আমাদের বুঝ হবে কবে?

  • শাদরুল আবেদীন
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ দিকে প্রথম নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিত (কোভিড-১৯) রোগী শনাক্ত হয় চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে। এরপর গত সাড়ে চার মাসে ২০০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে ভাইরাসটি।

যেহেতু কোনো প্রতিষেধক বা ওষুধ নেই, তাই লোকজনের নিজ নিজ ঘরে থাকা এবং সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখাকেই করোনা রোধের হাতিয়ার বলে মনে করা হচ্ছে। এই ধারণা থেকেই বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ লকডাউন ঘোষণা করে। অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হওয়া নিষিদ্ধ সবখানেই। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে আকাশ, নৌ আর সড়কপথের স্বাভাবিক সব গণপরিবহন, দোকান-পাট, সেলুন, রেস্তোরাঁ, বার, ক্লাব বা বিনোদন ও পর্যটন স্পট। যার কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে পুরো বিশ্ব। ১৯৩০ সালের বিশ্ব অর্থনীতিতে যে মহামন্দা হয়েছিল, করোনাকালে সে মন্দাকেও ছাড়িয়ে যাবে বলে শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

বিজ্ঞাপন

বলা হচ্ছে, বড় বড় রাষ্ট্রগুলো সিদ্ধান্তহীনতা এবং নাগরিকদের উদাসীনতায় পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না। চীনের পর পশ্চিমা দেশগুলোতে করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্র যেন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। দেশটিতে করোনায় এরই মধ্যে মারা গেছেন ৭৪ হাজার ৮০৯ জন। আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ ছাড়িয়েছে।

কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে বলা হচ্ছে, করোনার নতুন তীর্থভূমি হতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। যার মধ্যে পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

বিজ্ঞাপন

আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা ওয়ার্ল্ডও মিটারের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৩৮ লাখেরও বেশি, মৃত্যু ছাড়িয়েছে আড়াই লাখ। তবে আশার কথা হচ্ছে, এরই মধ্যে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন করোনা আক্রান্ত ১৩ লাখ ৬ হাজার ৪৬৬ জন।

বিগত বেশ কিছু দিন ধরে চীনে নতুন করে কোনো মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য দেশটিতে লকডাউন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। ইতালি, স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যে মৃত্যুর হার কমতে শুরু করেছে। দিন দিন বাড়ছে সুস্থদের সংখ্যা। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে মৃতের সংখ্যার পাশাপাশি সুস্থতার সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ধীরে ধীরে শিথিল করা হচ্ছে লকডাউন। কিছু বিধি মেনে বন্দিজীবন থেকে মানুষজনও বাইরে বরে হতে শুরু করেছেন।

বাংলাদেশের কী অবস্থা

এবার নজর দেওয়া যাক বাংলাদেশের দিকে। ওয়ার্ল্ডও মিটারের হিসেবে আক্রান্ত ও মৃত্যুর দিক দিয়ে ৩৭ নম্বরে রয়েছে বাংলাদেশ। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) তথ্য মতে, এ মহামারিতে দেশে এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ১১ হাজার ৭১৯ জন। মৃত্যু হয়েছে ১৮৬ জনের। এছাড়া সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১ হাজার ৪০৩ জন। নমুনা পরীক্ষা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।

সরকার কী করছে

প্রাণঘাতী করোনা রোধে কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে ২৬ মার্চ থেকে দেশে চলছে সাধারণ ছুটি। একই সঙ্গে তাল মিলিয়ে নৌপথ, আকাশ পথ ও স্থলপথে বন্ধ রয়েছে গণপরিবহন চলাচল। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেপ্টেম্বর ছাড়া খোলাই যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের প্রার্থনার স্থানগুলোতে লোকসমাগম সীমিত করা হয়েছে। এতোদিন ইসলামী ফাউন্ডেশনের (ইফা) নির্দেশনা অনুযায়ী মসজিদে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, জুমার নামাজ ও তারাবির নামাজে ৫-১০ জন মুসল্লি ইমামের পেছনে থাকতে পারতেন। যদিও ৭ মে থেকে মসজিদগুলো সবার জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে সবাইকে বার বার বজায় রাখতে বলা হচ্ছে নিরাপদ পারস্পরিক দূরত্ব। এছাড়া জেলায় জেলায় চলছিল লকডাউন বহাল থাকলেও আমাদের ক’জনই বা তা মানছি?

