প্রধানমন্ত্রী কাঁদলেন, ডা. জাফরুল্লাহ ও ডিআইজি হাবিব বিবেক নাড়া দিলেন
রাজপথে বহুবার নির্যাতিত নেতা ও সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এবং ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আবদুল্লাহর মৃত্যুতে রোববার (১৪ জুন) সংসদের বাজেট অধিবেশনে শোক প্রস্তাবে আলোচনা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী অঝোরে কেঁদেছেন। প্রায় একই সময়ে দু’জন বিশ্বস্ত সহকর্মী ও রাজনৈতিক সহচরকে হারিয়ে বেদনায় সিক্ত ও আবেগে আপ্লুত হন প্রধানমন্ত্রী।
সংসদ নিরব হয়ে যায়। বাকরুদ্ধ হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। করোনা সংক্রমণে দেশ ও জাতির কষ্টে এবং দলীয় নেতাদের প্রয়াণে হৃদয়ে ক্ষরণ হচ্ছে তার। যারা দল ও দেশের দুঃসময়ে ঢাল হয়েছিলেন, মাত্র একদিনের ব্যবধানে দলের গুরুত্বপূর্ণ এমন দুইজন সদস্যের মৃত্যুতে সংসদ, দেশ ও দল হিসেবে আওয়ামী লীগে বিরাজ করছে শোক।
দুই.
মানুষ মাত্রই রাজনীতি সচেতন ও রাজনৈতিক দর্শন ধারণ করেন। রাজনৈতিক মতাদর্শ ধারণ ও তার চর্চা করা যে কোনো মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়। কখনো কখনো অনেকের ব্যক্তিগত বিষয় ব্যক্তি সত্ত্বার ঊর্ধ্বে উঠে মানবিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। করোনাকালে করোনা টেস্টের কিট উদ্ভাবনসহ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছেন লড়াকু মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বাস্তব জীবনেও যিনি লড়াকু ও মহৎ মনোভাবাপন্ন।
অন্যদিকে, করোনাকালেও যারা নিজেদের জীবন তুচ্ছ করে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান (বার), যিনি অন্যতম একজন মহৎ মানুষ। ইতোমধ্যে করোনা সংক্রমণের কঠিন দিনগুলোতে সম্মুখে থেকে পুলিশ সদস্য ও জনগণের পাশে থেকে আত্মত্যাগ স্বীকার করেছেন তিনি, যা অধিকাংশ মানুষ জানে না।
তিন.
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিমের সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কের কারণে গত ১৩ জুন রাতে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী করোনামুক্ত জেনে মোহাম্মদ নাসিমের জানাজায় উপস্থিত হওয়ার প্রবল ইচ্ছা পোষণ করেন। তিনি করোনামুক্ত অথচ নিউমোনিয়া ও ঝুঁকিমুক্ত না হওয়ায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা তাকে হাসপাতালে থাকতে অনুরোধ করেন। অনুরোধ না শুনে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বরং তিনি বলেন ‘আমি যদি মোহাম্মদ নাসিমের জানাজায় গিয়ে মারাও যাই, তবু আমি তার জানাজায় যেতে চাই’।
অবশেষে ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের অনুরোধ না শুনেই হাতে কেনোলা নিয়ে দু’জনের কাঁধে ভর করে মোহাম্মদ নাসিমের মরদেহের কাছে গিয়ে তিনি স্যালুট দেন। আপনাকেও স্যালুট ও বিনম্র শ্রদ্ধা ডা.জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্যার। দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ একই সময়ে ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের নিহত সদস্যদের, জাতীয় চার নেতার এবং কবরস্থানে সমাহিত সবার রুহের মাগফেরাতের জন্য মোনাজাত করেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও দেশের সব গণমাধ্যমের কল্যাণে আমরা জানতে পেরেছি, দেশের অনেক মানুষ ডা.জাফরুল্লাহর সুস্থতার জন্য দোয়া করেছেন। প্রধানমন্ত্রী নিজে তার শারীরিক সুস্থতার বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়েছেন। ঢাকা মেডিকেলে কেবিনের ব্যবস্থা করেছেন। আমরা বুঝতে পেরেছি, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মহানুভবতা গগণচুম্বী বলেই কিংবা দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য তিনি অনেক ভাবেন বলেই দেশের মানুষও তাকে নিয়ে ভাবেন।
চার.
