করোনাকালেও ত্রাণ বরাদ্দে চরম বৈষম্য

  • ড. তুহিন ওয়াদুদ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো দারিদ্র্য মানচিত্র প্রকাশ করে ২০১৬ সালে। তখন গড় দারিদ্র্য ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। জেলাভিত্তিক এটাই সর্বশেষ পরিসংখ্যান। ২০১৯ সালে সেই দারিদ্র্যের হার কমে হয়েছে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। দেশে এখন মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী এখন দেশে মোট দরিদ্রের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৪০ লাখ। ২০১১ সালের সবর্শেষ আদমশুমারি অনুযায়ী সর্বশেষ জেলাভিত্তিক জনগণের পরিসংখ্যান পাওয়া যায়। ২০২০ সালে এসে সেই জনগণ জেলাভিত্তিক কিছু কিছু বেড়েছে।

বিজ্ঞাপন

আমরা যদি জেলাভিত্তিক দরিদ্র মানুষের সংখ্যা জানতে চাই, তাহলে ২০১১ সালের আদমশুমারি এবং ২০১৬ সালের সর্বশেষ দারিদ্র্য মানচিত্রকে আমলে নিতে হয়। এই পরিসংখ্যান মোতাবেক দরিদ্র মানুষের যে সংখ্যা পাওয়া যাবে, বাস্তবে তার চেয়ে সামান্য কিছু কম হবে। তারপরও উল্লিখিত সূত্র ধরে দেশে এবং জেলিভিত্তিক মোট দরিদ্রের সংখ্যা নির্ণয় করলে করোনাকালে ত্রাণ বরাদ্দের বৈষম্যচিত্র বোঝা যাবে।

২৮ মে পর্যন্ত সারাদেশে ১ লাখ ৯১ হাজার ৮১৭ মেট্রিক টন চাল (বিশেষ ভিজিএফসহ) ত্রাণ হিসেবে দেওয়া হয়েছে। কিছু নগদ অর্থও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ৫০ লাখ পরিবারকে আড়াই হাজার করে টাকা দেওয়ার জেলাভিত্তিক সংখ্যাও নির্ধারণ করা হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে যারা সুবিধাভোগী, তারা এই টাকা পাবেন না।

বিজ্ঞাপন

দেশের সবচেয়ে ধনী জেলায় বরাদ্দ

দেশের সবচেয়ে কম গরিব জেলা নারায়ণগঞ্জ। এই জেলায় মোট জনসংখ্যা ২৯ লাখ ৪৮ হাজার ২১৭। এই জেলায় দারিদ্র্যের হার ২ দশকি ৬ শতাংশ। মোট দরিদ্র রয়েছেন ৭৬ হাজার ৬৫৩ জন। এই জেলায় মোট চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৪ হাজার ৯৩৫ মেট্রিক টন। সে হিসেবে প্রত্যেক দরিদ্র ব্যক্তির জন্য বরাদ্দ ৬৫ কেজি ৪১১ গ্রাম। একটি পরিবারে যদি সদস্য সংখ্যা ৪ হয়, তাহলে বরাদ্দ সুষ্ঠুভাবে হলে ২৬১ কেজি ৬০০ গ্রাম চাল পাবে ওই পরিবার। জনপ্রতি এককালীন আড়াই হাজার টাকা নারায়ণগঞ্জে দেওয়া হবে মোট ১ লাখ ২০ হাজার পরিবারকে। যদি ৪ জন সদস্যের পরিবার হিসেব করি, তাহলে নারায়ণগঞ্জে গরিব পরিবার আছে ১৯ হাজার ১৬৩টি। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধাভোগীর কথা যদি ছেড়েও দিই, তবুও সরকারি হিসাব মতেই গরিব পরিবার ছাড়াও প্রায় ১ লাখ ১৩৭টি পরিবারের এই বরাদ্দ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

