মণিপুরে কি ক্ষমতায় ফিরছে কংগ্রেস?
এ যেন বিজেপির কাঁটায় বিজেপিকে বিদ্ধ করা। ২০১৭ সালের নির্বাচনে মণিপুর বিধানসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হয়েছিল কংগ্রেস। ৬০ আসনের বিধানসভায় ২৮ আসন পেয়েছিল কংগ্রেস। ২১ আসনে জয়লাভ করেছিল প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি। রাজ্যে ক্ষমতায় যেতে দরকার অন্তত ৩১টি আসন।
স্বাভাবিকভাবেই মাত্র ৩টি আসন পিছিয়ে থাকা কংগ্রেসের জন্য ক্ষমতায় যাওয়া অনেকটাই সহজ ছিল। কিন্তু অনেক সহজ সমীকরণকে উল্টে দিতে পারঙ্গম বিজেপি এখানেও উল্টে দেয় চেনা হিসাব-নিকাশ। কংগ্রেস ও বিজেপির বাইরে বাকি ১১টি আসন জিতেছে যে চারটি দল এবং একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী তাদের সবার সমর্থন নিজেদের পক্ষে নিয়ে ক্ষমতায় বসে যায় বিজেপি। হা করে দেখা ছাড়া যেন কিছুই করার থাকে না কংগ্রেসের।
তিন বছর পর সেই ইটের জবাব-ই কি পাটকেলে দিতে চলেছে কংগ্রেস? গেল বুধবার (১৭ জুন) মণিপুরে ক্ষমতাসীন বিজেপির তিন বিধায়ক দলত্যাগ করে কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন। একইসঙ্গে সরকার থেকে সমর্থন তুলে নিয়েছে এপিপি, তৃণমূল কংগ্রেস এবং একজন স্বতন্ত্র বিধায়ক। বিধানসভায় এপিপির আছে চার আসন (যে চারজনের একজন উপ মুখ্যমন্ত্রী, তিনজন মন্ত্রী। তারা পদত্যাগ করেছেন)। তৃণমূল কংগ্রেসের একটি আর স্বতন্ত্র বিধায়কের এক আসন মিলিয়ে ছয় বিধায়কের সমর্থন ছুটে গেছে বিজেপির হাত থেকে। ভেঙে গেছে ‘রেইনবো’ এলায়েন্স। ফলে ম্যাজিক নাম্বার হাতছাড়া হয়ে গেছে তাদের।
যদিও এর মাঝে মণিপুরের ক্ষমতায় যাওয়ার ম্যাজিক নাম্বারেও এসেছে পরিবর্তন। ২০১৭ সালের নির্বাচনের পরপরই কংগ্রেসের এক বিধায়ক দলত্যাগ করে বিজেপির পক্ষ নেন। আর পরবর্তীতে আরও ৭ বিধায়ক দলের বিপক্ষে ভোট দিয়ে আদালতের নির্দেশে বিধানসভায় নিষিদ্ধ আছেন। যে কারণে মণিপুর বিধানসভার মোট আসন সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২। ম্যাজিক নাম্বার ২৭।
অন্যদিকে, গত ১৭ জুন বিজেপির তিন বিধায়ক কংগ্রেসে যোগ দেয়ায় তারাও আস্থা ভোটে কোনও দলে ভোট দিতে পারবেন না। ফলে বিধানসভার আসন সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৪৯। ম্যাজিক নম্বর ২৫।
বর্তমানে মণিপুর বিধানসভায় কংগ্রেসের দলীয় বিধায়ক সংখ্যা ২০। তাদের সমর্থন করা এনপিপি, তৃণমূল কংগ্রেস আর নির্দলীয় একজন বিধায়কের সমর্থন যোগ করলে সে সংখ্যা দাঁড়ায় ২৬। যা ক্ষমতায় যাওয়ার ম্যাজিক নাম্বারের চেয়ে এক বেশি।
অন্যদিকে, তিন বিধায়ক দল ছেড়ে যাওয়ায় বিজেপির হাতে আছে ১৮ বিধায়ক। আর তাদের সঙ্গে আছে এলজিপির সমর্থন। যাদের বিধায়ক সংখ্যা ১। শুরুতে বিজেপিকে সমর্থন দেওয়া চারটি দলের অন্যতম এনপিএফ (যাদের বিধায়ক সংখ্যা ৪) অনেক আগেই বিজেপি সরকার থেকে নিজেদের সমর্থন তুলে নিয়েছে। ফলে বিজেপির হাতে বর্তমানে আছে মাত্র ১৯ বিধায়কের সমর্থন। যা ম্যাজিক নাম্বার ২৫ থেকে বেশ দূরে। আর বিজেপি যদি তাদের পুরনো জোট সঙ্গী এপিএফ-এর সমর্থন ফিরিয়ে আনতে সমর্থও হয় তারপরও সেই সংখ্যা দাঁড়াবে ২৩। যা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট নয়।
তাহলে কি হতে যাচ্ছে মণিপুর রাজ্যের বিজেপি সরকারের ভবিষ্যৎ? এন বীরেন সিং-এর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার কি টিকে যাবে নাকি ক্ষমতায় ফিরবে কংগ্রেস? যে রাজ্যে তাদেরই ক্ষমতায় থাকার নজির বেশি।
