করোনা, নয়াচীন ও মুজিব ভাবনা

  • শুভ কিবরিয়া
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

শুভ কিবরিয়া, ছবি: বার্তা২৪.কম

শুভ কিবরিয়া, ছবি: বার্তা২৪.কম

অবশেষে করোনাভাইরাস হানা দিল বাংলাদেশেও। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ যেসব অতিথিদের আসার কথা ছিল এই অনুষ্ঠানে আপাতত তাদের সফরও স্থগিত হলো। ফলে অনেক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, উত্তেজনা দূর হলেও করোনা এক জীবন্ত আতঙ্ক হয়ে আবির্ভূত হয়েছে। করোনায় মৃত্যুর হার এখনো যথেষ্ট কম। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায়, অপঘাতে, নৌকাডুবিতে যে পরিমাণ মানুষকে আমরা প্রতিনিয়ত হারাই তার চাইতে করোনার আঘাতে মৃত্যুহার অনেক কম। কিন্তু যেহেতু আমাদের হাইজিনিক সেন্স ও আচার খুবই দুর্বল এবং বাংলাদেশ অত্যন্ত জনঘনবসতির দেশ ফলে একটা আতংক থাকছেই। আর সব সময়ের মতই মুনাফাবাজদের আতংক ছড়ানোর প্রচেষ্টা তো আছেই। মুনাফাবাজরা যত আতংক ছড়াতে পারবে, ততই তাদের অন্যায় বাণিজ্যের সুবিধে।

আবার মানুষ গুজবে এক ধরণের সংক্রামিতও হয়। ফলে, সতর্ক না থাকলে করোনো এখানে ভয়ের বিষয় হয়ে উঠতে পারে। যদিও সরকার বারবার বলছে, করোনাকে ভয় করোনা, তবুও মানুষের ভয় যে যাচ্ছে তা মনে হয় না। অবশ্য এক্ষেত্রে আমরা চীনের শরণাপন্ন হতে পারি। করোনা বড় হানা দিয়েছে চীনে, উৎপত্তিও ওখান থেকেই। কিন্তু চীন এখন সেটা সামলে নিয়েছে। রাষ্ট্র হিসেবে সেটাই চীনের সক্ষমতা।

বিজ্ঞাপন

করোনা ও চীন যদিও সমার্থক তবুও দেখার বিষয় করোনা মোকাবিলায় চীন যেভাবে লড়ছে সেটা। চীনের এই সামর্থ্য নিয়ে ভাবতে যেয়ে, মনে পড়লো আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগে এই ভূখণ্ডের এক তরুণ রাজনীতিবিদ চীনে গিয়ে সে দেশ সম্পর্কে কী ভেবেছিলেন তার কথা- ‘নয়াচীনের উন্নতি দেখে সত্যিই আমি খুব সন্তুষ্ট হয়েছি। যদি দশ বৎসর তারা দেশকে শান্তিপূর্ণভাবে গড়তে পারে তবে দেশের জনসাধারণের কোনো দুঃখ-দুর্দশা থাকবে না, অশিক্ষা কুসংস্কার মুছে যাবে। এবং দুনিয়ার যে কোনো শক্তির সাথে তারা মোকাবিলা করতে পারবে সকল দিক থেকে, কারণ জাতিকে গড়ে তোলার যে প্রধান শক্তি জনসাধারণের মনোবল তা নয়াচীনের জনগণের মধ্যে আছে।’

দুই.

বিজ্ঞাপন

মাও সে তুংয়ের হাতে তখন নয়াচীন গড়ে উঠছে। আর পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৩২ বছর বয়সী এক রাজনীতিবিদ যে সদ্য ভাষা আন্দোলনের জন্য জেল খেটে কেবল কারাগারের বাইরে আসতে পেরেছে, তার সুযোগ হলো সেই নয়াচীন দেখার। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক তরুণ রাজনীতিবিদ শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন করাকালীন সর্বশেষ গ্রেফতার হন ১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে। ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জেল থেকে ছাড়া পান তিনি। এ বছরই অর্থাৎ ১৯৫২ সালের ২ অক্টোবর থেকে ১২ অক্টোবর নয়াচীন সরকারের উদ্যোগে পিকিংয়ে অনুষ্ঠিত হয় এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলন। এই সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান দলের প্রতিনিধি হিসেবে অংশ নেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর এই চীন সফরের অভিজ্ঞতার কথা তিনি পরে লিখেছিলেন জেলে বসে ১৯৫৪ সালে। তাঁর লেখাটা শুরু হয়েছিল এভাবে, “১৯৫২ সালে জেল হতে বের হলাম, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর। জেলে থাকতে ভাবতাম আর মাঝে মাঝে মওলানা ভাসানী সাহেবও বলতেন, ‘যদি সুযোগ পাও একবার চীন দেশে যেও।’ অল্পদিনের মধ্যে তারা কত উন্নতি করেছে। চীন দেশের খবর আমাদের দেশে বেশি আসে না এবং আসতে দেওয়াও হয় না। তবুও যতটুকু পেতাম তাতেই মনে হতো যদি দেখতে পেতাম কেমন করে তারা দেশকে গড়েছে।”

