গ্লোবাল ভাইরাস, লোকাল প্রতিরোধ

  • এরশাদুল আলম প্রিন্স
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

পৃথিবীকে এভাবে এর আগে আর কোনোদিন দেখা যায়নি। পৃথিবীর এই রূপ একেবারেই নতুন। আমরা বলি পৃথিবীটা একটি ছোট গ্রাম-গ্লোবাল ভিলেজ। উন্মুক্ত এ বিশ্বে সবকিছুই হাতের নাগালে। চাইলেই যাওয়া যায় আমেরিকা, রাশিয়া, মক্কা কিংবা চীন। চাইলেই পাওয়া যায় সব কিছু। হাতের মুঠোয় বিশ্ব। কিন্তু আসলে পৃথিবী যা ছিল তা-ই আছে। এর আয়তন কমেনি। কমেছে শুধু দূরত্ব। এটাই বিশ্বায়ন। বিশ্বায়নের মূল নিয়ামক হচ্ছে সহজ যোগাযোগ ও প্রযুক্তি।

সম্প্রতি চীন থেকে ছড়িয়ে যাওয়া একটি ভাইরাসের কারণে হাতের মুঠোয় থাকা বিশ্ব যেনো ক্রমেই হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব ক্রমেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার দিকে যাচ্ছে। অনেক দেশই অপর দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। বাকীরাও যোগাযোগ সীমিত করে ফেলেছে। অতি জরুরি না হলে কেউ বিদেশ ভ্রমণে যাচ্ছে না। এ এক বৈশ্বিক দুর্যোগ, বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা।

বিজ্ঞাপন

ইতোমধ্যে বিশ্বের ১০২টি দেশ করোনা আক্রান্ত হয়েছে। গতকাল আমাদের দেশে তিনজন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে।

করোনার কাছে অনেক উন্নত, শক্তি ও ক্ষমতাধর রাষ্ট্রও আজ অসহায়। যুক্তরাষ্ট্রেও আক্রমণ করেছে এই ভাইরাস। মৃতের সংখ্যা সেখানেও অনেক। কয়েকটি রাজ্যে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। চীন, ইতালি, ইরানের অবস্থাতো ভয়াবহ।

বিজ্ঞাপন

দেশে করোনা রোগী শনাক্ত করা গেছে, গতকাল এরকম ঘোষণা পর মানুষের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা লক্ষ্য করা গেছে। তবে আমি ভেবেছিলাম মানুষ অনেক বেশি ভীত ও শঙ্কিত হয়ে পড়বে। একটা প্রভাব পড়েছে বটে, কিন্তু রাস্তাঘাটে তার খবু একটা প্রভাব পড়েনি। হয়তো অবস্থা আরও খারাপের দিকে গেলে ভয়ের মাত্রাও বেড়ে যাবে। আমরা আশা করি, সে রকম পরিস্থিতি আসবে না। সবাই সাহসের সঙ্গে ও সতর্কতা অবলম্বন করে এই বিপদ মোকাবেলায় সফল হবো এটাই কাম্য।

গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে বলা হয়েছে, দেশে মাত্র তিনজন করোনা আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। আজ সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে যে তারা সুস্থ আছে। এখন ভাইরাস যাতে ওই তিনজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে সে জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। হাসপাতালের অন্য রোগী বা ডাক্তারদের মাঝে যাতে ভাইরাস না ছড়ায় সেদিক সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। কোনোভাবে কোয়ারান্টাইনের বাইরে এই ভাইরাস চলে এলে ঢাকা শহরে এই ভাইরাস প্রতিরোধের কি কোনো উপায় আছে? কাজেই সর্বোচ্চ সতর্কতাই এখন একমাত্র করণীয়। ঘরে যা ঢুকে পড়েছে তা যেন বাইরে বের না হয় ও বাইরে থেকে (অন্য দেশ) যাতে আর ভেতরে প্রবেশ না করে সেই ব্যবস্থা নিতে হবে।

চীন বা ইতালিতে করোনা যেভাবে হানা দিয়েছে সেভাবে যদি বাংলাদেশে হানা দেয় তবে অবস্থা তারচেয়েও ভয়াবহ হবে স্বাভাবিকভাবে এমনটাই মনে হয়। কারণ, আমাদের প্রতিকার ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুটোই দুর্বল। এমনকি যারা উন্নত দেশ তারাও এই ভাইরাসের হাত থেকে পরিত্রান পায়নি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে হবে। সীমিত সক্ষমতার মধ্যেই সর্বোচ্চ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

ঢাকা ও ঢাকার বাইরের সবগুলো হাসপাতালকে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। লড়াইটা আসলে ভাইরাসের সঙ্গে নয়, নিজের সঙ্গে। নিজের ও নিজেদের অভ্যাস ও আচরণের বিরুদ্ধে জয়ী হলেই ভাইরাসের বিরুদ্ধে জয়ী হওয়া যাবে।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শিকার দেশগুলোর আজ বেহাল দশা। সেখানে ব্যবসা–বাণিজ্য, উৎপাদন, যোগাযোগ সবকিছুই ব্যাহত। তারা তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে, যোগাযোগ সীমিত করেছে। স্বাভাবিক আমদানি-রপ্তানি সেখানে ব্যাহত। একেকটি শহর যেনো ভুতুড়ে শহর।

কিন্তু আমরা আবার অতিরিক্ত সচেতন হয়ে ঘরকে গুদাম বানিয়ে ফেলি। আসল সচেতন না হয়ে ভিন্ন কাজে মনোযোগ দেই। বিপদের কথা শুনেই আগে সবাই চাল-ডাল-পেঁয়াজ-রসুন বেশি বেশি কিনে রাখি। যেনো বিপদ যা হবার হোক, খাওয়া দাওয়াটা ঠিক রাখা চাই। আর আমাদের ব্যবসায়ীরা এর অপেক্ষাতেই থাকে। এ সুযোগেই তারা নিত্য পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। বাজারে সরবরাহ সংকট দেখা দেয়। কৃত্রিম সংকটও সেই সুযোগে সৃষ্ট করা হয়। শীত ফুরোলে, কিন্তু আজও পেঁয়াজের দাম কমলো না। এতে করে কারো কোনো লাভ হয় না। মাথা ঠাণ্ডা রেখে স্বাভাবিক জীবযাত্রা বহাল রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। বাসাকে গুদাম বানিয়ে দীর্ঘমেয়াদী সংকটের সমাধান করা যায় না।

গণমাধ্যমে দেখলাম, করোনার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর বাজারে মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার কেনার হিড়িক। তবে এখনও বাজারের নিত্য পণ্যের দাম বাড়েনি। এভাবে বাজারে আগুন লাগাবেন না। পত্রিকায় দেখলাম ফ্রান্সেও মাস্ক চুরি হচ্ছে। কোরিয়ায় হ্যান্ড সেনিটাইজার ছিনতাই হয়েছে। আমাদের দেশে যাতে এ অবস্থার সৃষ্টি না হয় সেদিকে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। বিপদ এলে সবাই মিলেই মোকাবেলা করতে হয়।

আমরা জানি না, করোনা আসলে কীভাবে ছড়ায়। কারণ, চীনের সঙ্গে উন্মুক্ত সীমান্ত রয়েছে মিয়ানমারের। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের আসা যাওয়া দুই দেশের মধ্যে। কিন্তু মিয়ানমারে নাকি এখনও কোনো করোনা রোগী নেই। এদিকে চীন থেকে সাড়ে বার হাজার কি.মি দূরে ইতালিতে ছড়িয়ে পড়েছে করোনা।

প্রায় দুই মাস হয়ে গেলো এখনও এর প্রতিষেধক আবিষ্কার করা যায়নি। কার্যকর কোনো প্রতিষেধকও আমাদের হাতে নেই। এর প্রতিষেধক আবিষ্কার হতেও নাকি আরও কমপক্ষে চার মাস লাগবে। তাও যদি শেষমেষ সম্ভব হয়। কাজেই কেউ করোনা আক্রান্ত হলে এক ঘরে হয়ে থাকাই (কোয়ারেন্টাইন) ঔষধ। করণীয় ও বর্জনীয়গুলো আমাদের মেনে চলতে হবে।

মনে রাখতে হবে, এ দেশে যদি এ ভাইরাস একবার রাস্তায় নামে তবে তাকে ঘরে ফেরানো কঠিন। কারণ ঢাকার রাস্তা কফ, থুতু আর নাগরিকদের মুত্রপাতে ভরপুর। এরকম একটি নাগরিক গোষ্ঠীকে নিয়ে সর্দি-কাশিই মোকাবেলা করতে পারি না, করোনা ভাইরাস মোকাবেলা করবো কীভাবে? অনেকে অবশ্য বলছে, আমরা যে পরিবেশে থাকি ও যে খাবার খাই, তাতে করোনা আমাদের কিছুই করতে পারবে না। এরকম হলেতো বেঁচেই যাই। ঢাকার মানুষের তো সারা বছরই জ্বর, সর্দি, কাশি লেগেই থাকে। এ সবই আমাদের গা সহা। কিন্তু মারলো করনো, দোষ হলো বেচারা সর্দি-কাশির-সেটিও কাম্য নয়। করোনাকে করোনার মতোই দেখতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্র বলেছে করোনাভাইরাসের উচ্চ ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। চীনও বলেছে একই কথা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উদ্বিগ্ন বাংলাদেশকে নিয়ে। কিন্তু আমাদের উদ্বিগ্ন হলে চলবে না। আমাদের সাহস নিয়ে মোকাবেলা করতে হবে। করোনায় করণীয় ও বর্জনীয়গুলো মেনে চলতে হবে। সরকার ও বিভিন্ন কর্তৃপক্ষকে যার যার দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। কোনো গাফলতি কাম্য নয়। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব না ছড়িয়ে সচেতনতা ছড়িয়ে দিন। সাহসের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমরা বিপদ মোকাবেলা করবো।

এরশাদুল আলম প্রিন্স: কলামিস্ট