করোনার সাথে সহাবস্থান!
গত সপ্তাহ দুয়েক আগে এই কলামে লিখেছিলাম, ‘হয় কারফিউ দিন, নয় সবকিছু খুলে দিন’। আমার মত তুচ্ছ সাংবাদিকের লেখা কেউ পড়ে বলে মনে হয় না। আমার ধারণা হয়তো সরকারের কেউ শিরোনামটি দেখে থাকবেন। তাতেই হয়তো তারা দ্বিতীয় বিকল্পটি বেছে নিয়েছেন। কিন্তু পুরো লেখাটি পড়লে বুঝতেন, আমি আসলে কারফিউ চেয়েছি, খুলে দেয়ার বিকল্পটি আমার অভিমানের কথা। কিন্তু সরকার আমার অভিমানের ভাষা বোঝেনি। তারা বরং ধীরে ধীরে ‘লকডাউন’ পরিস্থিতি শিথিল করার দিকে এগুচ্ছে।
বাজারের ওপর তো সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কখনোই ছিল বলে মনে হয়নি। শুরু থেকেই বাজারে ছিল ‘সাধারণ ছুটি’র উৎসবমুখর পরিবেশ। নানান টালবাহানা করে খুলে দেয়া হয়েছে গার্মেন্টস। ঈদের আগে মানুষের শপিং নিশ্চিত করার জন্য খুলে দেয়া হচ্ছে শপিং মলগুলো। বাংলার ঘরে ঘরে যেন ঈদ লেগেছে।
অথচ বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি কিন্তু আস্তে আস্তে খারাপের দিকে যাচ্ছে। যেদিন শপিং মল খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত এসেছে, সেদিনই বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ৬৮৮ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আর আক্রান্তের সংখ্যাটা ছাড়িয়েছে ১০ হাজারের ‘ম্যাজিক ফিগার’। শপিং মল খুলে দেয়ার জন্য সরকার এই 'শুভক্ষণ'কেই বেছে নিয়েছে।
আমি জানি অর্থনীতির চাকা অচল করে অনন্তকাল সাধারণ ছুটি চলতে পারে না। আমরা জানি, জীবনের সাথে জীবিকারও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। কিন্তু জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই। আস্তে আস্তে সাধারণ ছুটিও শিথিল করতে হবে। কিন্তু তার প্রায়োরিটি ঠিক করতে হবে সরকারকেই। শপিং মল নিশ্চয়ই অর্থনীতির জন্যও জরুরি কিছু নয়। অনেকদিন ধরেই আমার মনে হচ্ছে, সরকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কথায় নয়; চলছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা ব্যবসায়ীদের কথায়। ব্যবসায়ীরা চাইছেন বলেই গার্মেন্টস খুলেছে, তারা চাইছেন বলে শপিং মল খুলছে। তারা তো চাইবেনই। কিন্তু জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা কি এই সিদ্ধান্তের সাথে একমত? জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি কি শপিং মল খোলার পরামর্শ দিয়েছেন সরকারকে?
