ডাক্তারদের প্রতি কৃতজ্ঞতা
বিশ্বে ১৬ লাখের বেশি মানুষ করোনাভাইরাস থেকে সুস্থ হয়েছেন। এই সংখ্যা আরও বাড়বে। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে যতো না মানুষ মারা যাচ্ছেন, তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছেন।
মানুষকে নতুন প্রাণের দিকে নিয়ে যাওয়ার মূল কৃতিত্বই কিন্তু চিকিৎসকদের। পুরো স্বাস্থ্য সেবার সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট তাদের। তারা আছেন বলেই আমরা ফিরে পাচ্ছি আমাদের মা, বাবা, ভাই, বোন, আত্মীয়-স্বজনদের। তারা আছেন বলেই, নতুন এ রোগকে জয় করার সাহস মনে বাসা বাঁধছে কোটি মানুষের। গোটা বিশ্বেই ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা চিকিৎসকরা।
বাংলাদেশেও চিকিৎসকদের তুলনা হয় না। প্রথমে অবশ্য ঝুঁকি নিরসন করার দাবি তুলে সেবা দিতে না চাওয়া নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু দিন যত গেছে, এই জটিলতা কমে এসেছে। কোভিড-১৯ যুদ্ধের শুরুতে যতোটা না চিকিৎসকদের অনীহা দেখেছি, যুদ্ধের মাঝ পথে তা শক্তিতে পরিণত হতেও দেখছি। জান বাজি রেখে কাজ করছেন আমাদের চিকিৎসকরা। সেবিকারাও। তারাই এখন প্রকৃত বীর। যারা করোনা রোগীদের সেবা দিচ্ছেন, তারা প্রতিদিনই নিজের জীবন হাতে রেখে বের হচ্ছেন বাড়ি থেকে। ঝুঁকি কিন্তু তিনি একা বহন করছেন না, পরিবারের সদস্যরাও রয়েছেন ঝুঁকিতে।
জ্বর, গলা ব্যথা, শরীর ব্যথাসহ বেশ কিছু উপসর্গ নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিভার হসপিটালে করোনা টেস্ট করাতে গিয়েছিলাম। কিট সংকটের মধ্যেও সাধ্য মতো সেবা দিতে দেখেছি চিকিৎসকদের। অনেক রোগীকে তারা নির্দিষ্ট দিনে পরীক্ষা করাতে পারেননি, কিন্তু সুন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে বুঝিয়েছেন সীমাবদ্ধতার কথা।
করোনা পরীক্ষার আগে চিকিৎসক যখন রোগী দেখেন, তখন তিনি পরেন ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই)। গরমের মধ্যে এটা পরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিরক্তিহীনভাবে শোনেন রোগীর কথা। দূর থেকে এই শোনার কার্যক্রম চলছে। এক রুমের শেষ প্রান্তে দু’জন চিকিৎসক, অন্য প্রান্তে দু’জন রোগী। সঙ্গে থাকেন একজন সহকারী, তিনিও পিপিই পরা। তিনি রোগীর হাত থেকে ব্যবস্থাপত্র নিয়ে চিকিৎসককে দেন। এরপর লিখে দেওয়া হয় ওষুধ, পরীক্ষা করানোর প্রয়োজন পড়লে করা হয় পরীক্ষা। পাশের পিসিআর ল্যাবেও (পলিমারেজ চেইন রি-অ্যাকশন) আন্তরিকতার সঙ্গে নমুনা নেওয়া হয়। রোগীর সঙ্গে কথা বলে দেওয়া হয় সাহস। এই রোগ জয় করতে ওষুধের চেয়ে মনের সাহস ও আত্মবিশ্বাসই যে বড় বিষয়, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা এই চর্চা আরও বাড়ালে পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হটলাইনগুলোতেও (১৬২৬৩ অথবা ০১৯৪৪৩৩৩২২২) সেবা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই। অনেক মানুষ সাধারণ সেবা পাচ্ছেন ফোনে ফোনে। হালকা জ্বর কিংবা জ্বর জ্বর ভাব, সর্দি, কাশি সংক্রান্ত সমস্যার জন্য ফোনেই এসএমএসের মাধ্যমে ওষুধ পাচ্ছেন মানুষ। এতে অনেকে ঘরে বসেই সাধারণ ছুটির মধ্যেও সুস্থ হয়ে উঠেছেন। আবার উপসর্গ শুনে করোনা টেস্ট করানোর দরকার কিনা সেটির নির্দেশনাও হটলাইনের মাধ্যমে মিলছে। তাই করোনা হয়েছে কিনা, টেস্ট করা জরুরি কিনা তা জানতে আগে হটলাইনে যোগাযোগ করা জরুরি।
বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের পর এবার ঢাকা মেডিকেলের একটা ঘটনা বলি। বাইরের রোগীদের জন্য সেখানেও করোনা টেস্টের ব্যবস্থা হয়েছে কিছু দিন। ফিনল্যান্ড ভিত্তিক স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান অলওয়েল ডটকমের (olwel.com) সহায়তায় এ কাজ করা হয়। সেখানকার চিকিৎসক তুষার মাহমুদ জানান, যতোটা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করা যায়, তিনি এবং তার টিম করছেন। করোনা পরীক্ষা ছাড়াও প্রতিদিন বহু সাধারণ মানুষের ফোন কল তাকে ধরতে হয়। উপসর্গ শুনে সাধারণ ওষুধ দেওয়ার চেষ্টা করা ছাড়াও মূল দিকনির্দেশনা বা পরবর্তী করণীয় বলতে হয়। এই কাজগুলো তাকে চালিয়ে যেতে হচ্ছে মানবতার সেবা হিসেবেই।
ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে দেখেছি, প্রচুর চিকিৎসক করোনা পরীক্ষা করছেন। সঙ্গে তাদের পরিবারের সদস্যরাও। একই চিত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেলেও ছিল। চিকিৎসকরা সেবা দিচ্ছেন যেমন, তেমনি আক্রান্তও হচ্ছেন প্রচুর। শুধু নিজেরাই না, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে হচ্ছেন আক্রান্ত। বিশ্বে শত শত চিকিৎসক এখন পর্যন্ত সেবা দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। বাংলাদেশেও এমন ঘটনা ঘটেছে। ৩ মে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক চিকিৎসক কর্নেল (অব.) অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান। এর আগে ১৪ এপ্রিল দেশে প্রথম চিকিৎসক হিসেবে করোনাভাইরাসে মৃত্যু হয় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. মঈন উদ্দিনের। তাদের আত্মদান চির স্মরণীয়। তাদের মৃত্যু নেই।
ডক্টরস ফাউন্ডেশনের এপ্রিলের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ৫৫৪ জন চিকিৎসক। এই সংখ্যা বর্তমানে আরও বেড়েছে।
চিকিৎসকদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও সাংবাদিকরাও কোভিড-১৯ যুদ্ধে ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা। তারাও রোজ আক্রান্ত হচ্ছেন। অন্য বাহিনীর সঙ্গে গড়ে শতজনের কাছাকাছি সারা দেশে আক্রান্ত হচ্ছেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও। পুলিশ বিভাগ ও সরকার তাদের সহায়তা করছে।
সাংবাদিকদের অবস্থাও কম ভয়াবহ নয়। বিশেষ করে টেলিভিশন সাংবাদিকদের। কারণ তাদের মাঠে থেকেই কাজ করতে হচ্ছে, খবর সংগ্রহ করতে হচ্ছে। সাংবাদিকদের করোনা পরীক্ষায় বিশেষ আন্তরিকতা নিয়ে চিকিৎসকরা এগিয়ে এসেছেন। এ কাজেও রয়েছে সেই অলওয়েল ডটকম।
সম্প্রচার সাংবাদিক সংস্থার (বিজেসি) উদ্যোগে ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সহযোগিতায় রাজধানীর মহাখালী কমিউনিটি সেন্টারে একটি বুথ স্থাপন করা হয়েছে। যেখানে গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য করোনা পরীক্ষা সহজ করতে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে সঙ্গে নিয়ে নমুনা পরীক্ষা চলছে। আগাম নিবন্ধন করে গণমাধ্যমকর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা করোনা পরীক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন। এই কার্যক্রমে ল্যাব, কিট, টেকনিশিয়ান ও ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা করছে গাজী গ্রুপ, সেবা দিচ্ছে অলওয়েল।
কথায় আছে, শেষ বেলায় খড়কুটো আঁকড়ে বাঁচার চেষ্টা করে মানুষ। আসলেই তাই। চিকিৎসকদের দোষ যেভাবেই ধরা হোক না কেন বাংলাদেশে এ কথা আজ প্রমাণিত যে গুটি কয়েক চিকিৎসকের জন্য পুরো পেশার মানুষকে আমরা মন্দ বলতে পারি না। এই চিকিৎসকরা আছেন বলেই আমরা সুস্থ আছি। তারা সঠিক চিকিৎসাটা করতে পারছেন। নতুন প্রাণের আলো দেখানো ডাক্তারদের স্যালুট। এই মুহূর্তে আপনাদের একটা ফোন কলও অসুস্থ ব্যক্তির কাছে খড়কুটোর মতো। ভালোবাসা নেবেন আপনারা। ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ। আরও বেশি বেশি মানবতার সেবা করে প্রমাণ করে দিন, সেবাই পরম ধর্ম আপনাদের, যেন ভবিষ্যতে আর কেউ সমালোচনা করতে না পারে।
সৈয়দ ইফতেখার: লেখক, সাংবাদিক।