মৃত্যুর মিছিলে নিজের নামটা লেখাবেন না
আমরা খুব অস্বাভাবিক এবং কঠিন সময় পার করছি। অদৃশ্য প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস কখন কাকে ছোবল দেয় - এ নিয়েই এখন মানুষের সময় কাটছে অজানা ভয় আর আতঙ্কে। এর সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার সারাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছিল ২৬ মার্চ।
ওই ছুটি ঘোষণার সময়ই সরকারি প্রজ্ঞাপনে মানুষকে অকারণে ঘরের বাইরে বের না হতে অনুরোধ করা হয়েছিল। এ কারণেই ২৬ মার্চ থেকে রাজধানীর রাস্তাঘাট একেবারে ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই সেই চিত্র পাল্টাতে শুরু করেছে। আমাদের অতি উৎসাহী তরুণ-যুবক আর ভোজন রসিকদের কারণে লকডাউন অবস্থা কিছুটা ভেঙ্গে পড়েছে।
করোনাভাইরাসের কারণে মহামারি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে দফায় দফায় ছুটির মেয়াদ বাড়িয়ে ৫ মে পর্যন্ত করা হয়েছে। সর্বশেষ ছুটির মেয়াদ বাড়িয়ে ২৩ এপ্রিল সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল, তাতে স্পষ্ট বলে দেয়া হয়েছিল, সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত কেউ কোনো প্রয়োজনেই ঘর থেকে বের হতে পারবে না। অতি জরুরি কাজগুলো সন্ধ্যা ৬টার আগেই শেষ করতে হবে। একই সঙ্গে সরকারি কিছু কিছু জরুরি দপ্তর, কার্যাদেশ আছে এ রকম কিছু শিল্প কারখানা বিশেষ করে পোশাক কারখানা সীমিত আকারে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে খুলে দেয়ার কথাও জানানো হয়েছে সরকারের সর্বশেষ ছুটির আদেশে।
ছুটির মেয়াদ আরেক দফা বাড়ছে আগামী ১৬ মে পর্যন্ত। আমার ধারণা আগামী রোজার ঈদ পর্যন্ত এভাবেই দফায় দফায় ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হবে। উদ্দেশ্য একটাই- মানুষকে ঘরে রাখা, যাতে করোনাভাইরাস কাউকে আক্রান্ত করতে না পারে।
কিন্তু মানুষকে ঘরে রাখতে সরকারের এই চেষ্টা বা উদ্দেশ্য কতোটা সফল হয়েছে বা হচ্ছে? কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন এই ছুটির আবরণে চলমান লকডাউন নিয়েও। (এখানে বলে রাখা ভালো, সরকারের তরফ থেকে এখনও পর্যন্ত লকডাউন শব্দটা ব্যবহার করা হয়নি।) বলছেন, কী দরকার এমন লকডাউনের? যেটি মানুষ মানছেন না।
কিছু পোশাক কারখানা খুলে দেয়ার নামে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুরে দেদারছে খুলে দেয়া হয়েছে শত শত পোশাক কারখানা। আর সবকিছু বিশেষ করে গণপরিবহন বন্ধ থাকার পরও দিব্যি দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার পোশাক শ্রমিক ঢাকায় চলে আসছেন কোনো রকম বাধাবিপত্তি ছাড়া। এমনকি বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ঢাকার বাইরের শ্রমিকদের ঢাকায় আসতে বারণ করা হয়েছে। তারপরও প্রতিদিনই তারা আসছেন। এসব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কেউ কেউ বলছেন, বিজিএমএইএ প্রকাশ্যে শ্রমিকদের আসতে বারণ করলেও, আসলে তারা কারখানা শ্রমিকদের আসাটাকে ভেতরে ভেতের সাধুবাদই জানাচ্ছে।
এটা সত্য যে আমরা কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। একদিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ, অন্যদিকে দেশের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ- এসব নিয়ে। এই সংকট শুধু আমাদের নয়, গোটা বিশ্বের। তবে আমাদের একটু বেশি ভাবাচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে। কীভাবে এই সংকট থেকে বের হয়ে আসা যায়, সেই চেষ্টা সরকার করে যাচ্ছে। শর্ত সাপেক্ষে কিছু কিছু শিল্প কারখানা খুলে দিলেও সরকার সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দফায় দফায় ছুটির সময় বাড়িয়ে মানুষকে ঘরে থাকতে অনুরোধ করছে। কারণ ঘরে থাকাই করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বিশ্বব্যাপী একমাত্র স্বীকৃত অস্ত্র।
