নন-কোভিড রোগীদের মৃত্যুর দায় নেবে কে?
‘বাবার আইসিইউ সাপোর্টটা খুব দরকার ছিল, কিন্তু তা পাওয়া যায়নি। বাবার চিকিৎসাই হলো না, তিনি মারা গেলেন। আমি ডাক্তার হয়েও কিছু করতে পারলাম না। বাবার কিডনির সমস্যা ছিল, নিয়মিত ডায়ালাইসিস পেতেন। ডায়ালাইসিসের সময় প্রায়ই হঠাৎ করে প্রেসার বেড়ে যেত, শ্বাসকষ্ট হতো, ফুসফুসে পানি চলে আসত। আইসিইউ সাপোর্ট হলে ঠিকও হয়ে যেত।’- এই কথাগুলো ডা. সুস্মিতা আইচের।
পিতার করুণ মৃত্যুর পর সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় তিনি আক্ষেপ করে এসব বলেন। সুস্মিতা হচ্ছেন চিকিৎসা না পেয়ে শনিবার রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে মারা যাওয়া সরকারের একজন অতিরিক্ত সচিব গৌতম আইচ সরকারের মেয়ে।
একজন চিকিৎসক হয়েও সন্তান তার বাবাকে প্রয়োজনীয় এবং নূন্যতম চিকিৎসাটুকু দিতে পারেননি। বাবার চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটে গিয়েছেন। সরকারের একজন অতিরিক্তি সচিব বিনা চিকিৎসায়, চিকিৎসকদের অবহেলায় এবং যথা সময়ে হাসপাতালে ভর্তি না নেওয়ায় মারা গেছেন। গৌতম আইচ কোভিড-১৯ এর রোগী ছিলেন না। তিনি একজন কিডনি রোগী। তাকে নিয়মিত ডায়ালাইসিস নিতে হতো। ওই সময়টায় তার প্রেসার বেড়ে যেত, শ্বাসকষ্ট হতো, ফুসফুরে পানি চলে আসতো।
সুস্মিতার তথ্য অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে তার বাবার ডায়ালাইসিসের সময় প্রেসার বাড়ার পাশাপাশি শ্বাসকষ্ট শুরু হলে ল্যাবএইডের ইমার্জেন্সি থেকে তাকে ফোন করা হয়। তিনি তার বাবাকে ল্যাবএইডে ভর্তি করতে বলেন। কিন্তু কনসালটেন্ট নেই, এই কারণে তারা ভর্তি করতে অপরাগতা জানান। এও জানান, তারা আইসিইউ সাপোর্টও দিতে পারবেন না। অথচ তার বাবার তখন অক্সিজেন দরকার। তাই বিকেল ৪টায় ডায়ালাইসিস শেষ হওয়ার পর গৌতম আইচকে নিয়ে প্রথমে ইউনাইটেড হাসপাতালে যান। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, এ কারণে কোভিড-১৯ টেস্ট না করে তারা তাকে ভর্তি নেয়নি।
চিকিৎসক মেয়ে তার বাবার রোগের আদ্যপান্ত জানিয়ে বলেন, তার বাবা কিডনি রোগী, তাই আইসিইউ দরকার। কিন্তু তারা রেফারেন্স ছাড়া ভর্তি নেবে না। এরপর একে একে গৌতম আইচকে নিয়ে মহাখালীর ইউনিভার্সেল হাসপাতাল, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল, স্কয়ার হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী কার্ডিয়াক ও মিরপুর রিজেন্ট হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু কোথাও তাকে ভর্তি করাতে পারেননি। সবার একটাই বক্তব্য কোভিড-১৯ টেস্ট করে নিয়ে আসেন। কিন্তু কোনো হাসপাতালই নিজেরা টেস্ট করে রোগীকে নিতে চায়নি। অথচ দিন কয়েক আগেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালকে কোভিড-১৯ টেস্ট করার অনুমোদন দেয়। যার মধ্যে ইউনাইটেড ও স্কয়ার হাসপাতাল রয়েছে। এসব হাসপাতাল তাদের ভর্তিকৃত রোগীদের টেস্ট করতে পারবে। এক্ষেত্রে গৌতম আইচকে ভর্তি করে টেস্ট করা যেত। কিন্ত সেটা করা হয়নি।
অবশ্য সুস্মিতা সর্বশেষ এক আত্মীয়ের রেফারেন্সে শুক্রবার তার বাবাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে (বর্তমানে কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য ডেডিকেটেড) ভর্তি করিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। এমনকি মৃত্যুর আগে টেস্টও করা যায়নি।
বিনা চিকিৎসায় গৌতম আইচের মৃত্যু আরেকবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, এই করোনাকালে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা ও সমন্বয়হীনতা কতোটা প্রকট। এমনিতেই আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার বেহাল অবস্থা। তার ওপর গত দুই মাসে এই বেহাল ও বিশৃঙ্খল অবস্থা আরো ব্যাপকভাবে ফুটে উঠেছে। গৌতমের মতো আরও বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে সারাদেশেই। বিনা চিকিৎসায় বেশ কয়েকজন মারা গেছেন। যারা ছিলেন নন-কোভিড রোগী।
এই তো গত সপ্তাহে প্রান্তিক জেলা সাতক্ষীরায় এক গর্ভবতী মা সন্তান প্রসবের আগে চিকিৎসার জন্য সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে যান ভ্যানে করে। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে ভর্তিই করেনি। একপর্যায়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে ভ্যানের মধ্যেই তিনি সন্তান প্রসব করেন। ভাগ্যিস তিনি কোনো দুর্ঘটনার শিকার হননি।
