করোনার ওপর আম্পানের ঘা!
কৃষিবিদ হামিদুর রহমান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক। নিজে কৃষিবিদ বা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে কাজ করেছেন বলেই নয়, তার মধ্যে সব সময় একটা মাটির গন্ধ পাওয়া যায়।
তার কথাবার্তা, চালচলনে রয়েছে কৃষকভাব। যখন আমলা ছিলেন তখনও, এখনও মাটিসংলগ্ন। কৃষি সংক্রান্ত কোনো বিষয় হলে আমি তার সাথে যোগাযোগ করি। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতের পরদিন তাকে ফোন করলাম। যেন আমার ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলেন। বলতে শুরু করলেন, অর্ধেকের বেশি আম পড়ে গেছে, পানের বরজ মাটিতে মিশে গেছে।
এটুকু শুনে আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললাম, ঘূর্ণিঝড়ের নামটাই তো বলে দিচ্ছে, এটি আম আর পান খেতেই এসেছিল। প্রথমে তিনি মজাটা ধরতে পারেননি বা আমি এমন দুঃসময়ে মজা করব ভাবেননি। পরে বুঝতে পেরে হাসলেন। আসলে বহুদিন আমাদের জীবন থেকে প্রাণখোলা হাসি-উল্লাস হারিয়ে গেছে। প্রায় দুই মাস ধরে বাংলাদেশ স্থবির হয়ে আছে করোনা আতঙ্কে। তারপর এখন আম্পানের আঘাত। 'মরার ওপর খাড়ার ঘা' প্রবচনের আধুনিক ভার্সন হলো, 'করোনার ওপর আম্পানের ঘা'।
শুধু আমি নই, আমার মত অনেক মানুষ সারা বছর অপেক্ষায় থাকি, কবে আম আসবে। এবার এরই মধ্যে খোঁজ নিয়েছি, এ মাসের শেষে বা আগামী মাসের শুরুতে আম পাওয়া যাবে। এই সময়ে আম্পানের আঘাত, যার বড় একটা গেছে আমের ওপর দিয়ে। আমরা যারা সারা বছর অপেক্ষায় আছি, তাদের কাছে আম মানে কয়েক কেজি প্রিয় ফল। কিন্তু কৃষকের কাছে আম মানে তার সারা বছরের খোড়াকি। আম্পান শুধু আম বাগান বা পানের বরজেই আঘাত হানেনি, লাথি দিয়েছে সেই কৃষকদের পেটেও। কৃষিবিদ হামিদুর রহমানের চিন্তা এই কৃষকদের নিয়েই। তিনি বলতে লাগলেন, এই ঝড়ে পড়া কাচা আম কাজে লাগানোর নানা উপায়। কীভাবে আচার বানানো যায়, কীভাবে লবণ পানিতে বাড়িতে সংরক্ষণ করা যায়, কীভাবে সরকারি ত্রাণে আলুর বদলে আম দিয়ে কাজে লাগানো যায় ইত্যাদি ইত্যাদি নানান ভাবনা তার মাথায়। হামিদ ভাই জানালেন, শুধু আম বা পান নয়; আম্পানে ক্ষতি হয়েছে বহুমুখী ও ব্যাপক।
ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতিটা তাৎক্ষণিকভাবে নিরূপণ করা যায় না। সরকার প্রাথমিকভাবে ক্ষতির পরিমাণ ধরেছে ১১০০ কোটি টাকা। তবে আমার ধারণা, ক্ষতির পরিমাণ আরো অনেক বেশি হবে। তাছাড়া সব ক্ষতি টাকার অংকে নিরূপণ করা যায় না। আর শুধু আম বা পান নয় সব ধরনের রবিশস্যেরই ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কলা, পেঁপে, মরিচ, সয়াবিন, মুগডাল, ভুট্টা, চিনাবাদাম তো গেছেই, গেছে সব ধরনের সবজিও। ভেসে গেছে মাছের ঘের। সাধারণত ঘূর্ণিঝড় উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে। কিন্তু আম্পানের রাগ মনে হয় বেশি ছিল। দেশের অন্তত ২৬টি জেলায় আম্পান আঘাত লেগেছে। বাঁধ ভেঙেছে ৮৪টি পয়েন্টে, ফসলের ক্ষতি হয়েছে প্রায় দুই লাখ হেক্টর জমির।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশের সক্ষমতা বিশ্বে রীতিমত উদাহরণ। ১৯৭০ এর ঘূর্ণিঝড়ে মারা গিয়েছিল ৫ লাখ মানুষ। আমি নিশ্চিত, সেই ঘূর্ণিঝড় এখন হলে মৃত্যুর সংখ্যা ৫০ বা ১০০ তে নেমে আসবে। ঘূর্ণিঝড়ের আগে মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়ার ব্যাপক কর্মযজ্ঞে বাংলাদেশ এখন দারুণ দক্ষ। এত চেষ্টার পরও সুপার সাইক্লোন আম্পান কেড়ে নিয়েছে ২১ জনের প্রাণ।
পশ্চিমবঙ্গে মারা গেছেন ৭২ জন। সে তুলনায় বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে। তারপরও প্রতিটি প্রাণই মূল্যবান। এখন যারা বেঁচে আছেন তাদের পাশে আমাদের দাঁড়াতে হবে। ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে যেটা হয়, আগে অনেক হৈচৈ হয়। সিগন্যাল বাড়তে থাকে।
এখন তো সবাই মোবাইলেই জেনে যায় সাইক্লোনের অবস্থান, গতি এবং গতিপথ। ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার পরে এক-দু’দিন তা নিয়ে কথা হয়, লেখালেখি হয়। তারপর সবাই ভুলে যায়। কিন্তু একটি সাইক্লোনের ক্ষতি দীর্ঘ মেয়াদি। এক যুগ আগের সিডর আর আইলার ক্ষত কিন্তু এখনও পুরোপুরি শুকায়নি। বাঁধ ভেঙে যেসব এলাকায় লোনা পানি ঢুকে গিয়েছিল, সেসব জমির পুরো উর্বরা শক্তি এখনও ফিরে আসেনি।
এবার যে আরো ৮৪টি পয়েন্টে বাঁধ ভেঙেছে, সেগুলোও অনেক জমির উর্বরা শক্তি কেড়ে নেবে। তাই ক্ষতি যেমন দীর্ঘ মেয়াদি, পুনর্বাসন প্রক্রিয়াও হতে হবে দীর্ঘ মেয়াদি ও টেকসই। তাৎক্ষণিক ক্ষতি পূরণের ব্যবস্থা করে তাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তারপর ক্ষতির মাত্রা বিবেচনায় সাহায্য, বীজ, ঋণ- যার যেটা লাগে, সেটা দিতে হবে। একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, ঘূর্ণিঝড় কিন্তু অনেককে একদম নিঃস্ব করে দেয়। হয়তো তার ঘর উড়ে গেছে, ফসলের ক্ষেত মাটি হয়ে গেছে। তার মানে তার আর কিছু করার নেই। এখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার পাশে দাঁড়ানো। নইলে তিনি আর উঠে দাঁড়াতে পারবেন না।
ঘূর্ণিঝড় নিঃস্বকে বানায় নিঃস্বতর, আর কোটিপতিকে বানায় পথের ফকির। ধরুন, এক সম্পন্ন গৃহস্থের একটা বড়সর মাছের ঘের আছে। তার মধ্যে ব্যাংকের লোনও আছে। আম্পান সেই ঘের ভাসিয়ে নেয়া মানে কিন্তু সেই কোটপতি মৎস্য ব্যবসায়ীর মুহূর্তে পথের ফকির বনে যাওয়া। তিনি আসলে শুধু পথের ফকির নন, ঋণখেলাপিও হয়ে যাবেন। নিজের পেটে ভাত যোগানোর সামর্থ্য না থাকলেও ব্যাংক কিন্তু তাকে সহজে ছাড়বে না।
এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো, এসব অসহায় উদ্যমী মানুষদের পাশে দাঁড়ানো। বাংলাদেশের মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। প্রত্যেকবার ঝড়, জলোচ্ছ্বোস, বন্যার পর এমন অনেক মানুষের খবর পাই, যার সব শেষ হয়ে গেছে। আমি মনে মনে ভয় পাই, এই লোক নিশ্চয়ই ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু ঠিকই একটু সহায়তা আর দৃঢ় মনোবলে আবার ঘুরে দাঁড়ায় তারা। আমরা গণমাধ্যম, সাধারণ মানুষ আম্পানের কথা ভুলে গেলেও সরকার যেন তাদের পাশে থাকে।
একটা কৃতজ্ঞতা জানিয়ে লেখা শেষ করছি। এবারও সুন্দরবন বুকে আগলে বাঁচিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশকে। সুন্দরবন না থাকলে আম্পান বাংলাদেশের আরো অনেক বেশি ক্ষতি করতে পারত। শুধু এবার নয়, সুন্দরবন বারবার প্রাকৃতিক সুরক্ষা ঢাল হয়ে আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে। এত যে আমাদের বাঁচায়। আর আমরা বারবার সুন্দরবনের ক্ষতি করি। সুন্দরবনের পাশে বিদ্যুৎকেন্দ্র বানাই। অন্য কিছু না হোক, অন্তত বারবার ঝড় থেকে বাঁচায় বলে সুন্দরবনের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। প্রত্যেকবার আমাদের বাঁচাতে গিয়ে ব্যাপক ক্ষতি হয় সুন্দরবনের। কিন্তু দেখা গেছে, সুন্দরবনকে সুরক্ষার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো তাকে বিরক্ত না করা। সুন্দরবন আমাদের যেমন বাঁচায়, নিজেকে বাঁচানোরও নিজস্ব প্রাকৃতিক কৌশল আছে। তাই কৃতজ্ঞতা হিসেবে সুন্দরবনকে যেন আমরা বিরক্ত না করি।
প্রভাষ আমিন, হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।