ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে পাঠদান: বাস্তবতা ও করণীয়
৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ১৮ মার্চ সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রয়োজন হলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার কথা বলেছেন।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে এ বছর ক্লাস শুরু করা কঠিন হতে পারে। তাই এই স্থবির দশা কাটানোর জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনলাইনে ক্লাস শুরুর প্রয়োজনীয়তা এখন বেশ জোরেশোরেই আলোচনায় এসেছে।
২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণার পর দেশ তথ্য-প্রযুক্তিতে অনেক দূর এগিয়েছে। বর্তমানে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৯ কোটি ৮১ লাখ। এদের মধ্যে ৯ কোটি ২৪ লাখ মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ও ৫৭ লাখ ৩৫ হাজার ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছেন। তথ্য-প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে না পারলে বিশ্বায়নের এই যুগে টিকে থাকা সত্যিই কঠিন। বিশেষ করে এই দুর্যোগ মুহূর্তে অনলাইন প্লাটফর্মই হতে পারে শিক্ষার প্রধান মাধ্যম।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অনলাইন শিক্ষা বা ই-টিচিং অ্যান্ড লার্নিং বা ডিসট্যান্স লার্নিং এখন বহুল প্রচলিত বিষয়। করোনার প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই বিশ্বের ভালো মানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বন্ধ হয়নি শিক্ষা কার্যক্রম। সব সময়ের মতো তাদের দূর শিক্ষণ কার্যক্রম চলছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস, শর্টকোর্স, প্রেজেন্টশন অনলাইনেই সম্পন্ন হচ্ছে।
বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থীই এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে অধ্যয়ন করছেন। অনলাইনে শুধু ক্লাস নয় গুগল ফর্ম, গুগল ক্লাসরুমসহ বেশ কিছু অ্যাপস আছে যেগুলো দিয়ে পরীক্ষাও নেয়া যায়। তাই অনলাইন শিক্ষা আজ অবাস্তব কোনো বিষয় নয়। প্রসঙ্গত, গত ২ জুন (মঙ্গলবার) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে ডিন্স কমিটির সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখার জন্য বাস্তবতার নিরিখে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেরিতে হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালুর এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। শতবর্ষী ও ঐতহ্যিবাহী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে পাঠদান পদ্ধতি অনেক আগেই শুরু করা উচিত ছিল।
দেশের বর্তমান প্রযুক্তি সেবা বিবেচনায় এ কথা অনস্বীর্কায যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস বাস্তবায়ন সত্যিই চ্যালেঞ্জিং। কেননা এর জন্য যে টেকনিক্যাল সাপোর্ট প্রয়োজন, সেটি হয়তো সব শিক্ষার্থীর নেই। অনলাইনে ক্লাস করতে হলে উচ্চগতি সম্পন্ন ইন্টারনেট সংযোগ, ভালো স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটার অথবা ল্যাপটপ প্রয়োজন। উল্লখ্যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব শিক্ষার্থী পড়ালেখা করেন, তাদের বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আসা। অনেকের কাছেই অনলাইন ক্লাসের প্রয়োজনীয় ডিভাইস নেই। এ ছাড়া দেশে এখনও অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চল আছে, যেখানে নেটওয়ার্ক সুবিধা একেবারে অপ্রতুল বা নেই।
এর পাশাপাশি অনেক শিক্ষার্থীর কাছে এখন অনলাইন ক্লাস বিলাসিতার শামিল। কারণ, এ মহামারিতে এমন অনেক পরিবার আছে, যাদের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে গেছে। যারা টিউশন বা পার্টটাইম জব করে নিজেদের ও পরিবারের খরচ বহন করতেন, তাদের আয়ের উৎসও বন্ধ।
সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় আম্পানেও অনেক শিক্ষার্থীর পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এখনও অনেক এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এ ছাড়া অনেক শিক্ষার্থী প্রযুক্তিগত জ্ঞানেও দুর্বল। শুধু শিক্ষার্থীই নয়, প্রযুক্তি ব্যবহারে অনেক শিক্ষকও এখন পিছিয়ে। আবার অধিকাংশ শিক্ষকেরই অনলাইনে ক্লাস নেয়ার কোনো অভিজ্ঞতা নেই।
তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন পাঠদান পদ্ধতিকে এ সব চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখেই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সর্বাগ্রে অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করতে হবে। একজন ছাত্রও যেন তার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হন। মনে রাখতে হবে, ইচ্ছে করে ক্লাসে আসেন না আর ক্লাসে আসতে পারছেন না- দু’টো এক কথা নয়। এ লক্ষ্যে শুরুতেই সবার জন্য অনলাইন শিক্ষা চালু না করে এটি 'পাইলট প্রজেক্ট' আকারে উচ্চতর বিশেষত: এমএ শ্রেণীতে শুরু করা যেতে পারে।
এই প্রজেক্টের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে পরে আরও বিস্তৃত আকারে অনলাইনে পাঠদান শুরু করা যেতে পারে। যেসব শিক্ষার্থীর প্রয়োজনীয় মোবাইল বা ল্যাপটপ নেই, তাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে সমঝোতা চুক্তি করতে পারে, যারা সহজ কিস্তিতে শিক্ষার্থীদের জন্য এসব সামগ্রী সরবরাহ করবে। এর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সরকারের সাথে আলোচনা করে শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ শিক্ষা ঋণেরও ব্যবস্থা করতে পারে।
অনলাইনে পাঠদানের জন্য আরেকটি বাধা ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের গতি আর দাম। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিদ্যমান মোবাইল অপারেটরদের সাথে প্যাকেজ সুবিধার বিষয়ে কেন্দ্রীয় চুক্তি করতে পারে, যেখানে চুক্তি অনুযায়ী নিবন্ধিত শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যান্ডউইথের গতির বিষয়ে নিশ্চয়তা দেবে মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিগুলো।
অনলাইনে পাঠদান পদ্ধতি প্রথাগত পাঠদান পদ্ধতি থেকে আলাদা। সে ক্ষেত্রে শিক্ষকদের নিয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে অনলাইনে পাঠদানের জন্য সিলেবাস, পদ্ধতি এবং টিচিং ম্যাটেরিয়ালের প্রকৃতি নির্ণয় করা যেতে পারে। ব্যবহারিক ক্লাসের ক্ষেত্রেও এই কমিটি একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান বের করতে পারে। সর্বোপরি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে পাঠদান বাস্তবায়ন করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ও মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোর যুগপৎ বৈঠক দরকার। এসব বৈঠক থেকেও অনেক ফলপ্রসূ সমাধান উঠে আসবে।
সর্বশেষ, বাস্তবানুগ পরিকল্পনা ও যথাযথ প্রক্রিয়া শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে পাঠদান পদ্ধতি চালু করতে হবে, যা দেশের বাস্তবতার নিরিখে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীবান্ধব হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে পাঠদান পদ্ধতি চালু হলে, শুধু দেশি নয়, অনেক বিদেশি শিক্ষার্থীও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী হবে। সঠিক ও যুগোপযোগী উদ্যোগের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদানে চলমান স্থবিরতা কাটবে-এটাই সবার প্রত্যাশা।
এ কে এম ইফতেখারুল ইসলাম: সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।