স্বাস্থ্যবিধি ও ফিজিক্যাল ডিসট্যান্স সমাচার
একটা দৃশ্য অনেকেই হয়তো টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছেন এরকম যে, রাস্তায় লাইন দিয়ে গায়ে গা ঘেঁষে পোশাক শ্রমিকরা কারখানায় যাচ্ছেন এবং ভেতরে ঢোকার সময় তারা বেশ সুশৃঙ্খল। যথাসম্ভব শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে এবং হাতে স্যানিটাইজার মেখে তারা ঢুকছেন। প্রবেশমুখে তাদের কপালের সামনে বিশেষ যন্ত্র দিয়ে শরীরের তাপমাত্রাও পরীক্ষা করা হচ্ছে। সবার মুখে মাস্কও আছে। এটাই স্বাস্থ্যবিধি।
প্রশ্ন হলো, তাদের রাস্তা দিয়ে কারখানায় আসা-যাওয়ার পথে শারীরিক দূরত্ব কতটা বজায় থাকলো? কারখানার ভেতরেও কি তারা প্রত্যেকে তিন থেকে ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রাখছেন? তা না হয় মানা গেল। কিন্তু এই শ্রমিকরা যেখানে থাকেন, ছোট্ট একটি ঘরে যেভাবে তারা গাদাগাদি করে বসবাস করেন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, কমন টয়লেট, কমন রান্নাঘর। সেখানে কীসের স্বাস্থ্যবিধি আর কীসের ফিজিক্যাল ডিসট্যান্স? কারখানার ভেতরে শারীরিক দূরত্ব আর স্বাস্থ্যবিধি মানলেই কি তারা করোনামুক্ত থাকবেন? এটা কি একধরনের পরিহাস নয়?
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের মতো অতি ঘনবসিতপূর্ণ দেশে পোশাক শ্রমিকসহ এরকম নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে ফিজিক্যাল ডিসট্যান্স ও স্বাস্থ্যবিধি আসলেই কি কোনো বার্তা বহন করে? যখন এই শ্রমিকেরা শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে দেশের নানা প্রান্ত থেকে রাজধানী ঢাকায় এলেন, ফেরিঘাটের যে ভয়াবহ দৃশ্য গণমাধ্যমে এসেছে, সেখানে শারীরিক দূরত্ব আর স্বাস্থ্যবিধির সবক কোথায় ছিল? অথচ প্রায় সব শ্রমিক ঢাকায় আসার পরে পোশাক মালিকরা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানালেন, ঢাকায় ঢুকতে গেলে কারখানার আইডি কার্ড দেখাতে হবে। এই ঘোষণাটির কোনো মানে আছে কি? সব মিলিয়ে একটা গোঁজামিলের মধ্যেই চলছে করোনাকালীন পোশাক খাত। যার প্রমাণ অনেক শ্রমিকের করোনায় আক্রান্ত হওয়া। কিন্তু পোশাক মালিকরা জানিয়েছেন, কতজন শ্রমিক আক্রান্ত হলেন, নিরাপত্তার খাতিরে সেটি তারা জানাবেন না। কী দুর্দান্তর সিদ্ধান্ত। প্রশ্ন হলো, কতজন শ্রমিক মারা গেলেন, সেই তথ্য ওনারা জানাবেন তো?
এরকম অবস্থার ভেতরেই সরকারের তরফে সাধারণ ছুটির (লকডাউন নয়) মেয়াদ ১৬ মে পর্যন্ত বাড়ানো ঘোষণার দেয়া হয়েছে। সাথে সাথে এও জানানো হয়েছে যে, ঈদ সামনে রেখে শপিং মল খোলা রাখা যাবে। বলা হয়েছে, বিকাল ৫টা পর্যন্ত শপিং মল খোলা রাখা যাবে এবং মার্কেটে প্রবেশপথে হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে। প্রথমে জানা গেলো ৫ মে থেকেই শপিং মল খুলবে। এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র সমালোচনা শুরু হলে পরে সরকারের তরফে জানানো হলো, শপিং মল খুলবে ১০ মে থেকে।
প্রশ্ন হলো, বিকাল ৫টা পর্যন্ত কি করোনা ছড়ায় না? আর শপিং মলে প্রবেশের সময় না হয় সবাই স্যানিটাইজারে হাত ধুয়ে ঢুকলেন, সবার মুখে না হয় মাস্কও থাকলো, কিন্তু ভেতরে ঢোকার পরে কেনাকাটার সময় তারা কি তিন থেকে ছয় ফুট শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারবেন? এটা কি বাস্তবসম্মত? তাছাড়া এক ছাদের নিচে, একই দোকানে, পাশাপাশি বসে-দাঁড়িয়ে-হাঁটাচলা করে অনেক লোক কথা বলবেন, সবাই হয়তো দীর্ঘ সময় মাস্ক পরে থাকবেন না, তারা নিঃশ্বাস নেবেন, কেউ হাঁচি কাশিও দেবেন, সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধির কী হবে, আর শারীরিক দূরত্বেরই বা কী হবে? এসব বাস্তবতা মাথায় রেখেই স্বাস্থ্যমন্ত্রীও শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন যে, শপিং মল খুললে করোনার সংক্রমণ বাড়তে পারে।
তাহলে কী করা যেতো? যেহেতু ১৬ তারিখ পর্যন্ত সাধারণ ছুটি বাড়ানো হয়েছে, অতএব শপিংমল ১৬ তারিখের পরে সীমিত পরিসরে খোলার সিদ্ধান্তটি যথাযথ হতো। যেহেতু করোনার সামাজিক সংক্রমণ হয়েই গেছে, অতএব এবারের ঈদ সামনে রেখে শপিং মলগুলো না খুললে আরও ভালো হতো। কারণ এবার অসংখ্য মানুষের ঈদ এমনিতেই হবে না। যাদের পরিবারে কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, মৃত্যু হয়েছে, যারা কর্মহীন হয়েছেন, সেসব পরিবারে এবার ঈদ হবে না। সুতরাং জীবনে একবার ঈদ না করলে কী এমন ক্ষতি হবে? আর ব্যবসায়ীদের যে অর্থনৈতিক ক্ষতির কথা বলা হচ্ছে, সরকারের ঘোষিত প্রণোদনার সুষম বণ্টন হলে সে সমস্যারও সমাধান সম্ভব ছিল।
এর মধ্যে মসজিদও খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যদিও মসজিদের ভেতরে শারীরিক দূরত্ব এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বেশ কিছু শর্ত দেয়া হয়েছে। কিন্তু কতজন লোক এইসব শর্ত মানবেন এবং মেনে চলা কতটা বাস্তবসম্মত, সে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ারও সুযোগ নেই।
২.
করোনার শুরু থেকেই যে জিনিসটি খুব স্পষ্ট তা হলো, সরকার আসলে ব্যবসায়ীদের স্বার্থের বাইরে গিয়ে খুব বেশি কিছু করতে পারছে না। যেসব যুক্তিতে পোশাক কারখানা খোলা হয়েছে, সেগুলো খুব শক্ত নয়। যখন সারা বিশ্বে লকডাউন, যখন আন্তর্জাতিক ক্রেতারা তাদের অর্ডার বাতিল অথবা স্থগিত করেছে, যখন পোশাকের বিক্রি হবার কোনো সম্ভাবনা নেই, সেই সময়ে গার্মেন্টস কারখানা খোলার কী এমন জরুরত ছিল? সব কারখানা কি পিপিই বা মাস্ক বানায়?
এরইমধ্যে বিভিন্ন কারখানায় বেতনের দাবিতে শ্রমিকদের বিক্ষোভও হয়েছে। যখন সরকারের তরফে বারবার শারীরিক দূরত্ব আর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার তাগিদ দেয়া হচ্ছে, তখন শত শত শ্রমিক এক জায়গায় জড়ো হয়ে যেভাবে বিক্ষোভ করলেন, তাতে ওই বিক্ষোভকারীদের মধ্যে যদি একজনও করোনায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি কতজনের মধ্যে তা ছড়িয়েছেন—তার হিসাব আছে? এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা সরকার কী করেছে? এরকম একটি সময়েও শ্রমিকদের বেতনের জন্য বিক্ষোভ করতে হবে কেন? যে পোশাক খাত নিয়ে সরকার ও ব্যবসায়ীদের গর্বের সীমা নেই, দেশের অর্থনীতির অন্যতম লাইফ লাইন বলা হয় যে খাতকে, সেই খাতের শ্রমিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ করে কি তাহলে শুভঙ্করের ফাঁকিটা দেখিয়ে দিলেন?
আমাদের দেশে করোনা মোকাবেলায় নেয়া পদক্ষেপগুলো নিয়ে শুরু থেকেই নানারকম প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। সেটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ব্রিফিং হোক, আর রাস্তায় মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণে নেয়া পদক্ষেপই হোক। উপরন্তু শুরু থেকেই বলা হচ্ছে সাধারণ ছুটি। কেবল যেসব ভবনে বা এলাকায় করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে সেখানে ‘লকডাউন’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এবারও যখন ১৬ মে পর্যন্ত ছুটি বাড়ানো হলো, তখনও সাধারণ ছুটি শব্দটি ব্যবহার করা হলো। সামগ্রিকভাবে ‘লকডাউন’ শব্দটি ব্যবহারে অসুবিধাটা কোথায়, সেটিই পরিষ্কার নয়। এই শব্দ ব্যবহারে সাংবিধানিক কোনো বাধা থাকার কথা নয়। কিন্তু যখনই বলা হচ্ছে ছুটি বা সাধারণ ছুটি, মানুষ সেটিকে পাত্তা দিচ্ছে না। তারা বরং ছুটির মেজাজে বাইরে বের হচ্ছে।
করোনা মোকাবেলায় শুরু থেকেই আমাদের যে স্ট্র্যাটেজিক্যাল ভুল ছিল বলে মনে হয় তা হলো—আমাদের বারবার বলা হয়েছে, ভয় পাবেন না, সতর্ক থাকুন। বাঙালির সমস্যা হলো, তারা ভয় না পেলে সতর্ক হয় না। ফলে যখন ভয় না পেয়ে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেয়া হলো, মানুষ ওটাকে সিরিয়াসলি নেয়নি। না নিয়ে সিরিয়াসলি ঘরে থাকেনি। স্বাস্থ্যবিধি মানেনি। বরং শুরু থেকেই যদি সবার মনে মৃত্যুর ভয় ঢুকিয়ে দেয়া যেতো এবং গণমাধ্যমে এই ভয়টাই প্রচার করা হতো, তাহলে আজকে মনে হয় পরিস্থিতি খারাপ থেকে খারাপতর হতো না। বরং প্রতিদিন করোনা শনাক্ত এবং মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকলেও প্রতিদিন সারা দেশে মানুষের অবাধ চলাচলের যেসব ছবি গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা যাচ্ছে, তাতে ফিজিক্যাল ডিসট্যান্স আর স্বাস্থ্যবিধি শব্দগুলো হাস্যরস সৃষ্টি করছে। সরকারের ধরি মাছ না ছুঁই পানি সিদ্ধান্ত আর ‘অকুতোভয়’ মানুষের করোনাকে পাত্তা না দেয়ার মানসিকতা শেষমেশ আমাদের আক্রান্ত আর মৃত্যুর মিছিল কতটা দীর্ঘ করবে, সেটি দেখার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, রংধনু টেলিভিশন।