কংগ্রেস এরইমধ্যে রাজ্যের রাজ্যপালের কাছে বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন ডেকে আস্থা ভোট আয়োজনের দাবি জানিয়েছে। কংগ্রেস আশাবাদী সাবেক মুখ্যমন্ত্রী, ২০০২ সাল থেকে যিনি টানা তিন মেয়াদে (১৫ বছর) মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সেই ওকরাম ওবোই সিং-ই হতে যাচ্ছেন রাজ্যের পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী।
তবে সবকিছু যে খুব সহজেই মিটে যাবে ব্যাপার সে রকম না। বিজেপি অন্তত হাল ছেড়ে দেওয়া দল না। তারা নিজেদের সরকার টিকিয়ে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। তা না পারলে অন্তত সেই চেষ্টা করবে যাতে কংগ্রেসকে দূরে রেখে রাজ্যে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করানো যায়। আর মণিপুর রাজ্যে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হওয়ার নজির অনেক। ১৯৬৩ সালের পর থেকে অন্তত ১০ বার রাষ্ট্রপতির শাসন জারি হয়েছে রাজ্যটিতে। সর্বোচ্চ আড়াই বছর রাষ্ট্রপতির শাসন বলবত থাকার নজিরও আছে। এক্ষেত্রে অবশ্য মণিপুরের রাজ্যপাল নাজমা হেপাতুললাহর ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তার ওপরে নির্ভর করছে অনেক কিছু।
তবে মণিপুরে কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরতে পারবে কি পারবে না তারচেয়েও বড় কথা বিজেপি’র চূড়ান্ত রকমের ধাক্কা খাওয়া। বিজেপি যেখানে কংগ্রেসমুক্ত ভারতের ডাক দিয়েছে, আপাত দৃষ্টিতে খানিকটা নেতৃত্বহীন এবং কিছুটা ক্ষয়িষ্ণু মনে হওয়া কংগ্রেসের জন্য এটা বড় ধরণের কামব্যাক।
বিজেপি আর কংগ্রেসের রাজনীতির ধরণের মধ্যে বড় ধরণের ফারাক আছে। বিজেপি যেখানে আগ্রাসী কংগ্রেস সেখানে অনেকটাই সহনশীল। আর যারা ভেবেছিলেন ভারতের গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি কংগ্রেস ধুঁকতে বসেছে তাদেরও হয়তো নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। কারণ বিজেপি’র অনেক পুরনো জোটসঙ্গী তাদের ছাড়তে শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই অনেক রাজ্য থেকে ক্ষমতা হাতছাড়া হয়েছে বিজেপির। মহারাষ্ট্রে বিজেপির দীর্ঘদিনের সঙ্গী শিবসেনা তাদের ছেড়ে কংগ্রেসের সাথে সরকার গড়েছে। মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস নেতা সিন্ধিয়াকে দলে টেনে সেখানকার কংগ্রেস সরকারকে টলিয়ে দিয়ে নিজেদের সরকার গড়েছে বিজেপি। কংগ্রেসের ২২ বিধায়ক দল ছেড়ে যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে। তবে সেখানেও বিজেপিকে ছেড়ে কথা বলছে না কংগ্রেস। সামনে ২৪ আসনে উপ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। অধিকাংশ সমীক্ষা বলছে ২৪ আসনের অন্তত ২০টি জিতে পুনরায় মধ্যপ্রদেশে সরকার গড়তে যাচ্ছে কংগ্রেস।
২০২০ সালের শেষ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ভারতের অনেকগুলো রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। তালিকায় আছে অনেকগুলো উলেখযোগ্য রাজ্য। যার কোনটিতেই বিজেপির’র জয়লাভের সম্ভাবনা দেখাচ্ছে না নির্বাচন পূর্ববর্তী ভোট সমীক্ষা। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নিজের রাজ্য গুজরাটের পরবর্তী নির্বাচনেও কংগ্রেসের জয়লাভের সম্ভাবনা প্রবল।
দলের মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে চূড়ান্ত রকমের সমন্বয়হীনতা আর দীর্ঘসূত্রিতা, প্রকট-প্রবল প্রবীণ-নবীন দ্বন্দ্বকে ছাপিয়ে কংগ্রেসের এই ঘুরে দাঁড়ানো শুধুমাত্র জনগণের সমর্থনের কারণেই সম্ভব হচ্ছে। তবে কি বিজেপির রঙয়ের রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে ভারতবাসী?
পলাশ মাহবুব: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও সাংবাদিক।