করোনাকালে মানুষের পাশে দেবদূত হয়ে দাঁড়ানো ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান ব্যক্তিগত প্রচার ও প্রকাশ পছন্দ করেন না বলেই তার আত্মত্যাগ অনেকের অজানা। তার আত্মত্যাগ যে কোনো বিবেকবান মানুষকে নাড়া দেয়। তার অফিস থেকে বাসার দূরত্ব হেঁটে গেলেও ১০ মিনিটের বেশি লাগার কথা নয়। অথচ রোজার ঈদের আগে ৩৮ দিন তিনি বাসায় যাননি। ৩৮ দিন পরে শেষ রোজার (৩০ রোজা) দিন সন্ধ্যায় তিনি তার সরকারি বাসভবনে যান। বাসায় বাবা অন্তপ্রাণ ছোট্ট একটি ছেলে আছে। তিনি ছেলেকে বুকের মধ্যে পাননি আবার ছেলেও বাবার সান্নিধ্য পায়নি ৩৮টি দিন।
সেই সময়গেুলোতে করোনায় আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের পাশে একদিকে যেমন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সাহস যুগিয়েছেন, অন্যদিকে ত্রাণ নিয়ে ছুটে গিয়েছেন বিভিন্ন এলাকায়। দেশের এই কঠিন দুঃসময়ে শত ব্যস্ততার মধ্যেও ভুলে যাননি বেদে সম্প্রদায় এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষদের। বিভিন্নভাবে তাদের জন্য ত্রাণ সংগ্রহ ও বিতরণের ব্যবস্থাও করেছেন।
যিনি সমাজের পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে অনেক বছর ধরে আশার আলো দেখিয়ে চলেছেন। নিজ কাজের পাশাপাশি পথশিশু, বেদে সম্প্রদায় এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের পাশে ছায়া হয়ে থাকা তার নেশা। দেশের যে কোনো প্রান্তের মানুষের প্রতি সাধ্য অনুযায়ী সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। নিজের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সাভারে গড়ে তুলেছেন স্থায়ী বেদে পল্লী। হিজড়া সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নে সেলাই কাজের ব্যবস্থা ও ‘উত্তরণ বিউটি পার্লার’ গড়ে তুলতে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। ডিআইজি হাবিবুর রহমান- আপনাকে স্যালুট এবং বিনম্র শ্রদ্ধা।
দেশ ও সমাজের বিবেকবান মহৎ মানুষ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ডিআইজি হাবিবুর রহমান প্রমাণ করেছেন ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’।
আপনাদের সাথে এই জীবনে একবার, দুইবার কিংবা বারবার দেখা করার জন্য মনটি ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। এভাবে আরও যে সব সম্মুখ করোনাযোদ্ধা চিকিৎসক, নার্স, পুলিশ, সংবাদকর্মী ভাই-বোনেরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে লড়ছেন, তাদের সবার প্রতি জাতির পক্ষ থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা। মাঝে মাঝে সত্যি ঘর থেকে বের হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বুক ফেটে কাঁদতে ইচ্ছা করে।
করোনার ভয়াল সংক্রমণ কেড়ে নিচ্ছে মন্ত্রী, এমপি থেকে শুরু করে কত শিল্পপতি। আইসিইউ সুবিধা কিংবা অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্য কত হাহাকার! এসব ভেবে বের হতে পারি না। কেননা একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক না জানি করোনার কাছে আরও কত অসহায়! দেশ ও জাতির এই দুঃসময় ও জাতীয়-বৈশ্বিক সংকটে আইসিইউ সুবিধা কিংবা অক্সিজেন সিলিন্ডারের ধারে-কাছেও একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যেতে পারবেন না।
পরিশেষে, ত্রাণ কার্যক্রমে সহযোগিতা করার জন্য কিছু মানবিক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (কেশবপুর, যশোর সদর ও সাভার); সিনিয়র সহকারী কমিশনার (বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, ঢাকা); নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, (গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসন) এবং সাভার মডেল থানার অফিসার ইনচার্জের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা যাদের আন্তরিকতার কাছে আমাদের ঋণ ও ঋদ্ধতা বেড়ে গেছে।
মোহাম্মাদ আনিসুর রহমান: পিএইচডি গবেষক, ঝেজিয়াং ইউনিভার্সিটি, চীন এবং শিক্ষক ও সাবেক চেয়ারম্যান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ।