পুলিশকে কেন জঙ্গিরা টার্গেট করছে?

  • মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার (অব.)
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

২৮ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার রাত সাড়ে আটটার দিকে চট্টগ্রাম শহরের ব্যস্ততম এলাকা দুই নম্বর গেইট মোড়ে অবস্থিত পুলিশ বক্সের ভেতরে বোমার বিস্ফোরণ ঘটেছে। এতে ১০ বছরের এক শিশু ও একজন পথচারীসহ দুইজন কর্তব্যরত পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। বোমা বিস্ফোরণের পর তোলা ও পত্রিকায় প্রকাশিত পুলিশ বক্সের ছবি দেখে মনে হয় পুলিশ বক্সের ভেতরেই বোমাটি বিস্ফোরিত হয়েছে। পুলিশ বক্সের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তাতে বোঝা যায় বিস্ফারণের সময় পুলিশ বক্সের ভেতরে কেউ ছিল না। ভেতরে কেউ থাকলে তার বা তাদের গুরুতর আহত অথবা নিহত হওয়ার কথা। হতে পারে এটা সময় নিয়ন্ত্রিত (টাইম বোমা) বোমা ছিল এবং সেট করা নির্দিষ্ট সময়েই বিস্ফোরণ ঘটে গেছে। হয়তো ভাগ্যক্রমে ওই সময়ে পুলিশ বা অন্য কেউ ভেতরে ছিল না। আবার হতে পারে এটা ছিল দূর থেকে নিয়ন্ত্রিত বোমা। বোমাটি যে বা যারাই বিস্ফোরণ করিয়ে থাকুক না কেন তারা হয়তো বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটাতে চায়নি। শুধু মাত্র ভয় ও ত্রাস সৃষ্টি করা অথবা নিজেদের উপস্থিতি জানান দেওয়ার জন্যই এটা করেছে।

কিন্তু বড় কথা হলো পুলিশ বক্সের ভেতরে তারা বোমাটি স্থাপন করার সুযোগ পেল কীভাবে? সন্ধ্যার পরপরই ঘটনাটি ঘটেছে। তাতে বোঝা যায়, সকাল থেকেই সেখানে বক্সের ভেতরে অথবা আশপাশে অনবরত পুলিশ কর্তব্য ছিল। কোন ফাঁকে কী করে তারা বক্সের ভেতরে বোমাটি স্থাপন করতে পারল। তাতে বোঝা যায়, যখন যারাই কর্তব্যে ছিলেন তাদের পরিচিত কেউ ছদ্মবেশে পুলিশ বক্সে ঢুকে কাজটি করেছে, যাকে পুলিশ হয়তো সন্দেহ করেনি। এর মাধ্যমে আরেকটি বিষয় বের হয়ে আসে- পুলিশের প্রত্যেক সদস্য, সিপাই থেকে শুরু করে অফিসার পর্যন্ত প্রত্যেকে যদি নিজেদের নিরাপত্তার বিশেষ করে চলমান জঙ্গি পরিস্থিতি এবং তাদের লক্ষ্য ও কৌশল সম্পর্কে সতর্ক না হন তাহলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের অঘটন ঘটে যেতে পারে।

বিজ্ঞাপন

এ ধরনের ঘটনা চট্টগ্রামে এটাই প্রথম। এর আগে ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে, পুলিশ বক্স ও পুলিশের গাড়িতে পাঁচটি বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। সেগুলোতেও কেই নিহত হয়নি, অনেকেই আহত হয়েছেন। ঢাকার প্রতিটি ঘটনার পরপরই আইএসআই'র পক্ষ থেকে কথিত দায়দায়িত্ব স্বীকার করার বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে।

চট্টগ্রামের বেলায়ও তিন দিন পর আগের মতো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সাইট ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে আইএস কর্তৃক দায় স্বীকারের কথা প্রচারিত হয়েছে। চট্টগ্রামের ঘটনা এবং তার আগে ঢাকার পাঁচটি ঘটনার চিত্র মোটামুটি একই রকম। টার্গেট পুলিশ বক্স, পুলিশের গাড়ি। বিস্ফোরণটি এমনভাবে ও সময়ে ঘটানো হয় যাতে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা না ঘটে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ওঠে তাহলে এসব বোমা আক্রমণের উদ্দেশ্য কী হতে পারে।

বিজ্ঞাপন

ঢাকার ঘটনার পর কয়েকজন সন্দেহভাজন জঙ্গিকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বোমা হামলার প্রকৃত উদ্দেশ্য পুলিশ জানতে পেরেছে কিনা জানি না। তবে এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এবং আপত দৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে হলও তা মোটেও বিক্ষিপ্ত নয়। এগুলো অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে।

২০১৯ সালে ঢাকায় এবং এবার চট্টগ্রামে পুলিশকে লক্ষ্য করে যে আক্রমণ তার অনেক আগে থেকেই পুলিশের ওপর ভয়াবহ আক্রমণ হয়ে আসছে।

২০১৫ সালের ২২ অক্টোবর মিরপুরে কর্তব্যরত অবস্থায় এএসআই ইব্রাহিম মোল্লাকে হত্যা করে জঙ্গি সন্ত্রাসীরা। মিরপুরের মতো জনাকীর্ণ এলাকায় রাত নয়টার বগুড়া থেকে আসা একটি আন্তঃজেলা বাসে যাত্রী বেশে জঙ্গি সন্ত্রাসীরা আসে এবং পূর্বপ্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে কর্তব্যরত পুলিশ যখন সব যাত্রীদের তল্লাশি চালাতে শুরু করে তখনই যাত্রীবেশী সন্ত্রাসীরা এএসআই ইব্রাহিমকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে হত্যা করে।

প্রধান আক্রমণকারী সন্ত্রাসী এনামুল হক কামাল পালিয়ে যেতে সফল হলেও তার সঙ্গী মাসুদ রানা ওরফে সুমনকে পুলিশ ধরে ফেলে। ফলে সবকিছু জানা যায়। এনামুল হক কামাল বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলা ছাত্র শিবিরের সভাপতি। আরও পিছনের দুয়েকটি উদাহরণ দিই।

২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসের ৭ তারিখ হরতাল চলাকালে রাজশাহীতে শিবিরের কর্মীরা দুই পুলিশ সদস্যের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে সেই অস্ত্রের বাট দিয়ে ওই কর্তব্যরত পুলিশকে বেধড়ক পেটায়। তাতে দুই পুলিশ সদস্য মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পরের দিন পত্রিকায় পুলিশের লুটিয়ে পড়ার ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়।

২০০৮ সালের ১১ এপ্রিল শুক্রবার বাদ জুমা বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেইটে ধর্মান্ধ জঙ্গি ও জামায়াত শিবির একত্রিত হয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণ চালায়। ওই সময়ের জরুরি আইনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার রহস্যজনক কারণে ওই আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে তখন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

২০১৩ সালের ২৮ অক্টোবর দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ফাঁসির দণ্ড ট্রাইব্যুনাল থেকে ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জামায়াত শিবির দেশব্যাপী ভয়ঙ্কর তাণ্ডব শুরু করে। ওই দিন বিকালে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঙ্গ উপজেলায় পুলিশ ফাঁড়িতে আক্রমণ চালিয়ে বিশ্রামরত তিন পুলিশকে শিবিরের ক্যাডার বাহিনী হত্যা করে। তাই আমাদের বুঝতে হবে পুলিশের ওপর সন্ত্রাসীদের আক্রমণের ঘটনা নতুন কিছু নয়। কেউ কেউ হয়তো বলতে পারেন, জামায়াত শিবির তো শেষ, তাদের কথা আবার টেনে আনা হচ্ছে কেন?

এরকম যারা ভাবেন তাদের সঙ্গে আমি একমত নই। আজকে রাজনীতির মাঠে তাদের হয়তো দেখা যাচ্ছ না। কিন্তু তাদের রেজিমেন্ট ক্যাডার বাহিনী বিলুপ্ত হয়ে গেছে তা ভাবার মতো কোনো কারণ আমি দেখি না। বিগত সময়ে যেসব জঙ্গি সন্ত্রাসী ধরা পড়েছে তার প্রায় শতকরা আশিভাগ শিবিরের সদস্য। তাছাড়া অনুসন্ধান এবং গবেষণায় দেখা গেছে জঙ্গি সংগঠনগুলো বহু নামে এবং বহু নেতৃত্বের অধীনে কাজ করলেও এদের সকলেরই শেকড় এক জায়গায়। তারা সকলেই ওয়াহিতন্ত্রের খেলাফত এবং তাদের ব্যাখ্যা মতো শরিয়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যার উদাহরণ তালেবানি আফগানিস্তান এবং জেনারেল জিয়াউল হকের পাকিস্তান।

বাংলাদেশে জঙ্গিয়ায়নের বিস্তার কী ভাবে ঘটে তা নিয়ে দেশের প্রধান ইংরেজি দৈনিকে ২০১৬ সালে দুইটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বের হয়। শুদ্ধস্বরের টুটুলকে হত্যার চেষ্টায় জড়িত জঙ্গি সুমন হোসেন পাটোয়ারী কিভাবে জঙ্গি হয়ে ওঠে তার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বের হয় ২০১৬ সালের ২৪ জুলাই।

আর ২০১৪ সালের ২৫ অক্টোবর নারায়নগঞ্জ থেকে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গি, ঢাকার উত্তরায় বসবাসরত মুহম্মদ ওমর ওরফে ফয়জুল ওরফে রবি কীভাবে জঙ্গি হলো তার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বের হয় ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই।

