ভিক্ষুক নাজিমুদ্দিন আমাদের কী শেখালেন
এখন করোনাকাল, মহামারিকাল, দুর্যোগের সময়। দুর্যোগ, বিপদাপদ একা আসে না। সঙ্গে আরও বিপদাপদ নিয়ে আসে। তবে দুর্যোগ অনেক সময় অনেক সম্ভাবনাও নিয়ে আসে। সে কারণেই বিপদাপদে ধৈর্য ধারণ করতে হয়, মাথা ঠান্ডা রেখে পা ফেলতে হয়। বিপদ একদিন ঠিকই কেটে যায়। কিন্তু বিপদের সময় অনেকেই তাদের কাজের জন্য পরে লজ্জিত হয়, অনুতাপ করে। আবার অনেকেই বিপদে একজন আরেকজনের পাশে দাঁড়ায়।
এই করোনাকালে অনেক বড় বড় কথা বলার লোকদের আমরা দেখতে পাইনি। সারা বছর যাদের কথার গরমে চারদিক তোলপাড় থাকতো আজ তাদের অনেকেই লাপাত্তা। বড় বড় নেতা, বুদ্ধিজীবী, সমাজ সংস্কারককে আমরা এই দুর্দিনে মানুষের পাশে পাইনি। অনেক জনপ্রতিনিধিদেরও জাতি এই সময়ে খুঁজেও পায়নি। এ নিয়ে গণমাধ্যম তথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা, লেখালেখিও কম হয়নি। কিন্তু তারপরও তারা গর্ত থেকে বের হননি। আপনি বাঁচলে বাপের নাম-এই কথার মর্যাদা তারা রেখেছেন। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। ইতিহাস বলে, দুর্ভিক্ষ-মহামারি-মানবিক বিপর্যয়ের সময়ে এটিই স্বাভাবিক। রাজনীতি, জনসেবা, বড় বড় কথা সবই শান্তি ও স্বাভাবিক সময়ের জন্য। তার মানে, মানুষের যখন বিপদ তখন ওই সব বড় বড় কথাওয়ালারা লাপাত্তা হবে এটাই ধরে নিতে হবে। সময় ঠিক হয়ে গেলে আবার তারাই গর্ত থেকে উঠে এসে গরম গরম কথা বলবেন সেটাও মেনে নিতে হবে।
এই করোনা অনেক পয়সাওয়ালাকে করেছে ভিখারি, আবার ভিখারিকে করেছে রাজা। এ পৃথিবীতে মানুষ পেটের জন্য কতইনা সংগ্রাম করে। ক্ষুধার জ্বালা বড় জ্বালা। কারো ক্ষুধা কম, কারো ক্ষুধা বেশি। ক্ষুধার কোনো শেষ নেই। কারো শুধু পেট ভরলেই ক্ষুধা মিটে যায়। কারো সম্পদের পাহাড়েও মন ভরে না। পেটের ক্ষুধা মেটানো সহজ। কিন্তু লোভের ক্ষুধা মেটানো কারো পক্ষেই সম্ভব না।
এই করোনাকালে অনেকেই তাদের ক্ষুধা মেটাতে মাঠে নেমেছেন। সরকারি ত্রাণে তাদের লোভের দৃষ্টি পড়েছে। আবার এই করোনাকালেই অনেকে দাতা হয়েছেন। কেউ কেউ ত্রাণ দেয়ার ছবি তুলে সংবাদ করেছেন, সামাজিক গণমাধ্যমে সেই ছবি ছড়িয়ে দাতা হাতেম তাই হয়েছেন। আবার কেউ কেউ শুধু দান খয়রাতের ঘোষণা দিয়ে গণমাধ্যমের নজর কেড়েছেন। এসবই বিজ্ঞাপন। প্রচারে দোষ নেই। কিন্তু প্রচার সর্বস্ব হলেই বিপদ।
করোনাকালে অনেকে দাতা সেজেছেন, অনেকে ভিখারি হয়েছেন। আবার কোনো কোনো ভিখারি মানুষের পাশেও দাঁড়িয়েছেন। কোনো প্রচারের আশায় নয়। অনেক মানুষই আড়ালে আবডালে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। দেশের তরুণ, যুব সমাজ সব সময়ই একাজে এগিয়ে থাকে। তারাই বিপদের আসল বন্ধু। রানা প্লাজার ঘটনাও এই মাসেই ঘটেছে। সেদিনও দেশের জানবাজ তরুণরা আটকে পড়া মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল। রানা প্লাজার পাশে দাঁড়িয়ে কেঁদেছি। চোখ ভিজে গেছে জলে আটকে পড়া মৃত মানুষগুলোর কথা ভেবে, কল্পনা করে। কিন্তু তারই মাঝে নতুন আশায় বুক বেঁধেছি দেশের তরুণদের ভূমিকায়। তরুণরা যে যেভাবে পেরেছে আটকে পড়াদের পাশে, তাদের পরিবারের পাশে সেদিন দাঁড়িয়েছে। কাজেই রানা প্লাজায় আমরা হারিয়েছি অনেক। তবে পেয়েছি কিছু নতুন মানুষ, নতুন প্রাণ। এরাই বাংলাদেশের আগামীর শক্তি। এরাই আবার আজ এগিয়ে এসেছে করোনাকালে মানুষের পাশে।
এই করোনাকালে আমরা নিশ্চিত জানি, এরকম হাজারো নতুন প্রাণ যোগ হয়েছে দেশের বুকে যারা মানুষের জন্য কাজ করে আনন্দ পায়। এরাই আগামী দিনে জাতির রক্ত প্রবাহে গতি সঞ্চার করবে। এরা হয়তো মিডিয়ায় আসেনি। আসতে চায়ও না। এমন অনেকের কথা আমরা জানি। ওদের চোখে চোখে রাখুন। যত্ন দিন ওদের। উদ্বুদ্ধ করুন, উৎসাহ দিন। দেখবেন, ওরাই হবে আমার আপনার সবচেয়ে বড় আশ্রয়।
এদেশের বড় বড় টাকাওয়ালাদের আমরা সবাই চিনি। তারা কে কত টাকা দিয়েছে তাও আমরা জেনে গেছি। তাদের দান অবশ্যই মূল্যবান। মানুষের পাশে তারা এগিয়ে এসেছেন, এটা অনেক বড় কাজ। আবার অনেক নিম্নবিত্তের মানুষও তাদের সমর্থ অনুযায়ী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
জীবনের প্রয়োজনে নানাজন নানা পেশা বেছে নেয়। এদেশে চুরিও একদা পেশা ছিল। প্রতিদিন সকালেই শোনা যেতো আজ অমুকের বাড়িতে চুরি হয়েছে তো কাল তমুকের বাড়িতে চুরি হয়েছে। এইসব চোরদের মোটামুটি সবাই চিনতো। এরা সিঁধেল চোর। বাড়িঘরে চুরি করাই ছিল ওদের কাজ। এখন এই সব চোররা অতি সংকটাপন্ন প্রজাতি। আরও বড় বড় ও অভিজাত চোরের বাজারে এইসব খুচরা চোররা সুবিধা করতে না পেরে অন্য পেশা বেছে নিয়েছে। তাছাড়া সময়ের বদল হয়েছে। এই সব অভিজাত চোররা সরকারি ত্রাণ, রাষ্ট্রের কোষাগার সয়লাব করতেও কসুর করে না। এরা আবার সমাজে ভদ্দরলোক হিসেবে পরিচিত। করোনাকালে এরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। মানুষের দুর্যোগ ও বিপদাপদের সময় রাষ্ট্র এগিয়ে আসে। গরিব মানুষের জন্য, নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ত্রাণ সহায়তা দেয়। এর এসময়ই অভিজাত চোররা ত্রাণ চুরির সুযোগ খোঁজে। বিপদে কারও ঘর পোড়ে আর কেউ সেই ছাইয়ে আলো পোড়া দেয়।
করোনাকালে সমাজের তথাকথিত বড় লোক বা ভদ্দরলোক নয় এমন এক ভিখারিকে দেখি ভিক্ষার পয়সা মানুষের জন্য দান করতে। ভিখারি নাজিমুদ্দিন চাচা সমাজের কাছে তথাকথিত ভদ্দরলোক নন। বুড়ো বয়সে বাধ্য হয়েই ভিক্ষায় নেমেছেন। দিনমজুরি করতে গিয়ে ৮–৯ বছর আগে তার পা ভেঙে যায়। তখন থেকেই ভিক্ষা করে সংসার চালান। করোনার এই দুর্দিনে একদিকে আমরা দেখেছি সমাজের কিছু ভদ্দরলোকরা চুরি করতে কাছা বেধে নেমেছে, আরেকদিকে দেখছি নাজিমুদ্দিন চাচাদের এগিয়ে আসতে। একদিকে ত্রাণের চাল-ডাল-তেল চুরির হিড়িক, আরেক দিকে অন্যের মুখে খাবার তুলে দেয়ার প্রয়াস। করোনাকালে যখন সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, তখন নাজিমুদ্দিন মানুষের খোঁজ নিয়েছেন।
রাষ্ট্র যখন নাজিমুদ্দিনের মতো ভিখারিদের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা করেছে, তখন তিনিই হয়ে উঠেছেন ত্রাতা। নাজিমুদ্দিন চাচার বয়স ৮০। তিনি এই বয়সে ভিক্ষা করছেন। তাহলে রাষ্ট্রের ভিজিএফ–ভিজিডি কার্ড, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, দুস্থ ও বয়স্ক ভাতা—এসব কোথায় যায়, কারা পায়, কারা খায়? করোনা দুর্যোগের সময় সরকারি ত্রাণের তালিকায় নাজিমুদ্দিনের নাম লেখাতে গেলে তিনে বলেন, আমার লাগবে না, ভিক্ষা করেই আমার দিন চলে যাবে। অন্যদের সাহায্য করেন। তিনি তার ভিক্ষা করা কিছু টাকা সরকারের হাতে তুলে দিয়েছেন। সেই ছবি গণমাধ্যমে এলে চারদিকে শোরগোল শুরু হয়। সেই খবরে প্রধানমন্ত্রী ভিখারি নাজিমুদ্দিনের ঘর নির্মাণের জন্য জমি ও টাকা দেওয়ার নির্দেশ দেন। নাজিমুদ্দিনের কত টাকা দিয়েছেন সেটা বড় কথা না। তার নিয়তি তাকে আজ এ পেশায় নিয়ে এসেছে। কিন্তু মানুষের এই কঠিন সময়ে তিনি মানুষের পাশে দাঁড়াতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। এটাই মানবিকতা। এই কঠিন করোনাকাল হয়তো কেটে যাবে সহসা। নাজিমুদ্দিন চাচাও হয়তো হারিয়ে যাবেন স্মৃতির অন্তরালে। সে যাক। কিন্তু টিকে থাকুক এ মানবিকতা। শুধু দুর্যোগ, মহামারিকালেই নয়, সব সময়।
এরশাদুল আলম প্রিন্স: কলামিস্ট