চীনের শান্তি সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান প্রতিনিধি দলে ছিলেন রাজনীতিবিদ আতাউর রহমান খান, সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, লেখক-সাংবাদিক খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস ও উর্দুভাষী লেখক সৈয়দ ইউসুফ হাসান। পশ্চিম পাকিস্তান থেকেও একটি প্রতিনিধি দল এই সম্মেলনে অংশ নেন। পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতা পীর মানকি শরীফকে পাকিস্তান ডেলিগেশনের নেতা এবং আতাউর রহমান খান ও জনাব মাহমুদুল হক কাসুরীকে এই ডেলিগেশনের ডেপুটি নেতা হিসেবে ঠিক করা হয়। এই সম্মেলনে ৩৭টি দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। তুরস্কের বিখ্যাত কবি নাজিম হিকমত, রাশিয়ার বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখক আইজ্যাক আসিমভ, ভারতের বিখ্যাত লেখক মনোজ বসুর মতো খ্যাতিমান মানুষরাও এই সম্মেলনে অংশ নেন।বঙ্গবন্ধুর এই নয়াচীন সফরের অভিজ্ঞতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মশত গ্রন্থমালা সিরিজের প্রথম বই হিসেবে ‘‘ আমার দেখা নয়াচীন’’ শিরোনামে পাঠকের সামনে হাজির করে বাংলা একাডেমি ১ ফেব্রুয়ারি ২০২০, একুশের বইমেলার প্রথম দিনে।

তিন.

চীন সফরকালে তরুণ রাজনীতিবিদ শেখ মুজিবুর রহমান সে দেশটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করেন। তারই অভিজ্ঞতায় লেখেন, “নয়াচীনের অনেক কিছুই আমার ভালো লেগেছিল একথা সত্যি। কিন্তু নয়াচীন সরকার কম্যুনিস্ট মতবাদ ছাড়া অন্য কোন মতবাদের লোককে রাজনীতি করতে দেয় না। একমাত্র নয়াচীন- নেতা মাও সে তুংয়ের ‘নয়া গণতন্ত্রে’র নীতি যারা বিশ্বাস করেন তাদেরই রাজনীতি করার অধিকার আছে। আমার মতে ভাত-কাপড় পাবার ও আদায় করে নেবার অধিকার মানুষের থাকবে, সাথে সাথে নিজের মতবাদ প্রচার করার অধিকারও মানুষের থাকা চাই। তা না হলে মানুষের জীবন বোধহয় পাথরের মতো শুষ্ক হয়ে যায়।”

‘আমাদের রাষ্ট্রদূত নয়াচীন সরকারের প্রশংসা করেছেন। তিনি আমাদের বলেছিলেন, যে দক্ষতার সাথে এরা শাসনকার্য চালাইতেছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে দুনিয়ার যে কোনো শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রের সঙ্গে এদের তুলনা করা যাবে।’

চার.

