হাসপাতালগুলো কোন মন্ত্রণালয়ের অধীনে?
করোনার অজুহাতে দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় যা হচ্ছে, তা নিয়ে এখন একটানে একশ’ পৃষ্ঠার একটি বই লিখে ফেলা সম্ভব। ‘বাংলাদেশে করোনাকালের হাসাপাতাল’—এই নামে কেউ হয়তো সত্যি সত্যি বই লিখছেনও এবং সেটি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য, বিশেষ করে অতীতের ধারাবাহিকতায় আগামী একশ’ বছর পরে যদি এ রকম আরেকটি মহামারির ধাক্কা আসে, তাহলে তখনকার মানুষেরা জানতে পারবেন, মহামারির ভেতরেও তাদের পূর্বপুরুষেরা মানুষের জীবন নিয়ে কী ভয়ঙ্কর খেলা খেলেছেন। লাখ লাখ মানুষ অসহায়ের মতো মৃত্যুবরণ করলেও তাদের পূর্বপুরুষের পয়সার প্রতি লোভ যে মোটেও কমেনি, সেটি যাতে আগামী প্রজন্ম জানতে পারে, সেজন্য করোনাকালের হাসপাতাল ও চিকিৎসা বিষয়ে বড় ধরনের গবেষণা হওয়া দরকার।
অস্বীকার করার উপায় নেই, করোনা এসে আমাদের পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ‘ছ্যাড়াব্যাড়া’ অবস্থাটি সবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। সঙ্গত কারণে এ প্রশ্নও উঠেছে যে গত অর্ধ শতাব্দী ধরে আমাদের সরকারগুলো দেশের স্বাস্থ্য তথা চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রকৃত উন্নয়নে আসলেই কী করেছে, কতটুকু করেছে এবং কাদের জন্য করেছে?
এই প্রশ্নগুলো উঠছে করোনায় আক্রান্ত অনেকে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন, শুধু সে কারণে নয়, বরং করোনার অজুহাতে যে অন্য রোগে আক্রান্তরাও চিকিৎসা পাচ্ছেন না, এমনকি খুব প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকেও যে বঞ্চিত হচ্ছেন, সে কারণে। প্রশ্নটি সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালের জন্যই। তার সাথে সাথে এ প্রশ্নও আছে যে সরকার সব হাসপাতালে সব ধরনের রোগীর চিকিৎসা দেয়ার নির্দেশনা দিলেও করোনার ঝুঁকি মোকাবিলায় চিকিৎসক-নার্সসহ সংশ্লিষ্টদের পর্যাপ্ত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পেরেছে কি না? আবার সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকার পরও যদি চিকিৎসকরা হাসপাতালে না যান, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কি না?
করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর থেকেই এই অভিযোগটি আসছে যে সরকারি বেসরকারি কোনো হাসপাতালে গিয়ে মানুষ সেবা পাচ্ছে না। ডাক্তার নেই। নন-কোভিড (করোনার চিকিৎসা যেখানে হয় না) হাসপাতালগুলো চিকিৎসার আগে রোগীর করোনার নেগেটিভ রিপোর্ট চাচ্ছে; আবার কোভিড (করোনার চিকিৎসা যেখানে হয়) হাসপাতালগুলো করোনার রিপোর্ট পজেটিভ না হলে ভর্তি নিচ্ছে না। বাস্তবতা হলো, এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফাঁদে পড়েও অনেকের প্রাণ যাচ্ছে। এ রকম বাস্তবতায় গত ২৪ মে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয় যে দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে কোভিড-১৯ এবং নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য কোভিড ও নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসার জন্য আলাদা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। কিন্তু এই নির্দেশনার পরেও হাসপাতালগুলোর চিত্র তেমন বদলায়নি। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, কেউ কি কারো কথা শোনে? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বারবার এ জাতীয় নির্দেশনা দেয়ার পরও যখন পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয় না, তখন তো এই প্রশ্ন ওঠাও সঙ্গত যে হাসপাতালগুলো কি আদৌ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে? যদি না হয়, তাহলে এগুলো কোন মন্ত্রণালয়ের অধীনে? নাকি সরকারি হাসপাতালগুলো স্বায়ত্তশাসিত আর বেসরকারি হাসপাতালগুলো সব ধরনের জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে?