বরং বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে আমার যেটা মনে হয়েছে, বাংলাদেশ এখনও করোনা সংক্রমণের চূড়াটা স্পর্শ করেনি। শপিং মল খোলার পরদিন মানে মঙ্গলবার আক্রান্তের নতুন রেকর্ড হয়েছে- ৭৮৬, সেই রেকর্ডও পরদিন মানে বুধবারেই ভেঙ্গেছে- ৭৯০। তারমানে আমাদের সামনে আরো খারাপ সময় অপেক্ষা করছে। রেকর্ডভাঙা এই সংক্রমণ কোথায় গিয়ে থামবে এখনও কেউ জানি না।
গত ২৬ মার্চ থেকে দেশজুড়ে ‘সাধারণ ছুটি’ চলছে। শুরু থেকেই আমি বলছিলাম, ‘সাধারণ ছুটি’ টার্মটিই বিভ্রান্তিকর। সবাই ছুটির আমেজেই যেন আছে। সরকার ছুটি দিয়েছিল ঘরে থাকার জন্য। কিন্তু মানুষ দলে দলে বাড়ি ফিরেছে, উৎসবের আমেজে প্রতিদিন বাজারে গেছে। সাধারণ ছুটি ৪০ দিন পেরিয়েছে। সরকার যদি এই ৪০ দিন সত্যি সত্যি লকডাউন কার্যকর করতে পারতো, তাহলে নিশ্চয়ই এখন আমরা শিথিলের দিকে যেতে পারতাম। কিন্তু কেন জানি না, সরকার শুরু থেকেই পুরো বিষয়টায় সফট ছিল। মানুষকে ঘরে রাখতে কখনোই সরকার কঠোর হয়নি। আইন প্রয়োগ করেছে, কিন্তু বলপ্রয়োগ করেনি। কেন? সমালোচনার ভয়ে? কিন্তু জনগণের স্বার্থেই সরকারের কঠোর হওয়া উচিত ছিল। সরকারের নরম থাকার সুযোগে মানুষ দলে দলে বাড়ি গেছে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিয়ে মালিকরা পিংপং খেলেছে। বিকেলে অলিতে গলিতে ছিল ‘ভাল্লাগে না’ গ্রুপের দাপট। এমনকি জানাজায় লক্ষাধিক মানুষের সমাগমের মত অবিশ্বাস্য ঘটনাও ঘটেছে এই বাংলাদেশে। এইভাবে করোনার বিস্তার ঘটেছে দেশজুড়ে।
অথচ বাস্তবতা হলো, সাধারণ ছুটিকে অল্প সময়ের জন্য হলেও লকডাউন, ইমার্জেন্সি বা কারফিউতে উন্নীত করা দরকার ছিল। ‘সাধারণ ছুটি’র সফট টার্মে মানুষ বিষয়টা ঠিক উপলব্ধি করতে পারছে না। অথচ এই সময়েই সরকার ধাপেধাপে ছুটি শিথিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আগামী ১০ মে থেকে শপিং মল খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে দেখি ফেসবুকে সমালোচনার সুনামি। সমালোচনার অবশ্য কারণও আছে। আপনি একদিকে বলবেন, ঘরে থাকুন, আবার শপিং মলও খুলে দেবেন; তাতো হয় না। তবে সরকারের সমালোচনা করার পাশাপাশি আমাদের হাতে আরেকটা অস্ত্র আছে, শপিং মলে না যাওয়া। তাহলেই সরকারের উচিত শিক্ষা হবে। আর এবার চারদিকে যে অভাবের পদধ্বনি, তাতে একটা ঈদ না হয় আমরা নতুন কাপড় ছাড়াই পাড় করি। ঈদের জন্য রাখা টাকাটা গরীব মানুষকে দিন। বিশ্বাস করুন, ঈদের চেয়ে আনন্দ বেশি হবে, পুণ্যও হবে।
আসুন শুধু ফেসবুকে সমালোচনা না করে শপিং বর্জন করে সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাই। সরকার কিন্তু আপনাকে জোর করে ধরে শপিং মলে নেবে না। ইতিমধ্যেই বসুন্ধরা শপিং মল সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে তারা এখনই মল খুলবে না।