বাস্তব পরিস্থিতি কী

লকডাউনের মাঝেও প্রয়োজনে ও অপ্রয়োজনে বাজারে ভিড় করছেন সাধারণ মানুষ। অনেক জায়গায় মানা হচ্ছে না নির্দিষ্ট সামাজিক দূরত্ব (অন্তত ৩ ফুট)। এখানেও রয়েছে করোনা ঝুঁকি। এসব কিছু নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।

এখন আসি গার্মেন্টস ও শিল্প কলকারখানার কথায়। সরকারি নির্দেশনায় ২৬ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত প্রথম দফায় ছুটি ঘোষণা করা হয় কলকারখানাগুলোতে। এই ছুটিকে কেন্দ্র করে শ্রমিকদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয় গ্রামের বাড়ি যাওয়ার। ভয়াবহ ছোঁয়াচে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে গাদাগাদি করে বাড়ি যান তারা। ওই ছুটি শেষ হওয়ার আগে সরকার সাধারণ ছুটি বাড়ালেও কলকারখানা মালিকদের সিদ্ধান্তহীনতায় কর্মস্থলে ফিরতে বাধ্য হন শ্রমিকরা। অনেককে মোবাইল ফোনে কারখানা খোলার কথা জানিয়ে দেওয়া হয় বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসে।

এরপর সমালোচনার মুখে দ্বিতীয় দফায় ছুটি ঘোষণার পর শ্রমিকরা ফের বাড়ি যান। তবে কিছু শ্রমিক রয়ে যান বেতন ভাতা নেওয়ার জন্য। আবার অনেক মালিক চুরি করে কারখানা খোলা রেখে শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করছেন। অভিযোগ রয়েছে, কাজে না এলে চাকরি চলে যাওয়ারও হুমকি দেওয়া হচ্ছে অনেককে। দ্বিতীয় দফা ছুটি শেষে আবার শ্রমিকদের কাজে ফেরার পালা। বাস, লঞ্চ বন্ধ থাকলেও করোনা ঝুঁকি নিয়ে তারা বাড়ি থেকে কর্মস্থলে ফিরেছেন ফেরি, ট্রাক বা পিকআপ ভ্যানে গাদাগাদি করে। কারণ, তাদের তো চাকরি বাঁচাতে হবে। তাদের ভাষ্য, জীবন নয়, চাকরিই আগে। চাকরি না থাকলে না খেয়েই অনেককে মরতে হতে পারে।

সরকার বার বার প্রয়োজনীয় সুরক্ষার ব্যবস্থা করে কারখানা চালু রাখতে বলছে মালিকদের। কারখানাগুলোকে শ্রমিকদের সামাজিক দূরত্ব ও সুরক্ষা নিশ্চিতে কিছু নীতিমালাও বেধে দিয়েছে সরকার। কিন্তু সেসব বিধি কি সবখানে মানা হচ্ছে? এরই মধ্যে সাভার ও নারয়ণগঞ্জের বেশ কয়েকজন শ্রমিকের করোনা শনাক্ত হয়েছে বলে অইইডিসিআর জানিয়েছে।

এদিকে সরকার ঘোষিত অনুদান পেলেও কারাখানা মালিকেরা মার্চের বেতন দিতে গড়িমসি করেন। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ ব্যবস্থা নেবে বললেও তেমন একটা পদক্ষেপ দেখা যায়নি। এরপরও শেষ তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৯৫ শতাংশ শ্রমিক মার্চের বেতন পেয়েছেন। যদিও অনেক কারখানা শ্রমিক ছাঁটাই করেছে।