কিন্তু সরকারের এই অনুরোধ কতোটা কার্যকর হচ্ছে? শনিবার বিকেলে আইইডিসিআর’র একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলছিলাম। তিনি বলছিলেন, আমাদের তো অনেক রকম সংকট। সব বিবেচনা করে আগাতে হচ্ছে। তার ভাষায়, এখনও রাজধানীর ৯০ শতাংশ মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে না।
অবশ্য বাস্তব চিত্র বেশ ভিন্ন। আমরা যদি পোশাক শ্রমিকদের কথা বাদ দিয়ে রাজধানীর কাঁচাবাজারগুলো কিংবা নগরীর বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার অলিগলির দিকে তাকাই, তাহলে ভয় পাওয়ারই কথা। বাজারগুলোতে মানুষের উপচে পড়া ভিড়। সামাজিক দূরত্ব এখানে অসহায়। মানুষ গায়ে গা লাগিয়ে কেনাকাটা করছেন। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এটা তাদের অসচেতনতা নাকি উদাসীনতা-বোঝা মুশকিল।
একই অবস্থা রাজধানীর পাড়া-মহল্লারও। মোড়ে মোড়ে এবং পাড়ার দোকানগুলোতে তরুণ-যুবকদের অপ্রয়োজনীয় আড্ডা বেড়ে গেছে। এতে করে আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে। শনিবার আইইডিসিআর যে তথ্য দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, আক্রান্তদের মধ্যে ২৬ শতাংশই হচ্ছে ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সী। এখন বুঝতেই পারছেন এই লকডাউনে তরুণ-যুবকদের ঘরে আটকে রাখা যাচ্ছে না বা তারা ঘরে থাকতে চাচ্ছেন না। অতি উৎসাহী ও উদাসীন এই তরুণ-যুবারা নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে আনছেন। নিজেদের চরম ঝুঁকিতে ফেলছেন।
সরকার যখন প্রথম সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে, তখন থেকে মাঠে সক্রিয় ছিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ছুটির মেয়াদ বাড়ার সঙ্গে পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে মাঠে নেমেছিলেন সেনাবাহিনীর সদস্যরাও। কোনো রকম ফোর্স না করে মানুষকে বুঝিয়ে ঘরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন তারা। কিন্তু ছুটির মেয়াদ বাড়িয়ে ২৩ এপ্রিল জারি করা সর্বশেষ সরকারি আদেশে সীমিত পরিসরে কিছু সরকারি অফিস এবং পোশাক কারখানা খুলে দেয়ার ঘোষণা যখন এলো তখন থেকেই যেন পরিস্থিতি অনেকটা শিথিল হয়ে গেল। ২৫/২৬ এপ্রিল থেকে ঢাকার রাস্তায় যানবাহনের আধিক্য চোখে পড়ল। মানুষের উপস্থিতিও বেড়েছে তুলনামূলক। সব মিলিয়ে একটা ঢিলেঢালা ভাব। সাধারণ মানুষের ধারণা সরকার যেহেতু অফিস ও পোশাক কারখানা কিছুটা খুলে দিয়েছে তখন রাস্তায় নামাই যায়।
অবশ্য এর একটা কারণও আছে। রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি হঠাৎ কমে যাওয়া। গত এক সপ্তাহ ধরে আগের মত টহল নেই। চেকপোস্টে তল্লাশি নেই। থাকবেই বা কীভাবে? এখন পর্যন্ত ৮৫৪ জন পুলিশ সদস্যের দেহে কোভিড-১৯ ধরা পড়েছে। এর মধ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সদস্য সংখ্যা ৪৪৯ জন। এর বাইরে সারাদেশে ১২৫০ জন আছেন সঙ্গরোধে (কোয়ারেন্টাইন), আইসোলেশনে আছেন ১৭৪ জন। আর করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে ফ্রন্টলাইনে থেকে কাজ করতে গিয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করেছেন পাঁচজন। তাদের জন্য সমবেদনা। এই পরিসংখ্যানটা বলে দিচ্ছে পুলিশ সদস্যরা নিজেদের নিরাপত্তাটা নিশ্চিত করতে পারেননি। অর্থাৎ তাদের কাছে পার্সোনাল প্রোটেকশন ইকুইপমেন্ট (পিপিই) ছিল না বা তারা পাননি। এ কারণেই ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হয়েছেন।
শেষ করতে চাই এই বলে যে সরকার নতুন করে ছুটির মেয়াদ বাড়িয়েছে। এইবার যেন কঠোর অবস্থান নেয়া হয়। না হলে করোনাভাইরাস প্রতিরোধের চেষ্টাটাই বৃথা হয়ে যাবে। আর দেশের মানুষকেও ভাবতে হবে, অতি উৎসাহী আর উদাসীন হলে হবে না। সরকারের অনুরোধটা রাখুন। নিজেকে বাঁচাতে, নিজের মা-বাবা, ভাই-বোন, সন্তান, প্রিয়তমা স্ত্রী, পাড়া-প্রতিবেশী সর্বোপরি দেশের মানুষকে বাঁচাতে হলে দয়া করে ঘরে থাকুন। স্বেচ্ছায় মৃত্যুর মিছিলে নিজের নামটা লেখাবেন না। এতোদিন যেহেতু পার করেছেন, আর কয়টা দিন ধৈর্য ধরুন।
নিজামুল হক বিপুল: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক