মানুষ কেন ‘দ্যাশে’ যায়
করোনার ঝুঁকি মাথায় নিয়ে হাজার হাজার মানুষ ঢাকা ছাড়ছেন। ফেরিঘাটে তাদের উপচেপড়া ভিড়। অবস্থা বেগতিক দেখে ফেরি সার্ভিস বন্ধও করে দেয়া হয়। পদ্মা পার হতে ছোট নৌকার সহায়তায় বড় নৌযানে ওঠার সময় একটি নৌকা ডু্বেও গেছে। যদিও নদীর তীরেই নৌকাটি ডুবেছে বলে প্রাণহানির খবর মেলেনি। এইসব দৃশ্য গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় এসেছে, আসছে।
যারা যাচ্ছেন না তারা ফেসবুকে এসব ঘরফেরা মানুষের কড়া সমালোচনা করছেন। তাদের অবিবেচক, অদূরদর্শী বলে সম্বোধন, এমনকি গালাগালও করছেন। এখন প্রশ্ন হলো, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই মানুষগুলো কেন ঢাকা ছাড়ছেন, কেন তারা ঢাকায় এসেছিলেন এবং এখন কেন আবার সেই স্বপ্নের শহর থেকে ‘পালিয়ে’ যাচ্ছেন—সেই প্রশ্নের সঠিক উত্তর কি আমরা জানি?
একসময় বাংলা সিনেমার একটি গান বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল ‘ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইছে, লাল লাল নীল নীল বাতি দেইখা নয়ন জুড়াইছে’। ঢাকা হচ্ছে সেই আশা পূরণের শহর। রঙিন আলোর নিচ দিয়ে সাঁই সাঁই ছুটে চলা উদভ্রান্ত নাগরিকের শহর। যেহেতু এটা স্বপ্নের শহর, অতএব সেই স্বপ্নের দুঃস্বপ্ন হতেও সময় লাগে না। যেহেতু এটা আশা পূরণের শহর, অতএব গ্রাম থেকে আসা মানুষের আশাভঙ্গ হতে সময়ও লাগে না। ফলে তারা ‘দ্যাশে’ ফিরে যায়।
মানুষের কাছে দেশ আসলে তার জন্মস্থান। সেটি হয়তো কোনো একটি উপজেলা শহরের ছোট্ট গ্রাম। অথবা ছোট শহর। যে কারণে কোনো অল্প শিক্ষিত সাধারণ মানুষ যখন কারো সাথে পরিচিত হয়, তখন তাকে জিজ্ঞেস করে, আপনার দ্যাশ কই? বলে না যে আপনার বাড়ি কই? ফলে যখন সে জিজ্ঞেস করে আপনার দ্যাশ কই, তখন অন্যজন হয়তো জবাব দেয় বরিশাল, কুড়িগ্রাম, সাতক্ষীরা….। কেউ বলে না, আমার বাড়ি বাংলাদেশে। কারণ সবাই জানে দেশটার নাম বাংলাদেশ। কিন্তু সাধারণ মানুষ জানে, দেশ/ দ্যাশ আসলে নিজের বাড়ি। নিজের জন্মস্থান। যেখানে শেকড়। যেখানে মায়ের টান। যেখানে শৈশবে কাদায় মাখামাখি আর ধান-নদী-খালের মায়াভরা স্মৃতি। যেখানে বন্ধু-পরিজন। যেখানে নামলেই লোকেরা কাছে এসে বুকে জড়িয়ে ধরে। বলে, ‘কবে আইছো?’ অর্থাৎ মানুষ যেখানে যায়, যেখানে ফেরে, সেটিই তার দেশ, সেটিই তার দ্যাশ। রাজধানী বা অন্য কোনো ঝা চকচকে বড় শহর, রঙিন বাতির শহর, পয়সা উপার্জনের শহর তার দ্যাশ নয়। বরং এইসব শহরে তাকে আসতে হয় পেটের তাগিদে। কাজের খোঁজে। পেট তাকে দ্যাশছাড়া করে। কারণ দ্যাশের বাড়িতে তার কাজের সুযোগ নেই। কেন নেই? কারণ সবকিছু ঢাকায় বন্দি।
বছরের পর বছর ধরে যে ডিসেন্ট্রালাইজেশন বা বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলতে বলতে বিশেষজ্ঞরা মুখে ফেনা তুলে ফেলেছেন, সেই বিকেন্দ্রীকরণটা আজও হলো না। দূর মফস্বলের কোনো একটি ছোট সমস্যার সমাধানেও মানুষকে রাজধানীতে আসতে হয়। মামলা মোকদ্দমার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি তার নিজের জেলায় হয় না। সন্তানকে একটু ভালো স্কুলে পড়াতে চাইলেও তাকে ঢাকায় আসতে হয়। রোগব্যাধির চিকিৎসায়ও সে তার নিজের জেলা হাসপাতালের ওপর ভরসা করতে পারে না। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তার যোগ্যতা অনুযায়ী কোনো চাকরি বা কাজের ব্যবস্থা নিজের জেলা-উপজেলা শহরে নেই। পড়ালেখা শেষ করেই সবাইকে ঢাকায় আসতে হয়। দ্যাশ ছাড়তে হয়। পরিবার থেকেও বলে, ‘ঢাকায় যা, এইহানে থাইকা কী করবি?’ অর্থাৎ তার জন্মস্থানে, তার নিজের জায়গায়, তার শেকড় যেখানে, সেখানে তার করার কিছু নেই। নেই বলে তাকে আশা পূরণের জন্য, পরিবারের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য ঢাকায় আসতে হয়। কিন্তু ঢাকা তো তার দ্যাশ নয়। এটা তার একটা অস্থায়ী আবাস। ভাড়া বাসায় কিংবা মেসে অথবা বস্তিতে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। এক কাতে ঘুমাতে হয়। এখানে দিগন্তবিস্তৃত ফসলের খেত নেই। গ্রীষ্মের দুপুরে নদী ও খালের পাড়ে বসে হু হু বাতাস খাওয়া যায় না। এখানে খালি গায়ে ঘুরে বেড়ানো যায় না। সব সময় পোশাক পরে থাকতে হয়। এখানে জোরে চিৎকার করে কথা বলা যায় না। ভদ্রতার খাতিরে এখানে আস্তে কথা বলতে হয়। এখানে শুদ্ধ অথবা প্রমিত ভাষায় কথা বলতে হয়। কথায় যেন আঞ্চলিকতার টান প্রকাশিত না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হয়। অতএব সুযোগ পেলেই এই মানুষেরা দ্যাশে যায়। কারণ ওই দ্যাশেই তার প্রাণ। ওইখানে তার প্রিয়জন। দাদার কবর। লঞ্চ-ট্রেন বা বাস ঢাকা শহরের সীমানা পেরোলেই তার বুকের ভেতরে কেমন একটা অনুভূতি হয়। মনে হয় এই বুঝি একটা লম্বা করে শ্বাস নেয়া গেলো। ফলে এই স্বপ্ন পূরণের শহরে পেটের তাগিদে আসা মানুষেরা যখনই সুযোগ পায়, তখনই সে দ্যাশের বাড়িতে রওনা হয়। তাতে রাস্তায় বাধাবিপত্তি যতই থাকুক, সেসব পরোয়া করে না। এমনকি মাইলের পর মাইল হাঁটা; ভয়াবহ যানজটে খিচ মেরে বসে থাকা; বাঁচামরার প্রশ্ন ভুলে ট্রেনের ছাদে উঠে যাওয়া; ডুববে কি ভাসবে, সেই চিন্তা না করে অতিরিক্ত বোঝাই লঞ্চের ছাদে ও কার্নিশে বসে যাওয়া এমনকি পণ্যবাহী ট্রাকে দাঁড়িয়েও সে বাড়ি যেতে চায়। কারণ পেটের তাগিদে সে যেখানে এসেছে, এটি তার নিজের শহর নয়।
খেয়াল করে দেখবেন, এই করোনার মধ্যেও যে মানুষগুলো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, এমনকি কোলে নিষ্পাপ শিশুসন্তানকে নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হয়েছেন, তারা কেউই আর্থিকভাবে খুব স্বচ্ছল মানুষ নন। যাদের পয়সা আছে, তাদের অনেকই গাড়ি ভাড়া করে গেছেন। অনেকেই যাননি।
যারা এই শহরে মোটামুটি আরাম-আয়েশে আছেন, যাদের জীবিকা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়নি; লকডাউনের কারণে অফিসে বা কর্মক্ষেত্রে না গেলেও মাস শেষে যাদের বেতন অ্যাকাউন্টে চলে যাচ্ছে, সেইসব মানুষকে এই ভিড়ের মধ্যে আপনি হয়তো দেখবেন না।
এই ভিড়ের মধ্যে আছে তারা, যারা সারা বছর দুয়েকবার ঈদ বা এরকম আনন্দের উপলক্ষে দ্যাশের বাড়িতে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকে। সারা বছরে একটু একটু করে যাদের বাড়িতে কিছু কাজ জমে যায়। হয়তো গ্রামের বাড়ির ঘরটা মেরামত কিংবা ফসলের খেতেও কিছু কাজ তৈরি হয়। কিংবা বাড়ির পুকুর সেচতে হয়। কিন্তু যাদের এসব কাজ নেই, ঢাকা শহরেই যাদের জীবিকা ও বিনোদনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রয়েছে, তাদের এই ভিড়ের যাত্রী না হলেও চলে।
করোনার কারণে যে মানুষগুলো জীবিকা হারিয়েছে; যারা এই শহরে পেটের দায়ে এসেছিল কিন্তু এখন এখানে মাস শেষে ঘর ভাড়া দেয়া তো দূরে থাক, অনেকের হয়তো খাওয়ার পয়সা জোটানোও কঠিন, সেই মানুষগুলোকে আপনি কোন যুক্তিতে, কোন ভরসায়, কোন আশ্বাসে এই শহরের খাঁচায় বন্দি করে রাখবেন? সে তো এই খাঁচা ভেঙে পালাতেই চাইবে। রাষ্ট্রের সবকিছু যখন রাজধানী নামক একটি খাঁচার ভেতরে বন্দি করে ফেলা হয়েছে, তখন অভুক্ত পাখিরা সেই খাঁচা ভেঙে পালাতে চাইবে—এটিই তো স্বাভাবিক।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, রংধনু টেলিভিশন।