নিজের দেশে তখন স্বৈরতন্ত্র চালাচ্ছে শাসক গোষ্ঠী আর তার বিরুদ্ধে লড়ছেন এই তরুণ রাজনীতিবিদ। একদলীয় কম্যুনিস্ট চীনেও জনগণের যেটুকু অধিকার আছে কিংবা জনমঙ্গলের জন্য সে দেশের সরকার যতটুকুভাবে তার ছিটেফোঁটাও নেই নিজ দেশ পাকিস্তানে। কিছুটা বেদনায় কিছুটা উপহাসে লিপিবদ্ধ করছেন সেই বাস্তবতা- “আমাদের দেশে মানুষ না খেয়ে মারা গিয়েছে এই খবরটা বন্ধ করার জন্য অথবা প্রতিবাদ করার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা হয়। নয়াচীনে এরকম খবর রটলে সরকার এর খোঁজ নেয় কী জন্য লোকটা মারা গেছে। কতদিন না খেয়ে ছিল? জমিজমা কী পরিমাণ আছে? এরকম ঘটনা যেন আর ভবিষ্যতে না হয়। এই না খেয়ে মরার জন্য লোকাল কর্মচারীদের কৈফিয়ত দিতে হয়, আর আমাদের দেশে এই ঘটনা প্রকাশ হওয়ার জন্য কৈফিয়ত দিতে হয়। আপনারা বুঝতে পারবেন যদি আমি একটা ঘটনা বলি। আমাদের পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগের জনৈক মন্ত্রী খুলনার দুর্ভিক্ষ এলাকা ভ্রমণ করে বললেন যে, ‘লোকে না খেয়ে মরছে না, মরছে পুষ্টির অভাবে।’ পুষ্টির অভাব হয় কেন? এই কৈফিয়ত কে জিজ্ঞাসা করে? আর করলেই বা উত্তর দেবার জন্য লীগ মন্ত্রীমণ্ডলী বাধ্য হবে কেন? কারণ তারা জানে নিরাপত্তা আইন তাদের হাতে আছে। ইচ্ছা করলে যে কোনো মুহূর্তে বিনা ওয়ারেন্টে যে কোনো লোককে গ্রেপ্তার করে জেলে রাখতে পারে বছরের পর বছর।”

পাঁচ.

এই ভ্রমণে যত জায়গায় আনুষ্ঠানিকভাবে বক্তৃতা করতে হয়েছে তরুণ শেখ মুজিব সর্বত্র বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করেছেন। কেননা সেখানে তাঁর অভিজ্ঞতা হচ্ছে, ‘ আমি দেখেছি ম্যাডাম সান ইয়াৎ-সেন খুব ভালো ইংরেজি জানেন, কিন্তু তিনি বক্তৃতা করলেন চীনা ভাষায়। একটা ইংরেজি অক্ষরও তিনি ব্যবহার করেন নাই।’ ‘চীনে অনেক লোকের সাথে আমার আলাপ হয়েছে, অনেকেই ইংরেজি জানেন, কিন্তু ইংরেজিতে কথা বলবেন না। দোভাষীর মাধ্যমে কথা বলবেন।’

ছয়.

নয়াচীনে যা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল তা হল শিশুদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা। তিনি কিছুটা অভিভূত হয়েই যেন লিখছেন ,“নতুন চীনে দেখলাম শিশুরাই ‘প্রিভিলেজড ক্লাস।’ এই প্রিভিলেজড ক্লাসটা সরকারের নানা সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। নয়াচীন সরকারের হুকুম, প্রত্যেক ছেলেমেয়েকে স্কুলে দিতে হবে, একটা পরিমাণ ঠিক করে দিয়েছে, সেই পরিমাণ খেতে দিতে হবে। পোশাক ঠিক করা আছে, সেইভাবে পোশাক দিতে হবে। যাদের দেবার ক্ষমতা তাদের সরকারকে জানাতে হবে। সরকার তাদের সাহায্য করবে। নতুন মানুষের একটা জাত গড়ে তুলছে নয়াচীন। ১৫/২০ বৎসর পরে এরা যখন লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়ে দেশের জন্য কাজ করবে তখন ভেবে দেখুন নয়াচীন কোথায় যেয়ে দাঁড়াবে?”

নয়াচীন এখন পৃথিবীর অন্যতম অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি হয়েই দাঁড়িয়ে গেছে। করোনা মোকাবিলায় চীনের শক্তিমত্তাও প্রমাণিত হয়েছে। কাজেই রাষ্ট্রকে শক্তিমান করার পথটাই হচ্ছে বিপদকে মোকাবিলা করার সহজ উপায়। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষিত করতে পারলে, মানুষকে সাথে নিয়ে এগুতে পারলে যে কোন রাষ্ট্র বিপদের দিনে তার সামর্থ্য দেখাতে পারে।

জনমঙ্গলের এই ধারণা শেখ মুজিবুর রহমানের তরুণ বয়সে তাঁকে উদ্বেলিত করেছিল। নয়াচীনের অভিজ্ঞতা বয়ানে তার দেখা মেলে বিশদভাবেই।

করোনার হামলায় মুজিব বর্ষের অনুষ্ঠান সীমিত হলেও, চীনযাত্রার মুজিব ভাবনার বিস্তার, রাষ্ট্র ও সমাজকে, বিপদ মোকাবিলার শক্তি দিতে পারে। পথ দেখাতে পারে।


শুভ কিবরিয়া: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক।