গরিবের ওপর করোনার অর্থনৈতিক প্রভাব
পুরো বিশ্ব আজ ভয়ঙ্করভাবে বিপর্যস্ত। করোনা নামক প্রাণঘাতী ভাইরাসটি বিশ্বের প্রায় ১৮৮টি দেশে ছড়িয়েছে। ইতোমধ্যে প্রাণহানি ঘটেছে সহস্র লোকের। বাংলাদেশেও সম্প্রতি ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। এখনো পর্যন্ত সরকারি হিসাব মতে ৩৯ জন আক্রান্ত হয়েছেন, এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে চারজনের। আইসোলেশন এবং কোয়ারেন্টাইনের হিসাব করলে মোটের ওপর কমবেশি লাখ খানেক লোক ঘরবন্দী। মাদারীপুরের শিবচর, ঢাকার টোলারবাগ, গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর এরই মধ্যে লকডাউন করা হয়েছে।
পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনায় সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একযোগে কাজ করছে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো ও ব্যক্তি পর্যায়ে অনেকেই এগিয়ে আসছেন করোনাভাইরাস বিপর্যয় মোকাবেলায় সাহায্য করার জন্য। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাক্রমে মানুষজনকে বলা হচ্ছে প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে না যেতে। পুরো বাংলাদেশের কথা যদি বলা হয় তাহলে আমাদের বিবেচনায় নেওয়া উচিত জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশ। আর রাজধানী ঢাকার কথা যদি বলা হয়, তাহলে বলতে হবে ঢাকার চেয়ে জনবহুল শহর পুরো পৃথিবীতে আছে হাতে গোনা কয়েকটি। বিভিন্ন সূত্রের হিসাব মতে, রাজধানী ঢাকায় দুই কোটির বেশি লোক বাস করে। শুধু এই দুই কোটি লোক নয়, এদের সাথে দুই কোটি মানুষের পরিবার-পরিজনদের জীবন নির্বাহ হয় ঢাকা শহরের অর্থনীতির ওপর ভিত্তি করে। আবার প্রশাসনিক কেন্দ্র হওয়ার কারণে রাজধানী ঢাকার ওপর চাপটা একটু বেশি। এই শহরে যেমন সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ, ব্যবসায়ী ও উচ্চবিত্ত মানুষের বাস; তেমনি এখানে একটা বড় অংকের নিম্নবিত্ত মানুষের বাস। এই সব নিম্নআয়ের ও ছিন্নমূল মানুষেরা রাজধানী ঢাকার আশেপাশে প্রায় ১৩টি বস্তিতে বসবাস করে এবং ছোটখাটো কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে।তাদের বেশিরভাগই অপ্রচলিত বিভিন্ন সেবা খাত বা অপ্রাতিষ্ঠানিক পেশার সঙ্গে যুক্ত। অনেকেই কাজ করে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে। এদের কেউ রিকশাচালক, কেউ বাসাবাড়িতে গৃহস্থালির কাজ করে, কেউ শরবত বিক্রি করে, কেউ ঝাল মুড়ি বিক্রেতা। তারা এভাবেই নানা ছোটখাটো কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছে। শুধুমাত্র ঢাকা নয়, পুরো বাংলাদেশের কথা বিবেচনা করলে দেখা যাবে নিম্ন আয়ের মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক হিসেব মতে, বাংলাদেশে বিশ দশমিক পাঁচ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে এবং দশ দশমিক পাঁচ শতাংশ মানুষ অতি দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। এই পরিসংখ্যানটা রীতিমত উদ্বেগের বিষয়। এমনিতেই করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। উন্নত বিশ্বের দেশ সমূহে অর্থনীতির চাকা প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক যে মন্দাভাব সেটার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশে। বিজিএমইএ এবং বিভিন্ন জাতীয় পত্র-পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সূত্র অনুযায়ী বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি গার্মেন্টস শিল্পের ক্রয়াদেশ কমতে শুরু করেছে।
দেশব্যাপী করোনা আতঙ্কে জনমানুষের সাধারণ জীবনযাত্রা ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম প্রায় স্থবির। এমতাবস্থায় বিশ্বব্যাংক আশঙ্কা করছে বৈশ্বিক জিডিপি কমতে পারে প্রায় এক শতাংশ পর্যন্ত যেটা গত চল্লিশ বছরের সূচকে সবচেয়ে বেশি। বিপর্যয়কর এই অবস্থার মধ্যেই বাংলাদেশের নিম্নআয়ের মানুষজন মুখোমুখি হতে যাচ্ছে নির্মম বাস্তবতার। ঢাকা শহরের যারা ক্ষুদ্রআয়ের পেশাজীবী তারা দলে দলে গ্রামে পাড়ি জমাচ্ছে কারণ এখানে মানুষ চলাচল এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমিত হয়ে আসছে। তবে ক্রমান্বয়ে সারা দেশ জুড়েই এই অর্থনৈতিক স্থবিরতা বিরাজ করার আশঙ্কা রয়েছে। মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আছে বিত্তবান মানুষদের আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে মজুত প্রবণতা। অসাধু ব্যবসায়ীদের পণ্য মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা। নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে অতি মুনাফা লাভের চেষ্টা। এমন অবস্থায় মজুরিভিত্তিক জীবিকার ওপর নির্ভরশীল মানুষেরা বেশ দ্বিধাগ্রস্ত। এ মানুষগুলো কোনটির মোকাবেলা করবে! করোনাভাইরাস নাকি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির?
সন্দেহ নেই করোনা ভাইরাসের প্রভাবে পুরো বিশ্ব অর্থনীতি একটা খারাপ সময় পার করছে এবং সামনে হয়তো আরো খারাপ সময় অপেক্ষা করছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশ কি প্রস্তুত আসন্ন অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য? কোনটি আসলে আমাদেরকে বেশি বিপর্যস্ত করবে করোনাভাইরাস নাকি অর্থনৈতিক মন্দা? সরকারই বা কী ভাবছে বাংলাদেশের এ মানুষদেরকে নিয়ে?
এরই মধ্যে আয়সীমার নিচে অবস্থান করা মানুষেরা কাজ হারিয়ে বিপর্যস্ত। এই অবস্থায় করণীয় কি? সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে করোনাভাইরাস প্রতিরোধকালীন সময় এবং তার পরবর্তী সময়টাতে এইসব মানুষদের ওপর যেন অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব না পড়ে কিংবা তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন যেন ব্যাহত না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে এসব মানুষ যেন সুলভ মূল্যে তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় করতে পারে সে ব্যাপারে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
করোনা প্রতিরোধে সামাজিক ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য করণীয় নিয়ে সরকারকে এখনই ভাবতে হবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন এবং বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। ভাসমান ও নিম্ন আয়ের মানুষজনকে কীভাবে অর্থনৈতিক সুরক্ষা দেয়া যায় সেই পরিকল্পনা এখনই করতে হবে। প্রয়োজনে প্রত্যেক উপজেলায় সরকারি উদ্যোগে মানুষের জন্য সুলভ মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বিক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে ভর্তুকি দিতে হবে কিংবা রেশন কার্ডের ব্যবস্থা করতে হবে। এর সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে এই মুহূর্তে সারা দেশব্যাপী নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়ের ক্ষেত্রে উচ্চতরসীমা ঠিক করা যেতে পারে। যেমন একজন ক্রেতা একবারের কেনাকাটায় হয়তো সর্বোচ্চ ১০ কেজি চাল কিনতে পারবে এবং ৩ কেজি ডাল কিনতে পারবে অথবা অন্যান্য জিনিস কি পরিমাণ কিনতে পারবে তার একটা উচ্চতর সীমা এইভাবে ঠিক করতে হবে। এভাবে ভোক্তা পর্যায়ে অহেতুক মজুতকরণ প্রবণতা ঠেকানো যাবে। এতে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহে চাপ কমবে। মজুদ প্রক্রিয়ায় বাজারে অহেতুক কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অসাধু ব্যবসায়ীরা দ্রব্যমূল্য বাড়াতে পারবে না। এর সুফল হবে, এটি ভোক্তাবাজারে পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করবে এবং একইসঙ্গে পণ্যমূল্য নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে থাকবে। এভাবে সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে একদিকে যেমন অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব, তেমনি সামাজিক শৃঙ্খলাও রক্ষা করাও সম্ভব।
অপরাধ প্রবণতা নিয়ে বলা যায়, নিম্ন আয়ের মানুষ যদি তাদের আয় হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ে তবে তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়বে। সেক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতিসহ একটা সামাজিক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই সামনের দিনগুলোতে সরকারের মূলত দুটি চ্যালেঞ্জ: প্রথমত, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সুচিন্তিত ও হিসেবি পদক্ষেপ গ্রহণ এবং দ্বিতীয়ত, এই অন্তর্বর্তীকালীন সময় এবং তৎপরবর্তী কালে অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা।
দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য এই বিরাট জনগোষ্ঠী, যারা নিম্নআয়ের মানুষ তাদের জন্য এখনই একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। আমরা আশাবাদী, হয়তো আমরা করোনার মত মহাবিপর্যয় সামলে উঠতে পারবো। এর সঙ্গে সামনের দিনগুলোতে অর্থনৈতিক বিপর্যয় সামাল দেয়ার জন্য আমাদেরকে এখন থেকেই প্রস্তুত হতে হবে; ভাবতে হবে আমাদের নিম্নবিত্ত এবং দারিদ্রসীমার নিচে অবস্থানকারী মানুষদেরকে নিয়ে। সঠিক কর্মপরিকল্পনা এবং উদ্যোগের অভাবে যদি তাদের জীবন-জীবিকা বিপর্যস্ত হয় তবে সার্বিকভাবে দেশের সমাজ ও অর্থনীতি সেটি সামাল দিতে পারবে না। বিখ্যাত প্রবাদটির কথা মনে আছে তো? ‘নগর পুড়িলে দেবালয়র কি এড়ায়।’’
মোঃ রাকিবুল ইসলাম: প্রভাষক, স্থানীয় সরকার ও নগর উন্নয়ন বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়