শুরু থেকেই আমি সর্বাত্মক লকডাউনের পক্ষে ছিলাম। সেটা পুরোপুরি না হলেও ধাপে ধাপে সরকার অনেককিছুই কমিয়ে এনেছিল। এমনকি অনেক ঝুঁকি নিয়েও ৬ এপ্রিল থেকে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডাসহ সব ধরনের উপাসনালয় বন্ধ রাখা হয়। বাংলাদেশের জন্য মসজিদ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত অবশ্যই সাংঘাতিক স্পর্শকাতর। কিন্তু তাও স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় সেটা করতে হয়েছে। তবে মসজিদ পুরোপুরি বন্ধ না করে সাধারণ নামাজে ৫ জন, জুমার নামাজে সর্বোচ্চ ১০ জনের জামাতের অনুমতি দেয়া হয়। তবে শর্ত হলো, বাইরে থেকে কেউ এই জামাতে অংশ নিতে পারবে না। শুধু মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেমরাই এই জামাতে অংশ নেয়ার কথা।
রমজান আসার পর তারাবির নামাজে জামাতে আরও দুইজন হাফেজকে জামাতে অংশ নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়। মানে হলো, তারাবির জামাত হবে সর্বোচ্চ ১২ জন। কিন্তু ৫ জন হোক, ১০ জন হোক আর ১২ জন; কারোই কিন্তু বাইরে থেকে যাওয়ার কথা না। অথচ এই নিয়ম মানা হয়নি। ইমাম ছাড়া বাকি সবাই বাইরে থেকে গিয়ে জামাতে অংশ নিয়েছেন। গ্রামের দিকে অনেকেই জামাতে নামাজ পড়েছেন। যিনি বেশি প্রভাবশালী তিনিই জামাতে অংশ নেয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। এ নিয়ে মসজিদের ইমামরা খুব বিপদে ছিলেন। মসজিদে এসেও জামাতে অংশ নিতে না পারা নামাজীরা তাদের দেখে নেয়ার হুমকি দিতো। তাদের সেই বিপদ কেটেছে। মসজিদও খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সবকিছু খুলে দেয়ার পর শুধু মসজিদে জামাত বন্ধ রাখার কোনো মানেই হয় না। বরং সামনে যে ঝুঁকি, তাতে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া আমাদের উপায় নেই।
তারচেয়ে বড় কথা ঝুঁকিতেও সমতা থাকা দরকার। কালই এক শেয়ার ব্যবসায়ী ফোন করে বললেন, সরকার শপিং মল খুলে দিচ্ছে, অথচ স্টক এক্সচেঞ্জ বন্ধ। অথচ অর্থনীতিকে সচল করতে পুঁজিবাজার আগে খোলা উচিত। কারণ ডিজিটাল বাংলাদেশে ন্যূনতম লোকের উপস্থিতিতে ঘরে বসেই স্টক এক্সচেঞ্জ চালু রাখা সম্ভব। এমনকি মোবাইলেও শেয়ার কেনাবেচা করা যায়। চাইলে সম্পূর্ণ লকডাউনেও স্টক এক্সচেঞ্জ চালু রাখা যেতো। বিশ্বের অনেক দেশে লকডাউনেও পুঁজিবাজার সচল ছিল। তার দাবি, অবিলম্বে দেশের দুই পুঁজিবাজার খুলে দেয়ার।
তবে আমি এই মুহূর্তে গার্মেন্টস খোলার বিপক্ষে, বাজারে ভিড়ের বিপক্ষে, শপিং মল খোলার বিপক্ষে, শেয়ারবাজার খোলার বিপক্ষে, এমনকি মসজিদ খোলারও বিপক্ষে। আমার কাছে নিরাপত্তাটাই সবার আগে। মানুষের জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই। তবে খোলাই যখন হচ্ছে, তখন আর বৈষম্য করে লাভ কী। আস্তে আস্তে সবকিছু খুলে দেয়া হোক। করোনার সাথেই হোক আমাদের বসবাস। করোনার সাথে লড়াই হবে। যে জিতবে জিতবে, যে হারবে হারবে। যার যার নিরাপত্তা তাকেই নিশ্চিত করতে হবে। বাস্তবতা মেনে সরকার আস্তে আস্তে সব খুলে দিবে। কিন্তু কোথায় যাবেন, কী করবেন সে সিদ্ধান্ত আপনার। আপনার নিজের জীবন নিরাপদ রাখার দায়িত্বও আপনার। সরকারকে গালি দেয়ার আগে নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। সরকারকে গালি দিলেই করোনা দূরে থাকবে না।
প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।