গত সোমবার (৪ মে) সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, ঈদুল ফিতরেও কেউ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারবেন না। এক জেলা ও উপজেলা থেকে অন্য জেলা ও উপজেলায় যাওয়া কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে সরকার। ঈদের সময় বন্ধ থাকবে দূর পাল্লার পরিবহন। তবে ঈদ উপলক্ষে আগামী ১০ মে সীমিত আকারে খুলে দেওয়া হচ্ছে কেনাকাটার জন্য শপিং মলগুলো। খুলছে জামা-কাপড়ের বড় বড় হাট। একই সঙ্গে খুলতে শুরু করছে বিভিন্ন দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এসব জায়গায় মানুষের গাদাগাদিতে করোনা ঝুঁকি কয়েক গুণ বেশিই থাকছে। এছাড়া বৃহস্পতিবার (৭ মে) থেকে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে শর্ত সাপেক্ষে জোহর থেকে দেশের সব মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত ও তারাবির নামাজ আদায় করা যাবে বলে ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে।

ভবিষ্যৎ কী

সংক্রমণের প্রথম ৫৩ দিনে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী আট দেশের মধ্যে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা, মোট শনাক্ত হওয়া রোগী ও মোট সুস্থতার হার তুলনা করেছে ঢাকা ট্রিবিউন। তাদের প্রতিবেদনের তথ্য মতে, প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার ৫৩তম দিনে বাংলাদেশ মৃত্যুর হারের দিক থেকে সর্বোচ্চ ও সুস্থতার হারে সর্বনিম্ন অবস্থানের রেকর্ড গড়েছে। এর ফলে, এখন পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে আছে বাংলাদেশ।

করোনা আক্রান্ত রোগীদের সুস্থ করতে বিভিন্ন দেশ তাদের আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে শুরু করেছে। বিজ্ঞানীরা অনেকে অনেক কথা বলছেন। করোনা মহামারি থেকে কবে মুক্তি পাব, এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে আমরা কেউই বলতেও পারব না। এছাড়া গবেষকদের মতে, করোনা থেকে আমরা মুক্তি পেলেও তা একেবারে নয়। আবারও কোনো এক সময় বিশ্বের কোনো স্থানে করোনা দেখা দিতে পারে।

দেশে নমুনা পরীক্ষা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদিন বাড়ছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। তাই এই যে লকডাউন না মানা, কারখানা খোলা রাখা এবং শপিং খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী বলেই মনে হচ্ছে। ফলে করোনা রোধের বদলে বিস্তারের আশঙ্কাই থেকে যাচ্ছে। প্রথমদিকে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা পোশাক না থাকলেও এখন এর সংকট অনেকটা কমেছে। অনেক সাবধানতা মানার পরও এরা অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন। তাহলে শপিং মলে ক্রেতা কিংবা কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের ভিড়ে করোনা ঝুঁকিটা কতটুকু থাকছে? সে বিষয়গুলো আমাদের ভাবতে হবে। এটা ঠিক যে করোনার প্রাদুর্ভাবে আমাদের অর্থনীতি অনেকটাই স্থবির হয়ে গেছে। কিন্তু মানুষই যদি না বাঁচে এ অর্থনীতি কিসের জন্য? আর একটি বিষয়, সব কিছু খুলে দেওয়া হলেও করোনা কিন্তু শেষ হয়নি। তাই শপিং মল খোলা থাকলেই আমাদের হুমড়ি খেয়ে সেখানে যেতে হবে, বিষয়টি কিন্তু এমন নয়। করোনা ঝুঁকি নিয়ে বাজার, জিলাপির দোকান বা শপিং মলে আমরা যাব কি না, সে সিদ্ধান্ত কিন্তু আমাদের। দোকান-পাট খোলার কথা যেমন আমাদের জানানো হচ্ছে, তেমনি মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে করোনা ঝুঁকির কথাও। তাই আমাদেরই বুঝতে হবে, আমরা কোথায় কখন কেন যাব।

শাদরুল আবেদীন, নিউজরুম এডিটর, বার্তা২৪.কম