বুধবার (৩ জুন) একটি অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে খবর এসেছে, রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতাল একজন করোনা রোগীকে একটি রক্ত পরীক্ষা, দু’টি এক্সরে আর কিছু নাপা ও গ্যাসের ট্যাবলেট দিয়ে এক লাখ ৭০ হাজার ৮৭৫ টাকা বিল করেছে। অথচ ওই হাসপাতালটিকে সরকার করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য ডেডিকেটেড করেছে। সে হিসেবে এখানে বিনামূল্যে চিকিৎসা হওয়ার কথা। অথচ সাংবাদিক যখন এই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করলেন, তারা নির্লিপ্তভাবে জানিয়ে দিয়েছে, তারা সরকারের সাথে চুক্তি বাতিল করেছে। কবে বাতিল করল, কেন করল এবং সরকারের তরফে সেটা কেন জানানো হলো না—এ প্রশ্নও এখন উঠছে। কারণ ওই ভদ্রলোকের মতো আরও অনেকে এখনও ওই হাসপাতালে করোনার চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং দেখা যাবে তাদের প্রত্যেকের হাতে এ রকম লাখ লাখ টাকার বিল ধরিয়ে দেয়া হবে। একটি স্বাধীন দেশে, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হওয়া একটি দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় এ রকম নৈরাজ্য আর কতদিন চলবে?
এখনই যা করতে হবে:
১. নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। একজনও যদি বিনা চিকিৎসায় মারা যান, তাহলে সেটি অবশ্যই রাষ্ট্রের ব্যর্থতা এবং সংবিধানের অবমাননা। করোনা আরও কতদিন থাকবে, আরও কত লোকের মৃত্যু হবে—সেটা এখনই বলা কঠিন। কিন্তু করোনার অজুহাতে কোনো হাসপাতাল চিকিৎসা বন্ধ রাখলে সেটি অবশ্যই ফৌজদারি অপরাধ এবং সরকারকে এই অপরাধ দমনে শক্ত হতে হবে।
২. দেশের সরকারি বেসরকারি সব হাসপাতালে কোভিড ও নন-কোভিড সব ধরনের রোগীর চিকিৎসা নিশ্চিতে আলাদা ইউনিট করা, তথা অন্যান্য প্রস্তুতি নিতে হবে। সরকার দাবি করছে, চিকিৎসকদের সুরক্ষায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যদি তাই হয়, তাহলে চিকিৎসকরা কেন হাসপাতালে আসছেন না বা এলেও রোগীদের কেন সেবা দিচ্ছেন না, সেটি খতিয়ে দেখতে হবে। সুরক্ষা নিশ্চিতে ঘাটতি থাকলে সেই ঘাটতি পূরণ করতে হবে। কোনো হাসপাতালে গিয়ে কোনো রোগী যাতে চিকিৎসা করাতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে না আসেন, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
৩. চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টদের সুরক্ষা নিশ্চিতের পরেও যদি কোনো হাসপাতাল রোগীদের চিকিৎসা না দেয় বা দিতে গড়িমসি করে তাহলে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের পরিচালক এবং অন্যদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। পরপর কয়েকটি উদাহরণ তৈরি করে সুস্পষ্ট বার্তা দিতে হবে।
৪. কোনো বেসরকারি হাসপাতাল যদি চিকিৎসা দিতে না চায় তাহলে সেসব হাপাতালের নিবন্ধন বাতিল করতে হবে।
৫. এই মহামারির সময়েও যেসব বেসরকারি হাসপাতাল মানুষকে জিম্মি করে টাকা আদায় করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তার করতে হবে। ওইসব হাসপাতালকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিতে হবে।
৬. বছরের পর বছর ধরে যে বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে তা হলো বেসরকারি হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না—কারণ এর মালিকানা প্রভাবশালীদের। সরকারের এই বার্তাটি খুব সুস্পষ্টভাবে দেয়ার সময় এসেছে যে সরকার বা রাষ্ট্রের চেয়ে বেশি প্রভাবশালী বা সরকারের চেয়ে বড় মাস্তান কেউ নেই।
৭. সরকারের নীতিনির্ধারকদের ঠিক করতে হবে, তাদের কাছে কোনটি অগ্রাধিকার, জনস্বাস্থ্য নাকি কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মুনাফা?
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক, গবেষক।