এই দুই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন পড়লে বোঝা যায় প্রতিটি শহর, উপশহর এবং গ্রাম পর্যন্ত দেশব্যাপী সব শ্রেণি পেশার যুবকদের জঙ্গিয়ায়নের দীক্ষা ও রিক্রুটমেন্টের জন্য একটা ব্যাপকভিত্তিক নেটওয়ার্ক তারা তৈরি করেছে। একজন যুবক প্রাথমিকভাবে যাদের সংস্পর্শে আসে তারা দেখা যায় প্রথমভাগে মিলিট্যান্ট বা জিহাদি হওয়ার কথা বলে না। তার ধর্মের ভালো ভালো কথা দিয়ে শুরু করে। তারপর ধাপে ধাপে নতুন যুবক একজনের কাছ থেকে আরেকজন, তার থেকে অন্যজন এইভাবে হাত বদলাতে বদলাতে এক সময়ে এমন জায়গায় পৌঁছে যায় যেখান থেকে ফির আসার আর কোনো পথ থাকে না।

এই যে নেটওয়ার্ক সেটাতো বিলুপ্ত হয়নি। যদিও আপাতত তাদের কাজকর্মের স্রোতে কিছুটা ভাটা পড়েছে বলে মনে হয়।

২০১৬ সালে ১ জুলাই গুলশানের হোলি আর্টিজানের ঘটনার পর জঙ্গি সংগঠনগুলো বিশেষ করে জেএমবি বা নব্য জেএমবি এবং আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার আল ইসলামের সদস্যরা প্রায় তিন ডজনেরও বেশি বার নতুন করে হামলা চালাবার জন্য বড় ধরনের প্রস্তুতি নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু র‍্যাব-পুলিশের সতর্কতা ও তৎপরতায় প্রতিবারই তারা আগেভাগে ধরা পড়েছে। এসব গোলাগুলিতে অনেক জঙ্গি আহত-নিহত হয়েছে, অনেকে গ্রেফতার হয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বহুলাংশে হ্রাস পাওয়ার জঙ্গি নেটওয়ার্কিং এবং তৎপরত দুটোর কোনোটাই তারা আগের মতো করতে পারছে না।

অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী জঙ্গিদের প্রেরণা তথাকথিত আইএসআই ইরাক ও সিরিয়া থেকে উৎখাত হওয়ার পর সঙ্গত কারণেই সব দেশের জঙ্গিরা আপাতত কিছুটা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। এরকম একটা পরিস্থিতিতে গত বছর ঢাকায় পাঁচবার এবং সদ্য চট্টগ্রামে পুলিশের ওপর বোমা নিক্ষেপ ও বিস্ফোরণের কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে সেটাই প্রশ্ন।

এখানে লক্ষণীয়, এসময়ে তারা পুলিশের ওপর বোমা নিক্ষেপ বা বিস্ফোরণ ঘটালে তাতে হতাহতের বিষয়টি নিয়ে জঙ্গিরা খুবই সতর্ক। তারা হয়তো মনে করছে এই সময়ে বড় ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ চালালে সেটা হজম করার মতো রাজনৈতিক ও আর্থিক সক্ষমতা তাদের নেই। অন্যদিকে দেশব্যাপী তাদের যে অনুসারী রয়েছে তাদের মনোবল ধরে রাখার জন্য হলেও কিছু তৎপরতা মাঝে মধ্যে দৃশ্যমান করা প্রয়োজন। আর এই সময়ে এই আক্রমণগুলো পুলিশের ওপর চালানোর সম্ভাব্য দুটি কারণ রয়েছে। যেহেতু তারা আপাতত বড় ধরনের ধ্বংসযজ্ঞের দিকে যাচ্ছে না, তাই আক্রমণ বা বোমার বিস্ফোরণ সাধারণ মানুষের ওপর না হয়ে পুলিশের ওপর হলে দেশে ও বিদেশে প্রচার পাওয়া যাবে। দ্বিতীয়ত, পুলিশের ওপরে তাদের ক্ষোভতো বহু আগে থেকেই রয়েছে। সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের সঙ্গে পুলিশকে জানিয়ে দেয়া জঙ্গিরা ইচ্ছা করলে তাদের ওপর বহুবিধ পন্থায় আক্রমণ চালিয়ে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি সাধনের সক্ষমতা রাখে। এক প্রকার হুমকি ও ভয় দেখানো।

তাই আত্মতুষ্টিতে না থেকে সর্বোচ্চ সতর্কতাসহ জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ব্যবস্থা সর্বদা অব্যাহত রাখতে হবে। এটা স্পষ্ট আপাতত জঙ্গিরা লোপ্রফাইলৈ থাকলেও বসে নেই। শুধুমাত্র রাজনৈতিক ও আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার জায়গাটি একটু শক্ত হলেই তারা আবার আগের মতো টার্গেট কিলিং এবং অপতৎপরতা চালাবার চেষ্টা করবে।

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার (অব.): কলামিস্ট এবং ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।