অথচ আমাদের সংবিধানে ১৫ অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব।
দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী প্রথম শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। তারপর থেকে দুই মাস চার দিন পার হয়ে গেছে। এই ৬৪ দিনেও কোভিড-১৯ রোগী এবং নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসা কীভাবে হবে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিতে পারেনি আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগ।
রাজধানীতে প্রথমে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালকে কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য ডেডিকেটেড করা হয়। এরপর রোগী বাড়তে থাকলে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালকে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়। এভাবে পর্যায়ক্রমে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ৩৫০ শয্যা, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ২০০ শয্যা, সোহরাওয়ার্দীতে ১০০ শয্যা বরাদ্দ করা হয়। এর বাইরে একাধিক প্রাইভেট হাসপাতালকেও ডেডিকেটেড করা হয় কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, যেসব হাসপাতাল নন-কোভিড বা সাধারণ রোগীদের জন্য সেই হাসপাতালগুলোতেই এখন চিকিৎসা পাচ্ছেন না সাধারণ রোগীরা। করোনার নূন্যতম উপসর্গ রয়েছে, সন্দেহ হলেই রোগীকে ভর্তি তো দূরের কথা ছুঁয়েও দেখছেন না চিকিৎসকরা। এমন অনেক রোগী আছেন, যারা কিডনি, হার্টের কিংবা অন্য কোনো জটিল সমস্যায় ভুগছেন, তাদের ক্ষেত্রে হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন হলে স্বজনরা যখন অ্যাম্বুলেন্স কিংবা অন্য কোনো বাহনে করে হাসপাতালে নিয়ে যান, তখন আর ভর্তি করতে পারেন না। তারা হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় রোগী পরপারে পাড়ি জমান। যথাযথ চিকিৎসা পাওয়া যাচ্ছে না- এ কারণে এখন দেশের প্রায় সব হাসপাতালেই রোগীর উপস্থিতি কমে গেছে। তার মানে এই নয় যে দেশে রোগীর সংখ্যা কম।
করোনার এই সময়ে এখন পুরো স্বাস্থ্য সেবাটাই দেখছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্পষ্ট করে বললে অধিদপ্তরের মহাপরিচালকই হচ্ছেন এসব বিষয়ে সর্বেসর্বা। তিনিই সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার একক ক্ষমতা রাখেন। যেহেতু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিব টেকনিক্যাল পারসন না, তাই মহাপরিচালকের সিদ্ধান্তই এখন চূড়ান্ত। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার পরও ডিজি এখন পর্যন্ত নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসার ব্যাপারে কোনো সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারেননি। আবার মাঝে মধ্যে দু’একটা নির্দেশনা দিলেও হাসপাতালগুলো এবং চিকিৎসকরা তার সেই নির্দেশনাকে কোনো তোয়াক্কাই করছেন না। এর পাশাপাশি করোনার এই দুর্যোগময় মুহূর্তে চিকিৎসকদের মধ্যেও রয়েছে নানান বিভেদ। আছে নানান রাজনীতি। এসব কারণে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সমন্বয়হীনতা। ফলে করোনাকালেও স্বাস্থ্যসেবার বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। এসব কিছুর গ্যাঁড়াকলে পড়ে সাধারণ রোগীদের অবস্থা সংকটাপন্ন।
এই সংকটের উত্তোরণ ঘটাতে না পারলে আর নিজেদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দূর করা না গেলে সংকট কাটবে না। করোনা আক্রান্ত হয়ে যে মৃত্যু হবে, তার চেয়ে বিনা চিকিৎসায় ঢের বেশি মৃত্যু ঘটবে সাধারণ রোগীদের। যা একেবারেই অপ্রত্যাশিত ও অনাকাঙিক্ষত। চিকিৎসকদের অবহেলা আর দায়িত্বহীনতায় চিকিৎসা না পেয়ে এমন মৃত্যুকে স্বাভাবিক মৃত্যু না বলে যে কেউ এটিকে হত্যাকাণ্ড বললেও অত্যুক্তি হবে না। আর এই মৃত্যুর দায়-ই বা কে নেবে? তাই আর সময় নষ্ট না করে সঠিক দিক নির্দেশনা ও এর কঠোর বাস্তবায়ন এখন জরুরি।
লেখক: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।