দৃশ্য দূষণের অবসান চাই

  • এ টি এম মোসলেহ উদ্দিন জাবেদ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

এ টি এম মোসলেহ উদ্দিন জাবেদ, ছবি: বার্তা২৪.কম

এ টি এম মোসলেহ উদ্দিন জাবেদ, ছবি: বার্তা২৪.কম

গত কয়েক দশক ধরে আলোচিত বিষয়গুলোর অন্যতম হচ্ছে পরিবেশ ও এর বিপন্নতা। যা নিয়ে চিন্তিত সমগ্র বিশ্বের মানুষ। বিভিন্ন আইন প্রণয়ন, সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তারপরও থেমে নেই দূষণ। পরিবেশের সমস্যা বহুমাত্রিক। পরিবেশ দূষণের কথা এলেই বায়ু, পানি ও শব্দ দূষণের কথা বলা হয়। কিন্তু এসব ছাড়াও বর্তমানে এখন আরেকটি দূষণের কথা বলা হচ্ছে, সেটি হলো ‘দৃশ্য দূষণ’।

যত্রতত্র পোষ্টার, বিলবোর্ড, অবৈধ দেয়াল লিখন, আবর্জনা, অ্যান্টেনা, বৈদ্যুতিক তার, ভবন এবং যানবাহনের উন্মুক্ত অবস্থান প্রায়শই দৃশ্য দূষণ হিসেবে বিবেচিত হয়। কোনো অঞ্চলে অতিরিক্ত লোকজনও দৃশ্য দূষণের কারণ হয়। চাক্ষুষ দূষণের সংস্পর্শের প্রভাবগুলির মধ্যে রয়েছে, বিক্ষিপ্ততা, চোখের ক্লান্তি, মতামতের বৈচিত্র্য হ্রাস এবং পরিচয় হ্রাস। এ ধরণের দৃশ্য দূষণের আরেকটি ফলাফল হচ্ছে পর্যটন বিমুখতা।

বিজ্ঞাপন

বর্তমান যুগ বিজ্ঞাপনের যুগ। বহু বছর আগে কবি শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’। বিজ্ঞাপনে ঢেকে যাচ্ছে আমাদের সভ্যতা। শুধু যে রাজধানী ঢাকা বা অন্য মহানগরে এটা ঘটছে তাই নয়, মফস্বলেও আজকাল যেদিকে তাকাই সেদিকেই কুৎসিতভাবে ঢাকা পড়ে যায় প্রকৃতি। আকাশ ঢেকে গেছে নানারকম তারে। সুন্দর সুন্দর বাড়িঘরের সামনে ঝুলছে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন। বিভিন্ন স্থাপনায় আজ নানান ধরনের পোষ্টার, ব্যানার, অবৈধ দেয়াল লিখন, ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ডের ছড়াছড়ি।

রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন বড় শহরগুলোতে রাস্তায় বের হলেই শুধু চোখে পড়ে বিভিন্ন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের বড় বড় ব্যানার, পোষ্টার, বিজ্ঞাপন। রাস্তার পাশের স্থাপনাগুলোর দেয়াল, বৈদ্যুতিক খুঁটি, উড়ালসেতুর পিলার সর্বত্র পোষ্টার, ব্যানার ইত্যাদির ছড়াছড়ি। এছাড়া রয়েছে বিদ্যুতের তার, ইন্টারনেটের তার, ডিশ লাইনের তার। আর এ যেন পুরো শহরকে মাকড়শার জালের মতো জড়িয়ে রেখেছে। যার ফলে রীতিমতো এক ধরনের আতঙ্ক নিয়েই বাস করতে হয়। সবচেয়ে বড় আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে বিভিন্ন তারগুলো। বৈদ্যুতিক তারগুলো কোনো একটি কর্ডের ভেতর থাকে না। তাই সব সময়ই মনে হয়, যেকোনো সময়ই একটি বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

বিজ্ঞাপন

রাজনৈতিক নেতাদের পোষ্টার, ব্যানার, অবৈধ দেয়াল লিখন, ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ডের ছড়াছড়ি দেখা যায় রাজধানীসহ সারা দেশেই। নির্বাচন থাকুক বা না থাকুক সারা বছর ধরে বৈদ্যুতিক খুঁটি, গাছ ও দেয়ালে ঝুলতে থাকে এসব পোষ্টার, ব্যানার, প্ল্যাকার্ড। নেতাদের ছবি যুক্ত করে এগুলো তৈরি করা হয়। জাতীয় নেতা থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতারা এ ধরনের পোষ্টার, ব্যানার, ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড ছাপিয়ে এভাবেই জনগণের সামনে জাহির করছে। এছাড়া রয়েছে বিদ্যালয়, কলেজ, কোচিং সেন্টারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রচারণা বিজ্ঞাপন। আর তা দৃশ্যমান থাকে জনবহুল স্থানগুলোতে। এতে ব্যাপকভাবে দৃশ্য দূষণ হচ্ছে এবং যা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরক্তি তৈরি করে।

আমাদের দেশ ও আমাদের প্রতিবেশী দু-একটি দেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও এ ধরনের চিত্র দেখা যায় না। পরিবেশ বা নগরীর সৌন্দর্য বিনষ্টকারী এসব উপকরণ এখন যেমন মানুষের মাঝে বিরক্তিভাব নিয়েছে তেমনি বিব্রতকর পরিস্থিতির মাঝে ফেলে দিচ্ছে এর বিষয়বস্তু ও উপস্থাপনের ধরণ। রাস্তাঘাটে যানবাহনে চলার সময় দেখা যায় যে- বিভিন্নভাবে ভাড়া দেওয়া বা ওয়েব সাইটের পোষ্টার লাগানো থাকে। তাছাড়া অনেক ধরনের বিজ্ঞাপন দেওয়াও হয়, যা কিনা আমাদের মতো মেয়েদেরকেও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়।

আমরা অনেকেই দেশ বিদেশে ভ্রমণে গেলে কোথাও এই ধরণের দৃশ্য দূষণ তথা যত্রতত্র পোষ্টার, বিলবোর্ড, আবর্জনা, অ্যান্টেনা, বৈদ্যুতিক তার, ভবন এবং অটোমোবাইলগুলোর উন্মুক্ত অবস্থান দেখতে পাইনা শুধুমাত্র আমাদের দেশ ও প্রতিবেশী দু-একটি দেশ ছাড়া। দৃশ্য দূষণ না থাকার কারণে ওইসব দেশগুলোতে পরিবেশ দূষণ যেমন কমছে, তেমনি শক্তিশালী ভিতের উপর দাঁড়িয়েছে তাদের পর্যটন শিল্প। ঐ দেশগুলোর তুলনায় পরিবেশ রক্ষা ও পর্যটন উভয় ক্ষেত্রেই আমরা দিন দিন পিছিয়ে পড়ছি। যা কখনোই আমাদের দেশের জন্য ইতিবাচক নয়।

আমাদের বড় শহরগুলোতে বেশিরভাগ বাড়িঘরগুলোর দিকে তাকালে কোনো সৌন্দর্য ফুটে ওঠে না। বেশিরভাগ বাড়িঘরগুলো ঘিঞ্জি, পর্যাপ্ত জায়গা না রেখেই বাড়িঘরগুলো বানানো হয়েছে। তাই পরিকল্পিত সুন্দর বাড়িঘর নির্মাণে আইনের যথাযথ প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের আরো কঠোর হতে হবে। বড় শহরগুলোতে পর্যাপ্ত ও সুশৃঙ্খল গাড়ি পাার্কিং ব্যবস্থা করতে হবে, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং আমাদের সড়কগুলোতে বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে। সেই সাথে রাস্তায় যথাযথ লেনে গাড়ি চলাচল নিশ্চিত করতে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ নাগরিক সুযোগ সুবিধা ও কর্মসংস্থান বড় বড় দুটি শহরকেন্দ্রিক। তাই বড় বড় দুটি শহরে মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা। জনসংখ্যার এই মাত্রাতিরিক্ত চাপ কমাতে আমাদের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে বিকেন্দ্রীকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা না ফেলে নগরগুলোর বর্জব্যবস্থাপনা আধুনিকায়ন করতে হবে। পরিকল্পিত সুন্দর ঘরবাড়ি, সুশৃঙ্খল সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা, পরিমিত জনসংখ্যাও দৃশ্য দূষণ রোধে এবং সুস্থ মনন গঠনে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

বর্তমানে আমাদের দেশের বড় শহরগুলোতে বিলবোর্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটি একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। কিন্তু বড় শহরগুলোর বাইরে বের হলেই হাইওয়েগুলোর দুধারে, জেলা শহর ও মফস্বলে এখনো মিলছে বড় বড় বিলবোর্ড। অতীতে আমরা দেখেছি ঝড়ো বিলবোর্ড ভেঙ্গে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছে। তারপরও এধরণের বিলবোর্ড চিরতরে বন্ধের উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি না। বড় বড় এই বিলবোর্ডগুলো একদিকে যেমন দৃশ্য দূষণ করছে একইভাবে মানুষের প্রাণহানিরও কারণ হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতা দৃশ্য দূষণের আরেকটি কারণ। বেশিরভাগ বিলবোর্ড, পোষ্টার, ব্যানার, ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই লাগানো হয়।

আমাদের চারপাশে ঘিরে থাকা সামাজিক ও প্রাকৃতিক সব কিছু নিয়েই আমাদের পরিবেশ। আজ আমরা সবদিক দিয়েই দূষণের শিকার। কেবলমাত্র বস্তাপচা বুলি আওড়ে, নিয়ম বানিয়ে এর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। প্রয়োজন আইনের সঠিক প্রয়োগ। দেয়াল লিখন ও পোষ্টার নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১২ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। দৃশ্য দূষণ প্রতিরোধ অবৈধ দেয়াল লিখন, পোষ্টার, ব্যানার, ফেস্টুন ও বিলবোর্ড অপসারণে অভিযান জোরদার করতে হবে। যথাযথ উদ্যোগ নিয়ে দূষণের প্রভাব থেকে আমাদের দেশ ও জাতিকে রক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে।

 

এ টি এম মোসলেহ উদ্দিন জাবেদ: কলাম লেখক