কারাগারে যেতে হবে না, এই শর্তেই তিনি জোট বাধতেন। মৃত্যুর আগে শেষ সময়টা তিনি যথারীতি আওয়ামী লীগের সঙ্গেই ছিলেন। সরকারি দলের লেজুড়বৃত্তি করতে হয়তো তার ভালো লাগতো না। মাঝে মধ্যেই তিনি বিপ্লবী হওয়ার চেষ্টা করতেন, সরকার বিরোধী হুঙ্কার দিতেন। বেশি হুঙ্কার দিলেই মঞ্জুর হত্যা মামলার তারিখ পড়তো। ব্যস, এক তারিখেই এরশাদের বিপ্লব ফুরিয়ে যেতো। আবার তিনি গৃহপালিত বিরোধী দলে পরিণত হয়ে যেতেন। এভাবে ‘আইনের নিজস্ব গতি’ দিয়ে এরশাদকে নিয়ন্ত্রণ করতো সরকার। আর আইন কখনোই সবার জন্য সমান নয়। একই অপরাধ নিয়ে একজন আওয়ামী লীগ নেতা আর একজন বিএনপি নেতা আদালতে গেলে, দুজন কি একই আদেশ পাবেন? একজন আমজনতা আর একজন প্রভাবশালী কি আইনের সমান সুরক্ষা পাবেন? উত্তরগুলো আপনাদের সবার জানা।
আইন সম্পর্কে সিনিয়র সাংবাদিক মহসিন আল আব্বাস ভাইয়ের কাছে শোনা একটি গল্প দিয়ে লেখাটি শেষ করছি। দুজন গরিব যখন আইনি লড়াইয়ে নামে, তখন গরীব দুজনই ধ্বংস হয়ে যায়। একজন ধনী আর একজন গরীবের আইনি লড়াইয়ে গরীব ধ্বংস হয়ে যায়। আর দুজন ধনী লোকের মধ্যে আইনি লড়াইয়ে আইন ধ্বংস হয়ে যায়। পিরোজপুরে সম্ভবত আইন ধ্বংস হয়ে গেছে।
প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