দ্বিতীয় কম গরিব জেলা মুন্সিগঞ্জে বরাদ্দ

এই জেলায় মোট জনসংখ্যা ১৫ লাখ ২ হাজার ৪৪৯ জন। এই জেলায় দারিদ্র্যের হার ৩ দশমিক ১ শতাংশ, মোট গরিবের সংখ্যা ৪৬ হাজার ৫৭৫। এ জলায় মোট বরাদ্দ ২ হাজার ১৩৫ মেট্রিক টন চাল। যাতে প্রত্যেক দরিদ্র ব্যক্তির জন্য বরাদ্দ ৪৬ কেজি ৫৩৪ গ্রাম। তাতে ৪ জনের পরিবারের পাওয়ার কথা প্রায় ১৮৬ কেজি ৩০০ গ্রাম করে। ৪ জনের পরিবার ধরে হিসেব করলে এই জেলায় মোট গরিব পরিবারের সংখ্যা ১১ হাজার ৬৪৩টি। আর আড়াই হাজার টাকা করে পাবে মোট ৫২ হাজার পরিবার। গরিব পরিবারের বাইরে আরও ৪০ হাজার ৩৫৭টি পরিবার এই সহযোগিতা পাবে।
তৃতীয় কম গরিব জেলা মাদারীপুরের জনসংখ্যা ১২ লাখ ১২ হাজার ১৯৮। এই জেলায় গড় দারিদ্র্য ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। জেলার দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৪৪ হাজার ৮৫১। যাদের জন্য মোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২ হাজার ৬৫ মেট্রিক টন চাল। গরিব প্রতি বরাদ্দ ৪৬ কেজি ৭৭৭ গ্রাম। ৪ জনের পরিবার হলে পরিবার প্রতি পাবে প্রায় ১৮৭ কেজি। মাদারীপুরে মোট দরিদ্র পরিবার ১১ হাজার ২১২টি। এই জেলায় আড়াই হাজার টাকা করে পাবে মোট ৫৫ হাজার পরিবার। দরিদ্র পরিবার ছাড়া আরও ৪৩ হাজার ৭৮৮টি পরিবার পেতে পারে এ সহায়তা।

সবচেয়ে দরিদ্র জেলায় বরাদ্দ চিত্র

এখন আসি বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি দরিদ্র জেলায়। দেশের সবচেয়ে বেশি গরিব জেলা কুড়িগ্রামের মোট জনসংখ্যা ২০ লাখ ৬৯ হাজার ২৭৩। এই জেলার গড় দারিদ্র্য ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ। মোট দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ১৪ লাখ ৬৫ হাজার ৪৫। যাদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মোট ৩ হাজার ৮ মেট্রিক টন চাল। গরিবপ্রতি বরাদ্দ ২ কেজি ৮৬ গ্রাম চাল। ৪ জনের পরিবার পাবে সাড়ে ৮ কেজি ৩০০ গ্রাম চাল। এই জেলায় মোট গরিব পরিবারের সংখ্যা ৩ লাখ ৬৬ হাজার ২৬১টি। এই জেলায় আড়াই হাজার করে টাকা পাবে ৯০ হাজার পরিবার। বঞ্চিত হবে মোট ২ লাখ ৭৬ হাজার ২৬১টি পরিবার।

সর্বাধিক দরিদ্র, বরাদ্দ কম


দ্বিতীয় দরিদ্র জেলা দিনাজপুর হলেও সম্ভবত দেশে জেলাভিত্তিক সবচেয়ে বেশি গরিব মানুষ আছে এই জেলায়। এই জেলায় মোট জনসংখ্যা ৩১ লাখ ৬ হাজার ৯২৮। এই জেলার গড় দারিদ্র্য ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ। আর মোট দরিদ্র মানুষ রয়েছে ১৯ লাখ ৯৯ হাজার ৪৯০ জন। মোট বরাদ্দ ৩ হাজার ২৬ মেট্রিক টন চাল। দরিদ্রপ্রতি বরাদ্দ ১ কেজি ৫৩৭ গ্রাম চাল। ৪ জনের পরিবারে পাবে প্রায় ৬ কেজি চাল। এই জেলায় মোট দরিদ্র পরিবারের সংখ্যা ৪ লাখ ৯৯ হাজার ৮৭২টি। যার মধ্যে আড়াই হাজার টাকা করে পাবে মোট ৭৭ হাজার পরিবার। বঞ্চিত হবে প্রায় ৪ লাখ ২২ হাজার ৮৭২টি পরিবার।

গাইবান্ধার চিত্র

আনুপাতিকহারে কম বরাদ্দ পাওয়া জেলাগুলোর আরেকটি গাইবান্ধা। এই জেলায় মোট জনসংখ্যা ২৪ লাখ ৩০ হাজার ৬২৭। দারিদ্র্যের হার ৪৬ দশমিক ৭ শতাংশ। মোট দরিদ্র মানুষের সংখ্য ১১ লাখ ৩৫ হাজার ১০২। মোট বরাদ্দ ২ হাজার ১০৯ মেট্রিক টন চাল। মাথাপিছু বরাদ্দ ১ কেজি ৮৮৭ গ্রাম। ৪ জনের একটি পরিবার প্রায় ৭ কেজি ৫০০ গ্রাম চাল পাবে। এই জেলায় মোট দরিদ্র পরিবারের সংখ্যা ২ লাখ ৮৩ হাজার ৭৭৫টি। যার মধ্যে আড়াই হাজার টাকা করে পাবে ৭২ হাজার পরিবার। আর বঞ্চিত হবে ২ লাখ ১১ হাজার ৭৭৫টি পরিবার।

দেশের সবচেয়ে কম দরিদ্র জেলায় দরিদ্র পরিবার প্রতি নারায়ণগঞ্জে ২৬১ কেজি চাল, মুন্সিগঞ্জে প্রায় ১৮৬ কেজি চাল এবং মাদারীপুরেও প্রায় ১৮৬ কেজি চাল দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে দেশের দরিদ্র জেলাগুলোর মধ্যে কুড়িগ্রামে পরিবার প্রতি গড়ে আট কেজি, দিনাজুপরে ছয় কেজি, গাইবান্ধায় সাত কেজি চাল দেওয়া হয়েছে। রংপুরে পরিবার প্রতি ১৫ কেজি ও লালমনিরহাট ১৬ কেজি করে চাল দিয়েছে সরকার।

সরকার পরিবার প্রতি আড়াই হাজার করে টাকা ৫০ লাখ পরিবারে দেওয়ার কার্যক্রম শুরু করেছে। সরকারের এটি একটি অনেক বড় উদ্যোগ। বিতরণের জন্য তালিকা করা হয়েছে এবং তালিকা অনেকটা প্রকাশও করা হয়েছে। সেখানে কিছু কিছু দুর্নীতির চেষ্টা হয়েছে। তবুও মোবাইলের মাধ্যমে এই টাকা প্রদানে এই জেলা দুর্নীতি কমাবে। কিন্তু এই টাকাও জেলাভিত্তিক যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তাও অভিন্ন দোষে দুষ্ট। বরং এই তালিকায় আরও বেশি বৈষম্য দেখা যাচ্ছে। ৫০ লাখ পরিবার নির্ধারণ দেখে বোঝা যায়, সরকারের সদিচ্ছায় কোনো ত্রুটি নেই। যারা সরকারের সামাজিক নিরাপত্তার বিভিন্ন সুবিধা পাচ্ছে, তাদের এই অর্থ দেওয়া হবে না। নতুন করে ২ কোটি মানুষ এই সুবিধা পাবে।

দেশে সরকারি হিসাব মতে আর যে ১ কোটি ৪০ লাখ দরিদ্র থাকে তারা নিশ্চয়ই সামজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আছে। চাহিদাভিত্তক বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হলে দেশের সব দরিদ্র মানুষ সরকারের সহায়তা পাওয়ার কথা। কিন্তু বৈষম্যপূর্ণ বরাদ্দ হওয়ার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। অনতিবিলম্বে বৈষম্য দূরীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।

ড. তুহিন ওয়াদুদ: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর এবং পরিচালক, রিভারাইন পিপল